Alapon

জাতীয়তাবাদ ও ইসলাম



| জাতীয়তাবাদ ও ইসলাম |
- সাঈয়েদ আবুল আ'লা মওদুদী রহ.

জাতীয়তাবাদের অর্থ ও তার নিগূঢ় তত্ত্ব সম্পর্কে যারা চিন্তা করবে তারা নিঃসন্দেহে স্বীকার করবে যে, অন্তর্নিহিত ভাবধারা, লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যের দৃষ্টিতে ইসলাম এবং জাতীয়তাবাদ পরস্পর বিরোধী দুটি আদর্শ। ইসলাম নির্বিশেষে সমগ্র মানুষকে আহ্বান জানায় মানুষ হিসেবে। সমগ্র মানুষের সামনে ইসলাম একটি আদর্শগত ও বিশ্বাসমূলক নৈতিক বিধান পেশ করে-একটি সুবিচার ও আলাহভীরুমূলক সমাজ ব্যবস্থা উপস্থিত করে এবং নির্বিশেষে সকল মানুষকেই তা গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানায়। অতপর যারাই তা গ্রহণ করে, সমান অধিকার ও মর্যাদা সহকারে তাদের সকলকেই তার গণ্ডীর মধ্যে গ্রহণ করে নেয়। ইসলামের ইবাদত, অর্থনীতি, সমাজ, আইনগত অধিকার ও কর্তব্য ইত্যাদি কোনো কাজেই ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে জাতিগত, বংশগত, ভৌগলিক কিংবা শ্রেণীগত বৈষম্য সৃষ্টি করে না। ইসলামের চরম উদ্দেশ্য হচ্ছে এমন একটি বিশ্বরাষ্ট্র (World state) গঠন করা, যাতে মানুষের মধ্যে বংশগত ও জাতিগত হিংসা-বিদ্বেষের সমস্ত শৃংখলা ছিন্ন করে সমগ্র মানুষকে সমান অধিকার লাভের জন্য সমান সুবিধা দিয়ে একটি তামাদ্দুনিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম করা হবে। সমাজের লোকদের মধ্যে শত্রুতামূলক প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিবর্তে পারস্পারিক বন্ধুত্বমূলক সহযোগিতা সৃষ্টি করা হবে। ফলে সকল মানুষ পরস্পরের জন্য বৈষয়িক উৎকর্ষ ও সমৃদ্ধি লাভ এবং আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধনে সাহায্যকারী হবে। মানুষের কল্যাণ সাধনের জন্য ইসলাম যে নীতি ও জীবন ব্যবস্থা পেশ করে, সাধারণ মানুষ তা ঠিক তখন গ্রহণ করতে পারে, যখন তার মধ্যে কোনোরূপ জাহেলী ভাবধারা ও হিংসা-বিদ্বেষ বর্তমান থাকবে না। জাতীয় ঐতিহ্যের মায়া, বংশীয় আভিজাত্য ও গৌরবের নেশা, রক্ত এবং মাটির সম্পর্কের অন্ধ মোহ থেকে নিজেকে মুক্ত করে কেবল মানুষ হিসেবেই তাকে সত্য, সুবিচার, ন্যায় ও সততা যাচাই করতে হবে-একটি শ্রেণী, জাতি বা দেশ হিসেবে নয়, সামগ্রিকভাবে গোটা মানবতার কল্যাণের পথ তাকে সন্ধান করতে হবে।

