Alapon

তিতুমীরের জীবন-সংগ্রাম !




বুকে আছে অদম্য সাহস। আছে মনোবল। লড়াই করেছেন এক পরাশক্তির বিরুদ্ধে শুধুমাত্র ঈমানের জোরে। চারিদিকে যখন চলছে জুলুম, নির্যাতন, অবিচার ও অসম বন্টনের ছড়াছড়ি, তখন তার আগমন ঘটল এই সমাজের হাল ধরতে। আমরা কথা বলছি তিতুমীরকে নিয়ে।

ডাক নাম তিতুমীর হলেও তার প্রকৃত নাম সৈয়দ মীর নিসার আলী। ২৭ জানুয়ারি, ১৭৮২ সালে জন্ম হয় চব্বিশ পরগনা জেলার বাদুড়িয়া থানার হায়দারপুর গ্রামে যা বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মধ্যে পড়ে। তার পিতার নাম সৈয়দ মীর হাসান আলী এবং মাতার নাম আবিদা রোকেয়া খাতুন। তিতুমীরের পূর্বপুরুষ সাইয়েদ শাদাত আলী আরব থেকে বাংলায় এসে ইসলাম প্রচার শুরু করেন।

তার আসল নাম তিতুমীর ছিলো না। তার নাম তিতুমীর হওয়ার পেছনে আছে এক বেশ চমকপ্রদ কাহিনী। ছোট বেলায় যখন কেউ তেতো ওষুধ খেতে চাইতো না, এমনকি বৃদ্ধরা পর্যন্ত নাক ছিটকানি দিতেন, তখন তিনি সাবলীলভাবে সে ওষুধ খেয়ে নিতেন। আর সেই থেকে তার নাম তিতু। মূল নামের মীর থেকে এই নাম যোগ হয়ে সময়ের ব্যবধানে নাম হয়ে গেলো তিতুমীর।

মাত্র চার বছর বয়সে পড়াশোনা শুরু করার পর শিখতে লাগেন বাংলা, উর্দু, আরবি, ফারসি ও গণিত। গ্রামের মক্তবে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে তিতুমীর স্থানীয় এক মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন। মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি কোরআনের হাফেজ হন। এর পাশাপাশি দর্শনশাস্ত্রে তিনি ছিলেন পারদর্শী। যৌবনে পা দেওয়ার আগেই আয়ত্ত করেন তরবারি চালনা, তীরন্দাজি, মুষ্টিযুদ্ধ ও লাঠি খেলা। কলকাতায় এক কুস্তি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রথম হন। তারপরে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র কলকাতায়। পরবর্তীতে এক জমিদারের সান্নিধ্যে এসে শিখেন যুদ্ধ জয়ের কৌশল।

তিতুমীর জীবন বদলে দেয় মক্কায় হজ পালনের সফর। ১৮২২ সালে তিনি মক্কা গমন করেন এবং হজ্ব পালনের পর মদিনায় গমন করেন। সেখানে তার সাথে দেখা হয় সৈয়দ আহমদ বেরলভীর। তিনি তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে নেন। এরপর তিনি একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান হিসেবে দ্বীন প্রচারের অঙ্গীকার নিয়ে ভারতে ফিরে আসেন।

সেই সময় ব্রিটিশ ও নীলকররা সাধারণ মানুষের উপর অমানবিক নির্যাতন করত। চাবুকের আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হত কৃষক। ব্রিটিশ বেনিয়ার তল্পিবাহক হিন্দু জমিদারগণ খাজনা আদায়ের বাহানায় নিয়ে নিতেন গরু, ছাগল। প্রথম দিকে তিতুমীর প্রজাদের ওপর অত্যাচারের প্রতিকার করতে চেয়েছিলেন শান্তিপূর্ণভাবে ও সমঝোতার মাধ্যমে। কিন্তু সেটা আর সম্ভব হয়ে উঠে নি।

