Alapon

সূরা ইখলাসে আহাদের ধারণা এবং কিছু কথা...



আসুন এখন সূরা ইখলাসে ফিরে যাই। قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ --- । قُلْ শব্দটি রাসূল (সঃ) এর প্রতি একটি ইঙ্গিত যে, তাঁর উচিৎ এটা পাঠ করা। তাঁর এটা বলা উচিৎ। কিন্তু এটা এই ধারণাও দেয় যে, তাঁর এটা ঘোষণা করা উচিৎ। কারণ তাঁকে এটা অন্যদেরকে বলার আদেশ করা হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন যে, মানুষ তাঁর কাছে এসে বলতো, ইতিমধ্যে আমাদের অনেক ঈশ্বর রয়েছে। আমরাও আল্লাহর কথা আগে শুনেছি। আমরাও আল্লাহকে বিশ্বাস করি।

মুশরিকরা আসলে খোলাখুলিভাবেই দাবী করেছে যে, وَلَئِن سَأَلْتَهُم مَّنْ خَلَقَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضَ لَيَقُولُنَّ ٱللَّهُ (ওয়ালাইন সাআলতাহুম মান খলাক্বাস সামাওয়াতি ওয়াল আরদা লাইয়াক্বুলুন্নাল্লাহ) , অর্থাৎ যদি আপনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন কে আকাশ এবং পৃথিবী সৃষ্টি করেছে ? তারা বলবে, নিশ্চিতভাবেই আল্লাহ। কুরআন এটা নিশ্চিত করেছে। তো তারা বললো, আমাদেরকে তোমার ইলাহের নিসবা দাও। তুমি কি আল্লাহর বর্ণনা দিতে পারবে। (উপহাস করে বলত) তাঁর পারিবারিক ইতিহাস কি ? আমাদেরকে তাঁর বর্ণনা দাও। আর এর জবাবে নাযিল হলো এই সূরাটি।

তো, قُلْ শব্দটি আসার একটি কারণ হলো তাঁদের এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া। এটা قُلْ শব্দটির অন্তর্নিহিত অর্থগুলোর একটি। কুরআনের বৃহত্তর বিজ্ঞতার দৃষ্টিকোণ থেকেও قُلْ শব্দটি ইঙ্গিত দেয় যে, আল্লাহর প্রতি ইমান হলো এমন বিষয় যা এতোই গভীর, এতোই অন্তর্নিহিত এবং এতোই অন্তরঙ্গ যে, এই সূরাটি এটাকে এমনভাবে তুলে ধরছে যে, আপনাকে আল্লাহ সম্পর্কে বলতেই হবে। আপনাকে এটা মানুষের কাছে বলতে হবে। কারণ, এটা আপনার নবী (সঃ) এর সুন্নাহ এবং তাঁকে নির্দেশ করা হয়েছিলো এটা বলার জন্য। আর আপনি যেহেতু তাঁর অনুসারী, তাই আপনাকেও নির্দেশ করা হচ্ছে মানুষকে এটা বলার জন্য। এই সূরার বাণীটি আত্মস্থ করুন এবং মানুষের সাথে শেয়ার করুন। আর তাই এটা শুরু হয়েছে قُلْ দিয়ে।

