Alapon

মুসলিম উম্মাহর পরিচয়।



০১.

উম্মাহ শব্দটা আরবি শব্দ। এর দ্বারা এমন একটা সম্প্রদায়কে বোঝানো হয়, যারা কয়েকটি মৌলিক বিষয়ের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সেই বিশ্বাসগুলোর আলোকেই নিজেদের জীবন ও কর্মনীতি পরিচালনা করে।

‘উম্মাহ’ শব্দটি দ্বারা কোনো একটা নির্দিষ্ট ভাষা, নির্দিষ্ট অঞ্চল বা ভূখণ্ডের অধিবাসীদেরকে বোঝানো হয় না। বরং এই শব্দ দ্বারা বিশ্বের যে স্থানে যে মানুষটিই এক আল্লাহর ওপর ঈমান এনেছে, ঈমান এনেছে মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রিসালাত-সহ কয়েকটি বুনিয়াদের ওপর; তাদের প্রত্যেককেই বোঝানো হয় । সোজাসাপটা কথা হলো উম্মাহ শব্দটি মুসলিমদের সমষ্টিকেই বুঝানোর হয়। তবে সেটা শুধু নামগত মুসলমানদেরকে নয়। কারণ, বহু মুসলিম আছে ইসলামের মৌলিক বুনিয়াদ সমূহের ওপর বিশ্বাসী নয়। নাম মুসলমানের হলেও, জন্ম মুসলিমের ঘরে হলেও কিন্তু সে মুরতাদ। নাস্তিক কিংবা আজ্ঞেয়বাদী। আর সে কারণেই আমি বলেছি যে, শুধু নামগত মুসলমানদের সমষ্টিকেই মুসলিম উম্মাহ বলা হয় না।

মুসলিম উম্মাহর পরিচয়ে শাইখ ইউসুফ আল কারজাভী বলেন,
"মুসলিম উম্মাহ বিশ্বজনীন উম্মাহ। এক আকিদা, এক শরিয়াহ, এক মূল্যবোধ ও এক কিবলা ইসলামের সন্তানদের একতাবদ্ধ করেছে; যদিও তাদের বংশ, দেশ, ভাষা ও বর্ণে বৈচিত্র রয়েছে।...এই উম্মাহ মানুষের মাঝে পার্থক্য সৃষ্টিকারী সকল বিষয়কে সম্পূর্ণ নির্মূল করে দেয়।"


আবার অন্যদিকে উম্মাহর ব্যাপারে আলোচনায় ড. ইসমাঈল রাজি আল ফারুকী (রহ.)বলেন,
উম্মাহ শব্দটি জনগোষ্ঠী, জাতি, রাষ্ট্র, ইত্যাদির সমর্থক নয়। উম্মাহ হচ্ছে দেশ বা অঞ্চল অতিক্রমী, যা মোটেই ভৌগলিক বিবেচনা দ্বারা নির্ধারিত নয়। এর অবস্থান শুধু গোটা পৃথিবী নয়, বরং গোটা সৃষ্টি।


আসলেই তাই। ‘উম্মাহ’ এমনই এক শক্তিশালী পরিভাষা, যা দ্বারা জাত-পাত, সাদা-কালো, ধনী-গরিব, উঁচু-নিচু, দেশ-গোত্র, আরব-অনারব; সব ব্যবধানকেই ভেঙ্গেচুরে একাকার করে ফেলা হয়। এই একটি পরিভাষার অধীনে তাবৎ দুনিয়ার সব মানুষ আশ্রয় গ্রহণ করে। এই ছাতার নিচে আশ্রয়-অবস্থানকারী প্রত্যেক ব্যক্তিই একে অপরের ভাই। এরা একে অপরের দুঃখে কাঁদবে। সুখে হাসবে। কুরআনুল কারিমের বর্ণনায়ও এই বিষয়টা ফুটে ওঠে। পবিত্র কালামে পাকে আল্লাহ রব্বুল আলামিন বলেছেন,
"নিশ্চয়ই মুমিনগণ একে অপরের ভাই।"


রাসুলে করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও বলেছেন যে,
সারা দুনিয়ার মুমিনগণ হচ্ছে একটা দেহের ন্যায়। যদি দেহের কোনো বিশেষ অঙ্গ অসুস্থ হয়ে পড়ে, তাহলে অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেও তা অনুভূত হয়; সেটা জাগ্রত অবস্থায় হোক কিংবা জ্বরাক্রান্ত অবস্থায়।’ (মুসলিম : ৬৭৫১)।


তিনি আরো বলেছেন,
‘একজন মুমিন অন্য মুমিনের জন্য একটি ইমারত সদৃশ্য, যার এক অংশ আরেক অংশকে মজবুত করে।’ (মুসলিম : ৬৩৪৯)।



০২.

