Alapon

মহান আল্লাহর পথে জিহাদ এবং কিছু কথা...



জিহাদ আরবী ধাতুমল ‘জুহদুন’ থেকে নির্গত। অর্থ- চেষ্টা করা, আত্মত্যাগ করা, সাধনা করা, সংগ্রাম করা ইত্যাদি।

পরিভাষায় জিহাদ হলো- অস্ত্র, ধনসম্পদ, আমল, ইলম, কলম ও কথা ইত্যাদির মাধ্যমে আল্লাহর কালিমাকে সফলতার সুউচ্চ শিখরে প্রতিষ্ঠিত করা এবং কাফির ও কুফরের প্রভাব ও প্রতিপত্তিকে উৎখাত করার নিমিত্তে সর্বশক্তি ব্যয় করা। [১]

আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য তার হিদায়াতের পথে চলতে গিয়ে পাহাড়সম বাধা অতিক্রম করার জন্য নিজেকে অবিচল রাখা এবং ইসলামের প্রকৃত রূপ অন্যের নিকট উপস্থাপনের মাধ্যমে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা করাই জিহাদের মূল মর্মকথা।
গুরুত্ব ও ফজীলত :

আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনুল কারিমে ইরশাদ করেন,
‘তোমরা আল্লাহর পথে জিহাদ করো, যেভাবে জিহাদ করা উচিত।’ [২]

‘আর তাদের সাথে যুদ্ধ করো যতক্ষণ না ফিতনা (কুফর-শির্ক) নিঃশেষ হয়ে যায় এবং আল্লাহর দ্বীন সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর জন্যেই হয়ে যায়।’ [৩]

‘যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হল তাদেরকে, যাদের সাথে কাফেররা যুদ্ধ করে; কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে। আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করতে অবশ্যই সক্ষম।’ [৪]

‘আর লড়াই কর আল্লাহর রাস্তায় তাদের সাথে যারা লড়াই করে তোমাদের সাথে। অবশ্য কারো প্রতি বাড়াবাড়ি করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না।’ [৫]

‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের কি হল, যখন আল্লাহর পথে বের হওয়ার জন্যে তোমাদের বলা হয়, তখন তোমরা মাটি জড়িয়ে ধরো, তোমরা কি আখিরাতের পরিবর্তে দুনিয়ার জীবনে পরিতুষ্ট হয়ে গেলে? অথচ আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবনের উপকরণ অতি অল্প।’ [৬]

‘মুমিনদের মধ্যে যারা কোনো সঙ্গত কারণ না থাকা সত্ত্বেও জিহাদে অংশ নেয় না এবং যারা জান-মাল দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করে তারা সমান নয় ৷ আল্লাহ তায়ালা, যারা জিহাদে অংশ নেয়নি তাদের তুলনায় জিহাদকারীদের মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছেন, যদিও আল্লাহ প্রত্যেককেই পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ৷ মহা পুরস্কারের ক্ষেত্রে আল্লাহ মুজাহিদদেরকে যারা জিহাদে অংশ নেয়নি, তাদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন । এসব তার পক্ষ থেকে পদমর্যাদা, ক্ষমা ও দয়া ৷ আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াময়৷’ [৭]

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, ‘জিহাদ সব সময়ের জন্য ফরজ, এটি তখন থেকেই যখন আল্লাহ আমাকে পৃথিবীতে আমাকে প্রেরণ করেছেন, তা চলবে কিয়ামত পর্যন্ত। জালিম শাসকের জুলুম যেমন জিহাদের ফরজিয়াত বাতিল করতে পারে না, তেমনি ন্যায় বিচারকারী শাসকের ন্যায় পরায়ণতাও জিহাদ থেকে নিষ্কৃতি দিতে পারে না।’ [৮]

‘একবার এক ব্যাক্তি রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে এসে বললো, ‘আমাকে এমন আমলের কথা জানান, যা জিহাদের বরাবর।’তিনি বললেন : ‘আমি তা পাচ্ছি না’। তারপর বললেন : ‘তুমি ঘরে বসে মুজাহিদের সমান ফজিলত পেতে চাও!’