তো, قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ । এটা قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ থেকে আলাদা। কারণ قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ - কে আপনার সব মানুষের সাথে শেয়ার করা উচিৎ না, এটা আপনাকে বলেই দিয়েছে কার সাথে শেয়ার করতে হবে। اَلْكَافِرُونَ । তো আপনি আপনার প্রতিবেশীর কাছে যাবেন না, আর বলবেন না যে, কুরআন এই সূরাটির শুরুতে قُلْ বলেছে, তাই আমি আপনাকে বলতে চাই, يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ لَا أَعْبُدُ مَا تَعْبُدُونَ । কিন্তু এই সূরাটিতে নির্দিষ্ট করে বলা নেই। কাকে আপনি বলবেন ? আল্লাহ বলেননি, قُلْ يَا أَيُّهَا النَّاسْ (ক্বুল ইয়া আইয়ুহান নাস), يَا قُرَيْش يَا قَوْمِيْ (ইয়া কুরাইশ, ইয়া ক্বওমী)। শুরুতে কোনো مُنَادَى (মুনাদা) নেই। শুধু قُلْ , শুধু এটা বলো। জানেন এর অর্থ কি ? এতে কিছু আসে যায় না আপনি কোথায় আছেন, কে আপনার সামনে আছে, কি সুযোগ রয়েছে আপনার, হয়তো কেউ শুনছে, হয়তো কেউ শুনছেই না। শুধু বলুন। আপনি শুধু বলুন। হয়তো কেউ শুনছে না, ফেরেশতারা শুনছেন। যেই সাহাবী ইখলাস পাঠ করছিলেন, কেউ তা শুনছিলো না, তিনি জানতেন না যে রাসূল (সঃ) শুনছিলেন। তিনি পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন থামলেন এবং বললেন, তাঁর জন্য জান্নাত নিশ্চিত। তিনি স্বাভাবিকতার বাইরে গিয়ে রাসূল (সঃ) কে শুনাননি। তিনি শুধু পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন যখন তিনি শুনতে পেয়েছিলেন। যা আমরা শিখছি তা হলো, সূরা পাঠ করার এবং এর বাণী প্রচার করার উপকারীতা এবং শক্তিমত্তা অসামান্য। আর এর মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর রাসূলকে সেই ক্ষমতা প্রদান করেছেন শুধুমাত্র قُلْ শব্দটির দ্বারা।

এখন, قُلْ শব্দটির পর প্রথম শব্দ হলো هُوَ । قُلْ هُوَ اللَّهُ - তিনি হলেন আল্লাহ। এক মুহূর্তের জন্য কল্পনা করুন যে هُوَ শব্দটি এখানে নেই। তাহলে হবে قُلِ اللَّهُ أَحَدٌ । قُلْ - اللَّهُ أَحَدٌ । বলো, আল্লাহ হলেন এক। এখনো এটা বোধগম্য।
কিন্তু আয়াতটি বলছে, বলো, তিনি হলেন আল্লাহ; এক। তিনি হলেন আল্লাহ। আর তারপর- এক। আলাদাভাবে। “তিনি” শব্দটিই কেনো এখানে ? “তিনি” একটি সর্বনাম। যেকোনো ভাষায়, তিনি, সে, তুমি - এগুলো সর্বনাম। “তিনি” এমন সর্বনাম, “তিনি” এবং “এটি” - এই জাতীয় সর্বনামগুলো ব্যবহৃত হয়, যখন আপনি আগেই কারো সম্পর্কে বলেছেন। ঠিক আছে ? আপনি “তিনি” দিয়ে ঘটনা শুরু করেন না। আপনি বলেন, একদা এক লোক ক্ষুধার্ত ছিলো। আপনি বলেন না, একদা সে ক্ষুধার্ত ছিলো। আপনাকে প্রথমে বলতে হবে, এক লোক ক্ষুধার্ত ছিলো। এর পরের বাক্যে আপনি বলবেন, তিনি চলে গেলেন খাবার গ্রহণের জন্য। কারণ যখন আপনি বলেন, তিনি চলে গেলেন খাবার গ্রহণের জন্য, তখন ইতিমধ্যে আপনার শ্রোতাদের মাথায় কি রয়েছে ? লোকটি সেখানে ছিলো। তো, اَلضَّمِيْرُ يَعُوْدُ إِلَى الْمَذْكُوْر (আদ-দমিরু ইয়াউদু ইলাল মাযকুর), সর্বনাম নির্দেশ করে এমন কাউকে যার কথা ইতিমধ্যেই উল্লেখ করা হয়েছে। যার কথা আগেই বলা হয়েছে।