আমরা যদি খেয়াল করি, তাহলে দেখবো আল্লাহ রব্বুল আলামিন প্রত্যেক নবীকে তাঁর নিজস্ব জাতি, তাঁর নিজস্ব গোত্রের মাঝে, নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মাঝে প্রেরণ করেছেন। তাঁরা কেউই বিশ্বনবী ছিলেন না। তাই তো অন্যান্য নবী-রাসুলগণ তাঁদের নিজ অনুসারীদের যে ভাষায় দাওয়াত দিয়েছেন, সে ভাষার মধ্যেও কিন্তু বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান ছিলো না। তাঁরা আহ্বান করেছেন নিজ কওমকে। তবে সব নবী-রাসুলদের আহ্বাবানই ছিলো এক আল্লাহর দিকে। তাওহীদের প্রতি। শিরকিয়্যাতের বিরুদ্ধে। আমরা কুরআন থেকেই তাদের আহ্বান-সম্পর্কে জানতে পারি। যেমন, শুআইব আলাইহিস সালামের আহ্বান দেখুন,
‘হে আমার কওম, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত করো, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো ইলাহ নেই এবং মাপ ও ওযন কম করো না” ( সূরা : হুদ -৮৪)


আবার আদ জাতির প্রতি নবীরূপে প্রেরিত নবী হুদ আলাইহিস সালামের আহ্বান দেখুন,
“তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থন করো, তারপর তার দিকেই ফিরে আসো।” ( সূরা : হুদ -৫২)


মুসা আলাহিস সালামের আহ্বান দেখুন,
‘হে আমার কওম ! এ দুনিয়ার জীবন কেবল অস্থায়ী ভোগের বস্তু, আর নিশ্চয় আখিরাতই হলো স্থায়ী আবাস।’(সূরা : গাফির -৩৯)

নুহ আলাইহিস সালামের আহ্বান কুরআনে এভাবে এসেছে ,
“নিশ্চয় আমি নুহকে পাঠিয়েছিলাম তাঁর কওমের কাছে (এ কথা বলে), ‘তোমার কওমকে সতর্ক করো, তাদের নিকট যন্ত্রণাদায়ক আযাব আসার পূর্বে। হে আমার কওম ! নিশ্চয় আমি তোমাদের জন্য এক স্পষ্ট সতর্ককারী এ বিষয়ে যে, তোমরা আল্লাহর ‘ইবাদাত কর, তাঁকেই ভয় কর, আর আমার কথা মান্য করো।” (সূরা : নুহ ০১-০৩)


কিন্তু আল্লাহর কুরআন থেকে দেখতে পাই যে, মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর দাওয়াতে কখনো 'হে আমার কওম' বলে শুধুই নির্দিষ্ট একটা গোত্র, নির্দিষ্ট একটা জাতিকে সম্বোধন করেননি। কারণ মহান আল্লাহ সুবহানাহু ও’তাআলা মুহাম্মাদ (সা.)-কে নির্দিষ্ট গোত্র, নির্দিষ্ট অঞ্চল কিংবা নির্দিষ্ট বর্ণের জন্যে প্রেরন করেননি। তাঁকে পাঠানো হয়েছে সারা বিশ্বের সকল মানুষের জন্য। আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা.)-কে কাদের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করা হয়েছে, তা পবিত্র কুরআনুল কারিমে আল্লাহ রব্বুল সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন এভাবে,
"হে নবী আমি আপনাকে জগতবাসীর জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি ।" (সুরা : আম্বিয়া -১০৭)


পবিত্র কুরআন মাজিদের অন্য আরেকটি আয়াতে ইরশাদ হয়েছে,
"বড়োই বরকত সম্পন্ন তিনি, যিনি এই কুরআন তার বান্দার প্রতি অবতীর্ণ করেছেন, যাতে তিনি (এই কুরআন দিয়ে) বিশ্বজগতের জন্য সতর্ককারী হতে পারেন।" ( সূরা ফুরকান : ০১)


উক্ত আয়াতগুলো থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আমাদের প্রিয় নবী রাসুলে করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা পুরো বিশ্বজগতের জন্যই রহমত হিসেবেই প্রেরণ করা হয়েছে। প্রেরণ করা হয়েছে তাঁকে পুরো মানবতার জন্য মুক্তিদূত হিসেবে।

এখন যেহেতু পুরো মানবতার জন্যই তিনি প্রেরিত, তাহলে অবশ্যই সেই মানবদের কেউ হবে আরবি, কেউ হবে আজমি। কেউ হবে কালো, কেউ হবে সাদা। কেউ হবে পশ্চিমের অধিবাসী, কেউ হবে পূর্বের। কেউ হবে ধনী, কেউ হবে গরীব। আর ইসলামের পরিভাষায় এ ধরনের বাহ্যিক পার্থক্যওয়ালা মুসলমানদের সবাইকেই একত্রে মুসলিম উম্মাহ বলা হয়। স্বয়ং আল্লাহ রব্বুল আলামিনই মুসলমানদেরকে সম্বোধন করেছেন ‘উম্মাহ’ হিসেবে। চলুন মহাগ্রন্থ আল-কুরআন থেকে দেখে আসি বিষয়টা। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে :

- আর এভাবে আমি তোমাদেরকে মধ্যমপন্থী উম্মাহ বানিয়েছি। (সূরা : বাকারা -১৪৩)

- তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মাহ, তোমাদেরকে মানবজাতির কল্যাণে সৃষ্টি করা হয়েছে ...। (সূরা : আলে ইমরান-১১০)


'তোমাদেরকে মানবজাতির কল্যাণে সৃষ্টি করা হয়েছে' পবিত্র কুরআনের এই আয়াত প্রসঙ্গে ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী বলেন,
মুসলমানরা আদিষ্ট হয়েছেই নিজেদেরকে উম্মাহতে পরিণত করতে। এই উম্মাহই হচ্ছে মুসলমানদের অধিকার ও কর্তব্যের উৎস।

পঠিত : ৩৮০ বার

মন্তব্য: ০