Alapon

“অসাধারণ এক যুদ্ধজয়ের গল্প”




আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা পবিত্র কুরআনুল কারিমে মুমিনদেরকে সাহায্য আর বিজয় দান করার কথা বলেছেন। আল্লাহর সেই সাহায্যের বদৌলতে বিজয়ের অসংখ্য নজির ইতিহাসের পাতায় পাতায় লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। সেরকমই একটি বিজয় হচ্ছে সেলজুক সম্রাট সুলতান আল্প আরসালান কর্তৃক বাইজেন্টাইন সম্রাটের বিশাল বড়ো এক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিজয়।


বাইজেন্টাইন সম্রাট রোমানস ডিয়োজেনেস মুসলমান সেলজুকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ফ্রেঞ্চ, গ্রীক, রাশানসহ দুই লাখ মতান্তরে তিন লাখ সৈন্যের বিশাল এক বাহিনী নিয়ে আনাতোলিয়া তছনছ করে আর্মেনিয়ার ভন লেকের উত্তরে মুরাট নদীর তীরবর্তী মানযিকার্ট এসে হাজির হয়।


কিন্তু সেলজিক সুলতান আল্প আরসালানের হাতে তেমন বড়ো কোনো সেনাদল ছিলো না। তিনি তাদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতও ছিলো না। সেলজুক সম্রাট আল্প আরসালানের হাতে তখন মাত্র ১৫ হাজার সৈন্যের একটা বাহিনী ছিলো। তো মাত্র ১৫ হাজার সৈন্য নিয়ে কি আর এরকম একটা বিশাল পরাশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করা যায়?


সুলতান আল্প আরসালান সবদিক বিবেচনায় তাই তাদেরকে সন্ধির জন্য প্রস্তাব প্রেরণ করেন। কিন্তু বাইজেন্টাইন সম্রাট রোমানস ডিয়োজেনেস সুলতান আল্প আরসালানের প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে অহংকার প্রদর্শন করে বলে,
“আমি এমন এক বিশাল বাহিনী নিয়ে এসেছি, যার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা তোমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই স্বেচ্ছায় আমার আনুগত্য মেনে নাও।”



কিন্তু মুসলিমরা পরাজয় বরণ করার জন্য আসেনি। মুসলিমরা এসেছিই বিজয়ী বা নেতা হতে। কুফফার শক্তির শক্তির আনুগত্য করতে নয়। বাইজেন্টাইন সম্রাটের এমন হঠকারী আর অহংকারী মনোভাবের ফলশ্রুতিতে তাদের সাথে লড়াই বা সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। সুলতান আল্প আরসালান এবার তাঁর কাছে যে সেনাবাহিনী আছে, তাঁদের মধ্যে জিহাদের উদ্দীপনা তৈরি করতে লাগলেন। মুসলিম সৈন্যরাও বীরবিক্রমে সিংহ-গর্জনে লড়াই করতে প্রস্তুত। প্রস্তুত কুফুরির দম্ভকে চুরমার করে দিতে।

মরু-সিংহখ্যাত শহীদ উমর মুখতার রহিমাহুল্লাহ মুসলমানদের সংগ্রামী আর বিপ্লবী জিন্দেগি সম্পর্কে সবচেয়ে বড়ো এক অকাট্য সত্য কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন,

“আমরা হয় জিতি না হয় মরি। এর বাহিরে আমাদের আর কোনো রাস্তা নেই।”



বিশ্ব-ইসলামি রেনেসাঁর অগ্রনায়ক উস্তাদ মওদূদী রহিমাহুল্লাহ’র ভাষায়,

“দুনিয়ায় মুসলিম কখনো অপমানিত, পরাজিত ও অপরের হুকুমের তাবেদার হয়ে থাকতে পারে না। সে সবসময়েই থাকবে বিজয়ী ও নেতা হয়ে, কারণ ইসলাম তার ভেতর যে গুণাবলির জন্ম দিয়েছে তার ওপর অন্য কোনো শক্তিই বিজয়ী হতে পারে না।”



আর সেই গুণাবলিরই পরিপূর্ণ ধারণকারী ছিলেন সুলতান আল্প আরসালান। তাই তো তিনি সৈন্যসংখ্যার স্বল্পতা এবং লড়াইয়ের রসদ কম থাকার পরও একটুও ভীতচকিত হলেন না। তিনি বাইজেন্টাইন-সম্রাটের দূতকে বললেন,