কিন্তু সূরাটির শুরুতে আল্লাহর নাম উল্লেখ হয়নি। هُوَ শব্দটির আগে কারো কথা উল্লেখ করা হয়নি। এটা শুরু হয়েছে هُوَ দিয়ে। এটা একটা সমস্যা তৈরী করেছে। কারণ সর্বনামের উচিৎ কোনো নামকে নির্দেশ করা। সূরাটিতে 'হুয়া' ব্যবহারের সৌন্দর্য হলো, এটা এমন কিছুর প্রতি নির্দেশ করছে যা ইতিমধ্যেই আপনার মনে, আপনার হৃদয়ে রয়েছে। আরবীতে একে বলা হয় ضَمِيْرُ الشَّأْن (দমিরুশ শা’আন)। এটা আল্লাহর নিজস্ব ভঙ্গি একথা বলার জন্য যে, তিনি কে, এটা ইতিমধ্যেই আপনার মধ্যে রয়েছে। আর তিনি এমন কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছেন যা ইতিমধ্যেই আপনার হৃদয় এবং অন্তরের গভীরে প্রোথিত রয়েছে। তিনি আপনার আত্মা এবং মনের ভিতরে কোনো কিছুর প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করছেন যখন তিনি বলছেন هُوَ । قُلْ هُوَ । আর আপনি তাঁকে জানেন। আপনি তাঁকে জানেন। এটা খুবই খুবই শক্তিশালী। قُلْ هُوَ اللَّهْ
এখন, তিনি - হলেন আল্লাহ। তিনি হলেন আল্লাহ। যখন তিনি এটা বললেন, তিনি আল্লাহর বর্ণনা দেননি। তিনি সামনে অগ্রসর হননি। প্রকৃতপক্ষে, এটা নিজেই একটা বাক্য - বলো, তিনি হলেন আল্লাহ। বলো, তিনি হলেন আল্লাহ। এটা জবাব দিচ্ছে যা কুরাইশরা বলেছিলো তাদের উপাস্যদেরকে নিয়ে। সেগুলো আল্লাহর কন্যা, ফেরেশতারা আল্লাহর কন্যা আর তাদের মূর্তিও ছিলো। আর তারাও আল্লাহ শব্দটি ব্যবহার করতো। প্রসঙ্গক্রমে, আরবী বাইবেলে, রাসূল (সঃ) এর সময় থেকে, এমনকি তারও আগে সৃষ্টিকর্তার জন্য আল্লাহ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। তো এটা এমন কিছু না যা শুধুমাত্র মুসলিমরা ব্যাবহার করতো, খ্রিস্টানরাও আল্লাহ শব্দটি ব্যবহার করতো।

নাজরান এলাকায় আরব খ্রীস্টানরা থাকতো, তারা সৃষ্টিকর্তার জন্য আল্লাহ শব্দটি ব্যবহার করতো। মুশরিকরা সৃষ্টিকর্তার জন্য আল্লাহ শব্দটি ব্যবহার করতো। কিন্তু এখন তিনি বলছেন, না, আসলে তিনি হলেন আল্লাহ। অন্য কথায়, তোমরা কাউকে আল্লাহ বলতে পারো, তোমাদের কাছে সঠিক চিত্রটি নেই যে, তিনি আসলে কে। তোমরা তাঁকে ভুলভাবে নিরূপণ করেছো। তোমরা তাঁকে ভুলভাবে চিহ্নিত করেছো। তিনিই আসলে আল্লাহ। অর্থাৎ, যার কথা আমি বলতে যাচ্ছি, তিনিই আল্লাহ।

আর তাঁর সম্পর্কে প্রথম যে জিনিসটি আপনার জানা প্রয়োজন, তা হলো, أَحَدْ । قُلْ هُوَ اللَّهُ - أَحَدٌ । এটা বুঝিয়ে বলা কঠিন, আমি বুঝানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। আরবীতে আপনি যখন এক বলতে চান, আপনি বলেন - وَاحِدْ (ওয়াহিদ)। আপনি বলেন وَاحِدْ , আপনি أَحَدْ বলেন না। আপনি বলেন وَاحِدْ । আর আহাদ শব্দটি সাধারণত আরবীতে নেতিবাচক বাক্য ছাড়া ব্যবহৃত হয় না। যেমন, مَا جَاءَ أَحَدْ (মা জাআ আহাদ), مَا رَأَيْتُ مِنْ أَحَدْ (মা রআইতু মিন আহাদ) । আরবীতে أَحَدْ শব্দটির প্রধান ব্যবহার হলো, যখন কোনো বাক্য নেতিবাচক হয়। ঠিক আছে ? যেমন, কেউ আসেনি - لَيْسَ أَحَدْ فِي الْمَسْجِدْ (লাইসা আহাদ ফিল মাসজিদ)। لَيْسَ أَحَدْ । আপনি বলেন না - لَيْسَ وَاحِدْ فِي الْمَسْجِدْ , আপনি বলেন - لَيْسَ أَحَدْ فِي الْمَسْجِدْ । কেনো এরকম ? যখন আমরা বলি, لَيْسَ أَحَدْ فِي الْمَسْجِدْ , এটা সবসময় নেতিবাচক বাক্যে থাকে, এর অর্থ হলো, কেউই মাসজিদে নেই। অথবা আরো খুলে বলতে গেলে, একটা মানুষও মসজিদে নেই। যদি আমি এর পরিবর্তে لَيْسَ وَاحِدْ বসাই, لَيْسَ وَاحِدُُ فِي الْمَسْجِدْ (লাইসা ওয়াহিদুন ফিল মাসজিদ), যদি আমি এটা বলি, জানেন এর অর্থ কি ? একজন মানুষ মসজিদে নেই, কিন্তু হয়তো চারজন রয়েছে। তো যখন তারা নেতিবাচক বাক্য বলে এবং বলতে চায় “কেউই না”, তখন তারা ব্যবহার করে - أَحَدْ
স্পষ্টভাবেই সূরাতে বাক্যটি নেতিবাচক নয়, এটা হ্যাঁ-সূচক। বাক্যটি নেতিবাচক নয়। বরং শেষ শব্দটি নেতিবাচক - لَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ । আর সেখানে أَحَدْ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য।

