Alapon

সুলতানি বাঙলার শিক্ষাব্যবস্থার স্বরূপ!




প্রাক-মুসলিম যুগে বর্তমানকালের বাঙলা ভূখণ্ডটি বেশ কয়েকটা জনপদে বিভক্ত ছিল। আর ভিন্ন ভিন্ন রাজারা এসব জনপদ শাসন করত। এই রাজাদের মধ্যে কোনো রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক ঐক্যও ছিল না। বাংলায় সেনদের হটিয়ে যখন মুসলিম শাসনের সূচনা হয়, তখনও এই অঞ্চলটি পাঁচটি ভাগে বিভক্ত ছিল। বরেন্দ্র, রাঢ়, বঙ্গ, বাগদি, মিথিলা নামক পাঁচটি জনপদ মূলত বাঙলার নদ-নদী এবং প্রাকৃতিক বাধাসমূহকে সীমারেখা ধরে নিজেদের স্বতন্ত্র অবস্থা বজায় রেখেছিল। অর্থাৎ প্রাক-তুর্কি (মুসলিম) যুগে অখণ্ড বাঙলা কিংবা বাঙালি জাতীয়তাবাদ বলতে তো কিছুই ছিল না, বরংঞ্চ এই অঞ্চলটি পাঁচটি জনপদে বিভক্ত ছিল যাদের মাঝে ছিলো না কোনো রাজনৈতিক সদ্ভাব।


১২০৪ সালে তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির মাধ্যমে সর্বপ্রথম বাঙলায় মুসলিম শাসনের সূচনা হয়। বখতিয়ার খিলজি অবশ্য সম্পূর্ণ বাংলা জয় করতে পারেননি। তিনি বাঙলার উত্তর পশ্চিমের লখনৌতি অংশটা করায়ত্ত করতে সক্ষম হন। বাঙলার দক্ষিণ পূর্বের তুলনায় উত্তর পশ্চিমের ভূখণ্ড তুলনামূলক উঁচু এবং শুষ্ক। ফলে ঘোড়া চালাতে অভিজ্ঞ তুর্কি সৈন্যরা সর্বপ্রথম উত্তর পশ্চিম বাঙলা থেকেই তাদের বিজয় অভিযান শুরু করে। বখতিয়ার খিলজির মৃত্যুর পরে পরবর্তী মুসলিম শাসকরা ধীরে ধীরে সমগ্র বাঙলাকে মুসলিম শাসনাধীনে নিয়ে আনেন। লখনৌতি, সাতগাঁও এবং সোনারগাঁও—এই তিন অংশে বাঙলাকে বিভক্ত করে প্রথমদিককার তুর্কি শাসকরা প্রশাসন পরিচালনা করত। সুলতান শামস উদ্দিন ইলিয়াস শাহ (রাজত্বকাল ১৩৩৯-১৩৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) সর্বপ্রথম সমগ্র বাঙলা ভূখণ্ডকে একক প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে স্বাধীনভাবে পরিচালনা করার কৃতিত্ব অর্জন করেন। সাতগাঁও, সোনারগাঁও, লখনৌতি এবং পার্শ্ববর্তী সকল জনপদকে একত্রিত করে স্বাধীন অখণ্ড বাঙলা গঠন করে ইতিহাস সৃষ্টি করেন সুলতান শামস উদ্দিন ইলিয়াস শাহ।

মধ্যযুগে মুসলিমরা যেসব ভূখণ্ডে পা রাখত, সেসব ভূখণ্ডেই তাদের জ্ঞানের মশাল ছড়িয়ে দিত। বাংলা ভূখণ্ডেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। তুর্কি থেকে আগত খলজি সালতানাত নিজস্ব সংস্কৃতি, সভ্যতা, শিক্ষা কার্যক্রম খুব দ্রুততার সাথে বাংলাজুড়ে ছড়িয়ে দিতে থাকে। মুসলিম শাসকরা সব সময়ই অনুধাবন করত যে, বিজিত ভূখণ্ডে যদি সামরিক শক্তি জোরদারের পাশাপাশি শিক্ষার কার্যক্রম বিস্তৃত করা না হয় তাহলে শাসন ক্ষমতা ধরে রাখা কঠিনতর হয়ে যাবে। শুধু ইসলামি শিক্ষা বিস্তার এবং সাংস্কৃতিক চেতনার পরিস্ফুটনই এই ভূখণ্ডের জনগণের সাথে তুর্কিদের এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ করতে পারে বলে মনে করতো তৎকালীন তুর্কী শাসকেরা—বাস্তবে হয়েছিলো তা-ই।