‘তোমার পক্ষে কি এটা সম্ভব যে, মুজাহিদ যখন জিহাদের ‍উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হবে, তখন তুমি মসজিদে প্রবেশ করে নামায পড়তে থাকবে, আর তাতে ক্লান্ত হবে না এবং অনবরত রোযা রাখতে থাকবে, আর তা ভাঙবে না’?
সে বললো: ‘সেটা কার পক্ষে সম্ভব?’ [৯]
‘দ্বীনের মস্তক হল ইসলাম, তার স্তম্ভ হল নামায এবং তার চুড়া হল জিহাদ।’ [১০]
‘আল্লাহ-ভীতিকে তোমার উপরে অত্যাবশ্যক করে নাও। কারণ, এটা সকল কল্যানের সমষ্টি। আর আল্লাহর পথে জিহাদকে তোমার উপরে অপরিহার্য করে নাও। কারণ, এটা মুসলমানদের রাহাবানিয়্যাত।’ [১১]

‘যে ব্যাক্তি -উটের দুধ দোহনের সময়টুকু পরিমান হলেও আল্লাহ’র পথে ক্বিতাল করে, তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যায়। আর যে ব্যাক্তি সত্যি সত্যিই আন্তরিক ভাবে আল্লাহ’র কাছে জিহাদের ময়দানে দুশমনের হাতে নিহত হওয়ার কামনা করে, অতঃপর তার আগেই মারা যায় কিংবা নিহত হয়, তার জন্য একজন শহিদের পুরষ্কার রয়েছে। যে ব্যাক্তি আল্লাহ’র পথে ক্ষতিগ্রস্থ/আঘাতপ্রাপ্ত হয় কিংবা কোনো মুসিবতের সম্মুখীন হয়, নিশ্চই কিয়ামতের দিন ওসব ক্ষত/আঘাত বা মুসিবত এমন ভাবে হাজির হবে যে, তা দুনিয়াতে যেমন ছিল ওখানে তার চাইতে আরো অধিক পরিমানের মতো হবে। ওসব ক্ষত/আঘাতের স্থানে-এর রং হবে ফারান রং এর মত এবং ওগুলোর গন্ধ হবে মিশকের সুবাসের মত। আর যে ব্যাক্তি শরীরের খোশপাঁচড়া নিয়েই আল্লাহ’র পথে বের হয়, নিশ্চই তার উপরে শহিদের মোহর মেরে দেয়া হয়”। [১২]

‘শহীদের জন্য আল্লাহ তায়ালার নিকট ছয়টি পুরস্কার আছে। তাঁর প্রথম রক্তবিন্দু পড়ার সাথে সাথে তাকে ক্ষমা করা হয়, তাকে তার জান্নাতের বাসস্থান দেখানো হয়, কবরের আযাব হতে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়, সে কঠিন ভীতি হতে নিরাপদ থাকবে, তার মাথায় মর্মর পাথর খচিত মর্যাদার টুপি পরিয়ে দেওয়া হবে। এর এক একটি পাথর দুনিয়া ও তার মধ্যকার সবকিছু হতে উত্তম। তার সাথে টানা টানা আয়তলোচনা বাহাত্তর জন জান্নাতী হূরকে বিয়ে দেওয়া হবে এবং তার সত্তরজন নিকটাত্মীয়ের জন্য তার সুপারিশ কবুল করা হবে।’ [১৩]

আনাস ইবনু মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা বলেন: ‘আমার পথে জিহাদকারীর জন্য আমি নিজেই যামিন। আমি তার জীবনটা নিয়ে নিলে তবে তাকে জান্নাতের উত্তরাধিকারী বানিয়ে দেই। আমি তাকে (যুদ্ধক্ষেত্র হতে) ফিরিয়ে আনলে তবে তাকে সওয়াব বা গানীমত-সহ ফিরিয়ে আনি।’ [১৪]