শেষ আয়াতটিতে أَحَدْ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য। ঠিক আছে ? لَمْ يَكُنْ أَحَدٌ كُفُوًا لَهُ । এটা এরকম। কিন্তু হ্যাঁ-সূচক বাক্যে আল্লাহর নিজের জন্য أَحَدْ শব্দটি ব্যবহৃত হওয়ার মতো অনুরূপ দৃষ্টান্ত আরবী ভাষার আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। أَحَدْ ব্যবহৃত হতে পারে সংখ্যার ক্ষেত্রে, যেমন, أَحَدَ عَشَرَ (আহাদা আশারা)। أَحَدَ عَشَرَ كَوْكَبََا عَلَى سَبِيْلِ الْمِثَال (আহাদা আশারা কাওকাবান আলা সাবিলিল মিসাল)। أَحَدْ শব্দটি হতে পারে কোনো কিছুর জন্য مُضَافْ (মুদাফ) - أَحَدُكُمْ । যদি এটা হ্যাঁ-সূচক হয়, তখন এটা অন্য শব্দের সাথে জুড়ে থাকবে। এটা অন্য শব্দের সাথে إِضَافَةْ (ইদফা) হতে পারে, এটা অন্য শব্দের مُرَكَّبْ (মুরাক্কাব) হতে পারে, অথবা উদাহরণস্বরূপ, أَوْ جَاءَ أَحَدٌ مِنْكُمْ , মিনকুম হলো আহাদের সিফাত। ঠিক আছে ? এখানে أَحَدٌ مِنْكُمْ এর, مِنْكُمْ হলো فِيْ مَحَلِّ رَفْعِِ (ফি মাহাল্লি রফ’ইন)। আমি আজকে একটু বেশি ব্যাকরণ ব্যবহার করছি। কিন্তু এতে সমস্যা নেই। এর প্রয়োজন রয়েছে। আহাদ শব্দটি একা কখনোই হ্যাঁ-সূচক বাক্যে আসেনি; শুধুমাত্র قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ ছাড়া। তিনি এমনকি যেভাবে তাঁর অদ্বিতীয়তা বর্ণনা করেছেন সে বর্ণনাতেও তিনি অদ্বিতীয়। তিনি এমন একজন যিনি আর কারো মতো নন, এমনকি যেভাবে তিনি ব্যবহার করেছেন “একজন” শব্দটি যা অন্য কারোর মতো না।