“তোমার মনিবকে বলো, আমার রব আমাকে এখানে এজন্যই নিয়ে এসেছেন যেনো আমি তার প্রশংসা করতে পারি। আত পক্ষান্তরে আমার রব তোমাদেরকে এখানে নিয়ে এসেছেন যেনো তোমরা মুসলিমদের অধিঃনস্ত হও। তাদের খাবার রান্না করো।”


এমন জ্বালাময়ী উত্তপ্ত এই বাকযুদ্ধের পর যুদ্ধ ছাড়া সন্ধি-সমঝোতার কোনো পথই আর খোলা রইলো না।


সেদিন ছিলো বৃহস্পতিবার। আলিমদের পরামর্শে সুলতান আলপ আরসালান তাই সেদিন জিহাদে না গিয়ে শুক্রবার জুম'আর সালাতে শামিল হলেন। মুসলিমগণ সুলতান এবং তাঁর সৈন্যদের জন্য দু'আ করেন। এরপর শুরু হয়ে যায় উভয়পক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। এ যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় বাইজান্টাইনের বিশাল বাহিনী। মুসলমানদের হাতে আটক হয় অহংকারী বাইজান্টাইন সম্রাট। তার সৈন্যসংখ্যার অহমিকা তাকে ও তার বাহিনীকে পরাজয়ের স্বাদ আস্বাদন করা থেকে রেহাই দিতে পারেনি।


এই যুদ্ধটা যখন সংঘটিত হয়, তখন ছিলো ১০৭১ সাল। আর ইতিহাস-বিখ্যাত দিগ্বিজয়ী এই মহান ব্যক্তি এরপরের বছরেই তথা ১০৭২ সালের ডিসেম্বর মাসের আজকের এই দিনে তথা ১৫-ই ডিসেম্বর ইন্তেকাল করেন। বিদায় নেন পৃথিবী থেকে চিরকালের তরে।


আলপ আরসালান রহিমাহুল্লাহ দু'দিনের দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তিনি তাঁর কর্ম আর বীরত্ব দিয়ে ক্ষুদ্র সেই জীবনটাকে ইতিহাসের পাতায় অমর করে রেখেছেন। অমর হয়ে আছে তাঁর নেতৃত্বে হওয়া ঐতিহাসিক সেই যুদ্ধটিও। ইতিহাসে এই যুদ্ধটি মানযিকার্টের যুদ্ধ নামে পরিচিত।


এ মহান ব্যক্তি আল্প আরসালান নামে ইতিহাসে পরিচিতি পেলেও তাঁর মূল নাম মুহাম্মদ বিন দাউদ। তাঁর বীরত্ব, সামরিক দক্ষতা ইত্যাদির জন্য তিনি আল্প আরসালান উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। আল্প মানে সাহসী। বীর। আর আরসালান মানে হচ্ছে সিংহ। এক কথায় বাংলায় যাকে ‘বীরসিংহ’ বলা যায়।


তিনি তাঁর উপাধির চেয়েও ঢের বেশি সাহসী আর শৌর্য-বীর্যের অধিকারী ছিলেন। না হয় মাত্র ১৫ হাজার সৈন্য নিয়ে ২/৩ লাখের বিশাল এক পরাশক্তির বিরুদ্ধে এমনিই এমনিই লড়া যায়?


আবার দেখুন, বিজয়ী হবার পরেও তিনি বিরোধীদের প্রধান ব্যক্তিকে হাতের মুঠোয় পেয়েও মুক্ত করে দিয়েছেন। অবশ্য সন্ধির প্রস্তাবে সাড়া না দেওয়ার জন্য তিরস্কার করেছেন কিছুটা, তবে শেষ অবধি বাইজেন্টাইন সম্রাট রোমানস ডিয়োজেনেসকে মুক্তিপণ আদায়ের বিনিময়েই মুক্তি দিয়েছেন।


মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা এই মহান মুজাহিদ-শাসকের কবরকে ফিরদাউসের বাগান বানিয়ে দিন। এমন সহস্র দৃঢ়-চেতা বীর মুজাহিদ আমাদের ঘরে ঘরে মহান আল্লাহ দান করুন। আ-মী-ন!


~ রেদওয়ান রাওয়াহা

১৫/১২/২২

https://t.me/RedwanRawaha

পঠিত : ৩০০ বার

মন্তব্য: ০