Alapon

১০০ টাকার গল্প

তাহসিন আহমেদ। ৫ ফুট ৭ উচ্চতার টগবগে সুদর্শন এক যুবক। সদ্য ২১ পেরিয়েছে। আজ তার ডেট জনৈক এক মেয়ের সাথে। এটা কততম ডেটিং ছিল সেটা এখনও অজানা। এর আগে অন্য আরেক জনের সাথে সর্ম্পক ছিল। সম্পর্ক টা বেশি দিন টেকে নী। আপুটা নিরিহ সরল মনা ছিল। এই ছোট জীবনে নতুন করে ভুল পথে যেতে চাই নী। আবার ছেলেটাকে না বলতেও পারছিল না। একটু একটু পছন্দ ও করতো বটে। বাঁধ সাজলো অন্য জায়গায়। আপুটা তাহসিন কে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। বলেছিল বিয়ে করে তবেই তার সাথে প্রেম করবে। পবিত্র প্রেম। কিন্তু তাহসিন তাতে রাজি হয় নি। সম্পর্ক টা ওখানেই শেষ। পথযাত্রা টা শুরু হওয়ার আগেই শেষ।
তাহসিন আর মেয়েটা একসাথেই এক নাম করা রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করল। প্রবেশ করতে না করতেই চোখে পড়ল অবশিষ্ট টেবিলের উপর। ওখানেই বসবে মন স্থির করল। কিছুক্ষণের মধ্যে একজন ওয়েটার এলো কি খাবে তার অর্ডার নিতে। বিশেষ ছাড়ের পদটাই সে অর্ডার দিল। ও হ্যা মেয়েটার নামটাই বলা হয় নি। মেয়েটার নাম ছিল নুসরাত নিশা। দেখতে পূর্ণিমা চাঁদের মতো আর গুনে তার চে অনেকখানি মিষ্টি। আজ নিশা পরিপূর্ণ পর্দায় এসেছে। কালো বোরখা, হাতে গ্লাভস। শেষ যেদিন তাহসিন এর সাথে দেখা হয়েছিল সেদিন ছিল শাড়ি পরিহিতা। সেদিনের পর থেকে তাহসিন তাকে বলেছিল পর্দায় চলোফেরা করতে। রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় চোখ নিচু করে হাঁটতে। ভাই আমার সাচ্চা প্রেমিক দিলরুবা আশিক। হাত ধরে গল্প করতে ছিল। এমন সময় তাদের অর্ডারকৃত খাবার চলে এসেছে। খাবার খাওয়া শুরু করার আগে ফটোসেশান তাও শেষ করে নিল। ছোট ছোট বাটই এ চলছে তাদের খাওয়া। মাঝে মাঝে প্রেমিকের ভূমিকা টা পালন করছে। সে হিসেবে আই লাভ ইউ বলে দিল কয়েকবার। নিশা প্রতিউত্তরে কিছু না বলেই হেসে দিল। এভাবে দেখতে না দেখতেই চলে গেল ঘন্টাখানেক। আজকের মতো তাদের চলে যাওয়ার সময় হয়ে গেল। বিলটাও চলে এসেছে। বিলটা দিয়ে ওয়েটার কে একটা ১০০ টাকার নোট ধরায় দিল এত সুন্দর খাবার পরিবেশন করার জন্য। সে কিছু টা খুশি হল। না চাইতেও প্রতিদিনই এমন আলাদা বকশিশ পেয়ে যাচ্ছে । বেতন বাদেও কিছু অতিরিক্ত পাচ্ছে। শেষ প্রেম নিবেদন টুকু করে দুজন নিজেদের রাস্তা ধরল। তাহসিন বেশ খুশিই। কয়েকদিন পরের হয়তো শেষ উষ্ণ ভালোবাসা টুকু প্রকাশ করে এটাকেও ছেড়ে দিবে।

কাভি যাচ্ছে স্কুলের দিকে। তাদের এলাকার শেষ অংশে একটা মসজিদ তৈরি হচ্ছে। কিছু ভাইয়েরা তার জন্য টাকা তুলছে যাতে মসজিদের কাজ টা তাড়াতাড়ি শেষ করতে পারে। তার পকেটে ১০০ টাকা ছিল। সেখান থেকে ৭০ টাকা দিল তাদের কে। পথ মধ্যে আসতেই তাহসিন এর সাথে দেখা। আজ তাদের কয়েকজন বন্ধুর দেখা করার পালা। তাহসিনের বাড়ি কাভিদের পাশের এলাকায়। তাহসিনরা চার ভাই। বড় টা ক্যাডার, পরের টা ব্যাংকার আর তার পরেরটা নাম করা ব্যবসায়ী। তাহসিন সবার ছোট। অনেক উচ্চবিত্ত পরিবার। আর কাভিরা দুই ভাই। সে সবার বড়। তার ছোট একটা ভাই আছে। সে এবার এসএসসিতে কোনো রকম পাস করেছে। কাভি আর তাহসিন একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে । কাভির বাবা দিন আনে দিন খায়। তাও কোনো রকম চলে যাচ্ছে তাদের ছোট পরিবার। তাহসিনের গাড়িতে উঠে বসল কাভি। তাদের গন্তব্যে স্থল স্কুল মাঠ। মাঠের মাঝেখানে। আজ সাপ্তাহিক ছুটির দিন। তাই মাঠ কিছুটা খালি খালি। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই সেই আড্ডাতে মেতে উঠলো।