যাই হোক, দেশে ফিরে আসার পর ১৮২৭ সালে তিনি নদীয়া ও চব্বিশ পরগনায় ইসলাম প্রচার শুরু করেন। তিনি সামাজিক সংস্কার সাধন এবং শিরক-বিদয়াত থেকেও মুসলমানদের মুক্তির জন্য লড়াই করেন। একই সাথে ব্রিটিশবিরোধী প্রচার শুরু করেন তিনি। কারণ তিনি এতো দিনে বুঝতে পেরে গেছেন জমিদাররা কখনোই ব্রিটিশদের ছায়াতলে থেকে সাধারণ মানুষের উপর সুশাসন করবে না। কারণ তারা ব্রিটিশদের গোলাম। তিতুমীর হিন্দু ও মুসলমান কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করেন। তাছাড়া তার দাওয়াতে এক সময় অনেক নিম্ন বর্ণের হিন্দু মুসলমান হয়ে যান এবং একসময় ৪০০ জনের একটা দল গঠিত হয়।

এতো স্বল্প সময়ে তিতুমীরের জনপ্রিয়তা মোটেও পছন্দ হলো না জমিদারদের। এক সময় তারা মসজিদের উপর খাজনা এবং দাড়ি রাখা ও ইসলামী নাম রাখার উপর খাজনা আরোপ করে। সে সময় তারা মুসলিমদের ডাকতো বিভিন্ন উপহাসমূলক নাম ধরে যেমনঃ বোন্দা, গেন্দা, বুটা, চান্দি, গেন্দি, পেন্দি ইত্যাদি। কেউ ইচ্ছে করলেই মুসলমানি নাম রাখতে পারত না। এ জন্য জমিদারকে ‘খারিজানা’ খাজনা বাবদ পঞ্চাশ টাকা দিতে হতো। কেউ দাড়ি রাখতে চায় তো, তাকে খাজনা হিসেবে আড়াই টাকা গুনতে হতো। গোঁফ ছাঁটতে দিতে হতো পাঁচ সিকা।

মুসলমানরা মসজিদ বানাতে চাইলে তা স্বাধীনভাবে করা যেত না। জমিদারকে নজরানা না দিয়ে কারো মসজিদ বানানোর সাহস ছিল না। জমিদার প্রত্যেক কাঁচা মসজিদের জন্য পাঁচ টাকা, আর পাকা মসজিদের জন্য এক হাজার টাকা নজরানা নিত। এমনকি কারো সন্তান হলে এর জন্য জমিদারকে কর দিতে হতো। তাদের উদ্দেশ্য ছিল কেউ যেন খাজনা দেওয়ার ভয়ে তিতুমীরের দলে যোগ না দেয়। শুধু যে মুসলিমরাই নিপীড়িত হতো এমন না। নিম্ন শ্রেণির হিন্দুদেরও সহ্য করতে হচ্ছিল অসম্ভব নির্যাতন। চাবুকের আঘাতে মাটিতে রক্ত পড়ে ভিজে যেতে থাকে।

এসবের তীব্র বিরোধিতা করতে থাকেন তিতুমীর। তৎকালীন হিন্দু জমিদারদের অত্যাচার বেড়ে গেলে তিতুমীর এবং তার অনুসারীরা প্রতিবাদস্বরূপ ধুতির বদলে 'তাহ্‌বান্দ' নামে এক ধরনের বস্ত্র পরিধান শুরু করেন। এক সময় এ বিরোধ ও প্রতিবাদ হিন্দু জমিদার ও নীলকরদের সাথে সংঘর্ষে রূপ নেয় এবং তিতুমীর যুদ্ধে জড়িয়ে যান।

এ যুদ্ধে মিসকিন শাহ্‌ ও তার দলবল তিতুমীরের সাথে যোগ দেয়। অন্যদিকে গোবরাগোবিন্দপুরের দেবনাথ রায়, নাগপুরের গৌরি প্রসাদ চৌধুরী, তারাকান্দির রাজনারায়ণ, গোবরডাঙ্গার কালিপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ জমিদারেরা একজোট হয়ে তিতুমীরের সাথে ব্যাপক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। যুদ্ধে তিতুমীর জয় লাভ করেন এবং তার সুনাম সমগ্র এলাকাব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে তার সাথে যোগ দেন অনেক নিপীড়িত হিন্দু ও মুসলিম।

