Alapon

নিয়তের বিশুদ্ধতা ও মানুষের মূল্যায়ন



খুব নিষ্ঠা আর আন্তরিকতার সাথে, ভীষণ বিনয় আর ভালোবাসার সাথে, খুব আবেগ আর উদ্দীপনার সাথে অনেকগুলো কাজ করি। যেগুলোতে দুনিয়াবী কোন চাওয়া পাওয়া থাকে না। যেগুলো খুব নির্জনে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই একেবারে নিবেদিত প্রাণ হয়ে করতে হয়।

যেগুলোতে আমার দিনরাত একাকার করা পরিশ্রমের অজস্র প্রাণ বিদ্যমান থাকে। যেগুলোতে আমার মেধার সর্বোচ্চ বিনিয়োগ থাকে। যেগুলোতে আমার সুপ্ত-স্বপ্নের অজস্র ডালপালা থাকে, তবুও সেগুলো নিয়ে আমি দুনিয়াবী কোনো বিনিময় তো পাই-ই না, বরং অনেক সময় কতো কতো কাছের মানুষজনও আমার সেই পরিশ্রমের পাতাগুলো স্বাভাবিক চোখে দেখেন না বিধায় অনেক কটুকথা বলেন, অনেক অবমূল্যায়ন করেন। কেউ কেউ এককাঠি সরেস হয়ে অপবাদ দিতেও কুন্ঠিত হয় না।

এমন নিরবিচ্ছিন্ন নিরিবিলি একনিষ্ঠ কাজের পেছনের কারিগর এই মানুষটিকেই কেউ কেউ কখনো কখনো এমন কিছু কথা বলেন, এমন কিছু আচরণ করেন—যে কথাগুলোর আঘাতে বুকটা ঝাঁঝরা হয়ে যায়, যে আচরণগুলোর ভার বহন করাটা অনেক দুঃসাধ্য আর দুঃসহ হয়ে দাঁড়ায়। আর তখনই মন চায় সকল কাজবাজ রেখে, আড়ালের তৎপরতাগুলো রেখে আত্মমগ্ন একব্যক্তি হয়ে যাই। নিজেকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত এক অন্যরকম মানুষ হয়ে যাই, যেভাবে অন্যরাও হয়। ইচ্ছে করে— এমন কিছু কাজ করি, এমন পথে হাটি, যেখানে স্বীকৃতির আনন্দ আছে, প্রদর্শনের প্রলয়-তুফান আছে।

কিন্তু, হুট করেই তখন আমার ভেতর অন্য আরেক আমি হাজির হয়ে যায়, আমার ভেতর অন্য-এক আমি জেগে উঠে। আর সে যেনো পিঠ চাপড়িয়ে, মাথায় মমতার হাত বুলিয়ে আমাকে বলে যায়— আরেহ তোমার কাজটা যদি রহমানুর রহীম আল্লাহর জন্যই হয়; তাহলে তো সেই অসীমের মূল্যায়ন আর কবুলিয়াতকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত। তোমার-আমার প্রত্যেকটি কাজে, প্রতিটি পদক্ষেপেই তো কেবল মহামহিম আল্লাহর সন্তোষকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিৎ। পৃথিবীর কে কী করলো, কে কী ভাবলো—সেটা তো তোমার-আমার ভ্রুক্ষেপের বিষয় নয়। দেখার বিষয় নয়।

আল্লাহর রাসুল সল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো আমাকে-তোমাকে এটাই বলেছেন যে; নিয়ত খাঁটি করতে। ত্রুটিহীন করতে।
اَخْْلِصْ دِيْنَكَ يَكْفِيْكَ الْعَمَلُ الْقَلِيْلُ তোমার ঈমানকে খাঁটি করো। অল্প আমলই তোমার নাজাতের জন্য যথেষ্ট হইবে। [মুস্তাদরাকে হাকেম : ৪/৩০৬]


পবিত্র কুরআনুল মাজিদেও রব্বুল আলামিন আমার নিয়তকে, অন্তরকে, সংকল্পকে ত্রুটিহীন, বিশুদ্ধ আর খাঁটি করার নির্দেশ দিয়েছেন। আমার আল্লাহ রব্বুল আলামিনও তাঁর কালামে পাকে বলেন,
مَنْ كَانَ يُرِيْدُ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَزِينَتَهَا نُوَفِّ إِلَيْهِمْ أَعْمَالَهُمْ فِيهَا وَهُمْ فِيهَا لاَ يُبْخَسُونَ- أُولَئِكَ الَّذِينَ لَيْسَ لَهُمْ فِي الْآخِرَةِ إِلاَّ النَّارُ وَحَبِطَ مَا صَنَعُوا فِيهَا وَبَاطِلٌ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
‘যে ব্যক্তি পার্থিব জীবন ও তার জাঁকজমক কামনা করে, আমরা তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের ফল দুনিয়াতেই পূর্ণভাবে দিয়ে দেবো। সেখানে তাদেরকে কোনোই কমতি করা হবে না।’এরা হলো সেইসব লোক যাদের জন্য পরকালে জাহান্নাম ছাড়া কিছুই নেই। দুনিয়াতে তারা যা কিছু (সৎকর্ম) করেছিল আখেরাতে তা সবটাই বরবাদ হবে এবং যা কিছু উপার্জন করেছিল সবটুকুই বিনষ্ট হবে (বাতিল আকিদা ও লোক দেখানো সৎকর্মের কারণে)’ [সূরা হূদ : ১৫-১৬]।


