Alapon

"ইসলামি আন্দোলন ও মডারেট ইসলাম"



"ইসলামি আন্দোলন ও মডারেট ইসলাম"
- ব্যারিস্টার মাওলানা নাজিবুর রহমান মুমিন



২০০০ সালে আব্বু জামায়াতের আমীর নির্বাচিত হলেন, আর ২০০১ সালে চার দলীয় জোট বিপুল ভোটে ক্ষমতায় আসল। আব্বু আর মুজাহিদ চাচা গুরুত্বপূর্ণ ২টি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেলেন। অনেকের কাছে সেই সময়টা বাংলাদেশে জামায়াতের জন‍্য স্বর্ণযুগ বলে মনে হত। কিন্তু আব্বু বলতেন বিপদ আসছে। আব্বুকে উনার নেতাকর্মীরা সেই সময়ের পরিস্থিতির ব‍্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে তিনি উত্তরে বলতেন, ‘আমি যেন পুলসিরাত পারি দিচ্ছি’। এই সময়ের বাস্তবতা উপলব্ধি করতে হলে আমাদেরকে এর পটভূমি তথা বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের সামগ্রিক ইতিহাসকে বুঝতে হবে। এর বিস্তারিত আলোচনা অন‍্যকোন সময় হয়ত করা যাবে।

সংক্ষিপ্ত পরিসরে পটভূমিটা এরকম ছিল, কম‍্যিউনিষ্ট রাশিয়া যখন মুসলিম বিশ্বে আদর্শিকভাবে বিস্তার লাভ করছিল, ইরাক, মিশর সিরিয়া সহ অনেক দেশে বামপন্থীরা একে একে ক্ষমতা দখল করে ফেলেছিল, পুঁজিবাদী পাশ্চাত‍্য সভ‍্যতা তখন একান্ত বাধ‍্য হয়েই বামপন্থীদের ঠেকাতে ইসলামপন্থীদের সাথে ঐক‍্য গড়ে তোলে। সৌদী আরব ও অন‍্যান্ন আরব রাষ্ট্র সমূহের প্রত‍্যক্ষ সহায়তায় সারাবিশ্বে ইসলামপন্থীরা একটা অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশও এর ব‍্যাতিক্রম ছিলনা। কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর পাশ্চাত‍্য পুঁজিবাদী সভ‍্যতার একমাত্র আদর্শিক শত্রু হয়ে দাড়ায় ইসলাম তথা ইসলামপন্থীরা। ৯০ এর দশকে এই আদর্শিক লড়াইয়ের অংশ হিসেবে অত‍্যন্ত সুপরিকল্পিত ভাবে ২টি ভাবধারার উদ্ভব ঘটানো হয়। একটি হল জংগীবাদ অন‍্যটি মডারেট ইসলাম। এর একমাত্র উদ্দেশ‍্য ছিল ইসলামী মুভমেন্টকে লক্ষচ‍্যুত করা, ধ্বংস করা।

