Alapon

ঈশ্বর ও নৈতিকতা




নিরীশ্বরবাদীদের বিপক্ষে একটি অতি সহজ,সরল ও যৌক্তিক আর্গুমেন্ট পরিবেশন করতে যাচ্ছি। আর্গুমেন্টটা মূলত দার্শনিক ও থিওলজিয়ান উইলিয়াম লেন ক্রেইগের।এটি ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে কোনো দার্শনিক বা বৈজ্ঞানিক আর্গুমেন্ট নয়। এটি একটি ইথিক্যাল আর্গুমেন্ট। এটাকে Moral Argument বলা হয়।


আর্গুমেন্টটি হলো :



Premise 01. ঈশ্বরের অস্তিত্ব না থাকলে অবজেক্টিভ নৈতিক মূল্যবোধেরও অস্তিত্ব থাকে না।


Premise 02. অবজেক্টিভ নৈতিক মূল্যবোধের অস্তিত্ব রয়েছে।


Conclusion : সুতরাং ঈশ্বরের অস্তিত্ব রয়েছে।


আর্গুমেন্টটির প্রথম ও দ্বিতীয় premise যদি সঠিক হয়, তাহলে যৌক্তিকভাবেই conclusion টাও সঠিক হবে। আমি মনে করি, দু'টি premise ই সত্য।কেন আমি এমনটা মনে করি সেটা নিয়েই আলোচনা করব।


এখানে অবজেক্টিভ নৈতিক মূল্যবোধ বলতে বোঝানো হয়েছে, এমন কিছু নৈতিক মূল্যবোধ যেগুলো চিরন্তন সত্য।কোনো সম্প্রদায় বা গোষ্ঠী যদি এসব মূল্যবোধে বিশ্বাস না করে বা স্বীকৃতি না দেয়,তাহলেও এসব মূল্যবোধ সত্য।


উদাহরণস্বরূপ বলা যায়,উগ্র জার্মান জাতীয়তাবাদীদের কথা।তারা বিশ্বাস করত ইহুদিদের হত্যা করা উচিত। এটি ছিল তাদের নিকট একটি উত্তম কাজ। কিন্তু অবজেক্টিভ নৈতিক মূল্যবোধ অনুযায়ী এটি ভুল। যদি হিটলার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়ী হতো এবং সমকালীন সকল মানুষের মগজধোলাই করতে সক্ষম হতো,তবুও অবজেক্টিভ নৈতিক মূল্যবোধ অনুযায়ী সেটা ভুলই থাকত।


আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় যা শেখানো হয় তা হলো : অন্যের সমাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে সম্মান করা৷ আমি আমার নিজস্ব মূল্যবোধ অনুযায়ী অন্য সমাজের সমালোচনা করতে পারব না। তার সমাজব্যবস্থা তার কাছে সঠিক,আমার সমাজব্যবস্থা আমার কাছে সঠিক। এই ধারণাটিকে বলে Moral Relativism.


আপনি যদি এখন বলেন,জার্মান জাতীয়তাবাদীরা অন্যায় করেছে। তাহলে আপনি অবজেক্টিভ নৈতিক মূল্যবোধে বিশ্বাস করেন৷


সিংহভাগ নাস্তিকেরা মূলত ন্যাচারালিস্ট।ন্যাচারালিজম হলো একটি ওয়ার্ল্ড ভিউ। ন্যাচারালিজম অনুযায়ী,ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই, অস্তিত্বশীল সবকিছু স্পেস-টাইমের অভ্যন্তরে অবস্থান করে। অর্থাৎ ন্যাচারালিস্টদের মতে,সবকিছুই ন্যাচারাল বা ফিজিক্যাল। তাহলে ন্যাচারালিজমে অবজেক্টিভ নৈতিক মূল্যবোধের ভিত্তি কী? যদি ঈশ্বরের অস্তিত্ব না থাকে, তাহলে আমাদের ( মানুষের) জন্য নৈতিকতার মানদন্ড কে ঠিক করবে?এক্ষেত্রে মানুষের বা নৈতিকতার বিশেষত্ব বলতে কিছুই থাকবে না। এ দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী কেন আমরা কোনো নির্দেশনা পালনে বাধ্য থাকব? কারা আমাদের নির্দেশনা প্রদান করবে?ন্যাচারালিজম অনুযায়ী, আমরা হলাম বায়োলজিক্যাল ও সোশ্যাল ইভুলিউশনের প্রডাক্ট।যে মূল্যবোধগুলো আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে,সেগুলো হলো সোশিও-বায়োলজিক্যাল ইভুলিউশনের উপজাত (By Product) ।


