Alapon

ইতিহাসের উত্থান ও পতন এবং কিছু কথা...



চেঙ্গিস খানের উত্থান কিভাবে? কিভাবে সে এত শক্তিশালী হয়ে উঠল এবং এমন সাম্রাজ্য রেখে যেতে পারল, যার মাধ্যমে পদানত হয়েছিল দুনিয়ার সকল সালতানাত, রাজ্য এবং খিলাফত? আসলে চেঙ্গিস খান যে অঞ্চলে বাস করত, তার পাশের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা ছিল মুসলিম সভতা। সমরকন্দ, বুখারা— মহান খাওয়ারিজম সাম্রাজ্য। বর্তমানে এটা উজবেকিস্তান ও তাজিকিস্তান।

খাওয়ারিজম সাম্রাজ্য এত উন্নত ও মহান ছিল এবং সেকালে তারা উন্নতির যে পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তা সত্যিই আশ্চর্যের, মনকে মুগ্ধ করার মত। যাহোক, চেঙ্গিস খানের ইচ্ছা মুসলিমদের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করবে। এ লক্ষ্যে সে কিছু ব্যবসায়ী ও দূত খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যে প্রেরণ করে। তার প্রতিনিধি দল প্রথমেই যে শহরে প্রবেশ করে, সে শহরের মুসলিম গভর্নর ন্যাক্কারজনক এক কাজ করে বসে। সে সকল মালামাল বাজেয়াপ্ত করে এবং এ দলের কয়েকজনকে হত্যাও করে। দূত ও ব্যবসায়ী দলের সাথে এমন অহংকারী ও অন্যায় আচরণের বিচার চেয়ে সরাসরি দূত পাঠান খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যের সুলতান— মুহাম্মদ খাওয়ারিজম শাহ-এর কাছে।

বুঝতে হবে, সেকালের খাওয়ারিজম সাম্রাজ্য এত বড় কিংবা সমগ্র মুসলিম উম্মাহর একক খিলাফাহ ছিল না। মুসলিম ইতিহাসের বেশিরভাগ খিলাফতের সময়েই দুনিয়ার বিভিন্ন মুসলিম অঞ্চলের শাসকেরা নিজেদের মত রাজ্য শাসন করত এবং একজনকে কেন্দ্রীয় খলিফা হিসেবে স্বীকৃতি দিত, তার হাতে বায়াত হতো। খাওয়ারিজম এমনই এক সাম্রাজ্য, কেন্দ্রীয় খিলাফত নয়। এখানকার সুলতান খাওয়ারিজম শাহ নিজের মতোই সাম্রাজ্য চালাতেন। তো, চেঙ্গিস খান তার কাছে বার্তা দিয়ে দূত পাঠালেন—
‘আপনার অমুক শহরের গভর্নর আমার লোকদের সাথে এমন কাজ করেছে। আমি আমার রাজ্যের পক্ষ আপনার কাছে অনুরোধ করছি, আপনি ঐ শহরের গভর্নরের বিচার করুন। সে আমার লোকদের হত্যা করেছে, এজন্য রক্তমূল্য দাবি করছি। আর আমার লোকদের যেসব মালামাল ঐ গভর্নর ছিনিয়ে নিয়েছে, সেগুলোও আপনি ফেরত দেবার ব্যবস্থা করুন।’

যে কারণেই হোক, সুলতান মুহাম্মদ খাওয়ারিজম শাহ চেঙ্গিস খানের পাঠানো রাষ্ট্রদূতদের হত্যা করে বসেন। আজকের যুগে যেমন রাষ্ট্রদূতদের নিরাপত্তা সুরক্ষিত, সেকালেও এমন ছিল—তাদের হত্যা করা বড় খারাপ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হত। কোন বার্তাবাহককে আঘাত করার অধিকার আপনার নেই। আমাদের ইসলামী শরীয়াহও তাদের সুরক্ষা নিশ্চিতের নির্দেশ দেয়। কিন্তু সকল যুগের কিছু শাসক ও রাজনীতিবিদরা এ নিয়মের ব্যাত্যয় ঘটান। তারা রাষ্ট্রদূত হত্যার মত অমর্যাদাকর কাজ করে বসেন, অহংকার কিংবা রাগের বশে। সুলতান খাওয়ারিজম শাহ কি ভেবে তাদের হত্যা করেছিলেন? হয়তো তারা কোন অপরাধ করেছিল কিংবা সুলতান হয়তো ভেবেছিলেন—
‘এরা আমার কী করবে? নতুন রাজা চেঙ্গিস আবার কে? তার কি এমন ক্ষমতা আছে? তার দাবি না মানলে সে কি করবে আমার!’