পশ্চিমে তেলিয়াগিড়ি গিরিপথ থেকে পূর্বে চট্টগ্রামের উঁচু পাহাড়, উত্তরের হিমালায় পর্বত থেকে দক্ষিণের বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল ভূখণ্ড সুলতানি বাংলা হিসেবে পরিগণিত হতো। ১২০৪ সাল থেকে ১৫৭৬ সাল পর্যন্ত এই বিশাল ভূখণ্ডের শাসনব্যবস্থাকে একত্রে সুলতানি শাসন হিসেবে অভিহিত করা হয়। তৎকালীন বাংলার শিক্ষাক্রম নিয়ে দুভাগে আলোচনা করা হবে। (১) সুলতানি আমলে বাংলায় গড়ে ওঠা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (২) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-সমূহের কনটেন্ট তথা পাঠ্যক্রম।

(১) সুলতানি আমলে বাংলায় গড়ে ওঠা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

মুসলিম শাসনের শুরুতেই অতি দ্রুত বখতিয়ার খলজি এবং অন্য খলজি শাসকরা বিজিত বাঙলা ভূখণ্ডে মসজিদ, মাদরাসা এবং খানকাহ প্রতিষ্ঠা করতে থাকে। রাজধানী লখনৌতির পাশাপাশি দেওকূট, নাটোর (নারকুটি), মাহিসন্তোষ নামক শহরগুলোতে অনেক মসজিদ, মাদরাসা, খানকাহ তৈরি হয়। মুসলিম শাসনের গৌরবোজ্জ্বল সময়ে এসে গৌড়, পান্ডুয়া, একডালা, কসবা (রাজশাহী), তাবরিজাবাদ, ঘোড়াঘাট, সাতগাঁও, সোনারগাঁও, চাটগাঁওসহ বাংলার বৃহৎ শহরগুলোতে ব্যাপক নগরায়ণ শুরু হয়। আর এই নগরগুলোতে বসবাসকারী জনগণের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রয়োজন হয় বহুসংখ্যক মাদরাসার। বৃহৎ অবকাঠামোর মাদরাসা ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষা কার্যক্রম বড় শহরগুলোতে পরিচালনা করা সম্ভব নয় বিধায় বাঙলার সব শহরেই বৃহৎ অবকাঠামো বিশিষ্ট একাধিক মাদরাসার অস্তিত্ব ছিলো। সুলতানি আমলে বাংলাজুড়ে বিরাজমান থাকা মাদরাসাগুলো সম্পর্কে জানা যায় দুভাবে। (i) শিলালিপির মাধ্যমে (ii) সাহিত্যের মাধ্যমে।


i) শিলালিপি থেকে প্রাপ্ত মাদরাসার সন্ধান

সুলতান রুকন উদ্দীন কায়কাউসের (১২৯১-১৩০১ খ্রিষ্টাব্দ) সময়কালে হুগলী জেলার ত্রিবেণী এলাকায় কাজী নাসির নামক এক ব্যক্তি ১২৯৮ খ্রিষ্টাব্দে একটি মাদরাসা নির্মাণ করার শিলালিপি পাওয়া যায়। সুলতান শামস উদ্দীন ফিরোজ শাহের (১৩০১-১৩২২ খ্রিষ্টাব্দ) সময়কালের এক শিলালিপিতে হুগলী জেলায় আরেকটি মাদরাসার সন্ধান মেলে। এই মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠা করেন সুলতানের উজির জাফর খান। দার-আল-খাইরাত নামক এই মাদরাসাটি জাফর খান কর্তৃক ১৩১৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ তেরো শতকের শুরুর দিকে হুগলি জেলার ত্রিবেণীতে বৃহৎ অবকাঠামো বিশিষ্ট দুটি মাদরাসা বিরাজমান ছিল।
এছাড়াও খিত্তাহ শিমলাবাদ নামক জায়গায় সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহের (১৪৪২-১৪৫৯ খ্রিষ্টাব্দ) সময়কালে এক বৃহৎ মাদরাসা ছিল। খিত্তাহ শিমলাবাদ জায়গাটা বর্তমানে পাবনা জেলার উত্তরাংশ, বগুড়া জেলার দক্ষিণ পশ্চিমাংশ এবং রাজশাহী জেলার দক্ষিণ পূর্বাংশজুড়ে বিস্তৃত ছিল। শিলালিপি থেকে আরো জানা যায় যে, খিত্তাহ শিমলাবাদে স্বতন্ত্র দুইটা ভবনে মসজিদ এবং মাদরাসা গড়ে উঠেছিল।

