Alapon

বাংলাদেশে আওয়ামী দুঃশাসন দীর্ঘ হবার অন্তরালে



ঢাকার বুয়েটে আবরার ফাহাদ হত্যার দুই মাস পরে আলিগড় ও জামিয়া মিলিয়ায় নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে বিক্ষোভরত ছাত্রছাত্রীদের উপর পুলিশি তান্ডব হয়। তার পরের মাসে, জানুয়ারি ২০২০-তে জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে পুলিশ ও হিন্দুত্ববাদী ছাত্রসংগঠন এবিভিপি ছাত্রছাত্রীদের উপর হামলা চালায়। ছাত্র সংসদের সভানেত্রী ঐশী ঘোষ তার কিছুদিন পর একটা প্রতিবাদ সভায় মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আর পাশে দীপিকা পাড়ুকোন--অনেকেই দেখেছেন সে চিত্র। আলিগড়, জামিয়া, জে এন ইউ সর্বত্র পুলিশ ও শাসকদলের বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয় দেশ-বিদেশে। নাগরিকত্ব বিলের বিরুদ্ধে পৃথিবীর নানা শহরে, ভারতীয় দূতাবাসের সামনে, নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যে প্রবাসী ভারতীয়, বিশেষ করে ছাত্র-ছাত্রীরা প্রতিবাদ করছিলেন, তাঁদের বেশিরভাগই ছিলেন অমুসলিম। তাদের ব্যক্তিস্বার্থ নাগরিকত্ব বিল পাশ হলে কোনোভাবেই বিঘ্নিত হয় না। তারপরও তারা এসব প্রতিবাদের সামনের সারিতে থেকেছে। এদের অনেককেই পরে কৃষক আন্দোলনের সময় হোক বা হিজাব ব্যান--নানা ইস্যুতে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে দেখা গেছে। ফ্যাসিবাদ যতই ভারতে ডালপালা মেলুক, দেশের ভেতরে ও বাইরে শিক্ষিত সমাজ, অধ্যাপক, চাকরিজীবী, ছাত্রছাত্রী, গবেষক - মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নানা বর্গের একটা শ্রেণীর প্রতিবাদ কিন্তু সেই আধিপত্য বিস্তারকে চ্যালেঞ্জ করে চলেছে। এরা এসব কোনো কংগ্রেস বা সিপিয়েমের মত বিরোধী দলের ব্যানারে করেছে তাও না। নাগরিক সমাজের প্রতিরোধ হিসাবে দল-ব্যানারহীনভাবেই এসব হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিকে পরাস্ত করতে ফেসবুকের গ্রূপ 'নো ভোট টু বিজেপি'-ও এমন একটা ভূমিকা রাখল।

সব ফ্যাসিবাদের অধীনে গোলামির অভিজ্ঞতা একই হবে, এমন কোনো মানে নেই। জার্মানিরটার সঙ্গে ফারাক থাকবে ভারতের, ভারতের সাথে বাংলাদেশের। তারপরও দরজার বাইরে যতই রাষ্ট্রের খড়গ-কৃপান ঝুলুক, নিজের বুকের ভেতরে আগুন জ্বালিয়ে, দরকার হলে একলা চলেও সেই গোলামির সামনে নিজেকে হিমালয়ের মত দাঁড় করানো যায়। কোনও দলীয় শক্তিতে বলীয়ান না হয়েই, শুধু নিজের বিবেকের কাছে সৎ থেকে। তবে বর্তমান বাংলাদেশে এসবের কিছুই প্রায় নেই। প্রতিদিন যদি দেশটায় একটা করে আবরার ফাহাদ হয়, তাও দেশের ভেতর বা প্রবাসের বাংলাদেশি অধ্যাপক, ছাত্রছাত্রীদের বড় অংশকে কেউ নাড়াতে পারবে না। তারা পথে নামবে না। একটা বিবৃতি পর্যন্ত দেবেনা। দিলেও এমন একটা কিছুতে দেবে যেটার সরাসরি নিশানা সরকার-ক্ষমতাসীন দল না। অনেকটা নিরাপদ সড়কে চোখ বেঁধে সাইকেল চালানোর মত নিরাপদ হতে হবে তবেই। সেটাও আর করেনা এরা।