শাহাদাতের গল্প : [১৫]
আবু কুদামা (রহ.) আমাদের সালাফদের মধ্য হতে একজন বীর মুজাহিদ ছিলেন। জিহাদের ময়দানে তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত হয়েছে। বিশেষ করে রোমদের বিরুদ্ধে তিনি অনেক যুদ্ধ করেছেন।
আবু কুদামা (রহ.) একবার মসজিদে নববীতে বসে তাঁর বন্ধুদের সাথে গল্প করছিলেন। তখন তাঁর বন্ধুরা বলল, তুমিতো সারাটা জীবন জিহাদের ময়দানে কাটিয়ে দিয়েছ, জীবনে অনেক জিহাদ করেছ, আজকে তুমি আমাদের জিহাদের ময়দানের এমন একটি ঘটনা শুনাও যে ঘটনাটা তোমাকে সবচেয়ে বেশি আশ্চার্যান্বিত করেছে।
আবু কুদামা (রহ.) বললেন, আচ্ছা শুনোঃ
আমরা একবার রোমানদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার জন্য ফুরাত নদীর তীরে অবস্থিত দীনা নামক শহরের উপর দিয়ে দিয়ে যাচ্ছিলাম। পথিমধ্যে আমি একটি উট কিনার জন্য এক জায়গায় যাত্রা বিরতি করলাম।

আমাদের অবস্থানের খবর শুনে একজন মহিলা আসলো। সে আমার সাথে দেখা করল এবং বলল, আমার স্বামী জিহাদের ময়দানে শহীদ হয়েছেন, আমার কয়েকজন ছেলে জিহাদের ময়দানে শহীদ হয়েছে, আমার কয়েকজন ভাই ছিল তারাও জিহাদের ময়দানে শহীদ হয়ে গেছেন।

এখন শুধুমাত্র আমার একটি ছেলে আছে আর একটি মেয়ে আছে। আমার ছেলেটির বয়স ১৫ বছর। সে হাফেজে কোরআন। হাদীসের ব্যাপারে ভাল জ্ঞান রাখে। দক্ষ অশ্বারোহী, দেখতেও খুব সুশ্রী। আমার খুব ইচ্ছা ছেলেটিকে জিহাদে পাঠাবো। কিন্তু সে একাটি কাজে শহরের বাইরে গেছে। এখনো ফিরে আসেনি। অপেক্ষায় আছি সে আসলে আপনার সাথে জিহাদে পাঠিয়ে দিতাম।

এখন আপনাকে দেয়ার মত আমার ঘরে কিছুই নেই। আপসোস এত মহান একটি জিহাদ হচ্ছে আর আমি এটা থেকে বঞ্চিত থাকবো এটাতো কিছুতেই হতে পারে না। তখন তিনি ধুলোয় মাখা কয়েকটি মাথার চুল দিয়ে বললেন, এই চুল গুলোকে ঘোড়ার লাগাম হিসেবে ব্যবহার করবেন যাতে এই বরকতময় জিহাদে অংশগ্রহণ করা থেকে আমি কিছুতেই বঞ্চিত না হই।

আবু কুদামা (রহ.) বললেন, আমি চুল গুলো নিলাম এবং তার ছেলেকে দেখার জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। কিন্তু তার আসতে দেরি হচ্ছে দেখে আমরা গন্তব্যের দিকে রওয়ানা হয়ে গেলাম।

অনেক পথ অতিক্রম করার পর দেখতে পেলাম পিছন দিক থেকে একজন অশ্বারোহী ধুলো উড়িয়ে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে আসছে। কাছে আসার পর সেই অশ্বারোহী যুবক আমাকে চাচা বলে ডাক দিল এবং পরিচয় দিয়ে বলল, আমি ঐ মহিলার সন্তান যিনি আপনাকে জিহাদের জন্য চুল দান করেছেন। আমি আপনার সাথে জিহাদে অংশগ্রহণ করতে চলে এসেছি।

আবু কুদামা (রহ.) বলেন, আমি লক্ষ করলাম যে ছেলেটি একেবারেই ছোট। ১৪-১৫ বছর বয়স হবে মাত্র। আর জিহাদতো তার উপর আবশ্যকও নয়। তাই আমি তাকে লক্ষ করে বললাম বাবা, তুমি বাড়িতে ফিরে যাও। তোমার মায়েরতো কেউ নেই। তুমি বাড়িতে গিয়ে তোমার মায়ের পাশে থাকো। মায়ের খেদমত কর। মায়ের দেখাশুনা কর।তুমি আপাতত ফিরে যাও, পরে বড় হয়ে জিহাদে অংশগ্রহণ করো।