সুলতান শামস উদ্দীন ইউসুফ শাহের (১৪৭৪-১৪৯১ খ্রিষ্টাব্দ) সময়কালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় নির্মিত হয় বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ দারাসবাড়ি মাদরাসা। ১৪৭৯ সালের দিকে সুলতানের পৃষ্ঠপোষকতায় স্বতন্ত্র মসজিদসহ এই বৃহৎ মাদরাসাটি নির্মিত হয়। কালের পরিক্রমায় এই বৃহৎ অবকাঠামো বিশিষ্ট মসজিদ এবং মাদরাসাটি হারিয়ে যায়। ১৯৭৩ সালে জনৈক কৃষক চাষের জন্য মাটি খুঁড়তে গিয়ে অমূল্য এই প্রতিষ্ঠানকে আবারো লোকচক্ষুর সামনে নিয়ে আনেন। মাদরাসাটির বেশ বড় অবকাঠামো এখনো সগৌরবে টিকে আছে। সুলতান শামস উদ্দীন ইউসুফ শাহ দারাসবাড়ি মাদরাসা সংলগ্ন মসজিদটির নির্মাণ পুরোপুরি সমাপ্ত করলেও দারাসবাড়ি মাদরাসার কাজ পুরা শেষ করে যেতে পারেননি। ১৫০৩-০৪ সময়কালে গৌড়ের বিখ্যাত সুলতান আলাউদ্দীন হুসাইন শাহ কর্তৃক দারাসবাড়ি মাদরাসার সম্পূর্ণ কাজ সমাপ্ত হয়। আলাউদ্দিন হুসাইন শাহ কর্তৃক খোদাইকৃত শিলালিপি থেকে আরো জানা যায়, ১৫০২ সালের ১ম রমজানে এই মাদরাসার পুনর্নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়েছিল।


সুলতান হুসেইন শাহ কর্তৃক নির্মিত কাঠিয়ার মসজিদটি সংশ্লিষ্ট এলাকার জনসাধারণের ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করত। মসজিদের পূর্ব প্রান্তে স্থাপিত এক শিলালিপি থেকে জানা যায়, ১৫১০-১১ সালের সময়কালে গৌড়ের বিখ্যাত সুলতান আলাউদ্দিন হুসাইন শাহ এটি নির্মাণ করেন। হুসাইন শাহ রাজবংশের নির্মিতব্য এরকম আরো একটা মাদরাসার সন্ধান পাওয়া গেছে রাজশাহী অঞ্চলে। রাজশাহীর ঐতিহাসিক বাঘা মসজিদটি ষোলো শতকে সুলতান নসরত শাহ কর্তৃক নির্মিত হয়। আর এই মসজিদের পাশেই তৎকালীন সময়ে চালু ছিল একটা মাদরাসাও। শাহ মুয়াজ্জম দানিশমন্দ রাজশাহী জেলার বাঘা অঞ্চলে একটি খানকা স্থাপন করে অঞ্চলটিতে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করেছিলেন। তৎকালীন সুলতান নসরত শাহ এই পীরের সম্মানে বাঘা অঞ্চলে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। বাঘা মসজিদ নামে খ্যাত এই মসজিদটি আজও স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। শাহ মুয়াজ্জম দানিশমন্দের সুযোগ্য পুত্র শাহ হামিদ দানিশমন্দ পরবর্তী সময়ে বাঘা মসজিদের পাশে একটি মাদরাসা নির্মাণ করেন। ষোলো শতকের শুরুতে নির্মিত এই মাদরাসাটি উনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত এই অঞ্চলে শিক্ষার আলো জারি রেখেছিল। ১৮৯৭ সালে এক ভূমিকম্পে এই মাদরাসাটির অবকাঠামো ধ্বংস হওয়ার পর আর একে গড়ে তোলা হয়নি।

