Alapon

পাপ ও পতনের পথ : পতনের শুরুটা যেভাবে হয় !




একটু খারাপ লাগতে পারে। কঠিন মনে হতে পারে। হয়তো অনেকেই সহ্য করতে পারবেন না। বাঁকাচোখে দেখবেন। তবুও বলি। বলা কর্তব্য। আমাদের কাজ কিন্তু পৌঁছে দেওয়া। বলে যাওয়া। কে আমলে নিলো কে নিলো না, সেটা বিষয় না ।

পতন বলি বা পদস্খলন বলি, এটা মূলত শুরু হয় খুবই ছোটখাটো বিষয় থেকে। ছোটখাটো সুন্নাহ ছেড়ে দেওয়া, নানাবিধ ব্যক্তিগত আমলে শিথিলতা প্রদর্শন করা, একটু-আধটু ছাড়ের মানসিকতা—যেমন গোড়ালির নিচে প্যান্ট পরলে কী সমস্যা, নিকাব না করলে কী হইছে? বোরকা পরতে হবে, কুরআনে এরকম কিছু বলা আছে না-কি? বোরকা না পরে , মুখ না ঢেকে শালিন পোশাক পরলেও তো হয়। মোল্লারা ইসলামকে কঠিন করে ফেলেছে। আল্লাহর ইসলাম এত কঠিন না।

এরপর বলা হয়, সুন্নত না পড়লে তো আর গুনাহ নাই। ফরজটা পড়লেই যথেষ্ট। মিউজিক নিষেধের বিষয়ে হাদিস আছে ঠিক আছে, কিন্তু উস্তায কারজাভীর তো মত আছে যে, খারাপ কিছু না থাকলে সেটা হালাল। ( যদিও শেষ পর্যায়ের মত এটা না তাঁর, তাঁর ওয়েবসাইটে বিস্তারিত আছে। আমরা আস-সিলমে সেটার উদ্বৃত্তি অনুবাদ-সহ পোস্ট করেছি) এরপর শুরু হয়ে যায় মিউজিককে নরমালাইজ করা। যার প্রেক্ষিতে এটাকে নির্দোষ মতভিন্নতা হিসেবেই দেখা হয়। কিন্তু গভীরে যেতে চাই না, তলিয়ে দেখার তো সুযোগই নেই !

এক পর্যায়ে তখন সাধারণ আলেমদেরকে তো ভালো লাগেই না— এমনকি আন্দোলনমুখী কিংবদন্তি মাওলানা মওদূদী, জাস্টিস মালিক গোলাম আলী, মাওলানা নিজামী, মাওলানা আব্দুর রহিম, মাওলানা সাঈদী বা এই টাইপের আলেমদেরকেও তেমন একটা ভালো লাগেনা। ওনাদেরকে ইসলামী আন্দোলনের নেতা নেতা মনে হয় না। স্মার্ট স্মার্ট আর যুগোপযুগী মনে হয় না। কেমন যেন সংকীর্ণ মাইন্ডের মনে হয়। কিন্তু মনকে প্রবোধ দেওয়ার জন্যে বলা হয়—নাহ, ওনাদের সবকিছুকে তো আর মানার প্রয়োজন নেই। তাঁরা তো আর নিজস্ব ফিকহ দাঁড় করাননি। তাঁরা তো ফকিহ না। (ওপরের এই ধরনের আলিমদের মধ্যে কয়েকজনের ব্যপারে এতোটুকু যদিও ঠিক আছে, তবে সার্বিকভাবে তাদের হাদিস-ফিকহের বুঝ অনেক উচ্ছ লেভেলের। আমরা গতানুগতিক কাজের দিকে নজর বেশি নিবদ্ধ রাখায় অনেকেই ওনাদের ইলমের গভীরতা, হাদিস-ফিকহের ব্যুৎপত্তিকে উপলব্ধি করতে পারি না)