এরপর নদীয়া, চব্বিশ পরগনা ও ফরিদপুরের কিছু অংশ তার অধীনে চলে আসে এবং উক্ত অঞ্চলগুলো মিলে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয়া হয়। বন্ধ করে দেয়া হয় ব্রিটিশদের সব ধরনের খাজনা প্রদান। এটি ইতিহাসে বারাসাত বিদ্রোহ নামে পরিচিত। এই বিদ্রোহে ৮৩ হাজার কৃষক তিতুমীরের পক্ষে যোগ দিয়েছিলেন।

ব্রিটিশরা তিতুমীরের অগ্রগতি থামাতে দায়িত্ব দেন ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডারকে। বাঘারেয়ার নীলকুঠি প্রাঙ্গনে ১৮৩০ সালে ব্রিটিশ মিত্র হিসেবে গোবরডাঙ্গা ও নদীয়া অঞ্চলের জমিদারদের বিরুদ্ধে তিতুমীরের বাহিনীর যুদ্ধ হয়। এবারও যুদ্ধে জয় করেন তিতুমীর। পরবর্তীতে সরফরাজপুরের জমিদার কৃষ্ণদেব রায় জুম্মার নামাজের সময় মুসলিমদের ওপর হামলা চালালে দু জন ধর্মপ্রাণ মুসলিম নিহত হন।

এই ঘটনার পর তিতুমীর চলে আসেন নারিকেলবাড়িয়ায় এবং এখানেই আত্মরক্ষার জন্যে তার বাঁশেরকেল্লা নির্মাণ করেন। যে বাঁশেরকেল্লার নাম শুনেন নি, এমন মানুষ পাওয়া মুশকিল। সালটি ছিল ১৮৩১ সালের ২৭ অক্টোবর। বাঁশ ও কাদা দিয়ে তিনি ও তার অনুসারীরা এ কেল্লা নির্মাণ করতে থাকেন। কেল্লা নির্মাণের সাথে সাথেই চলতে থাকে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি।

এদিকে কৃষ্ণদেব রায় ২৯ শে অক্টোবর তিতুমীরের বাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা করেন। এতে তিতুমীর বাহিনীর অনেকে আহত হয়। এই ঘটনায় তিতুমীরের ভাগনে শেখ গোলাম মাসুম প্রায় ৫০০ জনের একটি সৈনিক দল নিয়ে তিতুমীরের সাথে যোগদান করে। গোলাম মাসুমকে সৈন্যদের প্রধান করা হয়। এদিকে কৃষ্ণদেব রায় থেমে থাকে নি। ৬ নভেম্বর আবার হামলা করে, কিন্তু এবার সুবিধা করতে না পারে কৃষ্ণদেব রায় ফিরে আসে এবং ব্রিটিশদের সাথে পরিকল্পনা করতে বসেন। যুক্ত হয় ব্রিটিশ নীলকুঠি ম্যানেজার ডেভিস, সাথে নেয় তাদের ভারী অস্ত্রশস্ত্র।

যুদ্ধ শুরু হয়। তীব্র যুদ্ধে সুবিধা না করতে পেরে ডেভিস পলায়ন করে এবং এ যুদ্ধেও তিতুমীর শত্রুকে পরাস্ত করতে সক্ষম হন। তিন দিনের মাথায় গোবরাগোবিন্দপুরের জমিদার দেবনাথ রায় হামলা করে বসেন। তিতুমীরের বাহিনীর ঈমানের জোরের কাছে যুদ্ধে হেরে যায় তারা এবং জমিদারদের নেতা দেবনাথ রায় নিহত হন।