আপনারা জানেন, আরবীতে এর নিকটতম শব্দটি হলো, وَحْد (ওয়াহদ)। একটি হলো وَاحِدْ (ওয়াহিদ), আমি আপনাদেরকে বলেছিলাম وَاحِدْ (ওয়াহিদ), কিন্তু আরবীতে আরেকটি শব্দ রয়েছে - الْوَحْد (আল-ওয়াহদ), وَحْد (ওয়াহদ), হা-এর উপর সুকুন সহ - وَحْد (ওয়াহদ)। وَمِنَ الرِّجَالْ اَلْوَحْد الَّذِيْ لَا يُعْرَفُ نِسْبُهُ وَلَا أَصْلُهُ (ওয়া মিনাররিজাল আল-ওয়াহদ আল্লাযি লা ইউরাফু নিসবুহু ওয়ালা আসলুহু)। অর্থাৎ, আরবরা বলে, وَحْد (ওয়াহদ) ব্যবহৃত হয় এমন ব্যক্তির জন্য যার সম্পর্কে আপনি জানেন না যে সে কোথা থেকে এসেছে, কোন পরিবার থেকে, কোন গোত্র থেকে। সে নিজেই এখানে রয়েছে। আমি বলতে পারছি না, সে কোন দেশের, কোন জাতীর, কোন পরিবারের; কে এটা ? এটা হলো وَحْد (ওয়াহদ)।

আপনারা জানেন, জিবরীল (আঃ) এসেছিলেন রাসূল (সঃ) এর সাথে দেখা করতে সাদা পোষাক পরে। সাহাবীরা তাঁর বর্ণনা দিতে পারতেন কি বলে ? وَحْد (ওয়াহদ)। কিন্তু আল্লাহ وَحْد (ওয়াহদ) শব্দটি ব্যবহার করেননি কারণ এটি ইতিমধ্যেই মানবজাতীর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। এটা ব্যবহৃত হয়েছে মানুষের বর্ণনা দেয়ার জন্য। ইবনে মনযুরের লিসানুল আরব অভিধানে এসেছে, لَا يُقَالُ رَجُلُُ أَحَدْ وَلَا دِرْهَمْ أَحَدْ كَمَا يُقَالُ رَجُلْ وَحْد (লা ইউক্বলু রজুলুন আহাদ ওয়ালা দিরহাম আহাদ কামা ইউক্বলু রজুল ওয়াহদ), অর্থাৎ, আপনি কখনো আরবীতে বলেন না, এক ব্যক্তি - رَجُلُُ أَحَدْ , আপনি এটা বলতে পারবেন না, অথবা, এক দিরহাম, دِرْهَمْ أَحَدْ , আপনাকে বলতে হবে - رَجُلْ وَحْد , دِرْهَمْ وَحْد (রজুল ওয়াহদ, দিরহাম ওয়াহদ) । এই وَحْد (ওয়াহদ) ব্যবহৃত হয়েছে আল্লাহ ছাড়া অন্যদের জন্য।

নেতিবাচক বাক্য ছাড়া আরবদের দ্বারা أَحَدْ শব্দটি কখনোই ব্যবহৃত হয়নি, তাই আল্লাহ এটা ব্যবহার করলেন। সুবহানাল্লাহ! এটাই قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ । শুধুমাত্র এই উক্তিটির মাধ্যমে আল্লাহ বলছেন, এটা এমন অদ্বিতীয়তা যা তোমরা অন্য কোনো অদ্বিতীয়তার সাথে তুলণাও করতে পারবে না। এমনকি তাঁর অনন্যতাও অনন্য। তাঁর তাওহীদও অনন্য।

আপনি তাওহীদ শব্দটি অন্য জিনিসের জন্যও ব্যবহার করতে পারেন। যখন অনেকগুলো জনিস একসাথে নিয়ে একটাতে পরিণত করা হয়, وَحَّدْتَهَا (ওয়্যাহহাদতাহা), অর্থাৎ, আপনি তাদেরকে একটিতে পরিণত করলেন। যখন আমার বাচ্চারা অনেকগুলো লেগো নিয়ে একটি ভবন তৈরী করে, وَحَّدْتَهَا (ওয়্যাহহাদতাহা), আপনি সেগুলো নিলেন এবং একটায় পরিণত করলেন। এটা হলো লেগোগুলোর তাওহীদ। কিন্তু আহাদ; কি অবিশ্বাস্য শব্দ !