বিচ্যুতির প্রাথমিক দিকে এইভাবে শুরু আরকি। এরপর তুর্কী সিরিয়ালকে কিছুটা নির্দোষ-নিষ্পাপ মনে হয়। মাঝেমধ্যে এবার মাইন্ড রিফ্রেশমেন্টের জন্যে সামাজিক নাটক-সিনেমাকে খুব বেশি দোষণীয় মনে হয় না বিধায় টুকটাক দেখা শুরু হয়। যুক্তি— সাংস্কৃতিক দেউলিয়াত্ব থেকে জাতিকে মুক্তি দিতে হলে এসব নিয়েও জানাশোনা লাগে। এবার সুস্থ-ধারার সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মহৎ উদ্দেশ্যে, সেগুলোর ত্রুটি তালাশের জন্য, বৃহৎ স্বার্থে(!) নিয়ম করে দেখা হয়। দেখে দেখে রিভিউ লেখা হয়। কারণ, আপনি ওই বিষয়ের সুক্ষ্ম বিষয়াদি না জানলে তো আর সাংস্কৃতিক গোলামি থেকে জাতিকে মুক্তি দিতে পারবেন না !

জাতিকে সাংস্কৃতিক গোলামি থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে এসব দেখা ভাইটি একপর্যায়ে স্বয়ং নিজেই সাংস্কৃতিক গোলাম বনে যায়। নাটক-ওয়েব সিরিজ দেখতে না পারলে তার ভালো লাগে না। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার খেলা নিয়ে হৈহুলোড় করতে না পারলে, বিশ্লেষণের বৈঠকে না বসতে পারলে নিজেকে ক্ষ্যাত ক্ষ্যাত মনে হয় ! যুগের সাথে তাল মেলানো ছেলে মনে হয় না......

এরপর আসে নির্দোষ ভাই-বোনের সম্পর্ক। দ্বীনের স্বার্থে, বিয়ের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে একসাথে মাহরাম-নন-মাহরাম চলাচল করা, প্রোগ্রামাদি করা, দ্বীনি জ্ঞান হাসিলের স্বার্থে, সভ্যতার একজন সৈনিক হিসাবে, হাকিকত অন্বেষণকারী একজন যুগোপযোগী মোতাফাক্কের হতে শুরু হয় জ্ঞান লেনদেনের উদ্দেশ্যে টুকটাক কথা। বই-ম্যাগাজিন বিনিময়। একসাথে ভ্রমণ। চ্যাটগ্রুপে এড হওয়া। মাঝেমধ্যে টুকটাক মজাদার কথাবার্তা, ম্যাসেজ আদান-প্রদান। এরপর দলিল আসে—"আরেহ! অমুক স্কলার কিন্তু বলেছে সাহাবিরা সীমিত পরিসরে পরিচয়ের ভিত্তিতে নিজেদের মাঝে হালাল কোর্টশিপ করতেন (নাঊযু বিল্লাহ)!

এই যে মুসলিম কমিউনিটিতে গতানুগতিকভাবে নারী-পুরুষকে আলাদা করে / পর্দা দিয়ে আগ-পিছে করে বসানো হয়—একসাথে বসানো হয় না, এটা কিন্তু ইসলামের সিস্টেম না। এগুলা সংকীর্ণমনা কিছু ব্যক্তিদের ফতোয়া, বা আগেকার আলেমদের মতামত। যারা পুরুষতান্ত্রিকতার দোষে দুষ্ট ছিলো। আমরা এই যুগের লোক, আমরা নতুন উসুল প্রণয়ন করবো। নতুন করে পুনরায় ইজতিহাদ করবো............"