অন্যত্র তিনি বলেছেন,
مَنْ كَانَ يُرِيدُ الْعَاجِلَةَ عَجَّلْنَا لَهُ فِيْهَا مَا نَشَاءُ لِمَنْ نُرِيْدُ ثُمَّ جَعَلْنَا لَهُ جَهَنَّمَ يَصْلاَهَا مَذْمُوْمًا مَدْحُوْرًا- ‘যে ব্যক্তি দুনিয়া কামনা করে, আমরা সেখানে যাকে যা ইচ্ছা করি দিয়ে দেই। পরে তার জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত করি। সেখানে সে প্রবেশ করবে নিন্দিত ও লাঞ্ছিত অবস্থায়’ (সূরা ইসরা- ১৭/১৮)।


তিনি আরও বলেন,
مَنْ كَانَ يُرِيْدُ حَرْثَ الْآخِرَةِ نَزِدْ لَهُ فِيْ حَرْثِهِ وَمَنْ كَانَ يُرِيْدُ حَرْثَ الدُّنْيَا نُؤْتِهِ مِنْهَا وَمَا لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِنْ نَصِيْبٍ- ‘যে ব্যক্তি আখেরাতের ফসল কামনা করে, আমরা তার ফসল বৃদ্ধি করে দেই। আর যে ব্যক্তি দুনিয়ার ফসল কামনা করে, আমরা তাকে সেখান থেকে কিছু দেই। কিন্তু আখেরাতে তার জন্য কোনই অংশ থাকবে না’ (সুরা শু'রা-৪২/২০)।


কুরআনুল কারিমে আরো ইরশাদ হয়েছে, فَاعْبُدِ اللَّهَ مُخْلِصًا لَهُ الدِّينَ
‘অতএব আল্লাহর ‘ইবাদাত করো দ্বীনকে (অর্থাৎ আনুগত্য, হুকুম পালন, দাসত্ব ও গোলামীকে) একমাত্র তাঁরই জন্য নির্দিষ্ট করে। । [সূরা যুমার : ২]

সূরা বায়্যিনাহতে ইরশাদ হয়েছে,
وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ
‘তাদের শুধু এ নির্দেশই দেয়া হয়েছে যে, তারা যেন একনিষ্ঠভাবে খাঁটি নিয়তে আল্লাহরই ইবাদত করে। [সূরা বায়্যিনাহ : ৫]



ইমাম ইবনুল মুবারক (রহঃ) বলেন, رُبَّ عَمَ
لٍ صَغِيْرٍ تُعَظِّمُهُ النِّيَّةُ، وَرُبَّ عَمَلٍ كَبِيْرٍ تُصَغِّرُهُ النِّيَّةُ ‘নিয়ত গুণে অনেক ছোট আমলও বড় আমলে পরিণত হয়; আবার অনেক বড় আমলও ছোট আমলে পরিণত হয়।’[ জামেউল উলূম ওয়াল হিকাম ১/১৩।]



এখন, নিয়তের বিশুদ্ধতা যদি আমি আনতে না পারি, তা হলে আমার অজস্র কাজ, অগণিত শ্রম, এতো এতো লেখালেখি,এতো এতো কলমবাজি, আমার উঁচুমানের শরীরে শিহরণ জাগানো ও লোমকূপ দাঁড় করানো বক্তৃতায়, আমার ক্যারিশমাটিক নেতৃত্বে, আমার সুগঠিত অনিন্দ্য ব্যক্তিত্বে শতো-সহস্র মানুষ উপকৃত হলেও আমি হবো না। আমি তো এক রবের দাস, আমার তো চাওয়া হবে কেবলই রবের সন্তোষ। পরকালের নাজাত। তাই না? তা হলে কোন যুক্তিতে মানুষের অবহেলায়, মানুষের অমর্যদায়, মানুষের কটুকথায় আর তুচ্ছতাচ্ছিল্যে, কিংবা গালিগালাজে আমার অন্তরে হাহুতাশের অনল দাউদাউ করে জ্বলে উঠবে? মানুষ হিসেবে সাময়িক সময়ের জন্য উঠলেও কেন সেটাকে হৃদয়ে বদ্ধমূল করে রেখে দেবো? কী কারণে আমার ইখলাস আর তাকওয়ার পারদটা ধুপ করে নিভিয়ে দেবো?

যদি নাজাত পেতে চাই, যদি মুক্তি পেতে চাই, যদি রবের কাঠগড়ায় আসামী হিসেবে দাঁড়াতে না চাই ; তা হলে আমাকেই তো আগে এই হাদিসটির আমল করতে হবে —আখলিস দ্বীনাকা ইকফি কাল আ'মালুল ক্বলীল—তোমার দ্বীনকে খাঁটি করো। অন্তরকে পরিশুদ্ধ করো। তা হলে অনেক কিছু করতে হবে না। অনেক ঘাম ঢালতে হবে না। অনেক শ্রমও দিতে হবে না। অনেক কথাও বলতে হবে না। অনেক লেখাও লিখতে হবে না। অনেক বেশি পড়তেও হবে না। অল্পতেই নাজাত পেয়ে যাবো। মুক্তি পেয়ে যাবো। পেয়ে যাবো জান্নাতুল ফেরদৌস। আর সকাল বিকেল হাটবো সেই ফিরদৌসের আঙ্গিনায়। হ্যাঁ, অল্পতেই !

এখন আমি যদি নিজেকে রব্বুল আলামিনের বান্দা মনে করি, তা হলেআমাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমি কোনটা চাই— মানুষের স্বীকৃতি আর বাহবা? নাকি অসীমের ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমাকে পরকালে নাজাত এনে দেবে, এনে দেবে মুক্তি?


#আত্মযাছাই
#নিজেকে_নাসীহা
~রেদওয়ান রাওয়াহা
https://t.me/RedwanRawaha
[i]

পঠিত : ৩৩৯ বার

মন্তব্য: ০