সূরা ইখলাসের প্রথম আয়াত- قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ "বল, তিনিই আল্লাহ, এক-অদ্বিতীয়।" শুধুমাত্র এই উক্তিটির মাধ্যমে আল্লাহ বলছেন, এটা এমন অদ্বিতীয়তা যা তোমরা অন্য কোনো অদ্বিতীয়তার সাথে তুলনা করতে পারবে না। এমনকি তাঁর অনন্যতাও অনন্য। তাঁর তাওহীদও অনন্য।

আল্লাহ সম্পর্কে অন্য যত চিন্তা আপনার আছে, এটা মনোযোগ দিয়ে শুনুন, আল্লাহ সম্পর্কে অন্য যত চিন্তা আপনার আছে, আল্লাহ সম্পর্কে অন্য যতো কিছু আপনি শিখবেন, আপনাকে প্রথমে অনুধাবন করতে হবে যে, সেই সকল জিনিস থাকবে এই একটি শব্দের ছায়াতলে। আর তা হলো - أَحَدْ (অদ্বিতীয়)
সকল উপলব্ধি 'আহাদুন' শব্দটির ছায়াতলে থাকবে।

কেনো আমি এটা বললাম ? খেয়াল করুন, আমি শুনি। আমি দেখি। আমি سَمِيْع (সামি), অর্থাৎ আমি শুনি। আমি بَصِيْر (বাসির), যার অর্থ কি ? আমি দেখি। আমার কিছু জ্ঞান আছে, আমি عَلِيْم (আলীম) ও। কিন্তু سَمِيْع (সামি), بَصِيْر (বাসির), عَلِيْم (আলীম) এগুলো কি আল্লাহরও নাম ? হ্যাঁ, এগুলো আল্লাহর নাম।

আল্লাহর একটি নাম হলো رَحِيْم (রহীম), তাই না ? আল্লাহর আরেকটি নাম হলো رَؤُوْف (রউফ)। এই দুটি নাম ব্যবহৃত হয়েছে রাসূল (সঃ) এর জন্যও। আর আল্লাহ তাঁর ব্যাপারে বলেছেন, بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ (বিল মু’মিনিনা র’উফুর রহীম)। রাসূল (সঃ) এর বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ বলেছেন যে, তিনি হলেন ইমানদারদের প্রতি رَؤُوْف (রউফ) এবং رَحِيْم (রহীম)। مَا غَرَّكَ بِرَبِّكَ الْكَرِيمِ (মা গররাকা বি রব্বিকাল কারীম)। وَجَاءَهُمْ رَسُولٌ كَرِيمٌ (ওয়া জাআকুম রাসূলুন কারীম)।

'কারীম' আল্লাহর জন্য, 'কারীম' মূসা (আঃ) এর জন্য। রহীম আল্লাহর জন্য, রহীম নবিজীর জন্য, রউফ আল্লাহর জন্য, রউফ নবিজীর জন্য। কিভাবে আমরা এটা বুঝবো ? কোন শব্দটির ছায়াতলে আল্লাহর অন্য নামগুলো চলে আসে ? أَحَدْ
যখন তিনি শুনেন, তাঁর শ্রবণ অন্য কারো শ্রবণের মতো না। যখন তিনি দেখেন, তাঁর দৃষ্টি অন্য কোনো দৃষ্টির মতো না। এটা কখনোই তুলণা করা সম্ভব না। এটা অনন্য।

যখন তিনি রাগান্বিত হন, আপনি তাঁর ক্রোধকে অন্য কারো সাথে তুলণা করতে পারবেন না। এর অর্থ শুধু এটা না যে তিনি সকলের চেয়ে বেশী ক্রোধান্বিত। আমার বাবা রাগান্বিত হন কিছু বিষয়ে, আমি রাগান্বিত হই কিছু বিষয়ে, আমার বাচ্চারা রাগান্বিত হয় কিছু বিষয়ে, আপনার বস রাগান্বিত হন কিছু বিষয়ে। মানুষ কোনো কোনো বিষয়ে রাগান্বিত হয়ে উঠে। কখনোই মানুষের রাগকে আল্লাহর রাগের সাথে মিলিয়ে ফেলবেন না।