ছেলেটি বলল চাচা, আমার মা আমাকে শেষ বিদায় দিয়েছেন। তিনি আমাকে আপনার সাথে জিহাদে যেতে বলেছেন আর আমি ভাল ঘোড় সওয়ার ও দক্ষ তীরন্দাজ। আপনি আমাকে সাহসী যোদ্ধা হিসাবে পাবেন। কখনো যুদ্ধ থেকে পৃষ্ঠ প্রদর্শনকারী হিসাবে পাবেন না। আপনি আমাকে সাথে নিয়ে নেন।

অনেক কাকুতি মিনতি করার পর আমি তাকে সাথে নিয়ে নিলাম।
আমরা কিছু পথ অতিক্রম করে এক জায়গায় তাবু গাড়লাম ও যাত্রা বিরতি দিলাম। মুজাহিদিনরা সবাই রোজা রেখেছিলেন তাই সফর করে সবাই ক্লান্ত পরিশ্রান্ত। বিকাল বেলা রান্না করতে হবে। ছেলেটি বলল, চাচা আপনারা সবাই রোজা রেখেছেন, আপনারাতো ক্লান্ত তাই দেন রান্নার কাজটা আমিই করি। সে জোড় করে বলল তাই রান্নার দায়িত্বটা তাকেই দেয়া হল। মুাজহিদিনরা ঘুমিয়ে পড়লেন। রান্না করে এক পর্যায়ে ছেলেটিও ঘুমিয়ে পড়লো।
আবু কুদামা (রহ.) বলেন, আমি ঘুমন্ত অবস্থায় ছেলেটির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে ঘুমের মাঝে মিটমিট করে হাঁসছে।আমি অন্যান্য মুজাহিদ সাথীদের বিষয়টি দেখালাম। ছেলেটির ঘুম ভাঙ্গার পর তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি হাঁসছিলে কেন? সে বলতে চাইলো না। অনেক জোড়াজুড়ির পর সে বলল, আমি দেখলাম স্বর্ণ রৌপ্য দ্বারা নির্মিত বিশাল একটি প্রসাদ। প্রাসাদটি দেখতে খুবই মনোরম ছিল। চাঁদের ন্যয় উজ্জ্বল অনেক গুলো সুন্দর মেয়ে সেই প্রাসাদ থেকে বের হয়ে আমাকে অভিবাদন জানাতে লাগলো। আমাকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছিল তাদের মধ্য থেকে একটি মেয়ে আমাকে ডাক দিয়ে বলল, হে মর্জিয়ার স্বামী! মার্জিয়া উপরে আছে। আমি প্রাসাদের উপরে চলে গেলাম। উপরে গিয়ে দেখি, খুব সুন্দর একটি মেয়ে বসে আছে যার উজ্জ্বলতা সূর্যের আলোকেও হার মানায়। আমি তাকে স্পর্শ করার জন্য তাড়াহুড়া করছিলাম। সে আমাকে বলল, ধর্য ধর, এখনো সমায় হয়নি। আগামীকাল দুপরে তুমি আমার সাথে স্বাক্ষাত করবে। এরপর আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো।

আবু কুদামা (রহ.) বললেন, পরের দিন রোমানদের বিরুদ্ধে আমারা তুমুল যুদ্ধ শুরু করলাম। এক পর্যায়ে আমরা বিজয় লাভ করলাম। রোমানরা পরাজিত হলো। যুদ্ধ শেষে দেখা গেল আমাদের অনেক সাথী আহত হয়ে ময়দানে পড়ে আছে, সাথীরা তাদেরকে তুলছে। আমিও আহত সাথীদের মাঝে মনে মনে ঐ ছেলেটিকে তালাশ করছিলাম। চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম সে কোথায় আছে। কিন্তু তাকে খুজে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ দেখতে পেলাম সেই ছেলেটি রক্ত মাখা অবস্থায় পড়ে আছে। আমি দৌড়িয়ে ওর কাছে গেলাম।
ছেলেটি আমাকে লক্ষ করে বলল, চাচা আমিতো শহীদ হয়ে যাচ্ছি। আমার এই রক্ত মাখা জামাটা আমার মাকে দিবেন আর বলবেন, আপনার ছেলে তার ওয়াদা পূর্ণ করেছে। সে লাড়াই করতে করতে বিজয় এনেছে, সে পিছু হটেনি। এতে করে আমার মা সান্তনা পাবে।
আর বাড়িতে আমার ছোট একটা বোন আছে। বাড়িতে তো কেউ ছিলনা তাই ও আমার কাছে থাকতো। আমিও ওকে অনেক আদর করতাম। ও আমাকে বাড়ি হতে বের হতে দিত না। সবসময় ভাইয়া ভাইয়া বলে ডাকতো। আপনি যখন বাড়িতে যাবেন তখন আমার ছোট বোনটাকে একটু শান্তনা দিবেন। আর আমার মাকে শান্তনা দিয়ে বলবেন, আমি শহীদ হয়েছি। আপনি সৌভাগ্যবান শহীদের মা।

