Alapon

অধিকার সচেতনতা ও নারীবাদ এক জিনিস নয়



নারীর বৈধ অধিকার সচেতনতাকে নারীবাদ এবং প্রাপ্য অধিকার সচেতন নারীকে নারীবাদী মনে করাটা আসলে ভুল চর্চা। নারীবাদ সম্পর্কে খণ্ডিত ধারণা বা উগ্র পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা থেকে এই ধরণের ধ্যানধারণা জন্ম লাভ করে। সুতরাং কাউকে নারীবাদী বলার আগে নারীবাদ সম্পর্কিত নিজের জ্ঞানকে যাচাই করে নেওয়া কর্তব্য।

মূলত ১৯ শতকের শেষ দিকে শুরু হওয়া নারীবাদী আন্দোলনের সূচনাতে অনৈতিক দাবি-দাওয়া খুব কম ছিল। গীর্জা ও ইউরোপের নিয়মিত ‘নারী নির্যাতনের’ বিরুদ্ধে অধিকার আদায়ের ‘প্রেরণা’ থেকে এর সূচনা হয়। শুরুতে তাদের দাবি ছিল ভোটাধিকার লাভ, সম্পত্তিতে ক্ষমতায়ন, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়ন এবং সামাজিক মর্যাদায় নারী-পুরুষের সমতা ইত্যাদি। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত নারীবাদীরা এসব মৌলিক দাবি-দাওয়ার ভেতর সীমাবদ্ধ ছিল। এই সময়টাকে বলা হয় নারীবাদের প্রথম তরঙ্গ। এই সময়ে তাদের যা দাবি-দাওয়া ছিল, আমরা দেখি, তার অনেকগুলোই ইসলাম নারীদের অধিকার বলে ঘোষণা করেছে। যেমন : সম্পত্তিতে নির্ধারিত অংশ, প্রাপ্য মোহরানা, বিয়ের ব্যাপারে সাবালিকা নারীর ও বিধবা বা তালাকপ্রাপ্তা নারীর স্বাধীনতা, রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে মতপ্রকাশের অধিকার, সামাজিক মর্যাদায় সমতা ইত্যাদি। উপরন্তু বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে নারীকে পুরুষের তুলনায় অধিক মর্যাদাশীল ও নারীর অধিকারকে পুরুষের অধিকারের তুলনায় অগ্রগণ্য করা হয়েছে। সন্তানের কাছে পিতার চেয়ে মায়ের মর্যাদাকে উঁচু করা হয়েছে। রাষ্ট্রকে বাধ্য করা হয়েছে একজন অভিভাবকহীন নারীর দায়িত্ব গ্রহণ করতে। সুতরাং কোনো নারী যদি এসকল অধিকার প্রাপ্তির জন্য আন্দোলন করেন বা কথা বলেন তাকে বর্তমান প্রচলিত অর্থে নারীবাদী বলে গালি দেওয়া ঠিক হবে না। কেন হবে না? কারণটা বুঝিয়ে বলছি।

১৯৬০ সালের পর থেকে শুরু হয় নারীবাদের ‘উগ্রপন্থা’র যুগ। ১৯৬০ থেকে মোট ৩টি ধাপে উন্নতি (বা অবনতি) করে এই উগ্র-নারীবাদ বর্তমান অবস্থায় পৌঁছেছে। নারীর অধিকার আদায়ের নামে শুরু হওয়া আন্দোলনটি এই সময় নারীকে পুরুষের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দেয় এবং এমনসব দাবি দাওয়া একের পর এক করতে থাকে যা সভ্যতা, ভদ্রতা, সৌজন্যতা বিনষ্ট করে মানুষের স্বাভাবিক রুচিবোধকে পর্যন্ত জর্জরিত করে। একজন ডিভোর্সি মহিলা কাকে বিয়ে করবেন? নাকি করবেন না? বা করলেও ক’টা বাচ্চা নেবেন? এই সমস্ত অধিকার নিয়ে তারা কথা বলতে থাকে। নারী চাকরি করতে বাইরে যাবে কি না, গেলে কখন যাবে, কখন ফিরবে বা ফিরবে কি না, বাইরে রাত কাটাতে পারবে কি না এসব নিয়েও তারা কথা বলতে থাকে। এই সময়েই অনেকগুলো নতুন নতুন অদ্ভুত পরিভাষার জন্ম হয় যার মধ্যে ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ একটি।

