Alapon

"একজন জালালুদ্দিন রুমি ও আজকের মুসলমান"



১ . জালাল উদ্দিন রুমির নাম শুনেনি, সম্ভবত পৃথিবীতে এমন মানুষের সংখ্যা খুব, খুব, খুবই কম। মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি নিজে যেমন একজন দ্বীনদার পরহেজগার মানুষ, তদ্রুপ তাঁর বাবাও ছিলেন অনেক বড়ো মাপের একজন আলিমে দ্বীন। এমন পরহেজগার মানুষ হবার পরেও প্রাচ্য বলেন বা পাশ্চাত্য বলেন—সবখানেই তাঁর গ্রহণযোগ্যতা সমানতালের, আকাশ-ছোঁয়া। সর্বত্রই রুমির সরব উপস্থিতি আজো বিদ্যমান। তবে সেই উপস্থিতিটা শাররীক নয়, সেই উপস্থিতিটা তাঁর কর্মের, চিন্তা ও চেতনার।

সম্ভবত ২০০৭ সালের বিবিসির একটা রিপোর্ট-মতে স্বয়ং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিদের একজন। তাঁর লিখিত কবিতার বইপত্র আজো সর্বাধিক বিক্রি হয় সেখানে। অথচ তিনি আজ থেকে প্রায় ৮০০ বছর আগে গত হয়ে গেছেন।

তিনি আজকের আফগানিস্তানে ১২০৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরে জন্মগ্রহণ করেন। আর মৃত্যুবরণ করেন ১২৭৩ সালের আজকের এই তারিখে। তথা ১৭ ডিসেম্বরে। তিনি যখনকার সময়ে ছিলেন, তখন মুসলিম দুনিয়ায় যেনো মঙ্গোলদের আগ্রাসনে কিয়ামতের বিভীষিকা নেমে এসেছিলো। মঙ্গোলদের আগ্রাসনের কারণে তাঁরা বলখ ছেড়ে চলে যান। বলখ হচ্ছে উত্তর আফগানিস্তানের একটি প্রদেশ।

তাঁর মায়ের নাম মুইমিনা খাতুন। তাঁর পিতৃ-বংশ যেভাবে সম্মানিত ছিলো, তেমনিভাবে তাঁর মাতৃ-বংশও ছিলো অনেক বেশি সম্মানিত। কবি রুমি এবং তাঁর পরিবার ফিকহী মাজহাবের দিক থেকে হানাফি ছিলেন। তাঁর বাবাও হানাফি মাজহাবের একজন আলিম ছিলেন। ফিকহে হানাফির প্রচারের কাজ করে গেছেন সারাজীবন। সেই ধারাবাহিকতা তিনিও ধরে রেখেছেন।

তৎকালীন আনাতোলিয়ার শাসক ( আজকের তুরস্ক ) তাঁর পরিবারকে সেখানে আমন্ত্রণ জানান। তাঁর বাবা সেই আমন্ত্রণ গ্রহণও করেন। অতঃপর কবি ও তাসাউফ-সম্রাট জালালুদ্দিন রুমি সেখানেই স্থায়ী হন। মৃত্যুবরণও করেন সেখানে। আল্লাহ তাঁর কবরকে ফিরদাঊসের ফুল বাগানে পরিণত করে দিন। আ-মী-ন।

২. মুসলমানদের মধ্যে আজকের দুনিয়ায় এখন আর রুমিদের জন্ম হয় না। কেমন যেনো মুসলিম মায়েরা রুমিদের জন্ম দিতে বন্ধ্যাত্বের পরিচয় দিচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলো আজ রুহ-শুন্য হয়ে উঠছে। এখানে হুমায়ন আজাদ-সালমান রুশদির মতো মুরতাদ জন্ম নিলেও হাফিজ-রুমি-ইকবাল জন্ম নেয় না। যারা জন্ম নিচ্ছে, তাঁরাও ফান্ডামেন্টালিস্ট মুসলিম হচ্ছে না।

মাওলানা রুমি যে-সময় জন্ম নিয়েছেন, সেসময় মুসলিমদের ওপর মোঙ্গলদের কেয়ামত চলছিলো। তারা মুসলিম দুনিয়ায় চালিয়েছে সামরিক আগ্রাসন, আর আজকের দুনিয়ার কুফফাররা মুসলিমদের ওপর যতোটা না সামরিক আগ্রাসন চালাচ্ছে, তারচেয়ে বেশি চালাচ্ছে ইন্টালেকচুয়াল আগ্রাসন। যার ফলে এখানে লালনের মতো উন্মাদের জন্ম হলেও মানব-জাতির গর্ব রুমিদের উদ্ভব হচ্ছে না। এখন মুসলিম যুবকেরা প্রেম-প্রেয়সী নিয়ে ঢাউস ঢাউস ফেসবুক স্ট্যাটাস দিতে পারলেও মানব-জাতির সংকট উত্তরণের জন্যে কোনো একটা লেখা লেখতে পারেনা। সারারাত জেগে বিশ্বকাপ নিয়ে উন্মাদনা প্রকাশ করতে পারলেও যে মুসলিমরা এসেছে পৃথিবীতে নেতৃত্ব দিতে, তাদেরকে নেতৃত্ব পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে বলিয়ান হবার কাজে দুরন্ত বেগে ছুটে চলার মতো, জেগে ওঠার মতো কোনো সৃষ্টিকর্ম উপহার দিচ্ছে না বা পারছে না।