প্রবাসী বাংলাদেশী পরিবার যারা ইউরোপ-আমেরিকায় আছে, তারা ধরেই নিয়েছে যে এসব দূরদেশে একটা 'গুড লাইফ'-এর জন্য তারা এসেছে। সূরা তাকাসুরে ধিকৃত চরম বস্তুবাদী জীবনকে সহি ঠাওরাতে নিজেকে ঘোষণা করেছে 'রেমিটেন্স যোদ্ধা'! গুড লাইফ আসবে বেশি বেশি অর্থ উপার্জন করে। দিনরাত ট্যাক্সি চালিয়ে, হালাল মাংস আর হারাম মদ সম্বলিত 'ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট'-এ দেদার বিক্রিবাট্টা করে। বছরের বাকি সময়টুকু যেহেতু ডিল্যাক্স ক্যাটাগরিতে হজ-উমরা করে, রমজানের সন্ধ্যায় প্রবাসী বাংলা চ্যানেলগুলোতে আপিল করা নানা ফালাহি প্রজেক্ট-এ ডলার-পাউন্ড সদকা করে, বিশ্বনাথ বা হবিগঞ্জে নির্মীয়মান মাদ্রাসা-মক্তব-এতিমখানায় যাকাত দিয়েই কেটে যায়--অতএব এত ব্যস্ত জীবনে জালেমের বিরদ্ধে হক কথা বলার সময় কোথায় ! এর মধ্যেও অনেকেই বলছে, তবে সেটা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রবাসী শাখাগুলোর ব্যানারে। ফলে প্রবাসী ভারতীয়দের ক্ষেত্রে, বা ভারতের নানা ক্যাম্পাসে যেমন দেখা গেল একটা নাগরিক সমাজ,ছাত্রছাত্রীরা, সঙ্গে কিছু লেখক, বুদ্ধিজীবী, অভিনেত্রী অনেকেই শ্বাশত কিছু সাংবিধানিক মূল্যবোধকে রক্ষা করতে পথে নামছে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেটা দেখা যায়না। দেশের ভেতরে গড়া শক্ত বলে বাইরেই যে কিছু একটা নাগরিক সমাজের প্রতিবাদ জন্ম হবে, যেহেতু এখানে অনেক মেধাও এসে জুটেছে উচ্চশিক্ষা, গবেষণা বা অধ্যাপনার সুবাদে--তেমন কিছুই চোখে পড়েনা। যদিও বিগত দেড় দশকে স্বৈরাচার বাংলাদেশে বটবৃক্ষে পরিণত। মানুষের জীবনের মূল্য তুচ্ছ। কিন্তু তারপরেও বাস্তবচিত্র--যত বেশি মেধা, ততবেশি দলদাস!

ভারতে আমরা জানি সংবিধানের প্রস্তাবনায় কী কী লেখা আছে। যারা জানত না, বছর দু'চারেক আগে কানহাইয়ার ভাষণ শুনে শুনে তাদেরও অনেকের প্রায় মুখস্ত হয়ে গেছিল। ফ্যাসিবাদের উত্থানের বিরুদ্ধে তাই নাগরিক সমাজ থেকে আসাদুদ্দিন ওয়াইয়েশির রাজনৈতিক দলেরও অস্ত্র থেকেছে সাংবিধানিক মূল্যবোধকে রক্ষার করার উপর জোর দিয়ে। তাই বাংলাদেশের মত অত সহজে 'আওয়ামি গেলে কি তবে দুর্নীতিবাজ বিএনপি' মার্কা প্রশ্ন দিয়ে সরকারের ছুপা সমর্থকরা সহজেই আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করে দিতে পারেনি। বিএনপি এলে দুর্নীতির সমূহ সম্ভাবনা এটা যেমন বাংলাদেশের একটা শিশুও জানে, ভারতেও অনেকেই জানত যে, কংগ্রেসের দুর্নীতিও একটা বড় কারণ মোদির উত্থানের পেছনে। বা তৃণমূলের নেতাদের কাছে সাতবার পা ধুঁয়ে পানি


