Alapon

সাহাবাদের অসাধারণ সুন্দর একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য...



[ হজরত কাব (রা) অলসতাবশতঃ তাবুক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি, মদিনায় থেকে যান। বড় একটি হাদিসে তিনি তাঁর ছেলের কাছে ঘটনার বিশদ বিবরণ তুলে ধরেন। সেখান থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ ব্যাখ্যাসহ এখানে তুলে ধরা হল।]

এরপর কাব (রা) বলেন, "রাসূল (স) তাবুকে পৌঁছার পূর্ব পর্যন্ত আমার কথা মনে করেননি।"
তিনি তাবুকে ক্যাম্প গড়লেন। তিনি কতদিন সেখানে অবস্থান করেন এ ব্যাপারে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। কেউ বলেন দশ দিন, কেউ বলেন ঊনিশ দিন। যাইহোক, তিনি বেশ কিছু দিন তাবুকে অবস্থান করেন।

সেই সময় কোন একদিন তাঁর কাবের কথা মনে পড়ল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন- "কাবের কি হয়েছে।" তখন বনু সালামার এক ব্যক্তি বলে উঠল - কাব নিজেও বনু সালামা গোত্রের, আর এই লোকটিও বনু সালামার - "হে আল্লাহর রসূল! তার সুস্বাস্থ্য ও সম্পদের দু’টি চাদর তাকে আটকে দিয়েছে এবং সেই চাদর দু’টির কিনারায় তাকিয়ে দেখাতে ব্যস্ত রয়েছে।" এটি আরবিতে কথা বলার একটি ধরণ। অর্থাৎ, তার উন্নত জামা-কাপড়, আরাম-আয়েশের জীবন তাকে পেছনে ফেলে রেখেছে। অর্থাৎ, তিনি পরকালের উপর দুনিয়াকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এই অভিযোগে তাকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে।

তখন মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা) ঐ লোকটিকে বললেন - "তুমি কতই না নিকৃষ্ট কথা বললে!" তারপর রাসূলুল্লাহ (স) কে বললেন - "ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি কাব সম্পর্কে ভালো ছাড়া অন্য কিছু জানি না।" অর্থাৎ আমি তাকে ভালো বলেই জানি।

এখন এখানে আমরা কী লক্ষ্য করলাম? যে লোকটি কাবের সমালোচনা করলো তিনি কে ছিলেন? তার নাম কি? আপনারা কেউ তার নাম বলতে পারবেন? আমরা জানি না। এ বর্ণনা থেকে আপনাদেরকে এই বিষয়টার প্রতি বিশেষভাবে মনোযোগ দিতে বলবো। যিনি প্রশংসা করলেন তিনি ছিলেন মুয়াজ ইবনে জাবাল, এবং কাব তার নাম উল্লেখ করলেন। কিন্তু যিনি সমালোচনা করেছিলেন কাব তার নাম গোপন করলেন। আপনাদের কি মনে হয় না, কাব (রা) ভালো করেই জানেন কে তার সমালোচনা করেছিল?

এখানে তাঁর সুযোগ ছিল লোকটার পাল্টা সমালোচনা করার। যেহেতু লোকটি তাঁর নিজ গোত্রের ছিল তিনি নিশ্চয় তার উপর আরও বেশি মনঃক্ষুণ্ণ ছিলেন। অন্যদিকে মুয়াজ কিন্তু বনু সালামার ছিল না। অন্য গোত্রের একজন তার প্রশংসা করলো আর নিজ গোত্রের একজন তার সমালোচনা করলো। কিন্তু তারপরেও কাব (রা) ক্ষুদ্রতার উর্ধে উঠে তার সমালোচনা তো করলেনই না, এমনকি তার নাম পর্যন্ত গোপন করলেন। ঘটনা বলার সময় তিনি শুধু বললেন, বনু সালামার এক ব্যক্তি।

সুবহানআল্লাহ! গোটা সীরাতে এই ধরণের ঘটনার উদাহরণ ভূরি ভূরি। বহু ঘটনায় সাহাবীরা এভাবে কারো ত্রুটি বর্ণনা করার প্রয়োজন হলে কৃত ব্যক্তির নাম গোপন রেখেছেন। এর দ্বারা সাহাবায়ে কেরাম (রা) দের উচ্চ মানের চরিত্রের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। আমার আপসোস হয়, যদি আমরা এমন আচরণ আয়ত্ত করতে পারতাম! অপর ভাইয়ের ভুল-ত্রুটি উপেক্ষা করুন। যদি উল্লেখ করতেই হয় তাহলে নাম উল্লেখ না করে শুধু ঘটনাটা বর্ণনা করুন।
আমাদের সময়ে এসে পত্র-পত্রিকায়, টিভি মিডিয়ায় এটা এক মহা আকার ধারণ করেছে। এমনকি কোনো কোনো ম্যাগাজিন বা পত্রিকার কাজই হলো মানুষের দোষ ত্রুটি নিয়ে গল্প গুজব ছড়িয়ে যাওয়া।