যখন আমি আমার মা-বাবাকে রাগান্বিত করি, যখন আমি আমার সন্তানকে রাগান্বিত করি, যখন আমি আমার ভাইকে রাগান্বিত করি, যখন আমি আমার বন্ধুকে রাগান্বিত করি, আর তারা আমার সাথে আর কথা বলতে চায় না, তারপর যখন আমি আল্লাহর রাগান্বিত হওয়ার মতো কাজ করি, আমি মনে করি যে আল্লাহও একইভাবে বিবেচনা করেন। আমি আল্লাহকে রাগান্বিত করেছি, তিনি আমার আশা ছেড়ে দিয়েছেন। অন্যরা যেমন আমার আশা ছেড়ে দিয়েছে, আল্লাহও আমার আশা ছেড়ে দিয়েছেন। আপনি একটি শব্দ সম্পর্কে বেখেয়াল হয়ে যাচ্ছেন - أَحَدْ আপনি হয়তো অন্য সবাইকে রাগান্বিত করেছেন, তারা হয়তো আপনাকে ছেড়ে যেতে পারে। আপনি আল্লাহকে রাগান্বিত করেন, আল্লাহ কি আপনাকে ছেড়ে যান ? না। না। তিনি অপেক্ষা করছেন। আল্লাহ অপেক্ষা করেন - আপনার জন্য যেনো তাঁর কাছে ফিরে আসেন।

আপনি হয়তো আল্লাহ থেকে হাজার মাইল দূরে। আর আপনি আল্লাহর দিকে এক কদম অগ্রসর হলেন। এটাকে অন্য কারো সাথে তুলণা করুন। আপনি আপনার সহোদর বোনের কাছ থেকে এক হাজার কদম দূরে সরে গেলেন। একটা ঝগড়া হলো, এরপর ১০ বছর কথা বলা বন্ধ। আপনারা একে অপরকে ঘৃণা করেন। সে আপনার নাম্বার ব্লক করে রেখেছে। আর এখন আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন একটি ছোটো কদম উঠানোর তাঁর উদ্দেশ্যে। আপনি কি আশা করেন যে সে আপনার কাছে দৌড়ে ছুটে আসবে ? না। “এতদিন পর এসেছো ? আর তুমি ‘সরি’ও বলনি ? এটা কি ? হাহ। তুমি কি মনে করেছো আমি সবকিছু ভুলে গেছি ? ভুলে যাবো তুমি কি বলেছো, তুমি যা করেছো ?” মানুষ কি এমনটাই করে না ? এমনকি তারাও যারা আপনাকে ভালোবাসে ? তারা ভুলে যায় না, তারা ছেড়ে দেয় না, তারা এগুলো মনে ধরে রাখে। সম্পর্ক আবার আগের মতো হয়ে যায় না। এটাই কি ঘটে না ?

যদিও আপনি মিমাংসা করে ফেলেন, পরের ঝগড়ায়, “আমার কখনোই তোমাকে ক্ষমা করা উচিৎ হয়নি। তুমি আগের মতোই আছো।” এরকমই কি ঘটে না মানবজাতির মধ্যে ? এখন, আমরা আল্লাহর সাথে অন্যায় করে ফেলি। আর আমাদের উপর মানুষের আশাভঙ্গ হওয়াতে আমরা এতোই অভ্যস্ত, মানুষের রাগের সাথে, মানুষের হতাশার সাথে আমরা এতোই অভ্যস্ত যে, আমরা মনে করি আল্লাহর রাগও একইভাবে কাজ করে। “আল্লাহ আমার উপর আশা হারিয়ে ফেলেছেন। কিভাবে এখন আমি তাঁর সাথে কথা বলবো। এখন আর কি করার আছে।” যখন আপনি উপলব্ধি করেন যে, আল্লাহ হলেন أَحَدْ , (অদ্বিতীয়) তখন তাঁর সাথে আপনার সম্পর্কটি পরিশোধিত হয়ে যাবে অন্য সম্পর্কগুলো নিয়ে তৈরী মনোভাবের তুলণায়।

ক্ষমাশীলতা, ক্রোধ, করুণা, ভালোবাসা, তত্ত্বাবধান, ন্যায়পরায়নতা সবগুলো নিয়ে ধারণা পরিবর্তিত হয়ে যাবে, কারণ আপনি আল্লাহকে বিশ্বাস করছেন أَحَدْ হিসেবে।