খেয়েও হয়তো বিজেপি পরের বিধানসভা ভোটে বাংলায় ক্ষমতায় এসেই অত জলদি দূর্নীতিবাজ হতে পারবে না। ভারতের সংবিধান নিজেও অনেক ধারায় পক্ষপাতমুক্ত না। তারপরও সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লেখিত কিছু
মানবিক মূল্যবোধকে তুলে ধরার জন্য ভারতে এতগুলো লোক, বিশেষ করে নারীরা কোনও দলীয় পতাকা ছাড়াই শাহীনবাগ থেকে পার্ক সার্কাসে নাগরিকত্ব বিলের বিরুদ্ধে এত ঠান্ডায় রাত জেগে বসে থাকল। দেশের বাইরে নানা শহরে প্রতিবাদ করল। আখলাক, জুনায়েদ, আফরাজুলদের পিটিয়ে মারার প্রতিবাদে এর আগেও এরকম অনেক প্রতিবাদ 'নট ইন মাই নেম'-র ব্যানারে হয়েছে। নানা ধর্ম, দল, মতের লোকজন সেটায় শামিল হয়েছে। দেশের গদি মিডিয়াকে ছাপিয়ে প্রবাসী ছাত্রছাত্রীদের একের পর এক প্রতিবাদ মোদির ভাবমূর্তিকে সাম্প্রতিক অতীতে বিদেশে চরম অস্বস্তিতে ফেলেছে।

কিন্ত বাংলাদেশের যে ছাত্র বা ছাত্রীটা হার্ভার্ড বা অক্সফোর্ড-এ পড়ে, সে তার দেশের সংবিধানের কোন মূল্যবোধকে বাঁচানোর জন্য পথে নামবে ? অবশ্যই বাংলাদেশের সংবিধানে অনেক মূল্যবোধেরই রক্ষার প্রতিশ্রুতি আছে। কিন্তু সেই ছাত্রটি তো সেসব জানেই না! পাওয়ার পলিটিক্সের বিরুদ্ধে মাস পলটিক্সের গুরুত্ব সে কোনদিন দেখেনি। সে শুধু জানে এই ভার্সিটিতে তার এক বড় ভাই ছিলেন অনেক বছর আগে। উনি সংবিধান লিখেছেন। অতএব কামাল হোসেনের সাথে একটা সেলফি কোনোভাবে নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করলেই বাজার গরম! বা সে যদি লন্ডনে বার-এট-লও পড়ে, তাও সে জানেনা সংবিধানের কোন জিনিসটা বাঁচানোর জন্য তাকে লন্ডনের বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে গিয়ে প্রতিবাদ করতে হবে। কারন সেতো আইন পড়তে এসেছে ব্যারিস্টার হওয়ার জন্য, ফিরে গিয়ে উচ্চ আদালতে উকিল হওয়ার জন্য। সংবিধানে উল্লেখিত মানবিক মূল্যবোধগুলো বুঝার জন্য তো চড়া ফি দিয়ে বিপিপিতে ভর্তি হয়নি, বরং একদিন চড়া ফি ফিরে পাবে এই আশায় হয়েছে। এরা সবাই সুযোগ পেলে প্রবাসের বাংলাদেশ দূতাবাসে যাবে, তবে ইফতার খেতে বা তার বাপের জন্মের আগে ভাষাদিবসের নিহতদের আত্মার প্রতি শোক জানাতে। দেশ থেকে আসা কোনও প্রতিমন্ত্রীকে নিজের মুখ চিনাতে। কিন্তু গতকাল পুলিশের গুলিতে ঢাকার রাজপথে যে প্রাণটা ঝরে গেল--সেটা নিয়ে তার মুখ দিয়ে টু শব্দটিও বেরোবে না। ওসব বিরোধী দলের লাশ !