এমন কেউ আর আসছে না আজ, যিনি ঘুমের ঘোরে নিমঘ্ন থাকা ঘুমন্ত মুসলিমদেরকে বস্তুবাদ-কথিত উদারতাবাদের পরিবর্তে কালজয়ী আদর্শ ইসলামের প্রাণশক্তিকে ধারণ করে জেগে ওঠার গান শোনাবে। কেন যেনো মুসলিম-মানসকে শুদ্ধতার প্রাণ-প্রবাহে ভাসিয়ে দেওয়ার মতো কোনো কালজয়ী-ভূবনজয়ী সাহিত্য-সংস্কৃতিও সৃষ্টি হচ্ছে না। দীনে হকের পতাকাকে সারা দুনিয়ায় ওড়াবার জন্যে মুসলমানদের অন্তরাত্মাকে সামনে থেকে নেতৃত্বে দেবে, এমন বিশুদ্ধ চিন্তার একদল নর্শাদুলেরও আগমন ঘটছে না এই দুনিয়ার বুকে। যারা আছে বা তৈরি হচ্ছে, তাঁরাও এক চিমটি ইসলাম, আধা চিমটি লিবারেলিজম, পৌনে এক চিমটি সেকুলারিজমকে সাথে নিয়েই এক জগাখিচুড়ি মার্কা মুসলিম হিসেবে তৈরি হচ্ছে। তৈরি করছে অন্যদেরকেও।

আমরা আজকে ইসলামের পরিচয়, মুসলিম সংস্কৃতি, দীনের বিধি-বিধান নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগি। কাফেরদেরদের করুণা পেতে যাচ্ছেতাইভাবে দীনকে কাটছাঁট করি। ভাবি—এটাই হয়তো জাতে ওঠার সিঁড়ি। কিন্তু, রুমি স্বাভাবিকভাবে দীন নিয়ে আত্মগ্লানী কিংবা হীনমন্যতায় ভুগতেন না। আজ পর্যন্ত তাঁর ইসলামি পরিচয় নিয়ে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য—কোথাও কোনো ধোঁয়াশা নেই। তাঁর কাজ তাঁকে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য করেছেন, করেছেন স্মরণীয়-বরণীয় । কিন্তু, আজ আমরা কী করছি? আমরা নিজের পরিচয় আড়াল করতে চাইলেও, উদার হতে চাইলেও শেষতক কুফফার শক্তির কাছে কখনোই আল্টিমেট গ্রহণযোগ্যতা পাই না। রুমি আমাদের জন্য বড়োসড়ো একটা উদাহরণ হতে পারেন যে, কাজ যদি নিখুঁত হয়, মৌলিক হয়, তাহলে নিজের আদর্শ নিয়ে হীনমন্যতার জায়গা থাকে না। বিশ্বের কাছে সার্বিকভাবে ইসলামের পরিচয়, মুসলিম আইডেন্টেটি নিয়েও নিজের জায়গা করে নেওয়া যায়।

এই যে রুমির মসনবীর কথায়ই ধরুন, এটাকে কপি করে কতো কতো কর্ম পরে সৃষ্টি হয়েছে, যার কোনো ইয়াত্তা নেই। স্বয়ং রবি-ঠাকুরের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আছে যে, তিনি রুমির মসনবীকেই অনুসরণ করে গীতাঞ্জলি লিখেছেন। অথচ আজ আমরা এভাবে এমন কোনো সৃষ্টি করতে পারি না, যে সৃষ্টিকে অন্যরা অনুকরণ করবে। আমরা করি কী? আমরা করি অন্যদের শব্দে শব্দে লাইনে লাইনে নকল।

আল্লাহ-রাব্বুল আলামিন আমাদের বিজয়ী জাতি মুসলিমদের মধ্য থেকে হাজারো রুমি তৈরি করে দিন। যারা এভাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধর্ম-বর্ণ, জাত-পাত নির্বিশেষে মানুষের মাঝে অমর হয়ে থাকবে। থাকবে শুদ্ধ চিন্তার প্রভাবক হয়ে। যাদের কাছে থাকবে পৃথিবীর প্রতিটি বনী-আদম ঋণী হয়ে। আল্লাহ আমাদেরকে কবুল করুন।


~রেদওয়ান রাওয়াহা
১৭/১২/২২

পঠিত : ৪০৭ বার

মন্তব্য: ০