কিছুদিন পরে আবিস্কার হয়ে যায়—নাহ নাহ ! এতোদিন যেই সেকুলারিজমকে হারাম বলছি, এইটা কিন্তু হারাম না। জাতীয়তাবাদ কিন্তু ইসলাম বহির্ভূত বিষয় না। জাতিপ্রীতি বা দেশপ্রেম থাকতেই পারে ! ইসলামী রাষ্ট্র বলতে আসলে কিছুই নাই। শরিয়া আইন এই সময় উপযোগী নয়। এইটা বহু আগের কথা। তখনকার সমাজ-বাস্তবতার আলোকে এইটা ঠিক ছিলো। এখন এসব প্রাসঙ্গিক নয়। খেলাফত, ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা, এগুলা বকওয়াস। এগুলা জামাতি-ইখওয়ানিদের ফাউল আবিষ্কার। এসব নিয়ে যারা কথা বলে, এরা বাস্তবতা বিবর্জিত।

এভাবে বলা হয়, নারী-পুরুষ আলাদা কিছু না। পুরুষ আর নারী সমানই। নারীর ওপর পুরুষের কোনো অভিভাবকত্ব আর কর্তৃত্ব নেই। কওমাহ'র ভুল অনুবাদ আর ভুল তাফসির হইছে। মুফাসসিরগণ যেহেতু পুরুষ ছিলো, সেহেতু পুরুষের পক্ষেই লেখছে। আসুন, দলে দলে নারীরা ব্যাখ্যার দায়িত্ব কাঁধে নিন। ইসলামী সংগঠন, মুসলিম কমিউনিটি, মাদরাসা— সবখানেই নারীরা আজ দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। আপনার নাগরিকত্বের ব্যাপারে কম্প্রোমাইজ করবেন না। এই যে হাদিস দিয়ে বলা হয়— স্বামীর আনুগত্য করা ফরজ। অথচ এটা করতে স্ত্রী বাধ্য নয়। স্বামী কি সেকেন্ড খোদা নাকি যে তাঁর আনুগত্য করতে হবে? তার থেকে অনুমতির বিষয় আসবে কেন? নারীরাও ইমামতি করতে পারবে। কুরআনে তো রানী বিলকীসের কথা বলা হইছে, যে রাষ্ট্রপ্রধান ছিলো। রাসুল যেখানে নারীকে নেতা বানাইলে ক্ষতির বিষয় বলছে, সেটা তো নির্দিষ্ট সেই নারীর জন্য বলছে। ইসলামী রাষ্ট্রে নারী প্রধান হতে পারবে না, এইটা কি কুরআনের কোথাও আছে? এগুলো মোল্লাদের বানানো কথা......! আসুন আমরা নেতৃত্ব নিই। ইমামতি করি। পুরুষতন্ত্র-গ্যাংকে পাত্তা দেওয়ার টাইম নাই। এভাবে চলতেই থাকে। চলতেই থাকে। দেখুন শুরুটা হয়েছিলো কোথা থেকে ?

এবং সত্যিকারভাবে বিষয়গুলো এরকমই হয়। সবাই যে সর্বশেষ পর্যায়ে আসবে, এরকম না। সবার মাত্রা যে একরকম হবে, বিষয়টা তা না। তবে যারা চূড়ান্ত পর্যায়ে আসে, সবারই কিন্তু শুরুটা এমনই ছিলো। এটা সব ঘরানার মুসলিমদের ক্ষেত্রেই সত্য। আলিয়া হোক, কওমিয়া হোক, মানহাজী হোক আর মাদখালী হোক, জামায়াত-শিবির হোক আর চরমোনাই হোক— সবার ক্ষেত্রেই পতন ও পদস্খলেনের সিম্পটমগুলা মোটাদাগে এইরকমই ।
ওপরে আমি যে কথাগুলো বললাম—এসবগুলোর পেছনেই কারো না কারো, কোনো না কোনো দলিল-যুক্তি অবশ্যই আছে। আলেমদের কেউ না কেউ এসবের পক্ষে কোনো না কোনো একটা দিকে মতামত দিয়েছেনই। মানে এসব পজিটিভ হবার ক্ষেত্রে আরকি ! যত ছাড় আপনি খুঁজতে চান, পাবেন। এইজন্যই আমাদের শহীদ নেতা, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, ফকিহ, আলিমে দ্বীন মাওলানা নিজামী বলেছেন—
"বেশি ছাড়ে যেতে নেই, যত ছাড়ই দেন না কেন আপনি, বাতিল খুশি হবে না।"