তবে আপনার দল কী আওয়ামী ? চক্ষুলজ্জা যেহেতু একটু হলেও মিটমিট করে জ্বলছে, তাই আমতা আমতা করে উত্তর হবে ''না মানে ভাই বুঝতেই পারছেন তো বঙ্গবন্ধু স্কলারশিপ নিয়ে এদেশে পড়তে এসেছি'' অথবা ''আসলে ভাই ঢাবির চাকরি থেকে লিভ নিয়ে কেমব্রিজে পিএইচডি-টা করতে এসেছি। ফিরে গিয়ে আবার অধ্যাপনায় যোগ দিতে হবে তো''! একবার তো বিগত লাইলাতুল ভোটলুটের আগের দিন কলকাতার কাগজে বেরোনো আমার এক আওয়ামির স্বৈরাচার নিয়ে লেখা উত্তর-সম্পাদকীয় পড়ে অক্সফোর্ড-এর এক গ্রোসারি শপে দেখা হওয়া একজন বাংলাদেশি গবেষক জানালো ''যথার্থ লিখেছেন ভাই, লাইক দিতে পারিনি পোস্টে। দেশে সরকারি চাকরি করি বলে। তাই এখানেই বলছি আপনাকে"! এরা নিজের কেরিয়ারের বাইরে গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়ের মূল্য বুঝবে ? তাই বলে এরা কিন্ত বোবা-কালা না। স্কুল থেকেই ডিবেট করে (টিভিতে দেখে যদিও আমার এসব বাচনিক শিল্প বেশি, যুক্তিপ্রতিষ্ঠা কম মনে হয়), পড়াশোনায় খুবই ভাল বলেই বিদেশে ভাল জায়াগায় এসেছে, এরা ভাষাদিবসের অনুষ্ঠানে কলকাতার সাথে পাল্লা দিয়ে 'বাঙালি' সাজে, নিজ দেশ একটা গুরুত্বহীন কোনো ম্যাচে জিতলেও এদের জাতীয়তাবাদ, আসাবিয়াত উথলে উঠে। গালিব তার প্রেমিকার জন্য যত কবিতা লিখেনি, অক্সব্রিজের ভালোবাসায় এরা পাতার পর পাতা ব্লগ লিখতে পারে, ভিডিও বানাতে পারে।(এই ব্যাপারে বাকি সব দেশকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশি স্টুডেন্টসরাই টপে, দেশে ফিরেও এসব অক্সব্রিজ-আইভি লীগের মার্কেটিং আরও দু'তিন দশক 'নস্টালজিয়া'-র ছদ্মবেশে জারি থাকে)।

কিন্ত সেদিন সোয়াসে, অক্সফোর্ড-কেমব্রিজে, মেনল্যান্ড ইউরোপ বা আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে ভারতীয় ছাত্রছাত্রীগুলো তাদের দেশে মুসলিমদের মব লিনচিংয়ের বিরদ্ধে, হিজাব ব্যানের বিরুদ্ধে, ক্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করল, আন্দোলনরত কৃষকদের পাশে দাঁড়াল,ভারতীয় দূতাবাসগুলোর সামনে স্লোগান দিল--তাদের অনেকেই তো সরকারি বৃত্তি পেয়েই বিদেশে পড়তে এসেছে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে লিভ নিয়েও। তাদেরও তো একদিন দেশে ফিরতে হবে। উত্তর আসবে, বাংলাদেশে এসব ক্ষেত্রে সরকারি দল, ছাত্রলীগের রোষানলে পড়ার বেশি আশঙ্কা। প্রত্যুত্তরে বলব, তবে একটা কাজ করুন। একের পর এক ঢাকায় লাশ পড়লে, গুম হলেও যখন প্রবাসে একটা প্রতিবাদ, বিবৃতি কিছুই দিতে পারবেন না, তবে আজ থেকে মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন এসব নিয়ে গর্ব করা বন্ধ করুন। এমনিতেই মুক্তিযোদ্ধাদের নখের সমান আপনার সাহস নেই, খামোখা তাদের কুরবানিগুলোকে আওয়ামি লীগের দলীয় ইতিহাসে মিশিয়ে দিতে মদত দিবেন কেন? আল জাজিরার এক ঘন্টার রিপোর্ট দেখে, 'আয়নাঘর'-এর হদিস পেয়ে, এমনেস্টি-হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রভৃতিতে গুম-খুন-তোলাবাজির ফিরিস্তি দেখে, সংখ্যালঘুর ধর্মীয় অধিকার হরণ, উলেমাদের শাসকদলের হাতে লাঞ্চিত


