Alapon

মহান আল্লাহ কেবল মানুষের অন্তর দেখেন...



অনেক অল্পবয়সী নারীদের মেক-আপ করার ইচ্ছা সাধারণত হাই স্কুলে থাকাকালীন সময়ে শুরু হয়। অল্পবয়সী নারী হিসেবে, আমরা প্রায়ই আমাদের বান্ধবীদের এমন কিছু করতে দেখি যাকে মেক-আপ পাড়ায় ‘কুল' হিসেবে প্রচার করা হয়। যাইহোক অল্প বয়সী নারীদের মেক-আপের প্রতি বেশি ঝুঁকতে দেখে পিতা-মাতাদের হতাশা এমনভাবে বেড়ে যায় যে, রাসায়নিকের স্তরে লেপা (মেক-আপে আবৃত) তাদের ছোট্ট মেয়েটির নিষ্পাপ মুখের দিকে তারা ভয়ের দৃষ্টিতে তাকাতে বাধ্য হয়।

আপনি আজ যেদিকেই তাকান—সেটা সোশ্যাল মিডিয়া হোক কিংবা টিভি, বিজ্ঞাপন, যাইহোক হোক না কেন! সব জায়গাতেই নিখুঁত মেক-আপে সজ্জিত নারীদের ছবি দেখতে পাবেন। পুরুষেরা নির্বিকারভাবে নারীদের এই সব ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবে যে, ছবিগুলোতে থাকা ‘মেক-আপ’ তাদের স্ত্রীদের রূপচর্চার জন্য একমাত্র আদর্শ মাধ্যম। অথচ এই সব ছবি তৈরিতে দামী প্রসাধনী সামগ্রী ব্যবহার করার পাশাপাশি প্রচুর সময়ও ব্যয় করা হয়।

পাশাপাশি ছবিগুলো তোলার পর সেগুলোকে ফটোশপ দিয়ে আরো সুন্দর করে এডিট করা হয়। তারপর বিলবোর্ডে এসব ছবি ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু কিছু স্বামী (অনেক ক্ষেত্রে নারীরাও) এটা বুঝতে চায় না যে, তাদের স্ত্রী'রা সেলিব্রিটিদের বিজ্ঞানপনের ছবির শুধু ‘মেক-আপের’ মাধ্যমে নিজেদেরকে সবচেয়ে সুন্দরী হিসেবে মেলে ধরতে পারবে না কারণ বাস্তব জীবনে কোনো ফটোশপ নেই। অথচ মেক-আপে আবৃত সেলিব্রিটিদের ছবি যে ধোঁকা ছাড়া আর কিছু নয় অনেকে সেটা বুঝতেই চায় না।

আপনি সোশ্যাল মিডিয়া, টিভি-সিনেমায় যত বেশি ঢু মারবেন, তত বেশি মেক-আপের ফাঁদে পড়বেন। এমনকি সবচেয়ে আত্মবিশ্বাসী নারীরাও সহজে এর শিকার হতে পারে। আমিও সেই নারীদের মধ্যে একজন ছিলাম। সত্যি বলতে আমার মোবাইল কিংবা টিভি স্ক্রিনের সামনে মেক-আপে আবৃত সেলিব্রিটির নকল ছবি আসলে আমি এখনও সংগ্রাম করি। এর মোহ থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য লড়াই করি।

যাইহোক আমার মেক-আপ যাত্রা শুরু হয়েছিল হাই স্কুলে থাকাকালীন সময়ে। এর আগে আমি মেক-আপের সাথে যুক্ত পণ্যগুলোর বিষয়ে তেমন একটা ধারণা রাখতাম না। আমার বান্ধবীরা ছিল সেসময়ে আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দরী নারী, যারা সবসময় তাদের সৌন্দর্যকে সবার সামনে মেলে ধরার চেষ্টা করত। তাদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে আমিও তাদের মত হতে চাইতাম।

এমনকি আমি একজন অল্পবয়সী এবং সাদাসিধা কিশোরী হিসেবে প্রতিদিন নিজেকে মডেলের বেশে দেখতে চাইতাম। আমার হাই স্কুল জীবনের শেষ বছর থেকে শুরু করে পরবর্তী বছরগুলোতে, আমি উল্লেখযোগ্যভাবে আমার মেক-আপের প্রতি আগ্রহকে আরও বাড়িয়ে তুলি। মোটকথা মেক-আপের পণ্যসামগ্রীর প্রতি বেশি ঝুঁকে যাই। পণ্যগুলোর মধ্যে শুধু ব্লাশ এবং মাসকারাই ছিল না বরং ছিল কনসিলার, আইলাইনার, আইশ্যাডো, হাইলাইটার, ব্রোঞ্জার এবং গ্লস। এই পণ্যগুলোর মধ্যে অসংখ্য ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ ছিল। এগুলো আমার ত্বকের বারোটা বাজানোর পাশাপাশি ত্বককে আগের চেয়ে আরও বেশি স্ফীত করে দেয়।

আমার জীবনে ঘটা একটা লজ্জাজনক বিষয় হলো, আমি সেসময় মেক-আপ না করে ঘর থেকে বের হতে পারতাম না। কারণ তথাকথিত কৃত্রিম লাবণ্যময়ী সেলিব্রিটিদের ছবির ঝলকানিতে আমি আমার আসল চেহারা নিয়ে সবসময় হীনমন্যতায় ভুগতাম। পরবর্তীতে আমি যখন বিদেশে গিয়ে নারীদেরকে নিকাব পরতে দেখি তখন আমারও এটি পরার শখ জাগে। সেখানকার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, আপনি হয় নিজেকে মেক-আপ দিয়ে ঢেকে রাখবেন অথবা ইসলামের নির্দেশ অনুসারে নিজেকে নিকাব দিয়ে ঢেকে রাখবেন। মোটকথা আপনার যেটা ইচ্ছা সেটা গ্রহণ করতে পারবেন।

ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্য, নিকাব হলো একটি ঢাল যা আমাকে জঘন্য চিন্তাধারার পুরুষদের দৃষ্টি থেকে রক্ষা করে এবং ঈর্ষাকাতর মহিলাদের দৃষ্টি থেকেও রক্ষা করে। আল্লাহ তা'আলা বলেছেন, “হে নবী, তুমি তোমার স্ত্রীদেরকে, কন্যাদেরকে ও মুমিনদের নারীদেরকে বলো, ‘তারা যেন তাদের জিলবাবের কিছু অংশ নিজেদের উপর ঝুলিয়ে দেয়, তাদেরকে চেনার ব্যাপারে এটাই সবচেয়ে কাছাকাছি পন্থা হবে। ফলে তাদেরকে কষ্ট দেয়া হবে না। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (সূরা আল- আহযাব, আয়াত ৫৯)
(জিলবাব হচ্ছে এমন পোশাক যা পুরো শরীরকে আচ্ছাদিত করে রাখে)

অর্থসহ এই আয়াতটি পড়ার পর থেকে নিকাব সম্পর্কিত সকল বিষয়ই আমার কাছে অর্থপূর্ণ মনে হয়েছিল। আমার আত্মবিশ্বাসের অভাবের কারণ হলো আল্লাহ তা'আলা যা আদেশ করেছেন আমি তা অনুসরণ করিনি। আমি এই দুনিয়াতে আমার সৌন্দর্য প্রদর্শন করতে আসিনি বরং এটি লুকিয়ে রাখতে এসেছি। এবং শুধুমাত্র আমার স্বামীর কাছেই তা প্রকাশ করতে এসেছি। আমরা সকলে যেই আত্মিক শান্তি খুঁজি, তা শুধুমাত্র তখনি পাবো যখন আমরা আল্লাহ তা'আলার কাছে নিজেদেরকে সম্পূর্ণ রূপে সঁপে দিবো। বিশ্বাস করেন, আমি নিজে এর সাক্ষী। যেই মূহুর্তে আপনি হারাম কাজ (বেপর্দা চালচলন) ছেড়ে দিবেন, ঠিক সেই মূহুর্তে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা'আলা আপনাকে এমনভাবে কাছে টেনে নিবেন যা আপনি কল্পনাও করেননি।

ব্যক্তিগত রূপচর্চা ও সৌন্দর্য বিষয়ক শিল্প হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে অনিয়ন্ত্রিত শিল্পগুলোর মধ্যে একটি। বর্তমানে এটির মূল্য ৫৩৪ বিলিয়ন ডলার। রূপচর্চার পণ্যগুলোর মধ্যে হরমোন বিঘ্নকারী উপাদান থাকে যা শিশুদের জন্মগত ত্রুটি বাড়ানোর পাশাপাশি ক্যান্সারের ঝুঁকিও বাড়ায়। এছাড়া এই পণ্য সামগ্রীগুলোর উপাদান আসে অনৈতিক উৎস থেকে এবং এগুলো অমানবিক কাজকেও সমর্থন করে। তাছাড়া মেক-আপের পণ্যগুলো মারাত্মক অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করার পাশাপাশি ত্বককে অকালে বয়সে পরিণত করে এবং সূর্যের আলো থেকে ত্বককে দূরে রাখে। অথচ ত্বককে ঠিক রাখার জন্য সূর্যের আলো দরকার। কয়েক শতাব্দী ধরে, ব্রণ, একজিমা এবং সোরিয়াসিসের মতো ত্বকের বিভিন্ন সমস্যার চিকিৎসার জন্য সূর্যালোক ব্যবহার করা হয়েছে।

আমাদের সকলের জানা উচিত যে, আমাদের দেহ আমাদের ব্যক্তিগত কোনো সম্পত্তি নয়। আমাদের পুরো শরীর আল্লাহ তা'আলার। মোটকথা আমাদের যা কিছু আছে তার প্রকৃত মালিক আল্লাহ তা'আলা। আমাদের শরীরের যত্ন নিতে হবে। পাশাপাশি আমরা যেন এর অপব্যবহার না করি তা নিশ্চিত করাও আমাদের দায়িত্ব। আমি এখন তিনটি মূল্যবান পরামর্শ দিয়ে শেষ করতে চাই যেগুলো আমার মধ্যে থাকা হীনমন্যতা কমাতে ব্যাপকভাবে সাহায্য করেছিল:
১) মহান আল্লাহ তা'আলা আপনাকে যে সুন্দর চেহারা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন তার জন্য কৃতজ্ঞ হোন। তিনি আপনার শারীরিক গঠন বিশেষভাবে আপনার জন্যই তৈরি করেছেন। সুতরাং আপনার রবের শুকরিয়া আদায় করুন।
২) সকল সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্ট মুছে ফেলুন– যেগুলো আপনাকে আপনার চেহারা নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগায় এবং যেসব সেলেব্রিটিরা কৃত্রিম সৌন্দর্যের প্রচার করে তাদেরকে আনফলো করুন।
৩) জেনে রাখুন, সমাজ আপনাকে কতটা সুন্দর বলে তার দ্বারা আপনার যোগ্যতা মাপা হয় না; বরং আপনার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তা'আলার কাছে আপনি কতটা সুন্দর সেটা হচ্ছে যোগ্যতার আসল মাপকাঠি।

আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের দেহ এবং তোমাদের আকৃতি দেখেন না; বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও আমল দেখেন।”

মূল: দ্য মুসলিম স্কেপটিক
তর্জমায়: তানভীর হায়দার

পঠিত : ৩১৯ বার

মন্তব্য: ০