Alapon

ভাটিরাজ ঈসা খাঁ: বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক




"এই সেই ভয়ঙ্কর ব্যক্তি যে কখনো আনুগত্য স্বীকার করে নি" -- আবুল ফজল।
বঙ্গবীর ঈসা খাঁ মাসনাদ-ই-আলা বাহাদুর ছিলেন ১ জন দুর্দান্ত 'মেরিন জিনিয়াস'। তিনি দুর্ধর্ষ নৌসেনাধ্যক্ষ এবং অসাধারণ গেরিলা কমান্ডার ছিলেন। নৌশক্তিতে বলীয়ান ঈসা খাঁর এক্সট্রা-অর্ডিনারি মেরিন ট্যাকটিক্সের জোরেই গানপাউডার ইম্পায়ার মুঘল সাম্রাজ্য বারবার পরাস্ত হয়েছিলো তাঁর কাছে। দুর্ভেদ্য ভাটিতে একের পর এক সেনাপতি বদল করে বারবার অভিযান চালিয়েও বাদশাহ আকবরকে পরাস্ত হতে হয়েছিলো ঈসা খাঁর কাছে। তাঁর অসাধারণ রণকুশলতা ও নৌ-পারদর্শিতায় একের পর এক মুঘল সেনাপতি ব্যর্থ হয়ে ফিরে গিয়েছেন। ড. হাবীবা খাতুন তাঁর অভিসন্দর্ভে প্রমাণ করেছেন যে, 'ভাটিরাজ ঈসা খাঁর প্রাসাদসমূহের মধ্যে মূল রাজপ্রাসাদ ছিলো নারায়ণগঞ্জের কাতরাবু তে।'

পানাম নগর ছিলো ঈসা খাঁর সেনানিবাস। সমরাঙ্গনে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী ধারা বিদ্যমান ছিলো, যথা: নদীমাতৃক বঙ্গের নৌবাহিনী ও রণহস্তীবাহিনী । বাংলার প্রাচীন গঙ্গারিডাই সভ্যতার দুর্ধর্ষ রণহস্তীবাহিনীর প্রতাপের কথা শুনেই আলেকজান্ডার দি গ্রেট পূর্বে অগ্রসর না হয়ে সৈন্য প্রত্যাহার করে চলে গিয়েছিলেন। মেগাস্থিনিস রচিত 'ইন্ডিকা' গ্রন্থে রণহস্তীবাহিনীতে বলীয়ান প্রাচীন বাংলার কথা বিদ্যমান। নৌশক্তিতে বাঙালি সর্বদাই ছিলো দুর্ধর্ষ। বঙ্গের সুলতান ফখরউদ্দীন মুবারাক শাহ এই নৌশক্তির জোরেই কদর খান কে পরাজিত ও হত্যা করে বঙ্গের স্বাধীনতা রক্ষা করেছিলেন । শাহ-ই-বাঙ্গালাহ শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহর নৌবাহিনী জলে এবং হস্তীবাহিনী স্থলে সৃজন করেছিলো প্রচণ্ড দাপট। নদীমাতৃক বাংলায় বাঙালির সুবিখ্যাত নৌশক্তির গৌরব টিকিয়ে রেখেছিলেন ভাটিরাজ ঈসা খাঁ। ১৫৭২ সালে ত্রিপুরা অভিযানে প্রচণ্ড বীরত্ব প্রদর্শন করায় তিনি বাদশাহ দাঊদ শাহ কররানী কর্তৃক "মাসনাদ-ই-আলা" খেতাবপ্রাপ্ত হন। ১৫৭২ সালে বাদশাহ দাঊদ শাহ্ যখন সিংহাসনে আরোহণ করেন সেসময় তখন ত্রিপুরার রাজা কর প্রদান বন্ধ করে দিলে ক্রুব্ধ হলে দাউদ শাহ ত্রিপুরা অভিযান শুরু করেন। এসময় তাঁর অধীনস্থ একজন রাজা সোনারগাঁ থেকে তাঁর নৌবাহিনী ও পদাতিক ফৌজ সহ সুলতানের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। এই রাজা অতি উচ্চ বংশজাত হবার দরুণ আত্মসম্মানবশত শাহী দরবারে হাজিরা দিতেন না, যার বাবা ছিলেন ভাটিরাজ গজদানী সুলায়মান খাঁ , দাদা ছিলেন বাইসওয়ারা রাজপুতদের নরপতি রাজা ধনপৎ সিংহ, মা ছিলেন হোসেন শাহী বংশীয়া সৈয়দা মোমেনা খাতুন, নানা ছিলেন সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ ইবনুস সুলতান হোসেন শাহ্।
তিনি অতি উচ্চ বংশের হওয়ায় বাংলার সুলতানদের সার্বভৌমত্ব মনেপ্রাণে মান্য করলেও
গৌড়ের রাজদরবারে হাজিরা দিতেন না।