তিনি রাষ্ট্রদূতদের হত্যা করেই ক্ষান্ত হলেন না, তাদের কাটামুণ্ডু চেঙ্গিস খানের কাছে ফেরত পাঠালেন। ঐতিহাসিকরা লিখেন—
‘চেঙ্গিস খানের কখনোই নিজ অঞ্চলের বাইরে গিয়ে অন্য অঞ্চল দখল করবে। অন্য ভূখন্ড দখল করবে কিংবা বিশাল সাম্রাজ্য গড়বে। তার ইচ্ছা ছিল নিজের অঞ্চলের মানুষদের নিয়ে ভালোভাবে জীবনযাপন করা। কিন্তু সুলতান কর্তৃক রাষ্ট্রদূত হত্যার ঘটনাটি তার উত্থানের অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। এ ঘটনা তাকে এতোটা ক্ষুদ্ধ করে, এর রেশ ধরে তিনি একের পর এক সাম্রাজ্য দখল করতে শুরু করে, পরিবর্তন করে দেয় ইতিহাসের গতিপথ।’

এভাবে চেঙ্গিস খানের অন্তরে ক্ষমতাবান হওয়া, সাম্রাজ্য জয় করার সংকল্প চেপে বসে। তার মনে তৈরি হয় যেকোনো মূল্যে দুনিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাবান ও বিধ্বংসী সম্রাট হওয়ার অদম্য আকাঙ্ক্ষা। সতিকার অর্থেই তার প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্য মানবেতিহাসের সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যে পরিণত হয়েছিল। তার দুনিয়া দখলের মিশনের নির্মম ও বিধ্বংসী কার্যক্রমের অনুঘটক কি ছিল? —আমাদের একজন সুলতান কর্তৃক শরীয়া অমান্য করা। প্রচলিত কূটনৈতিক প্রটোকল এবং রীতিনীতি অমান্য করা। নিজের ব্যাপারে অহংকার এবং এমন একজনকে ছোট করে দেখা, যার ব্যাপারে তিনি ভেবেছিলেন— ‘সে কী করবে! সে নতুন একজন রাজা। আমি তার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী!’ আসলেই খাওয়ারিজম সাম্রাজ্য দুর্দান্ত ও অসাধারন ছিল, এজন্যই সুলতান অহংকার করেছিলেন, হত্যা করেছিলেন চেঙ্গিসের পাঠানো রাষ্ট্রদূতদের।

কিন্তু ফলাফল ছিল পুরো উম্মতের জন্য মারাত্মক! এ ঘটনার পর চেঙ্গিস খান সিদ্ধান্ত নিল— ‘এর শক্ত জবাব আমি দিয়েই ছাড়ব!’ সে তার সকল মোঙ্গল যোদ্ধাদের জমায়েত করল, ঐক্যবদ্ধ করল। এরা ছিল ভয়ানক যোদ্ধা! এরা এমন পদ্ধতিতে ঘোড়া চালাতো, যা দুনিয়ার অন্যদের থেকে ভিন্ন। তাদের অস্ত্রের আকার-আকৃতিও ছিল আলাদা ধরণের এবং মরণাত্মক। হ্যাঁ, মুসলিমরাও যুদ্ধ ও অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী, কিন্তু বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে এই বর্বর মোঙ্গলরা এগিয়ে ছিল। তাদের ধনুক ও তীর পাল্লায় এবং আঘাত হানায় অনেক বেশি কার্যকরী ছিল। তারা ঐক্যবদ্ধ হওয়ায় সংখ্যায়ও তারা এখন কম নয়। তাছাড়া তাদের মনে দুনিয়াকে পায়ের নিচে পিষে ফেলার অগ্নীসম জেদ বিরাজ করছে।