বিভিন্ন শিলালিপি থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, পনেরো ও ষোলো শতকের দিকে সুলতানি বাংলার দিকে দিকে বহু মাদরাসা গড়ে উঠেছিল। বিভিন্ন সুলতান, তাদের নিযুক্ত প্রশাসকরা এসব মাদরাসায় অনুদান প্রদান করত। আর এসব মাদরাসার শিক্ষা কার্যক্রমের পুরোটাই বুজুর্গ পীর এবং সুফিদের দ্বারা পরিচালিত হতো।

(ii) সাহিত্য এবং অন্যান্য উৎস থেকে প্রাপ্ত মাদরাসাসমূহ

রাজশাহী জেলার মাহিসন্তোষ এলাকায় তেরো শতাব্দীর দিকে এক অনন্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন বিখ্যাত সুফি মাওলানা তাকী উদ্দীন আরাবী। ভারতবর্ষের নানা প্রান্ত থেকে এসে বহু বিখ্যাত আলেম শিক্ষা গ্রহণ করেন এই মাদরাসা থেকে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন বিহারের শায়েখ ইয়াহিয়া মানেরী। শায়েখ ইয়াহিয়া মানেরী অবশ্য বাংলাদেশে তেমন দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করেননি। তবে তার সন্তান শায়েখ শরফুদ্দীন মানেরী বাংলার শীর্ষ একজন ইসলাম প্রচারক ছিলেন। শায়েখ ইয়াহিয়া মানেরী ১২৯১ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। অর্থাৎ রাজশাহী জেলার মাহিসন্তোষ তেরো শতাব্দীর মাঝামাঝিতে বিখ্যাত এক শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল।

সুলতানি বাংলার উৎকর্ষকালে মাহিসন্তোষ শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় এই এলাকায় বহু স্থাপনা গড়ে তোলেন তৎকালীন সুলতানরা। সুলতান রুকনউদ্দীন বারবাক শাহ (১৪৫৯-৭৪ খ্রিষ্টাব্দ) কর্তৃক এই এলাকায় নির্মিত একটি মসজিদের ধ্বংসাবশেষ সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়। সুলতান বরবাক শাহ এখানে টাকশালও নির্মাণ করেন। তাই মধ্যযুগে বড় একটা সময় এই এলাকাটি “বরবাকাবাদ” নামে পরিচিত ছিল। এ ছাড়াও এই মাহিসন্তোষ এলাকায় প্রায় ৩৭টি দুর্গের ধ্বংসাবশেষ এবং বহু ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থাপনা রয়েছে। সব মিলিয়ে বলা যায়, মাওলানা তাকী উদ্দীন আরাবী কর্তৃক নির্মিত মাদরাসার জন্য মাহিসন্তোষ একসময় বাংলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহরে পরিণত হয়। আর তাই এই এলাকায় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সুলতানেরা অসংখ্য স্থাপনা গড়ে তোলে এবং মাহিসন্তোষ হয়ে উঠে সুলতানি বাংলার এক গুরুত্বপূর্ণ নগরী।