মুঘল শাসনামলে মুঘল সুবাদার দের দুর্বলতার কারণে মগ-পর্তুগিজ জলদস্যুরা যেখানে ঘনঘন ঢাকায় হানা দিতো, সেখানে ঈসা খাঁ এতোটাই শক্তিধর ছিলেন যে, তাঁর ও তাঁর পুত্রের রাজত্বকালে আরাকানী দের দুঃসাহস হয়নি তাঁর রাজত্বে আক্রমণ করার। ভাটিরাজের প্রবল নৌশক্তির কারণেই মগ-পর্তুগিজরা ভাটির দিকে চোখ তুলবার সাহস করে নি….ঈসা খাঁর নৌসেনাপতি মাজলিস কুতুব, মাজলিস দেলোয়ার, মাজলিস প্রতাপের পরাক্রমে মুঘলদের বারবার পিছু হটতে হয়েছিলো…

'রুস্তম-ই-আকবর' খ্যাত রাজা মানসিংহ ১৫৯৫ সালে শোচনীয়ভাবে ঈসা খাঁর নিকট পরাজয়বরণ করেন। বস্তুতপক্ষে, বাংলার নৌবাহিনীর শৌর্য ১৬১২ সালে মুঘল শাসন প্রকৃত অর্থে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরই সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়ে! ঈসা খাঁ কখনোই মুঘলদের আনুগত্য স্বীকার করেন নি।তিনি বাংলার সুলতান ব্যতীত কারোর আনুগত্য করতেন না। ১৫৭৫ সালে তুর্কোইয়ের যুদ্ধে বাংলার বাহিনীর হাতে এতো মুঘল সৈন্য নিহত হয়েছিলো যে, স্থানটির নামই হয়ে যায় 'মোগলমারী', এই যুদ্ধ ইতিহাসে মোগলমারীর যুদ্ধ নামেও পরিচিতো।

যুদ্ধের পূর্বেই বাদশাহ আকবরের চক্রান্তের জাল ছড়িয়ে পড়ে গৌড়ের প্রতিটি প্রান্তে। সম্রাট আকবরের চক্রান্তে এবং বিশ্বাসঘাতক কুতলু খান লোহানীর সহায়তায় গুপ্তচর নারীদের গৌড়ের শাহী হারেমে দাসী হিসেবে পাঠানো হয় এবং দাউদ শাহর মতো মহান মুসলিম বীরকে পরাজিত করার লক্ষ্যে আকবরের চক্রান্তে তাঁকে মদ্যপানে আসক্ত করবার চেষ্টা করা হয়। আকবরের প্রচেষ্টা সাময়িক সময়ের জন্য সফল হয় এবং বাদশাহ দাউদ শাহ সাময়িককালের জন্য মদ্যপানে আসক্ত হয়ে পড়েন। এটিই বাংলার কোনো সুলতানের প্রথমবারের মতো মদ্যপানের ঘটনা। এর আগে বাংলায় একটি নিদর্শনও নেই যে, কোনো সুলতান মদ্যপান করতেন। বরং ফেই শিন লিখেছেন-
"বাংলার রাজপ্রাসাদে মদ্যপান নিষিদ্ধ ছিলো, কারণ এতে শালীনতার ব্যত্যায় ঘটবার আশঙ্কা থাকে। বরং সুলতানরা পান করতেন মিষ্টি শরবত"। বাংলার সুলতানদের মধ্যেই একমাত্র দাউদ শাহই সাময়িক সময়ের জন্য মদপান করেছিলেন, তাও বাদশাহ আকবরের চক্রান্তে। [ তথ্যসূত্র: "তারিখ-ই-দাউদী", 'মানজাখ-ই-আফগানি']