আর চাচা, আমি যে আপনাকে স্বপ্নের দেখা মার্জিয়ার কথা বলেছিলাম, মার্জিয়া আমার মাথার পাশেই দাড়িয়ে আছে। সে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। এই বলে ছেলেটি শহীদ হয়ে গেলো।

আবু কুদামা (রহ.) বলেন, পরবর্তিতে আমরা যখন ফিরে আসছিলাম তখন সেই ছেলেটির বাড়িতে গেলাম। বাড়িতে গিয়ে দেখি দরজায় ওর ছোট বোনটি দাড়িয়ে আছে। আমি ওকে বললাম, তোমার মাকে ডাক। ছেলেটির মা আসলো এবং আমাকে বলল, আপনি কি আমাকে সান্তনা দিতে এসেছেন না সুসংবাদ দিতে এসেছেন? আমি জিজ্ঞাসা করলাম সান্তনা কোনটা আর সুসংবাদ কোনটা?

সে বলল, আমার ছেলে যদি সুস্থ অবস্থায় ফিরে আসে তাহলে আমাকে সান্তনা দিন আর আমার ছেলে যদি শহীদ হয়ে থাকে তাহলে এটা হবে আমার জন্য সুসংবাদ।
আবু কুদামা (রহ.) বললেন, আলহামদুলিল্লাহ্‌! আপনার ছেলে বীরত্বের সাথে লাড়াই করতে করতে আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয়েছে, পিছু হটেনি। তখন ঐ মহিলা বললেন, সমস্ত প্রশংসা ঐ স্বত্তার যিনি আমার এই ছেলেকে পরকালে নাজাতের ওসীলা বনালেন। [১৫]

জিহাদ বনাম জঙ্গিবাদ : জিহাদ ও জঙ্গিবাদ কখনো এক নয়। জিহাদ একটি ইবাদত। এর রয়েছে কিছু মহান উদ্দেশ্য। পক্ষান্তরে সন্ত্রাসবাদ বা অন্যান্য যুদ্ধ কখনো ইবাদত নয়। বরং তা হারাম কাজ। ইসলামি জ্ঞানের সল্পতার কারণে এক শ্রেণির লোক জিহাদ এবং সন্ত্রাসকে এক করে ফেলেছে । এ দুটো পরস্পর বিপরীত ।

মানুষকে সত্যনিষ্ঠ ও নৈতিকগুনে গুণান্বিত করা জিহাদের অন্যতম উদ্দেশ্য। ইসলামি রাষ্ট্র ও তার নাগরিকদের নিরাপত্তা প্রদান করা এবং মুসলমানদের ধর্ম পালনে সকল প্রতিবন্ধকতা রোধ করা জিহাদের মৌলিক উদ্দেশ্য।

পক্ষান্তরে সন্ত্রাসবাদের উদ্দেশ্য হলো অন্যায়ভাবে রক্তপাত করে রাজ্য জয়, ক্ষমতা দখল, সম্পদ অর্জন করা এবং লুটতরাজ ও খুন-খারাবির মাধ্যমে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা । জিহাদে সন্ত্রাসবাদ তথা জঙ্গিবাদের কোনো স্থান নেই ।

তাই তো কোনো নিরপরাধ মানুষকে বোমা মেরে, গুলি করে হত্যা করাকে ইসলাম সমর্থন করে না। সেটা কখনো জিহাদ নয়। বরং তা সন্ত্রাস। আর ইসলাম সন্ত্রাসবাদকে কিছুতেই সমর্থন করে না। বরং কঠোর হস্তে তা দমন করার নির্দেশ দেয়। [১৬]