৯০ এর দশকের পূর্বে যারা আফগানিস্তান বা অন‍্যান্ন দেশে জিহাদে লিপ্ত ছিলেন, তাদের সাথে মুসলিম দেশ সমূহের ইসলামী মুভমেন্টসহ অধিকাংশ মুসলিম সরকারগুলোর একধরনের বোঝাপড়া ছিল। মুসলিম দেশগুলোতে এই মুজাহিদ লিডাররা রাষ্ট্রিয় সম্মান লাভ করতেন। ৮০ এর দশকের শেষ দিকে আফগান মুজাহিদ নেতা গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের বাংলাদেশ সফরের কথা মনে আছে, তাঁকে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এরশাদ রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা দিয়েছিলেন। তখন এটাও একধরনের বোঝাপড়া ছিল যে, মুসলিম প্রধান রাষ্টগুলোতে ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজ সেই দেশের রাজনৈতিক নিয়ম মেনেই চলবে। যার কারণে আমরা দেখি ৯০ এর দশকের আগে মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে, শুধুমাত্র মিসর ছাড়া, কোথাও জংগীবাদের তেমন অস্তিত্ব ছিলনা। কিন্তু হঠাৎ করে ৯০ এর দশকে মুসলিম প্রধান দেশগুলোয় জংগীবাদের উথ্থান ঘটে এবং দেশি বিদেশী মিডিয়া সমূহে এদেরকে বিশাল কাভারেজ দেয়া শুরু হয়। বাংলাদেশও এর ব‍্যাতিক্রম ছিলনা। কিন্তু বাংলাদেশে এই জংগীবাদের ফাঁদে মুলধারার ইসলামী আন্দোলনকে ফেলা সম্ভব হয়নি। এর প্রধানতম শিকার হয় মূলত কওমী মাদ্রাসার কিছু সরল সোজা ছাত্র-শিক্ষকবৃন্দ। আমি সেই সময়কার মাদ্রাসার ছাত্র হিসেবে দেখেছি, কীভাবে আফগান ফেরত মুজাহিদদের বেশধরে, মাদ্রাসায় বিশাল অংকের ডোনেশনের লোভ দেখিয়ে কিছু ভীনদেশী গোয়েন্দা বিভাগের লোকেরা মাদ্রাসার ছাত্রদেরকে বিভ্রান্ত করত, জংগী ট্রেনিংয়ে উদ্বুদ্ধ করত। আল্লাহর রহমতে জামায়াত ও শিবিরের নেতৃবৃন্দ এই ষড়যন্ত্রের ব‍্যাপারে সতর্ক থাকায় জামায়াত শিবিরের কোনো জনশক্তি এই ষড়যন্ত্রে পা দেয়নি।

ইসলামী আন্দোলনকে লক্ষচ‍্যুত করতে পাশ্চাত‍্য পূঁজিবাদী গোষ্ঠির আরেকটি উদ‍্যোগ ছিল মডারেট ইসলাম। দুর্ভাগ‍্যজনকভাবে ইসলামী মুভমেন্টের একটা অংশ এই ষঢ়যন্ত্রের ফাঁদে পা দেয়। তাত্বিকভাবে এই মডারেট ইসলামের উদ্দেশ‍্য ছিলো প্রথমে ইসলামের সুপ্রতিষ্ঠিত কিছু নীতি-নৈতিকতার ব‍্যাপারে প্রশ্নের অবতারনা করা, বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা। এক্ষেত্রে নারীর অধিকার, নারীর ক্ষমতায়নের পশ্চিমা সস্তা স্লোগানগুলোকে ব‍্যাবহার করা হয়। ২য় পর্যায়ে, ইসলামের সার্বজনীন আদর্শগুলোকে পশ্চিমা মানবাধিকার, বাকস্বাধিনতা, গনতন্ত্র ইত‍্যাদি আদর্শের সমার্থক হিসেবে প্রচার করা হয়। ৩য় পর্যায়ে এসে বলা হতে থাকে যে, ইসলামের আদর্শগুলোকে ইসলামের নাম না নিয়েও প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

এই এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন‍্য মুসলিম স্কলারদেরকে পাশ্চাত‍্য বিশ্বে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যাওয়া হত, বিভিন্ন সেমিনার সিম্পজিয়ামের আয়োজন করা হত। দু:খজনক ব‍্যাপার হোল, বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের একজন শীর্ষস্হানীয় ব‍্যাক্তিত্ব প্রাথমিকভাবে এই ফাঁদে পা দেন। কিন্তু পরবর্তীতে ২০০১ সালে নাইন ইলেভেনের পরিপ্রেক্ষিতে এই চক্রান্তের স্বরূপ যখন তিনি বুঝতে পেরে পাশ্চাত‍্য শক্তির ইসলামী আন্দোলন বিরোধী ষড়যন্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেন, তখন তিনি পশ্চিমা বিশ্বের চক্ষুশুলে পরিনত হন, মডারেট ইসলামের অন‍্যতম পুরোধা হওয়ার পরও এখন উনার পশ্চিমা বিশ্বে প্রবেশ নিষিদ্ধ। বাংলাদেশের জামায়াত ঘরনার ২ জন বুদ্ধিজীবীকে আমেরিকায় ৯০ এর দশকের শুরুর দিকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, যাদের একজনের হাতধরে বাংলাদেশে মডারেট ইসলামের বিস্তার লাভ করে। অপরজন আমেরিকার নেতৃত্বে একটি নতুন বিশ্বব‍্যাবস্থার সৃষ্টির প্রচেষ্টার ষড়যন্ত্রের ব‍্যাপারে বিস্তারিত জানতে পেরে উদ্বিগ্ন হন, এ ব‍্যাপারে সংগঠনকে সতর্ক করেন।