মূলত এই সময়টাতেই নারীকে পুরুষের মুখোমুখি করা এবং নারী অধিকার আদায়ের নামে পুরুষদের গালমন্দ করা বা পুরুষের প্রতি মন্দ ধারণা তৈরী করার অভ্যাস গড়ে ওঠে। পুরুষতন্ত্র নামে এক ‘অদৃশ্য’ ও কল্পিত তন্ত্রের জন্ম দেওয়া হয়, যাকে নারীবাদের প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কারও ভেতর নারীকে আয়ত্বে রাখার প্রবণতা দেখা গেলে তাকে পুরুষতান্ত্রিক বলে গালাগাল করা হতে থাকে। বর্তমান প্রচলিত অর্থে নারীবাদ হলো এই র‌্যাডিকাল ফেমিনিজম বা উগ্রপন্থী নারীবাদ; যাদের মূল বক্তব্য পুরুষতন্ত্র বিরোধী বা মৌলিকার্থে পুরুষশাসন বিরোধী। এরা কোনভাবেই পুরুষের শাসনাধিকার বা ক্ষমতায়ন মেনে নিতে রাজি নয়। ফলে এই রোগে আক্রান্ত কাউকে কাউকে আপনি বলতে দেখবেন,
‘যদি বিয়ের আগে জানতাম ইসলামি রাষ্ট্রগুলো পুরুষকে নারী-শাসনের অধিকার এমনভাবে দিয়েছে তাহলে ভয়ে বিয়েই করতাম না।’


তাদেরকে আপনি বলতে শুনবেন,
‘পুরুষের গোলামি আর সংসারের ঘানি টানতে টানতে ইহকাল শেষ করা বোকামি; নিজের আখিরাতের জন্য সময় বের করুন।’


কাউকে হয়ত বলতে শুনবেন,
‘মেয়ে, পুরুষ ছাড়াও তোমার জীবন চলবে; সুতরাং অত প্যারা না নিয়ে চিল করো।’


এগুলো মূলত র‌্যাডিকাল ফেমিনিজমে আক্রান্ত হওয়ার আলামত; সে হতে পারে হিজাবি, নন-হিজাবি, নিকাবি বা আলিমা। নারীবাদের প্রাথমিক তরঙ্গের সাথে এদের দূরত্ব যোজন যোজন। ফলে কেবল অধিকার সচেতন হলে তাকে ফেমিনিস্ট বলা অনুচিত বা ক্ষেত্র বিশেষে জুলুম। খোদ নারী সাহাবিরাও নিজেদের অধিকার আদায়ে সচেতন ছিলেন। তবে, নারীকে পুরুষের মুখোমুখি দাঁড় করানোর মানসিকতা থাকলে বা নারী অধিকারের নামে ‘অ-প্রাপ্য’ কিছু দাবি করলে তাকে ফেমিনিস্ট বলা যেতে পারে। এ ধরণের মানসিকতা মোটেও সমর্থনযোগ্য নয়।

মোদ্দাকথা, নারীবাদের জুঁজুঁ যাতে নারীদের প্রতি জুলুম করতে বা অযথা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করতে আমাদের উৎসাহিত না করে। এটা সুস্পষ্ট জুলুম। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হবে ইসলামসম্মত। ইসলাম যেসব অধিকার নারীকে দেয় সেগুলো যদি সে দাবি করে তাহলে তাকে ব্যঙ্গ করার বা তার প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করার অধিকার কোনো পুরুষের নেই; এটা স্পষ্ট হারাম। তবে হ্যাঁ, কোনো নারী যদি অধিকারের নামে পুরুষবিরোধীতায় অবতীর্ণ হয়, পুরুষকে নারী-প্রগতির প্রধান অন্তরায় মনে করে, নারী অধিকারের নামে অনৈসলামি দাবি-দাওয়া উত্থাপন করে এবং পুরুষতন্ত্রের বিরোধিতার নামে ইসলামি আইনের বিরুদ্ধে নারীসমাজকে প্ররোচিত করে তাহলে অবশ্যই তার প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে এবং তার অনিষ্ট থেকে অন্যদের সতর্ক করতে হবে; কিন্তু কাউকে কটাক্ষ করা কোনভাবেই বৈধ নয়। নফসের ধোঁকায় পড়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে আমি যাতে ইসলামের ক্ষতি না করে বসি; এই অনুভব অন্তরে জাগরুক থাকা বাঞ্ছনীয়।

পঠিত : ৩৩৭ বার

মন্তব্য: ০