হতে দেখে আপনার বিবেক যদি শুধু চাকরি আর বৃত্তির কাছেই বন্ধক থাকে --তবে তো কোনো গোলামি থেকেই মুক্তি লাভের যোগ্যও না আর আপনি। আপাদমস্তক গোলামি করেও নিজেকে গোলাম ভাবতে পারছেন না শুধু এই কারনেই যে, কিছু লোক নিজেদের স্বার্থ নিয়ে এত পাটিগনিত না কষে অতীতে ইংরেজ বা পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে আপনার বাপ-দাদাকে স্বাধীন করে গেছিল বলে।

যদিও সেই স্বাধীনতাকে পরে কোনোদিন আপনি চোখে দেখেননি, গল্প শুনেছেন। যেমন ভোটের গল্প শুনেন--আজকে পশ্চিমবঙ্গে ভোটে জিতে মমতা মুখ্যমন্ত্ৰী হল, বা আমেরিকায় বাইডেন। আপনি সেগুলো পোস্ট করে একটা স্বপ্নে কাচ্চি খাওয়ার মতো সুখ পান। আপনার স্বাধীনতা তো বাইশ গজে! সেখানেই আপনি চাইলেই নড়াইলের কোনও মাথা বিকানো আলেকজান্ডারকে বিশ্ববিজেতা কল্পনা করে দুনিয়া মুঠোয় করতে পারেন। জিতেছে না, কিন্তু একদিন তো জিতবে! সে একদিন কালেভদ্রে এলেই সেদিন বিজয়-দিবস ! মোদিও চেয়েছিল পাকিস্তানকে ক্রিকেটে হারিয়ে আমাদের সবার মধ্যে জাতীয়তাবাদের নেশা ধরাতে। পুরো সফল হয়নি। অনেকেই সেটা থেকে বেরিয়ে এসেছে বলেই ক্যা আন্দোলনের সময় নীরব থাকার জন্য তুলোধুনো করতে ছাড়েনি তাদের শৈশবের প্রিয় ব্যাটসম্যান থেকে অভিনেতা কাউকেই। সব কুছ ইয়াদ রাখা জায়েগাতে সেই নামগুলোও শামিল আছে। হাওয়া ঘুরলে তারা নিজে থেকেই একঘরে হবে। কিন্তু আপনার তো কিছুই মনে রাখার দায় নেই। বাংলাদেশে মানবাধিকার, মানবীয় মূল্যবোধ,গণতন্ত্র ভুলুন্ঠিত হতে দেখেও তা বিশ্ববিবেকের সামনে তুলে ধরার দায় নেই। একটা প্রতিবাদও করতে অপারগ। সংবিধানের প্রস্তাবনায় কী আছে, দেশে আদতে কী হচ্ছে, নাগরিক সমাজ কাকে বলে-- এসব না জেনেও তো আপনার ইন্টেলেকচুয়ালিটির ইঞ্জিন দিব্যি ফেসবুকে দৌড়াচ্ছে।