বাংলার কিংবদন্তিতুল্য হাদিস শিক্ষক শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা। বুখারায় জন্মগ্রহণকারী এই মহান সুফি ১২৮১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বাংলার সোনারগাঁও অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করেন। সোনারগাঁওয়ে তার খানকাতে ইসলামি শিক্ষার পাশাপাশি পার্থিব বিষয়সমূহও পড়ানো হতো। শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামার খানকা থেকে শিক্ষালাভ করেছিলেন বাঙলার আরেক কিংবদন্তি মাওলানা শরফুদ্দীন আবু ইয়াহিয়া মানেরী। উচ্চশিক্ষার অনন্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে সোনারগাঁও অচিরেই বিখ্যাত হয়ে ওঠে। সোনারগাঁও-কেন্দ্রীক শিক্ষাব্যবস্থার রূপকার মাওলানা শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা ১৩০০ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে তার প্রতিষ্ঠিত মাদরাসার পাশেই সমাহিত করা হয়। আজও এই জায়গায় মাদরাসাটির ধ্বংসাবশেষ এবং মাওলানার রওজা অবশিষ্ট রয়েছে।

সুলতানি বাংলায় বেশ কয়েকজন সুলতানের রাজধানী হওয়ার মর্যাদা লাভ করে পান্ডুয়া নগরী। সুলতান শামস উদ্দীন ইলিয়াস শাহ, জালালুদ্দীন মোহাম্মদ শাহ, রুকনউদ্দীন বরবাক শাহ, শামস উদ্দীন ইউসুফ শাহ, জালালুদ্দিন ফতেহ শাহসহ বেশ কয়েকজন শাসক পান্ডুয়া নগরীতে শিক্ষা কার্যক্রম বেগবান করতে বিভিন্নভাবে সহায়তা করেন। সে সময় সুফিধারার জ্ঞানচর্চা এবং আধ্যাত্মিক নগরী হিসেবে পান্ডুয়া বেশ খ্যাতি অর্জন করে। হযরত নুর কুতুব আলম বাংলার অন্যতম শীর্ষ সুফি সাধক হিসেবে ইতিহাসে পরিচিত। এই মহান সুফি সাধক পান্ডুয়াতে তার খানকা স্থাপন করে জনসাধারণকে তাওহিদের শিক্ষা প্রদান করতেন। এ ছাড়াও তার খানকার পাশে তিনি গড়ে তোলেন একটা হাসপাতাল। তার নির্মিত জামে মসজিদের গঠন কাঠামো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এর পশ্চিম প্রান্তে বেশ উঁচু একটা জায়গা রয়েছে। ধারণা করা হয়, এই জায়গায় নামাজের আগে এবং পরে শিক্ষাদান কার্যক্রম পরিচালিত হতো। পারস্যের প্রায় অনেক পুরোনো মসজিদের প্রান্তেও এরকম উঁচু কাঠামো রয়েছে, যা মূলত শিক্ষাদান কাজে ব্যবহৃত হতো।

এতক্ষণ পর্যন্ত আলোচনা করা হলো শিলালিপি এবং সাহিত্যিক তথ্য থেকে প্রাপ্ত সুলতানি বাংলার বিভিন্ন মাদরাসা নিয়ে। এই মাদরাসাগুলোর পাঠ্যক্রম কেমন ছিল তা নিয়ে এখন আলোকপাত করা হবে।

(২) পাঠ্যক্রম তথা কনটেন্ট

তৎকালীন সুলতানি বাংলায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে পাঠ্যক্রম কেমন ছিল, তা পুরোপুরি জানা অনেকটাই অসম্ভব। এরপরেও বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন উৎসের মাধ্যমে মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া যায় সুলতানি বাংলার তৎকালীন পড়াশোনার পদ্ধতি এবং পাঠ্যক্রম নিয়ে। মুসলিম শিশুরা ছোট বয়সেই মক্তব এবং মসজিদের মাধ্যমে জ্ঞানের হাতেখড়ি লাভ করত। প্রায় মক্তবসমূহ মসজিদের সাথে সংযুক্ত থাকতো। আবার কিছু ক্ষেত্রে সমাজের অভিজাত শ্রেণি তাদের ঘরের মধ্যেও ছোটোখাটো মক্তবের ব্যবস্থা করত।