জিহাদ ও সন্ত্রাসবাদের মধ্যকার পার্থক্য একটি হাদীসের উদ্ধৃতি দ্বারা স্পষ্ট ফুটে ওঠে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, ‘যুদ্ধে তোমরা প্রতারণা বা ধোঁকার আশ্রয় নেবে না, চুক্তিভঙ্গ করবে না, কোনো মানুষ বা প্রাণীর মৃতদেহ বিকৃত করবে না বা অসম্মান করবে না, কোনো শিশু-কিশোরকে হত্যা করবে না, কোনো মহিলাকে হত্যা করবে না, কোনো গীর্জাবাসী, সন্ন্যাসী বা ধর্মযাজককে হত্যা করবে না, কোনো বৃদ্ধকে হত্যা করবে না, কোনো অসুস্থ মানুষকে হত্যা করবে না, কোনো বাড়িঘর ধ্বংস করবে না, খাদ্যের প্রয়োজন ছাড়া গরু, উট বা কোনো প্রাণী বধ করবে না, যুদ্ধের প্রয়োজন ছাড়া কোনো গাছ কাটবে না। তোমরা দয়া ও কল্যাণ করবে, কারণ আল্লাহ দয়াকারী- কল্যাণকারীদেরকে ভালবাসেন।’ [১৭]

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর জীবনের সকল যুদ্ধে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন যথাসম্ভব কম প্রাণহানি ঘটাতে। শুধু মুসলিম রাষ্ট্রের নাগরিক ও যোদ্ধাদের জীবনই নয়, উপরন্তু তিনি শত্রুপক্ষের নাগরিক ও যোদ্ধাদেরও প্রাণহানি কমাতে চেয়েছেন। বস্ত্তত ইসলাম জিহাদকে যে মানবিক রূপ প্রদান করেছে তা অন্য কোনো ধর্মেই পাওয়া যায় না।

বিপরীতে প্রতারণা করা, চুক্তি ভঙ্গ করা, নারী, শিশু, বৃদ্ধদের হত্যা করা, অসুস্থ মানুষকে হত্যা করা, বাড়িঘর ধ্বংস করা ইত্যাদি এগুলো হলো সন্ত্রাসবাদ। সন্ত্রাস ও জঙ্গিদের কর্মকাণ্ড। যা ইসলাম কখনওই সমর্থন করে না।

বিজয়ের শর্তাবলী : মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা যখন কোন বাহিনীর সাথে সংঘাতে লিপ্ত হও তখন সুদৃঢ় থাকো এবং আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করো, যাতে তোমরা উদ্দেশ্যে কৃতকার্য হতে পারো। আর আল্লাহ তা’আলার নির্দেশ
মান্য কর এবং তাঁর রাসূলের। তাছাড়া তোমরা পরস্পরে বিবাদে লিপ্ত হইওনা। যদি তা করো, তবে তোমরা ব্যর্থ হয়ে যাবে এবং তোমাদের প্রভাব চলে যাবে। আর তোমরা ধৈর্য ধারণ কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন।’ [১৮]

আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বিজয়ের পাঁচটি শর্ত উল্লেখ করেছেন। মুমিনগণ এ শর্তগুলো পূঙ্খানুপুঙ্খ পালন করে জিহাদে অবতরণ করলে বিজয় অবশ্যই ছিনিয়ে আনবে ইনশাআল্লাহ।

[১] ইস্তিকামাত তথা সুদৃঢ় থাকা।
[২] যিকরুল্লাহ তথা আল্লাহ তায়ালাকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করা।
[৩] সর্বদা আল্লাহ ও তার রাসূলের নির্দেশের পাবন্দি করা।
[৪] মুজাহিদরা সর্বদা একতাবদ্ধ থাকা। পরস্পর বিবাদ, বিতণ্ডায় লিপ্ত না হওয়া।
[৫] ধৈর্য ধারণ করা।

বর্তমানে বলা চলে এই পাঁচটি বিষয়ের কোনোটিই যথোপযুক্ত আমাদের মধ্যে নেই। সবচেয়ে বেশি যে শর্তটির শূন্যতা তা হলো- ঐক্যবদ্ধতা। ফিকহি মাসায়েল, বিভিন্ন প্রথা-বিশ্বাস, বিদআত ও সত্যের অনুসন্ধিৎসাহীনতা যুগের পর যুগ ধরে আমাদের মুসলিম উম্মাহকে বিভক্ত করে রেখেছে।