তুর্কোইয়ের যুদ্ধের পর কটকের সন্ধি অনুসারে বাংলা ও বিহার মুঘলদের দখলে চলে যায় এবং দাউদ শাহ উড়িষ্যার সুলতানে পরিণত হন। তুর্কোইয়ের যুদ্ধের পর দাউদ শাহ্ মদ্যপানের জন্য তওবা করেন ও হেরেমে গুপ্তচর হিসেবে আসা সন্দেহভাজন সকল দাসীকে বহিষ্কার করেন। এরপর আর কখনো মদ্যপান করেন নি তিনি। [তথ্যসূত্র: 'সিয়ার-উল-মুতাখখীরিন']

এত চক্রান্তের পরেও মোগলমারীর যুদ্ধে দাউদ শাহ এবং তাঁর সৈন্যরাপ্রচণ্ড শৌর্য-বীর্যের পরিচয় দিয়েছিলেন, কিন্তু যুদ্ধের শেষদিকে মুঘলদের ছোঁড়া একটি তীর হঠাৎ বাংলার বীর গুর্জার খানের চোখে লাগে। প্রধান সেনাপতি গুর্জার খানের মৃত্যু বাংলার বাহিনীকে দুর্বল করে দেয় শেষ মুহূর্তে। সেইদিন গুর্জার খানের শাহাদাত না হলে বাংলার ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো!

কিন্তু বাংলা-বিহার মুঘলদের দখলে গেলেও কিছুকাল পরেই গৌড়ে প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে। এমন মারাত্মক মহামারী আর কখনো বাংলায় আগে হয়নি! একে একে মুঘল সৈন্য ও সেনাপতিরা মহামারিতে মারা যেতে থাকে, মারা গেলেন আকবরের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খান-ই-খানান মুনীম খান। এই মহামারীকে বাংলার মুসলিমরা আকবরের উপর আল্লাহর গজব হিসেবে আখ্যায়িত করে। [সূত্র: "তারিখ-ই-দাউদী" -আব্দুল্লাহ]

মুনীম খানসহ মুঘল সেনারা নিহত হলে দাউদ শাহ্ উড়িষ্যা থেকে সসৈন্যে রওনা দেন এবং তান্ডা পর্যন্ত প্রতিটি মুঘল দুর্গ দখল করতে থাকেন। আফগান ও বাঙালিরা উত্তরপ্রদেশের গাজিপুরের জামানিয়ার মুঘল দুর্গ দখল করে নেন।

এসময় ঈসা খাঁ মাসনাদ-ই-আলা বাদশাহ দাউদ শাহর নাম নিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং মুঘল মীর-ই-বাহার শাহবর্দীর নৌবহরকে বিধ্বস্ত করে দেন। অ্যাডমিরাল শাহবর্দী পরাজিত হয়ে ঈসা খাঁর আনুগত্য স্বীকার করে তাঁর সাথে যোগ নেন। এরপর আর কখনো ঈসা খাঁর লড়াই থামেনি। আবুল ফজল তাই ঈসা খাঁর মৃত্যুদিনে উল্লসিত হয়ে লিখেছেন-
"ভাটির রাজা আজ বখতিয়ারপুর প্রাসাদে ইন্তিকাল করেছেন। এই সেই ভয়ঙ্কর ব্যক্তি, যে কখনো আনুগত্য স্বীকার করেনি। শাহানশাহ আলামপানার দরবারে আসার সৌভাগ্য তার হয়নি। এই ভয়ঙ্কর ব্যক্তিটির মৃত্যুতে ভাটির বিদ্রোহীদের শেষদিন ঘনিয়ে এসেছে। হিন্দুস্তানী সাম্রাজ্য এখন নিরাপদ..."["আকবরনামা"]


আজ এই ইতিহাসবিকৃতির যুগেও মানুষ ঈসা খাঁকে এখনো মনে রেখেছে গভীর শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায়। তিনি বেঁচে আছেন মানুষের হৃদয়ে। ঈসা খাঁর অসাধারণ বীরত্বের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বাংলার অন্যতম বৃহৎ নৌঘাঁটির নামকরণ করা হয়েছে "বানৌজা ঈসা খান"।
----------------------------------------
লেখক: রাজিত তাহমীদ জিত

পঠিত : ৩৬৮ বার

মন্তব্য: ০