মুহাম্মদ ইয়াদান বখশ নামক এক মুহাদ্দিস মধ্যযুগে একডালা অঞ্চলে হাদিস শিক্ষা প্রদান করতেন। তার কাছে সে সময় বুখারি শরিফের তিনটা কপি ছিল। অর্থাৎ বোঝায় যাচ্ছে, তৎকালীন বাংলার মাদরাসাগুলোতে হাদিসের বইয়ের প্রচুর চর্চা হতো। ফিকহ তথা ইসলামি আইন সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জন ইসলাম চর্চার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ফিকহ সম্পর্কিত বিভিন্ন ইমামের বইসমূহ তৎকালে বিভিন্ন মাদরাসায় পড়ানো হতো। ফিকহের বেশির ভাগ বই লেখা হতো ফারসি ভাষায়। আর তাই ফারসি হয়ে ওঠে মধ্যযুগীয় বাংলার শিক্ষা প্রদানের ভাষা। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, ইসলাম চর্চার প্রাথমিক পর্যায়ে কুরআন, হাদিস ও ফিকহের চর্চা হতো বাংলার মাদরাসাসমূহে।

বাংলা, আরবি ও ফারসি এই তিন ভাষার মাধ্যমে তৎকালীন সময়ে শিক্ষার সমস্ত কার্যক্রম সম্পাদন করা হতো। কুরআনের ভাষা হিসেবে আরবি শিশু বয়স থেকেই সকলে শিখত। এ ছাড়াও মুসলিম শাসকদের আরবি শিক্ষার বেশকিছু নজির পাওয়া যায় তৎকালীন দলিল-দস্তাবেজের মাধ্যমে। আইন আদালতের ভাষা হিসেবে মধ্যযুগে প্রায় পুরোটা সময় ফারসি ভাষা ব্যবহৃত হতো। এ ছাড়াও কুরআন-হাদিস বাদে বাকি অন্যান্য শিক্ষা কার্যক্রম ফারসি ভাষাতেই পরিচালিত হতো। এমনকি সমস্ত ধর্মীয় কিতাবাদি লেখা হতো ফারসি ভাষায়। পনেরো ও ষোলো শতাব্দীর সময়ে বেশকিছু চীনা পরিব্রাজক বাংলা সফর করেন। তারা তাদের সফরনামায় এই অঞ্চলের বহুল ব্যবহৃত ভাষা হিসেবে বাংলা ও ফারসিকে চিহ্নিত করেন। বাংলার সুলতানরা তাদের দাপ্তরিক কাজের পাশাপাশি সাহিত্য রচনা এবং পড়ার জন্যও ফারসি ভাষা ব্যবহার করত। সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের সাথে পারস্যের কবি হাফিজের পত্র বিনিময়ের মাধ্যমে তা আরো স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়।

মুসলিম শাসকরা মাদরাসা থেকে জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি এসব মাদরাসায় বিপুল সাহায্যও প্রদান করত। সুলতানি বাংলার বিভিন্ন ফরমান থেকে দেখা যায়, বিভিন্ন সুলতানরা মাদরাসার শিক্ষকদের নানা সময় লাখেরাজ সম্পত্তি প্রদান করত। রাজশাহী অঞ্চলের কসবা বাঘা মাদরাসায় উনিশ শতকেও প্রায় ২৭৫০ বিঘা লাখেরাজ জমি ছিল। যা মাদরাসা কর্তৃপক্ষকে সুলতানি আমলেই প্রদান করা হয়েছিল। ব্রিটিশ আমলের আগপর্যন্ত বাংলার মোট ভূমির প্রায় ২০% মাদরাসা-মসজিদের জন্য লাখেরাজ সম্পত্তি হিসেবে বন্দোবস্ত ছিল। ফলে খুব সহজেই এই মাদরাসাসমূহ পরিচালিত হতে পারত এবং ছাত্রদের বিনা বেতনে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারত।