অপরদিকে আফগানিস্তানের ভূমিতে তালেবানরা উল্লেখিত সকল শর্ত পূঙ্খানুপুঙ্খ মেনে চলে দীর্ঘ দুই যুগের ধৈর্য ঘুটিয়ে বিজয়ের পথে অবলীলায় হেঁটে চলছে। বিশ্বের সুপার পাওয়ার আমেরিকাসহ ন্যাটোভুক্ত চল্লিশটি দেশের আফগান ভূখণ্ডে কবর রচিত হলো। পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে রাতের আঁধারে নিঃশব্দে উড়াল দিয়ে পালিয়ে যেতে হলো তাদের। এটি তালেবানসহ মুসলিম উম্মাহর জন্য মহান রবের পক্ষ থেকে এক মহাবিজয়।

এই বিজয় নিমিষেই অর্জন হয় নি। এতে পুড়তে হয়েছে রক্ত ও আত্মত্যাগের অনেক কাঠখড়। সুদীর্ঘ দুই যুগ ধরে ধৈর্য ধারণ করে বিপদ, বোমা ও বারুদের শব্দ ঝংকারে অবিচল থেকে এক আল্লাহর পথে চলে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে এ-ই সফলতা।

আল্লাহ রব্বুল আলামীন আমাদের সকলককে তার দ্বীনের একনিষ্ঠ খাদেম এবং মুজাহিদ হিসেবে কবুল করে নিন। আমিন।
_________
রেফারেন্স.
[১] তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম। মুফতী তাকী উসমানী হাফি.।
[২] সূরাহ হজ্ব, আয়াত : ৭৮।
[৩] সূরাহ আনফাল, আয়াত : ৩৯।
[৪] সূরাহ হজ্ব, আয়াত : ৩৯।
[৫] সূরাহ বাকারা, আয়াত : ১৯০।
[৬] সূরাহ তাওবা, আয়াত : ৩৮।
[৭] সূরাহ নিসা, আয়াত : ৯৫-৯৬।
[৮] আবু দাউদ, হাদীস : ৩৭৮১।
[৯] সহীহ বুখারী, হাদিস : ২৬১৬; মুসনাদু আহমদ- ৮/৩৪৩।
[১০] সুনানে তিরমিযী, হাদীস : ২৬১৬; সুনানে ইবনু মাজাহ, হাদীস : ৩৯৭২; মুসতাদরাকু হাকিম- ২/৭৬।
[১১] আল-মু’জামুস সাগীর, ইমাম তাবরানী- ২/৬৬; মুসনাদে আবু ইয়া’লা- ১/৪৪২; মাজমাউয যাওয়ায়ীদ, হাইছামী- ২/৬০।
[১২] সুনানে আবু দাউদ– ৩/২১ হাদীস : ২৫৪১; সুনানে তিরমিযী-৪/১৮৫ হাদীস : ১৬৫৭; মুসনাদে আহমদ– ৫/২৪৪ হাদীস : ২২১৬৯; সুনানে ইবনে মাজাহ- ২/৯৩৩ হাদীস : ২৭৯২; মুসতাদরাকু হাকিম- ২/৮৭; সহীহ ইবনে হিব্বান-১০/৪৭৮ হাদীস : ৪৬১৮।
[১৩] জামিউত তিরমিজি, হাদীস : ১৬৬৩।
[১৪] জামিউত তিরমিজি, হাদীস : ১৬২০।
[১৫] শাইখ তামিম আল আদনানী হাফি. এর লেকচার অবলম্বনে।
[১৬] মুকাদ্দিমাতু কিতাবিল জিহাদ, পৃ. ২৪।
[১৭] বাইহাকী, আহমাদ ইবনুল হুসাইন (৪৫৮ হি.), আস-সুনানুল কুবরা ৯/৯০।
[১৮] সূরাহ আনফাল, আয়াত : ৪৫-৪৬।
.
—আব্দুল্লাহ আল কাফী

পঠিত : ১১৩৮ বার

মন্তব্য: ০