Alapon

প্রাচ্য-পাশ্চাত্য তত্ত্বের দ্বন্দ্ব এবং কাতার বিশ্বকাপ

লোকপ্রশাসন বিভাগের একজন শিক্ষার্থী হয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অংশ হিসেবে বিশ্বের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অনেক বিষয় সম্পর্কে অধ্যয়ন করতে হয়। তারই অংশ হিসেবে “ওরিয়েন্টাল এন্ড অক্সিডেন্টাল থোটস” মানে “প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য চিন্তা” নামে একটি টপিক পড়তে হয়েছিলো। সেখানে যা পড়েছিলাম সোজা কথায় তাহলো, প্রাচ্য চিন্তা মানে 'এনসিয়েন্ট' ভাবাপন্ন চিন্তা ভাবনা, যেখানে পারিবারিক বন্ধন, নৈতিকতা, ধর্ম এসব বিষয়গুলো। আর পাশ্চাত্য চিন্তা মানে, প্রগতি, উন্নয়ন, জ্ঞান-বিজ্ঞান, আধুনিকায়ন ইত্যাদি।

আসলে এই যে ওরিয়েন্টাল এবং অক্সিডেন্টাল বা প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য চিন্তাভাবনা দৃষ্টিভঙ্গি তা পুরোটাই পশ্চিমাদের দৃষ্টিভঙ্গি। তারা কিভাবে নিজেদের দেখে এবং কিভাবে প্রাচ্যের লোকদের চিন্তাভাবনা এবং জীবনধারণ পদ্ধতিকে দেখে তার থিওরিটিক্যাল বা তত্ত্বগত দিকই হচ্ছে ওরিয়েন্টালিজম ও অক্সিডেন্টালিজম। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সীমানাটা কেমন? প্রাচ্য অর্থ পূর্বদিকস্থ আর পাশ্চাত্য বা প্রতীচ্য অর্থ পশ্চিমস্থ। ইউরোপের পূর্বস্থ দেশসমূহকে প্রাচ্য বলে। যেমন- মধ্যপ্রাচ্যের ১৮টি দেশ ( ইরাক, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, তুর্কি ইত্যাদি)। দূরপ্রাচ্য ৬টি দেশ ( উ. কোরিয়া, দ. কোরিয়া, জাপান, চীন, তাইওয়ান, মঙ্গোলিয়) । ইউরোপ, আমেরিকা হলো পাশ্চাত্য বা পশ্চিমা।
এখন আসি বর্তমানে চলমান “দ্যা গ্রেটেস্ট শো অন দ্যা আর্থ” এর কাতার সংস্করণের সাথে আজকের আলোচনার সম্পর্ক এবং উদ্দেশ্যটা কি? ফুটবল বিশ্বকাপ-২০২২ নিয়ে অনেক আগে থেকেই জল্পনা-কলনার শেষ নেই। মুসলিম দেশ হিসেবে কাতার অনেক রেস্ট্রিকশনের মধ্য দিয়ে আয়োজন করেছে এবারের বিশ্বকাপ। অনেক সমালোচনা হয়েছে এবং হচ্ছে। কারণ, কাতার বিশ্বকাপে মদ্যপান, অবাধ যৌনতা, সমকামীতা, স্বেচ্ছাচারিতামূলক চলাফেরাসহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে কাতার কর্তৃপক্ষ। একই সাথে ফিলিস্তিনের উপর ইসরায়েলের আগ্রাসনের প্রতিবাদ হিসেবে ইসরাইলের পাসপোর্টে কাতার ভ্রমনে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। পশ্চিমা মিডিয়া থেকে শুরু করে খেলোয়াড়েরা পর্যন্ত এসব বিষয় নিয়ে সরব। আলোচনা-সমলোচনা চলছেই। জার্মান দল তো মাঠেই প্রতিবাদী ফটোসেশান করলো। আবার অন্যদিকে ফ্রান্সের গোলকিপার হুগো লরিস মন্তব্য করেছেন, “ফ্রান্সে আমরা বিদেশিদের স্বাগত জানাই তখন আমাদের দেশের রীতিনীতি ও সংস্কৃতিকে সম্মানের কথা বলি। আমাদেরও একই কাজ করা উচিত যখন আমরা কাতারে যাব। আমি তাঁদের নীতির সঙ্গে সহমত বা বিপক্ষে সেটা অন্য আলোচনা। কিন্তু আমাদের সম্মান জানানো উচিত।” মুসলিম বিশ্বের দেশ হিসেবে কাতার মুসলিম রীতিনীতি এবং মুসলিম সংস্কৃতিকে প্রমোট করবে এটাই স্বাভাবিক। অনেকে মনে করেন, এটা যারা মানতে চায় না তারা সংকীর্ণ মানসিকতার অধিকারী ছাড়া আর কিছুই নন।