১২ ই নভেম্বর ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডারের নেতৃত্বে আরেক দফা যুদ্ধ শুরু হয়। সুবিধা করতে না পেরে কোনমতে প্রাণ নিয়ে আলেকজান্ডার পালিয়ে আসতে পারলেও তিতুমীরের হাতে বন্দী হয় এক দারোগা ও জমাদ্দার।

কোনোভাবে তিতুমীরকে দমাতে না পেরে এবার ব্রিটিশরা তাদের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৮ নভেম্বর সমগ্র ভারতের গভর্নর লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক বাশের কেল্লায় হামলার পরিকল্পনা করেন। দায়িত্ব দেয়া হয় চৌকস সেনা কর্মকর্তা লে. কর্নেল স্টুয়ার্টকে। সাথে আছে হাজার হাজার প্রশিক্ষিত সৈন্য এবং বিপুল পরিমাণ গোলা বারুদ। লে. কর্নেল স্টুয়ার্ট হামলা করেন বাঁশের কেল্লায়। অত্যাধুনিক আর্টিলারি আর প্রশিক্ষিত ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর সামনে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুললেও শেষ রক্ষা হয়নি তিতুমীরের।

তিনি চাইলে আত্মসমর্পণ করতে পারতেন। এতে তার প্রাণও বেঁচে যেত হয়তো। কিন্তু তিনি মাথা নত করেননি সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তির কাছে। তিতুমীর এমন পরিস্থিতিতে তাঁর অনুসারীদের অভয় দিয়ে বলেন "মৃত্যুকে ভয় পেলে চলবে না। এই লড়াই আমাদের শেষ লড়াই নয়। আমাদের কাছ থেকে প্রেরণা পেয়েই এ দেশের মানুষ দেশ উদ্ধার করবে। এই লড়াইয়ের পথ ধরেই একদিন দেশ স্বাধীন হবে।"

যুদ্ধের এক সময় একটি গোলা এসে তার গায়ে আঘাত করে এবং তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ইংরেজদের কামানের গোলাবর্ষণে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা। প্রায় ২৫০ জনের মতো বন্দী করা হয়, তার বাহিনীর প্রধান গোলাম মাসুমকে ফাঁসি দেওয়া হয়। আরও অনেককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় সাথে সাথে। এভাবে শেষ হয়ে যায় ইতিহাসের বারাসাত বিদ্রোহ। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় বাশেঁর কেল্লা। যার অনুপ্রেরণা আমাদের হৃদয়ে রয়ে যাবে আজীবন।

একজন মুজাহিদ কখনও মাথা নত করে না, তারই প্রমাণ তিতুমীর। তিনি বিদ্রোহী মানুষদের মধ্যে আশার সঞ্চার করে গেছেন, পরবর্তীতে এ ঘটনা অনেককে অনুপ্রাণিত করেছে ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য। এবং বলাই বাহুল্য যে, তার সময় ব্রিটিশের কিছু এলাকা হলেও স্বাধীন ছিল। তিনি সর্বপ্রথম ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বল্পস্থায়ী হলেও বাংলায় এক স্বাধীন ইমারত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

তার ত্যাগ ও বীরত্বের কথা বাঙালি স্মরণে রেখেছে। সে জন্যই বিবিসির শ্রেষ্ঠ বাঙালির জরিপে তালিকায় ১১ নাম্বার স্থান দখল করে নিয়েছেন শহীদ তিতুমীর। তার বীরত্বের কথা স্মরণ করে বাংলাদেশের একটি কলেজের নাম "সরকারী তিতুমীর কলেজ" রাখা হয়েছে। তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের নাম। দ্বীনের তরে, দেশের তরে তিতুমীরের অবদান ও আত্মত্যাগের কথা মনে রাখবে এ দেশের প্রজন্মের পর প্রজন্ম।


লিখেছেন: Shakil Ahammed
তথ্যসূত্র: শহীদ তিতুমীর- আলমগীর হোসেন খান
Wikipedia English & Bangla
BBC Bangla
Roar Bangla

পঠিত : ২৮৪ বার

মন্তব্য: ০