পক্ষান্তরে জাতীয়তাবাদ মানুষের মধ্যে জাতীয়তার দৃষ্টিতে পার্থক্য সৃষ্টি করে। জাতীয়তাবাদের ফলে অনিবার্য রূপে প্রত্যেক জাতির জাতীয়তাবাদী ব্যক্তি নিজ জাতিকে অন্যান্য সমগ্র জাতি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর মনে করবে। সে যদি অত্যন্ত হিংসুক জাতীয়তাবাদী (Aggressive Nationalist) না-ও হয়, তবুও নিছক জাতীয়তাবাদী হওয়ার কারণে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, আইন-কানুনের দিক দিয়ে সে নিজ জাতি ও অপর জাতির মধ্যে পার্থক্য করতে বাধ্য হবে। নিজ জাতির জন্যে যতোদূর সম্ভব অধিক স্বার্থ ও সুযোগ-সুবিধা সংরক্ষণের চেষ্টা করবে। জাতীয় স্বার্থের জন্য অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রাচীর দাঁড় করাতে বাধ্য হবে। উপরন্তু যেসব ঐতিহ্য ও প্রাচীন বিদ্বেষভাবের উপর তার জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত, তার সংরক্ষণের জন্যে এবং নিজের মধ্যে জাতীয় আভিজাত্যবোধ জাগ্রত রাখার জন্য তাকে চেষ্টানুবর্তী হতে হবে। অন্য জাতির লোককে সাম্যনীতির ভিত্তিতে জীবনের কোনো বিভাগেই সে নিজের সাথে শরীক করতে প্রস্তুত হতে পারবে না। তার জাতি যেখানেই অন্যান্য জাতি অপেক্ষা অধিকতর বেশী স্বার্থ ও সুযোগ-সুবিধা লাভ করতে থাকবে বা লাভ করতে পারবে, সেখানে তার মন ও মস্তিষ্ক থেকে সুবিচারের একটি কথাও ব্যক্ত হবে না। বিশ্বরাষ্ট্রের (World State) পরিবর্তে জাতীয় রাষ্ট্র (National state) প্রতিষ্ঠা করাই হবে তার চরম লক্ষ্য। সে যদি কোনো বিশ্বজনীন মতাদর্শ গ্রহণ করে, তবুও তা নিশ্চিতরূপে সাম্রাজ্যবাদে পরিণত হবে। কারণ তার রাষ্ট্রে অন্যান্য জাতীয় লোকদেরকে সমান অংশীদার হিসেবে কখনো স্থান দেয়া যেতে পারে না। অবশ্য গোলাম ও দাসানুদাস হিসেবেই তাকে গ্রহণ করা যেতে পারে।

এখানে এ দ্বিবিধ মতবাদের নীতি, উদ্দেশ্য ও অন্তর্নিহিত ভাবধারার সাধারণ আলোচনাই করা হলো। এতোটুকু আলোচনা থেকে সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয় যে, এ দুটি সম্পূর্ণরূপে পরস্পর বিরোধী। যেখানে জাতীয়তাবাদ হবে, সেখানে ইসলাম কখনোই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। অনুরূপভাবে যেখানে ইসলাম কায়েম হবে, তথায় এ জাতীয়তাবাদ এক মূহুর্তও টিকতে পারে না। জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও উৎকর্ষ হলে ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার পথ সেখানে অবরুদ্ধ হবে। আর ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হলে জাতীয়তাবাদের মূল উৎপাটিত হবেই। এমতাবস্থায় এক ব্যক্তির পক্ষেএকই সময় এ উভয় সময় কেবলমাত্র একটি মতকে গ্রহণ করতে পারে। একজন লোক একই সময় কেবলমাত্র একটি মতকে গ্রহণ করতে পারে। একই সময় এ দুই বিপরীতমুখী নৌকায় আরোহণ করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। একটি অনুসরণ করে চলার দাবী করার সাথে সাথেই তার ঠিক বিপরীত আদর্শের সমর্থন, সাহায্য ও পক্ষপাতিত্ব করা মানসিক বিকৃতির পরিচায়ক। যারা এরূপ করছে তাদের সম্পর্কে আমাদেরকে বাধ্য হয়েই বলতে হবে যে, হয় তারা ইসলামকে বুঝতে পারেনি, নয় জাতীয়তাবাদকে, কিংবা এ দুটির মধ্যে কোনোটিকেই তারা সঠিকরূপে অনুধাবন করতে সমর্থ হয়নি।

পঠিত : ১৭৩ বার

মন্তব্য: ০