এখন আসি আলোচনার শুরুতে যেই প্রশ্নটা উথাপন করেছিলাম তার মিমাংসা করি। “গরিবের ঘরে সুন্দরী বউ মানায় না”। যেহেতু পশ্চিমারা মনে করে, পূর্বের লোকজন তাদের থেকে নিচে এবং পূর্ব শুধু তাদের শাসনের জন্যই, সেহেতু কাতার এতো জাঁকজমকপূর্ণ একটি বিশ্বকাপের আয়োজন করে ফেলবে তা মানা যায় না। তার উপর যারা তাদের গোলামী করবে তাদের রেস্ট্রিকশন আমরা কেনো মানবো? যাদেরকে বছরের পর বছর কখনো শরনার্থী হিসেবে বিশ্ব দরবারে করুণার পাত্র কখনোবা টেরর আখ্যা দিয়ে ঘৃণার পাত্র হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে তাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সাহস কি করে হয়? যেমন বলেছিলাম, এই ওরিয়েন্টাল ও অক্সিডেন্টাল তত্ত্বের ভিত্তিতে তারা মনে করে পূর্বের লোকজন চিন্তা-চেতনায় “ক্ষ্যাত” প্রকৃতির এবং সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য এগুলোর কোনো মূল্য নেই। তাদের সমাজে নৈতিকতার ভিত্তি নেই। অথচ তাদের ভিত্তিহীন নৈতিকতার মানদন্ড তারা সারা দুনিয়ে ছড়িয়ে দিতে তারা তৎপর। যার উদাহরণ, সমকামিতা একটি মানবাধিকার। ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া সহ পুরো মধ্যপ্রাচ্যের বুকে পশ্চিমাদের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ আগ্রাসনে লক্ষ লক্ষ নারী, শিশু এবং আপামর জনতার লাশে কবর রচিত হয়, অগনিত মানুষ বিকলাঙ্গ ও ঘরহীন যাযাবর হয়ে যায় তখন মানবতা এবং মানবাধিকার বৈমাত্রিয় সুলভ আচরণ করে। আবার যারা এই আগ্রাসন থেকে মুক্তির পথ বেছে নেয় তারা সারা দুনিয়ায় টেরোরিস্ট নামে পরিচিত।

পশ্চিমা স্বার্থেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের উপর আরোপিত ষাট লক্ষ হিহুদি হত্যার বিচার দাবি করা হয়েছিলো যাতে ফিলিস্তিনের বুকে ঘৃণ্য বেলফোর আদেশের বাস্তবায়ন করা যায়। হিটলার খলনায়ক হয়েছিলো ঠিকই কিন্তু একই যুদ্ধে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক তান্ডব চালিয়ে অসংখ্য বেসামরিক নাগরিক হত্যার জন্য আমেরিকাকে জবাবদিহি করতে হয়নি। “বিচার মানেই তালগাছটা আমার” এটাই ওরিয়েন্টাল ও অক্সিডেন্টালের মূল কথা। উন্নয়নের লোভ দেখিয়ে ইকোনমিক ডিপেন্ডন্সি বা অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা তৈরি করে তৃতীয় বিশ্বের দেশ তথা প্রাচ্য ও এশিয়ার দেশগুলোকে শোষণ করতে কত থিওরি আর ফর্মুলা যে পশ্চিমের আছে তার হিসেব নেই। পুঁজিবাদ বলেন আর সমাজতন্ত্র বলেন সবই পশ্চিমা উদ্ভাবন। তাদের প্রগতির নীল নকশায় ক্ষতবিক্ষত পূর্বের নিজস্বতা এবং নৈতিকতা বোধ। লুটপাট হচ্ছে এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে শুরু করে মেধা, শ্রম সবকিছু। ধর্ম উন্নয়ন ও প্রগতির জন্য অন্তরায়। তাই তারা ধর্মনিরপেক্ষতার বুলি আওড়িয়ে প্রাচ্যের ক্ষমতায় একটি অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ রাখার চেষ্টা করে। মজার ব্যাপার হচ্ছ, ইউরোপীয় মিশনারী ধর্মপ্রচারকদের মাধ্যমেই সারা দুনিয়াতে পশ্চিমারা উপনিবেশবাদের রাস্তা তৈরি করেছিলো। বিশেষ করে আফ্রিকায়। যেখান থেকে স্বর্ন লুটের ধারা এখনো অব্যাহত। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর পাহারায় লুট করে পশ্চিমা বিশ্ব।

ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে বিশ্ব দেখেছে মানবতা কি জিনিস। কিন্তু গত আট দশক ধরে ইসরায়েল ফিলিস্তিনের উপর যে আগ্রাসন চালিয়ে আসছে সেখানে বিশ্ব মানবতা অন্ধ। অনেক কথা হয়েছে। মূল কথা হলো, কাতার যে তার দেশের সম্পদের সঠিক ব্যাবহার করে আজকে বিশ্বে একটি ব্র‍্যান্ড কান্ট্রিতে পরিণত হচ্ছে, তাদের কে টেক্কা দিয়ে বিশ্বকাপের মতো একটি আয়োজন করছে এবং একটি ভাবমূর্তি তৈরি করছে এইটা আসলে পশ্চিমা গুরুদের চোখে লেগেছে। তার উপর মুসলিম দেশ। যাদের কে তালেবান, আইএস ইত্যাদি নামে পুরো বিশ্বে পরিচয় করানো হলো তাদের এতো ভালো ভাবমূর্তি সহ্য হবে কেনো? সারা দুনিয়ায় কোথাও গনতন্ত্র, কোথাও প্রগতি, কোথাও মানবাধিকার ইত্যাদির সংকট তৈরি সেই দেশের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে, এই বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে কাতার পশ্চিমাদের প্রাচ্য চুলকানির শিকার হবে নাতো?

পঠিত : ২৩০ বার

মন্তব্য: ০