আসলেই এটার আল্টিমেট ফলাফল কিন্তু ভালো না, সুখকর নয়। ইসলাম প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাকারী ভাইয়েরা তো ফাঁক-ফোকর খুঁজবে না। সে তো সব সময় সর্বোত্তমটাকেই বেছে নেবে। সব সময় উত্তমের অনুসরণ করতে না পারলেও কিন্তু ছাড়ের মনোভাব রাখবে না। ফাঁক-ফোকর খুঁজবে তো জাহেলিয়াতে বুঁদ হয়ে থাকা ব্যক্তিরাই। আমরা তো আসছিই জাহিলিয়াতের মস্তিষ্ককে খণ্ড-দ্বিখণ্ডিত করার জন্যে। জাহিলিয়াতের প্রত্যেকটা সিঁড়িকে উপড়ে ফেলার জন্য ! নির্ভেজাল দ্বীনে হককে বিজয়ী করার জন্য। নতুবা সেই পথে নিজেদের তপ্ত লহু ঢেলে দিয়ে মানুষের কাছে সত্যের সাক্ষ্য হয়ে রব্বুল আলামিনের দরবারে হাজির হবার জন্যে !

ফাঁক-ফোকর খোঁজা, কোন আমলে কী ছাড় আছে—এসব তো আমরা করবো না। আমাদের জন্য এসব খোঁজাটা তো খুব বেশি প্রয়োজন নেই। আমরা তো দিনে জিহাদ করে রাতে তাহাজ্জুদ পড়া উম্মাহ ! আমরা তো বাসর ঘরে স্ত্রীরে রেখে উম্মুক্ত তরবারি নিয়ে জিহাদের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়াদের উত্তরসূরী। আমরা তো সারারাত জেগে কিয়ামুল্লাইল করে পা-ফুলিয়ে ফেলা রাসুলুল্লাহ সল্লালাহু আলাইহি ওসাল্লামের উম্মত ! আমরা কেন ফাঁকফোকর খুঁজবো ? এটা তো আমাদের সাথে যায় না, বেমানান ।

ইকামাতে দ্বীনের কর্মীরাও যদি কেবলই ফাঁকফোকর খুঁজে বেড়ায়, তবে ইকামাতে জাহিলিয়াতে নিমজ্জিত মানুষেরা কী করবে? ভেবেছেন কখনো? সব সময়ই ছাড় খোঁজা, ফাঁকফোকর খোঁজা মানে আপনার অন্তরে রোগ আছে। নফসের দাসত্বের রোগ। আল্লাহর দাসের কাজ হলো নফসের দাসত্বের গলায় লাত্থি মারা। আর সেটা না করে যদি আপনি কেবলই নফসের দাসত্ব-আনুগত্য করেন, তবে আপনার দ্বারা অন্তত ইকামাতে দ্বীন হবে না। ইকামাতে দ্বীন ছেলে খেলা নয়। কঠিন সাধনার বিষয়। পুড়ে পুড়ে খাঁটি সোনা হওয়ার বিষয়। এটা না করে মুখে মুখে ইকামাতে দ্বীনের কথা বলা কেবলই ভণ্ডামি, নয়তো আত্মপ্রবঞ্চনা।

আসুন, সংস্কারের নামে, ইকামাতে দ্বীনের নামে আত্মপ্রবঞ্চনা না করি। সর্বশেষ আমাদের উস্তায, বিশ্বের মুসলিম জাগরণের অন্যতম অবিসংবাদিত ইমাম, উস্তায সাঈয়্যেদ মওদূদী রহমাতুল্লাহি আলাইহির একটা উক্তি দিয়ে শেষ করছি, যেখানে তিনি তিনি বলেছেন,
"জাহিলিয়াতের সাথে আপোষ করার পদ্ধতি আবিষ্কারের নাম সংস্কার নয়।" ( ইসলামি রেনেসাঁ আন্দোলন )



- রোহান আবদুল্লাহ

পঠিত : ৪৫৮ বার

মন্তব্য: ০