কিন্তু সুবহানআল্লাহ! আমাদের ধর্ম ঠিক তার উল্টোটা করতে বলে। সবাই আমাদের রাসূলুল্লাহ (স) এর বিখ্যাত এই হাদীসটি মনে রাখবেন। "যে কেউ তার ভাইয়ের অনুপস্থিতে তার সম্মান রক্ষা করবে, আল্লাহ সুব হানাহু ওয়া তায়ালা কিয়ামতের দিন তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করবেন।"

আপনি যদি কোনো মুসলমান ভাইয়ের অনুপস্থিতে তার সমালোচনা করার সময় তার মানসম্মানের প্রতিরক্ষা করেন, তাহলে এই প্রতিরক্ষা কিয়ামতের দিন আপনার জাহান্নামের আগুন থেকে প্রতিরক্ষার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

তাই, পরের বার কোনো আড্ডায় যদি কোন মুসলমান ভাইয়ের সমালোচনা করা হয়, এবং আপনি তাকে চিনে থাকেন, তাহলে তার সম্মানের পক্ষে কথা বলুন। এই ঘটনায় হযরত মুয়াজ যেভাবে কাবের সম্মানের পক্ষে কথা বলেছেন। আর যদি না চিনে থাকেন তাহলে আলোচনার বিষয় পরিবর্তন করে ফেলুন। কারণ আমাদের তো এমনিতেই গীবত করা উচিত নয়।

-- Seerah of Prophet Muhammad (S) Part: 88

আমরা যে শুধু নিজেদের পাপের কথা গোপন করে ফেলি তাই নয়, আমরা অন্যদের পাপও গোপন করে ফেলি। এটি আমাদের ধর্মের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি শিক্ষা। আমি যদি আপনাকে কোনো পাপ করতে দেখি বা আপনি যদি আমাকে কোনো পাপ করতে দেখেন সেক্ষেত্রে শরিয়া আমাদের বলে— তাকে গোপনে উপদেশ প্রদান করো এবং এরপর তোমার মুখ বন্ধ করে ফেলো। কারো কাছে এটা তোমাকে বলতে হবে না। কারো এখানে নাক গলানোর কিছু নেই। তবে, যদি খুন বা এরকম অন্য কোনো অধিকার লঙ্ঘন করা হয় তখন বলতে হবে।

কিন্তু একান্ত ব্যক্তিগত পাপ— যা কারো অধিকার নষ্ট করছে না, এমন পাপের ক্ষেত্রে শরীয়ত আমাদের উপর বাধ্যবাধকতা আরোপ করে যে, আমরা কাউকে এটা বলতে পারবো না।

কারণ, আল্লাহ হলেন সিত্তির, যিনি ঢেকে ফেলেন। কাউকে একান্তে ব্যক্তিগত কোনো পাপ করতে দেখলে যদি মানুষের কাছে তা বলে বেড়ান, এটা এক ধরণের অপবাদ যার জন্য কখনো কখনো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা শাস্তি দিতে পারেন।

তাই, আমাদেরকে এ ব্যাপারে খুব সাবধান থাকতে হবে। মানুষের দোষ ত্রুটি নিয়ে বলাবলি করা যাবে না এবং গীবতে জড়ানো যাবে না। আমরা সবাই জানি, গীবত হলো অপর ভাই সম্পর্কে এমন সত্য বলা যা শুনলে সে অসন্তুষ্ট হবে। আর অপবাদ হলো তার নামে মিথ্যা বলা।

আমরা এ ব্যাপারটা খুবই চমৎকার একটি হাদিস থেকে জানতে পারি। রাসূল (স) বলেন— "আল মুস্লিমু আখুল মুসলিম। ওয়া মান সাতারা আন আখিহিল মুসলিম, সাতারাহুল্লাহু ইয়াওমাল কিয়ামাহ। অর্থাৎ—এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের পাপ গোপন করে ফেলবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার পাপ গোপন করে ফেলবেন।"

কারণ, আল্লাহ হলেন আস-সিত্তির, যিনি ঢেকে ফেলেন। কত সুন্দর এক রব আমাদের! আমরা তাঁর বিরুদ্ধে পাপ করি। তিনি আমাদের প্রত্যেকটি পাপ সম্পর্কে জানেন। অথচ তিনি ক্রমাগত অন্য মানুষদের মন থেকে এগুলো গোপন করে ফেলেন।

— ড. ইয়াসির ক্বাদী

পঠিত : ৩৪৭ বার

মন্তব্য: ০