এবার আমরা কিছু নিরীশ্বরবাদী দার্শনিকদের নৈতিকতা বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গী সম্পর্কে আলোচনা করব।


ব্রান্ট্রান্ড রাসেল ১৯ শতকের একজন বিখ্যাত অজ্ঞেয়বাদী - নিরীশ্বরবাদী দার্শনিক৷ নৈতিকতা সম্পর্কে তিনি বলেছেন :


". . . ethics arises from the pressure of the community on the individual. Man . . . does not always instinctively feel the desires which are useful to his herd. The herd, being anxious that the individual should act in its interests, has invented various devices for causing the individual’s interest to be in harmony with that of the herd. One of these is [government, one is law and custom, and one is] morality."[১]



রাসেলের মতে,নৈতিকতার জন্ম হয়েছে মানুষের প্রতি সামাজিক চাপের কারণে। মানুষ সর্বদা এমন সব কাজ করতে আগ্রহবোধ করে যা সাধারণত সমাজের স্বার্থের বিরোধী হয়।এজন্য সমাজের নেতারা সর্বদা চিন্তিত থাকেন। তারা চান সবাই যেন সমাজের নিয়ম মেনে চলে। এ জন্য তারা বিভিন্ন ডিভাইস আবিষ্কার করেছেন। এগুলো হলো : আইন-কানুন , নৈতিকতা, সরকার ইত্যাদি।


রাসেলের মতে, নৈতিকতা হলো একধরনের herd mentality. Herd mentality বলতে বোঝায় আবেগ কর্তৃক সম্পাদিত কাজ। যেমন : কোনো চোরকে গণধোলাই দেওয়া।তিনি মানবিক মূল্যবোধকে এরকম নীচু দৃষ্টিতেই দেখেছেন।


মাইকেল রুজ হলেন বর্তমান সময়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ [জীববিজ্ঞানের] দার্শনিক ও নিরীশ্বরবাদী। নৈতিকতা সম্পর্কে তিনি বলেছেন :


"Morality is a biological adaptation no less than are hands and feet and teeth. … Considered as a rationally justifiable set of claims about an objective something, ethics is illusory. I appreciate that when somebody says, “Love thy neighbor as thyself,” they think they are referring above and beyond themselves. … Nevertheless, … such reference is truly without foundation. Morality is just an aid to survival and reproduction, . . . and any deeper meaning is illusory. "[২]



আমরা দেখতে পাচ্ছি, তিনি নৈতিকতাকে বায়োলজিক্যাল এডাপটেশন হিসেবে অভিহিত করছেন। তার মতে,নৈতিকতার কোনো ফাউন্ডেশন বা ভিত্তি নেই।এটি আমাদের অস্তিত্ব রক্ষা ও বংশগতিধারা রক্ষা করার একটি মাধ্যম মাত্র। তিনি প্রশ্ন করেছেন, এ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সিতে কি ধর্ষণ একটি অপরাধ?

অনুজীবদের জগতে প্রায়ই ধর্ষণের মতো ঘটনা সংঘটিত হয়।কিন্তু প্রকৃতিবাদ বা ন্যাচারালিজমের দৃষ্টিতে এসব ইতিবাচক ঘটনা। কারণ,এর দ্বারা তাদের বংশবৃদ্ধি হচ্ছে।


গত শতাব্দীর একজন গুরুত্বপূর্ণ মানবতাবাদী দার্শনিক হলেন পল কার্জ। নৈতিকতা সম্পর্কে তিনি বলেছেন:



"The central question about moral and ethical principles concerns their ontological foundation. [That is to say, their foundation in reality.] If they are neither derived from God, nor anchored in some transcendent ground, are they purely ephemeral?"[৩]



তিনিও নৈতিকতা কে আপেক্ষিক বলে মনে করেন। সুতরাং নিরীশ্বরবাদীরা অন্যের কর্মকে খারাপ বলার অধিকার রাখে না। কারণ,তাদের নৈতিকতার কোনো ভিত্তি নেই।