হঠাং করে এক বৃদ্ধ লোক তাদের মাঝে উপস্থিত হল। কাভি মানুষ টাকে চিনতে পারল। বৃদ্ধের নাম শফিক। গ্রামের শেষ মাথায় বসবাস তার। রুগ্ন জরাজীর্ণ শরীরটা। বয়সের ভাড়ে নেতিয়ে পড়েছে কিছুটা শিকড়হীন পুঁইশাকের মতো। তার একটাই ছেলে ছিল। সে মস্ত বড়ো ক্যাডার। পছন্দের মেয়ের সাথে বিয়ে করে আজ সে অন্যত্র থাকে। বিয়ের পর মা বাবার খোঁজ খবর আর রাখিনি। এমনটা দেখে কাভি বললো কি হয়েছে চাচা। "বাবা কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করো আমাকে, গত পাঁচ দিন হতে চললো ওষুধ কিনতে পারিনি। আজ ও কিনতে না পারলে কি হবে জানি না।" কাভি কিছুটা অপ্রস্তুত অবস্থায় বলে ফেললো কত টাকা লাগবে ওষুধ কিনতে ? শফিক চাচা বলে ওঠলেন ১০০ টাকা। মসজিদের জন্য দান করার পর কাভির কাছে বাকি ৩০ টাকা ছিল। ভেবেছিল বাড়িতে যাওয়ার সময় বাদাম কিনে নিয়ে যাবে। কিন্তু সাত পাঁচ না ভেবে পুরো ৩০ টাকাটাই দিয়ে দিল শফিক চাচা কে। সাথে তার বন্ধুদের ও কিছু দিতে বললো। তাহসিন ছাড়া কেউ কিছু দিতে চাইলো না। তাহসিন পকেট থেকে ম্যানিব্যাগ টা বের করে কয়েকশো নোটের ভিড়ে কোণায় পড়া থাকা ছিঁড়া ৫ টাকার নোট টা তুলে দিল তার হাতে। দিতে দিতে বললো এসব লোক ভুয়া। টাকা নিয়ে মদ গাজা খেয়ে বেড়ায়। এদের কে সাহায্য না করা ভালো। শফিক চাচা সে আর কি বলবে। একটু মৃদু হাসি দিল কষ্ট টুকু ঢাকার চেষ্টা করতে। কোনো মতে টাকা নিয়ে চলতে শুরু করলো। কাভি কিছুই বললো না আর। ছেলেটা ভাবছে শফিক চাচারে আর ৭০ টাকা দিতে পারলে ভালো হত। কিন্তু সে আর কি করবে। তার যে সে উপায় নাই। সন্ধা নামতে না নামতেই তাদের আড্ডা তাও শেষ হল। মাগরিবের আজান হচ্ছে। শীতের সন্ধা। কাভি নামায পড়ার জন্য মসজিদের পথ ধরলো বাকিরা সবাই নিজেদের বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
দিন টা ছিল শুক্রবার। খুব শীত পড়ছে গত কয়েকদিন। ফজরের নামায পড়া টা কঠিন হয়ে পড়েছে কাভির জন্য। তবে আজ সে উঠতে পেরেছে। চারদিক কুয়াশায় ঢাকা পড়ছে। সাথে মৃদু হাওয়া বইছে। সাথে ভেসে আসছে শরষে ফুলের ঘ্রাণ। নামাজ আদায় করে বসে আছে কাভি। ইমাম সাহেব সেই কখন চলে গিয়েছে। মুয়াজ্জিন সাহেব বসে আছে কখন সবাই যাবে আর সে মসজিদ টা তালা মেরে নিজের বাড়ির পথ ধরবে। কিছুক্ষণের মধ্যে সবাই আস্তে আস্তে চলে যেতে শুরু করলো। হঠাৎ কেউ একজন দৌড়াতে দৌড়াতে এসে কি যেন বলে গেল মুয়াজ্জিন সাহেবের কানে কানে। কাভি একটু আড় চোখে তাকিয়ে আবার পথচলা শুরু করল। চারদিকে কুয়াশা টা আরও ঘন হয়েছে। বাতাসটা হালকা বেড়েছে। দূর থেকে ভেসে আসছে ঘুঘু, কবুতরের ডাক। অন্য পাখিরাও কিচির মিছির করে ছুটে চলেছে খাবারের সন্ধানে।

মুয়াজ্জিন সাহেব মাইক টা চালু করলেন–
"" একটি শোক সংবাদ। একটি শোক সংবাদ। ক পুর গ্রামের আতিকের বাবা অরফে শফিক সাহেব কিছুক্ষণ আগে নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেছেন । ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।"

পঠিত : ৪০৪ বার

মন্তব্য: ০