বাংলার সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ (১৩৯২-১৪১০ খ্রিষ্টাব্দ) কর্তৃক পবিত্র মক্কা নগরীতে এক মাদরাসা স্থাপন করা হয়। মক্কা নগরীর উম্মে হানি গেটের নিকটস্থ এই মাদরাসায় তৎকালে ইসলামের চার মাজহাবের আলোকেই পাঠদান করানো হতো। একেক মাজহাবে ইজতিহাদি বিষয়গুলো একেকভাবে ব্যাখ্যা করা হতো। ( হঠাৎ করে উদ্ভূত হওয়া ছোটোখাটো সমস্যাকে কুরআন ও হাদিসের আলোকে নিজস্ব চিন্তায় সমাধান করার প্রচেষ্টাকে ইসলামি শরিয়তে ইজতিহাদ হিসেবে গণ্য করা হয়। সাহাবি মুয়াজ ইবনে জাবালকে ইয়েমেনের গভর্নর হিসেবে প্রেরণকালে এই সাহাবির ইজতিহাদি ক্ষমতায় মুগ্ধ হন রাসূল (সা.)। সেই থেকে মুসলিম আইনে ইজতিহাদ এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে।) আর এই বিভিন্ন ব্যাখ্যা শেখার মাধ্যমে ছাত্রদের অনুধাবন ও দক্ষতাশক্তি ব্যাপক বৃদ্ধি পেত।

মক্কার এই মাদরাসার শিক্ষা কার্যক্রম বাংলা ভাষায় পরিচালিত হতো। কেননা, মক্কার এই মাদরাসার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তৎকালীন বাংলার বেশকিছু শাসক। আর তাই বলা যায়, ফিকহের পড়াশোনা তৎকালীন বাংলা অঞ্চলের মাদরাসাসমূহে ব্যাপকহারে করানো হতো। সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ হানাফি ফিকহ মতেই সকল কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। তার আগে-পরে বাংলা শাসন করা সব সুলতানই হানাফি মাজহাব মতে বিভিন্ন বিষয়ের সমাধান করতেন। কিন্তু পাশাপাশি ইসলামের অন্যান্য মাজহাবের ব্যাপারে সুলতানরা সহনশীল মনোভাব পোষণ করতেন। এ ছাড়াও হানাফি মাজহাবসহ বাকি তিন মাজহাবের শিক্ষা প্রদান কার্যক্রমেও সমান উৎসাহ প্রদান করতেন বাংলার তৎকালীন শাসকেরা। যার প্রমাণ হলো বাংলার সুলতান কর্তৃক নির্মিত মক্কার মাদরাসায় সব ধরনের ফিকহশাস্ত্র নিয়ে পাঠদানের ইতিহাস।

ধর্মীয় বিষয়াদির পাশাপাশি তৎকালে বাংলার মাদরাসাসমূহে পার্থিব বিষয়সমূহ নিয়েও পাঠদান চলত। যুক্তিবিদ্যা, চিকিৎসা, রসায়ন, গণিত, ভূগোল, জ্যোতির্বিদ্যার পাঠদানও মাদরাসাসমূহে করানো হতো। সুলতানি বাংলার এমন শিক্ষাক্রমের বিষয়টি পরবর্তী সময়ে বিখ্যাত মোঘল প্রশাসক আবুল ফজলের বর্ণনাতেও এসেছে। আবুল ফজল তার বইয়ে লেখেন, "বাংলার প্রতিটি ছাত্র নৈতিক শিক্ষার পাশাপাশি গণিত, ভূগোল, কৃষি, জ্যোতিষশাস্ত্র, ইতিহাস, পৌরনীতিতে সমান পারদর্শী হতো।" তৎকালীন মাদরাসাসমূহে উচ্চশিক্ষার জন্য দরকারি পার্থিব সকল বিষয়ের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা থাকত। বিষয়ের পাঠদানের ওপর ভিত্তি করে মাদরাসাসমূহকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে বিভক্ত করা হতো। চিকিৎসাবিষয়ক পাঠদানের মাদরাসাসমূহ প্রথম ক্যাটাগরির হিসেবে বিবেচিত হতো।