এটা বলতে আমি ক্লান্তি বোধ করি না যে, এই বাণীটি, আল্লাহর দীনের এই বাণীটি হলো আশার বানী। এটা আসলে আশাবাদী হওয়ার বাণী। যখন মানুষ মনে করে যে আল্লাহ তাকে অভিশাপ দিয়েছেন, আল্লাহ তাকে শাস্তি দিচ্ছেন। সে কঠিন সময় পার করছে, আল্লাহ তাকে শাস্তি দিচ্ছেন। আল্লাহ তাকে অভিশাপ দিয়েছেন, আল্লাহ তাকে ভুলে গিয়েছেন। আল্লাহ তার প্রতি রাগান্বিত, সেজন্যই সে এই দুরবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। “কেনো আল্লাহ আমাকে এই অবস্থায় রেখেছেন ? কেনো এমনটা ঘটছে আমার সাথে ? কেনো আমি ? কেনো আমি ? কেনো আমি ?”

আমি আপনাকে দুইটি বিষয় বলবো। এক, প্রথমত, যখন আপনি বলছেন যে, কেনো আল্লাহ আপনার সাথে এমনটা ঘটতে দিচ্ছেন, হতে পারে যেই সকল যন্ত্রনার মধ্যে দিয়ে আপনি যাচ্ছেন, তা হয়তো কম মূল্যবান হতে পারে একটি জিনিসের তুলণায় - আপনার আল্লাহর কাছে ফিরে আসার তুলনায়। শুধু আপনার আল্লাহর কাছে ফিরে আসা।

আল্লাহ জানেন যে, যদি তাঁর কাছে ফিরে না আসেন আরো অনেক কঠিন যন্ত্রণা আপনার জন্য অপেক্ষা করছে, আর তাই তিনি শুধু আপনার ফিরে আসার অপেক্ষায় আছেন। শুধু এটুকুই। এটা তাঁর ভালোর জন্য না, এটা আপনার জন্য ভালোর জন্য। এটা আপনার জন্য অন্য সবকিছুর চেয়ে মূল্যবান। إِلَّا مَنْ أَتَى اللَّهَ بِقَلْبٍ سَلِيمٍ (সে ব্যক্তি সফল যে আল্লাহর কাছে প্রশান্ত অন্তর নিয়ে হাজির হবে) আর আপনি তাঁকে সেই সুযোগ দিচ্ছেন না। কারণ আপনি তাঁর সম্পর্কে সেরকম ধারণাই করছেন যেমন ধারণা অন্যদের ব্যাপারে করেন।

অন্য সবাই হয়তো আপনার কাছে কিছুর জন্য দায়বদ্ধ হতে পারে। যখন কাউকে ধন্যবাদ দেন...যদিও ধন্যবাদের অর্থ হওয়া উচিৎ এরকম যে, আমি আপনার কাছে ঋণি। কিন্তু আপনি অসন্তুষ্ট হয়ে যান, “আপনাকে স্বাগতম" (you are welcome ) বললেন না যে !
কেউ বললো, “ধন্যবাদ।” আর আপনি বললেন, “আমি জানি, আমি এ ধন্যবাদ প্রাপ্য ।” এখানে প্রত্যাশা রয়েছে; তাই না ? ধরুন কাউকে সাহায্য করলেন। কমপক্ষে তার কাছে কি বলার আশা করেন ? ধন্যবাদ। আপনি কিছু প্রত্যাশা করছেন। মূলত, আমাদের জীবনের সকল সম্পর্কের ক্ষেত্রেই কিছু প্রত্যাশা থাকে।

আপনার কাছে এবং আমার কাছে আল্লাহর কোনো দায়বদ্ধতা নেই। তিনি আমাদের কাছে কোনো কিছুর জন্য দায়বদ্ধ নন। আপনি এবং আমি এটা বলার অবস্থানে নেই যে, কেনো আপনি আমার সাথে এমনটা করলেন ? আমাকে কেনো জন্ম দেয়া হলো ? কেনো তিনি আমাকে জীবন দান করলেন ? তিনি আপনাকে এই ব্যাখ্যা দেয়ার জন্যও দায়বদ্ধ নন। তিনি أَحَدْ তাঁর সম্পর্কে এরকম ধারণা করবেন না যে, তিনি আপনার কাছে কোনোভাবে দায়বদ্ধ। তিনি যাই দিয়েছেন, সবই উপহার। সবকিছু। قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ

- নোমান আলী খান
- সূরা ইখলাসের আলোচনা থেকে

পঠিত : ৩৫৩ বার

মন্তব্য: ০