রিচার্ড টেইলর একজন প্রমিনেন্ট ইথিসিস্ট। তিনি আমাদের একটি বিশেষ মানব সভ্যতার কথা কল্পনা করতে বলেছেন। এই সভ্যতার মানুষেরা প্রাকৃতিকভাবে জীবনযাপন করে থাকে৷ এদের সমাজে কোনো আইন বা নিয়ম-নীতি নেই। এই সমাজের একজন মানুষ অপর একজন মানুষকে হত্যা করে তার সমস্ত সম্পত্তি দখল করে নিল। সুতরাং সেই সমাজের মানুষদের দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী সে কোনো অপরাধই করেনি। ধরুন একটি সিংহ একটি জেব্রাকে হত্যা করে খেয়ে ফেলল৷ টেকনিক্যালি এটি কিন্তু হত্যা নয়। হত্যা মানব সমাজের ক্ষেত্রে একটি অপরাধ। সুতরাং প্রাকৃতিকভাবে দেখতে গেলে সিংহ খুনী নয়।একটি চিল যদি অপর চিলের খাবার চুরি করে, তাহলে এটি চুরি নয়। কারণ,চুরি করা মানুষেদের নৈতিক মূল্যবোধের দৃষ্টিতে অপরাধ।


টেইলর মূলত যা বোঝাতে চেয়েছেন তা হলো :এই বিশেষ সভ্যতার মানুষদের ক্ষেত্রেও এরকম হতে পারে। কারণ,তারা প্রাণীজগতের অন্যান্য প্রজাতিদের মতোই একটি প্রজাতি। সুতরাং, তারা যদি একে অপরকে হত্যা করে বা চুরি করে, তাহলে হত্যা বা চুরির মতো কোনো টার্ম বা অপরাধ থাকবে না।কারণ,এগুলো শুধুই আমাদের কালেক্টিভ কল্পনার জগতে অস্তিত্বশীল কিছু সামাজিক কনস্ট্রান্ট। এ দৃষ্টিতে অবজেক্টিভ মোরাল ভ্যালু বলতে কোনোকিছুর অস্তিত্ব থাকতে পারে না।


ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিরীশ্বরবাদী দার্শনিক ফ্রেডরিক নিৎস দাবি করেছিলেন,ঈশ্বরের মৃত্যুর দ্বারা নিহিলিজমের আর্বিভাব ঘটে। নিহিলিজম শব্দটি থেকে ল্যাটিন শব্দ nihil থেকে। এর অর্থ শূন্যতা। নিহিলিজম বলতে বোঝায় জীবনের উদ্দেশ্য ও নৈতিক মূল্যবোধের অনুপস্থিতি। তিনি মূলত বলতে চেয়েছিলেন,ঈশ্বর মৃত্যু হলে আমাদের জীবনে অবজেক্টিভ মিনিং-এর অস্তিত্ব থাকে না।সমসাময়িক আস্তিক ও নিরীশ্বরবাদী দার্শনিকেরা নিৎসের কথার সাথে সহমত পোষণ করেন। আমিও এক্ষেত্রে নিৎসের দাবিটিকে সত্য মনে করি৷


সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, নিরীশ্বরবাদীদের যুক্তি অনুযায়ী, অবজেক্টিভ ভাবে নিরীশ্বরবাদীরা নৈতিক হতে পারে না। নিরীশ্বরবাদীদের দ্বারা সমাজিক বিশৃঙ্খলা তৈরি হওয়ার ঝুঁকিও রয়েছে।


কিন্তু তারা ঈশ্বরের তৈরি নৈতিকতার মানদন্ড মেনেই জীবন-যাপন করে থাকে।এজন্যই তারা সমাজে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করছে৷ অথচ তারা স্রষ্টাকে অস্বীকার করে।এভাবে নিরীশ্বরবাদীদের স্ববিরোধীতা আমরা স্পষ্টভাবে প্রত্যক্ষ করতে পারছি।


কোনো নিরীশ্বরবাদী যদি আপনার ধর্মের সমালোচনা করে থাকে নৈতিকতার ভিত্তিতে। তাহলে তাকে মূর্খ বা অজ্ঞ বললে কোনো ভুল বা অপরাধ হবে না।


তথ্যসূত্র:


[১]Bertrand Russell, “Authority in Ethics”, Human Society in Ethics and Politics, Chapter 10


[২]Michael Ruse, “Evolutionary Theory and Christian Ethics,” in The Darwinian Paradigm (London: Routledge, 1989), 262,268,289.


[৩]Paul Kurtz, Forbidden Fruit (Buffalo, N.Y.: Prometheus Books, 1988), p. 65.


-লিখেছেন : খোন্দকার আবু শিহাব

পঠিত : ৩০৩ বার

মন্তব্য: ০