সুলতান জালালুদ্দিন ফতেহ শাহ (১৪৮১-১৪৮৬ খ্রিষ্টাব্দ)-এর সময়কালের এক দলিল থেকে জানা যায়, তিনি কাশফ তথা কুরআন-হাদিসের আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের প্রচেষ্টা চালাতেন। এ ছাড়াও আরো বেশকিছু সূত্র থেকে তৎকালীন সুলতানদের কুরআনের তাফসিরের জ্ঞান অর্জন, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব অধ্যায়ের নজির পাওয়া যায়। সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ একজন দক্ষ তিরন্দাজ ছিলেন। পাশাপাশি যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন এই সুলতান। কিন্তু এরপরেও জ্ঞান অর্জনের জন্য পিপাসু ছিলেন এই সুলতান। বিভিন্ন সময়ে তৎকালীন সেরা মাদরাসাসমূহে অবস্থান করে বেশকিছু বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন সুলতান আজম শাহ। সুলতান গিয়াসউদ্দিন ইওয়াজ খলজি (১২১২-১২২৬ খ্রিষ্টাব্দ) কর্তৃক বাংলার বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য মসজিদ, মাদরাসা ও সরাইখানা স্থাপন কর হয়। এই সকল প্রতিষ্ঠান স্বনির্ভরভাবে চলার জন্য তিনি অনেক লাখেরাজ সম্পত্তিও প্রদান করেন প্রতিষ্ঠানসমূহকে।


মধ্যযুগে নির্মিত বিভিন্ন স্থাপত্য এবং মসজিদের দেয়ালে বৈচিত্র্যময় কারুকার্যের সন্ধান পাওয়া যায়। অর্থাৎ সে সময়ে গ্রাফিতি ও চিত্রকর্মের ব্যাপক চর্চা হতো। ক্যালিগ্রাফি-বিষয়ক পড়াশোনা তখন মাদরাসাসমূহে করানো হতো। কেননা, তখন প্রিন্টিং প্রেস আবিষ্কৃত হয়নি। কিতাবসমূহ সুন্দরভাবে লেখার জন্য প্রচুর চাহিদা ছিল ক্যালিগ্রাফারদের। আর এই ক্যালিগ্রাফাররা পাশাপাশি মসজিদ এবং স্থাপত্যের দেয়ালেও তাদের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। সুলতানি আমলের বিভিন্ন দলিল থেকে দেখা যায়, বেশকিছু সুলতান তাদের নামের সঙ্গে "বাদিল" উপাধি গ্রহণ করতেন। আরবি শব্দ বাদিল দ্বারা বোঝানো হয়, আল্লাহর রাস্তায় অকাতরে দান করা ব্যক্তিকে। বাংলার বেশকিছু সুলতান এত অকাতরে মসজিদ-মাদরাসায় দান করতেন যে, তাদের নামের সঙ্গে "বাদিল" উপাধি যুক্ত হয়ে যায়। একইভাবে বেশ কয়েকজন সুলতান জ্ঞান অর্জন করে সুখ্যাতি অর্জন করেন। আর তাদের নামের সঙ্গে “ফাজিল” এবং “কামিল” উপাধি দেখা যায় বিভিন্ন দলিল-দস্তাবেজে।

আলিম, ফাজিল, কামিল, বাদিল, কাশফ সম্পর্কিত বিভিন্ন উপাধি সুলতানদের নামের সঙ্গে দেখা যেত। আর এই থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, মধ্যযুগে বাংলার সুলতানরা মাদরাসা এবং ধর্মীয় শিক্ষার সঙ্গে ব্যাপক আকারে জড়িয়ে ছিলেন। সুলতানদের শিক্ষার প্রধান মাধ্যম ছিল এই মাদরাসাসমূহ। আর এই মাদরাসাসমূহ থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানের সাহায্যে বাংলা অঞ্চলকে সুন্দরভাবে শাসন করতেন সুলতানরা। মধ্যযুগে মুসলিম বাংলার শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার পর আমাদের সামনে এটিই প্রতীয়মান হয় যে, সে সময় শিক্ষা কার্যক্রমে সরাসরি সুলতানিরা সাহায্য করতেন। সুলতানদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এসব প্রতিষ্ঠান উপমহাদেশের মধ্যে শীর্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। আর সুলতানি বাংলার (১২০৪ থেকে ১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত) সময়কাল বিবেচিত হতে থাকে এই অঞ্চলের স্বর্ণযুগ হিসেবে।

লেখকঃ ড. এ কে এম ইয়াকুব আলী
ভাষান্তরঃ সাইফুদ্দিন আহমেদ

পঠিত : ১২২০ বার

মন্তব্য: ০