তারপরও আপনি একা না। হয়ত নাম শুনেননি বাইরে আছেন বলে। কিন্তু দেশে গেলে দেখতে পাবেন অনেক আলেম-ওলামা, দ্বীনি শিক্ষায় স্ব-শিক্ষিত জেনারেল ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা উঠতি দাওয়াতী বক্তা-লেখক, উত্তর-আধুনিক চিন্তা নিয়ে বইমেলায় বেরোনো বই সই করে করে আঙ্গুল ব্যাথা তাত্ত্বিক-- অনেকেই আপনার মতো। আপনি একা না। এরা সব মুত্তাকি, পরহেজগার, আপাদমস্তক পাগড়ি, সুন্নত আবৃত ইসলামি লেখক, ফেসবুক পেজে ইসলামের সোনালী ইতিহাস নিয়ে একের পর এক ভিডিও নির্মাতা। জানিনা তাদের তাকওয়ার কোঠায় ভয় আল্লাহর বেশি না ছাত্রলীগেরই, কিন্ত তারপরও কিছু জেনুইন তাকওয়া যে একদম নেই তা তো না। আপনিও তো আল্লাকেই উত্তম রিজিকদাতা মনে করেন, ছোট থেকেই মুদির দোকানে সেই আয়াতটা লিখা আছে দেখতেন। এখন বড় হয়ে একটা এসি ডিল্যাক্স ক্লাসে ফি বছর উমরাময় আরামপ্রদ প্রবাসী জীবন, সরকারি স্কলারশিপ বা নির্ঝঞ্ঝাট চাকরি জীবনের জন্য একটু আল্লাহর সঙ্গে আওয়ামী লিগকেও রিজিকদাতা ভেবে সব কিছু মেনে নিচ্ছেন এই যা পার্থক্য! তা আপনার এই চলমান শির্কের বিরদ্ধে কেয়ামতে উপস্থাপনযোগ্য যুক্তি-প্রমাণ জোগাড় করে রেখেছেন তো ? মিরাজের সেঞ্চুরি তো কালকেই ভুলে যাবেন, বিশ্বকাপ হয়ে গেলে মেসি-রোনাল্ডোরাও চলে যাবে। কিন্তু আপনার নীরবতা যে জীবন্ত মানুষগুলোকে প্রতিদিন লাশে পরিণত করছে ? সুযোগ পেলে ব্রাজিলের জার্সি না আর্জেন্টিনার পতাকা-- কোনটা জড়িয়ে এদের দাফন করবেন ভাবছেন ? জার্মানিতে হিটলারের ফ্যাসিবাদ কিন্তু শুধু ইহুদিদেরই একমাত্র টার্গেট করেনি। ডিজিএফআই থেকে ছাত্রলীগ-- এরাই-বা ব্যতিক্রম হতে যাবে কোন দুঃখে ?

"ওরা প্রথমে যখন কমিউনিস্টদের ধরে নিয়ে যেতে এলো,
আমি কোন কথা বলিনি,
কারণ আমি কমিউনিস্ট নই।
তারপর ওরা যখন ট্রেড ইউনিয়নের লোকগুলোকে ধরে নিয়ে গেল,
আমি নীরব ছিলাম,
কারণ আমি শ্রমিক নই।
তারপর ওরা যখন ফিরে এলো ইহুদিদের ধরে নিয়ে যেতে,
আমি তখনও চুপ করে ছিলাম,
কারণ আমি ইহুদি নই।
ওরা আবারও আসল ক্যাথলিকদের ধরে নিয়ে যেতে,
আমি টু শব্দটিও উচ্চারণ করিনি,
কারণ আমি ক্যাথলিক নই।
শেষবার ওরা ফিরে এলো আমাকে ধরে নিয়ে যেতে,
আমার পক্ষে কেউ কোন কথা বলল না,
কারণ, কথা বলার মত তখন আর কেউ বেঁচে ছিল না।"

পঠিত : ৩১৯ বার

মন্তব্য: ০