আব্বু এ ব‍্যাপারে প্রথম থেকেই সতর্ক ছিলেন, উনার কলিগদের অনেকে এ ব‍্যাপারে আব্বুকে নমনীয় হওয়ার পরামর্শ দিলেও আব্বু ইসলামের মৌলিক বিষয়ে ছাড় না দেয়ার ব‍্যাপারে সবসময় আপোষহীন ছিলেন। এক্ষেত্রে সংগঠনের মহিলা বিভাগের নেত্রী হিসাবে আম্মুর ভূমিকাও ছিল উল্লেখযোগ‍্য। মাদ্রাসায় পড়ুয়া ছাত্র হিসাবে আমিও অল্পবিস্তর আব্বু আম্মুর এই সংক্রান্ত আলোচনায় অংশ নিতাম। আম্মু এই দ্বীনের মৌলিক বিষয়ে অটল থাকার ব‍্যাপারে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার কারণে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে উনার প্রতিষ্ঠিত একটি স্কুল ছেড়ে যেতে বাধ‍্য করা হয়। আব্বুর অনমনীয় মনোভাবের কারণে গোলাম আযম চাচার উপর একটি গোষ্ঠির প্রচন্ড চাপ থাকা স্বত্বেও সংগঠনের ভেতরে মডারেট ইসলামের কিছুই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত‍্য যে, একটি দেশের দুতাবাস ও এনজিওর সহযোগিতায় বিভিন্ন প্রোগ্রামের মাধ‍্যমে কিছু লোকেকে তারা ঠিকই বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়, যার পরিণতিতে আজকে একটি নতুন দলের উদ্ভব হয়েছে, যাদের নেতাকর্মীরা একসময় ইসলামের জন‍্য জীবনদিতে প্রস্তুত থাকলেও এখন দলের কাগজ পত্রে ইসলামের নাম নিশানা পর্যন্ত রাখতে লজ্জা পান।

২০০১ সালে নাইন ইলেভেনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই মডারেট ইসলাম প্রজেক্টে নতুন মাত্রা যোগ হয়। ইসলামের কিছু মৌলিক পরিভাষা, জিহাদ, শরিয়া আইন, এগুলোকে জংগীবাদের সমার্থক করে ফেলা হয়। প্রেসিডেন্ট বুশ প্রকাশ‍্যে ঘোষনা দেয়, হয় তুমি আমাদের সাথে থাকবে, নতুবা শত্রু হিসাবে পরিগনিত হবে। এ সময় ইসলামী দলগুলোকে তাদের অবস্থান পরিস্কার করতে ক্লিয়ার ম‍্যাসেজ দেয়া হয়। বাংলাদেশে জামায়াত ইসলামী ক্ষমতার অংশীদার হওয়ায় তাদের ব‍্যাপারে আলাদাভাবে নজর দেয়া হয়। বাংলাদেশ সরকারের উপর আফগানিস্তান ও ইরাকের অন‍্যায় যুদ্ধে অংশগ্রহন করার জন‍্য প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু জামায়াত ও বেগম জিয়ার দৃঢ়তার কারণে এই চাপ উপেক্ষা করা সম্ভব হয়েছিল। আব্বু সংসদে পরিষ্কার ভাষায় আমেরিকার চাপিয়ে দেয়া এই ওয়ার অন টেররকে অন‍্যায় যুদ্ধ বলে সমালোচনা করেন। মডারেট ইসলামপন্থীরা এসময় যে কোনো মূল‍্যে পশ্চিমা বিশ্বকে আস্থায় রাখার লক্ষে ইসলামী দলগুলোকে ব‍্যাপক আদর্শিক সংস্কারের ব‍্যাপারে চাপ দিতে থাকে। এসময় পশ্চিমা স্টেক হোল্ডাররা আব্বুকে বিভিন্ন মিটিংয়ে প্রায়ই প্রশ্ন করত, জামায়াত ক্ষমতায় গেলে শরীয়া আইন কায়েম করবে কি-না? এক পর্যায়ে আব্বু-সহ বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে লন্ডনে দাওয়াত দিয়ে এনে মডারেট ইসলামের সবক দেয়ার চেষ্টা করা হয়। আব্বুর অবস্থান এক্ষেত্রে পরিষ্কার ছিল, তিনি বলতেন- আমরা ইসলামী রাজনীতি করি আল্লাহর আইন কায়েম করার জন‍্যই। কারও যদি এই বিষয়ে ভুল বুঝাবুঝি থেকে থাকে আমরা সেটা দূর করার জন‍্য সংলাপে প্রস্তুত, কিন্তু কারও ডিকটেশনে আদর্শকে জলান্জলি দিতে প্রস্তুত নই । আব্বু এক্ষেত্রে একটা জিনিস বিশ্বাস করতেন এবং আমাদেরকে বলতেনও, তাগুতী শক্তিকে যতই ছাড় দেয়া হোক তাদের পরিপূর্ন অনুসরন না করা পর্যন্ত তারা কখনই সন্তুষ্ট হবেনা (সূরা বাকারা: ১২০)। সুতরাং আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে তাদেরকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টার কোন মানে নেই।

আসলে হয়েছেও তাই, বিশ্বব‍্যাপি ইসলামী আন্দোলনের কিছু অংশ পশ্চিমা শক্তিকে আস্থায় নেয়ার জন‍্য মডারেট ইসলামের প্রজেক্টকে সম্পূর্নরূপে প্রত‍্যাখান করতে পারেনি। আজকে তাদের ভাগ‍্যও জামায়াতের থেকে ভিন্নতর নয়, বরং ক্ষেত্র বিশেষে আরও খারাপ হয়েছে তাদের অবস্থা। সুতরাং ইসলামই হল সমস‍্যা, যতক্ষন পর্যন্ত এর নাম নিশানা আমাদের মধ‍্যে থাকবে, ততক্ষন পর্যন্ত তাগুতী শক্তির কাছে আমরা শত্রু হিসেবেই পরিগণিত হব। আব্বু এই বিষয়টিই উনার শেষ ক'টি বছর বিভিন্ন লিখনী, বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ‍্যমে বুঝাতে চেষ্টা করেছেন। তিনি বলতেন যে, আমরা জংগীও না আমরা মডারেটও না। আমরা মধ‍্যমপন্থী ইসলামী দল, আমরা নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আল্লাহর জমীনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা করতে চাই। এই পথে চলতে গিয়ে কিছু লোক টিকতে না পেরে ডানে-বামে ছিটকে পড়বে, কিছু লোক শাহাদাত বরন করবে, কিন্তু যারা শত বাধা বিপত্তির মুখে আল্লাহর উপর ভরসা করে সবর ও ইস্তিকামাতের সাথে টিকে থাকতে পারবে আল্লাহ তাদের হাতেই বিজয় পতাকা দান করবেন ইনশাআল্লাহ।

ইসলামী আন্দোলন ও মডারেট ইসলামের উপর আব্বুর একটি আলোচনা এই লিংকে দেখতে পারেন। বক্তব‍্যটি ২০০৮ সালে লন্ডন মুসলিম সেন্টারে এক কর্মী সমাবেশে দেয়া। ভিডিওটি আমার আনাড়ী হাতে রেকর্ড করা।



★ লেখক: শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী রহিমাহুল্লাহ'র ছেলে

★ লেখাটি নাজিব ভাইয়ের ফেসবুক টাইমলাইন থেকে "আব্বু এবং আমি (শহীদ মাওলানা নিজামী স্মরণে)" সিরিজের ৪র্থ ও ৫ম পর্ব থেকে সংগৃহীত।


=সংকলনে :#As_Silm টীম

পঠিত : ৩৫৫ বার

মন্তব্য: ০