চেঙ্গিস খান তার বাহিনী নিয়ে সবার আগে আক্রমণ করলেন সমরকন্দ। তার রাজ্যের সবচেয়ে কাছের মুসলিম অধ্যুষিত শহর। এটি দিয়েই তার নির্মম ও বিধ্বংসী অভিযানের যাত্রা শুরু হল। সমরকন্দের পর সে ধ্বংস করেছিল সেই বুখারা, যে শহরে বসে ইমাম বুখারী তার ছাত্রদের সহীহ বুখারীর দারস দিতেন! ইমাম বুখারীর বুখারা। শত শত আলেম ও তালিবুল ইলমের পদচারণায় মুখর শহর বুখারা। আজকের যুগেও এ শহর নিজের ঐতিহ্য ও স্মৃতি নিয়ে দাড়িয়ে আছে। এ শহর দখল করে নিল চেঙ্গিস।

শহরের সবাইকে বুখারার গ্র্যান্ড মসজিদে এনে জমায়েত করল। ঘোড়ায় চড়ে, বুট পায়ে দিয়ে সে মিম্বারে গিয়ে বসল। বুখারার ঐ মসজিদ, ওই মিম্বার আজও টিকে আছে। চেঙ্গিস খান নিজের চোখ দিয়ে ১৫০ ফুট লম্বা মসজিদের যে মিনার দেখেছিল, সেখানে তা আপনিও দেখতে পাবেন। মসজিদের দেয়ালে কিছু পরিবর্তন আনা হলেও মিনারটি আগের মতোই আছে। যাহোক, চেঙ্গিস খান মসজিদের মিম্বারে বসল। সবাইকে উদ্দেশ্য করে ঐতিহাসিক এক ভাষণ দিল। তার ভাষণটি ছিল মোঙ্গলীয় ভাষায়, এটিকে পরে আরবিতে অনুবাদ করা হয়। সেদিন চেঙ্গিস কি বলেছিল?—
‘শুনো মুসলমানেরা! আমি তোমাদের জন্য তোমাদের রবের পাঠানো আজাব! কারণ তোমরা নিজেরা নিজেদের ধর্ম অমান্য করেছ। নিজ ধর্ম অনুযায়ী কার করোনি। এজন্যই তোমাদের রব আমাকে তোমাদের কাছে পাঠিয়েছেন, তোমাদের শাস্তি দিতে!’

তার বক্তব্যে গভীরতা ছিল বলতে হবে। এই বক্তব্যের পর শহরের অধিকাংশ নির্দোষ-নিরপরাধ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এ ছিল ভবিষ্যতের গণহত্যাগুলোর সূচনা। পরবর্তীতে তার বিজিত সকল শহরে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালায়, এমনকি শহর দখলের পরও। এটাই ছিল তার যুদ্ধের কৌশল। সে বুঝেছিল, কেবল মঙ্গোলীয় যোদ্ধাদের মাধ্যমে সারা দুনিয়া জয় করা সম্ভব নয়, এজন্য বিভিন্ন সাম্রাজ্যের শাসক ও জনগণের মনে ভয়ের সৃষ্টি করতে হবে।

চেঙ্গিস ছিল ইতিহাসের প্রথম ব্যক্তি, যে ভয় ও ত্রাসকে ‘আর্ট’-এ পরিণত করেছিল। ভয় ও ত্রাস ছড়িয়ে কিভাবে কোন মাত্রায় শত্রুর মনে ভীতি ঢুকাতে হবে, মনোবল ভেঙ্গে দিতে হবে, চেঙ্গিস তা খুব ভাল করে জানত। ভয় দিয়েই জয় করতে হবে—এ বাস্তবতা সে ভালো করে জানত। অনেক ঐতিহাসিক লিখেছেন,
‘ব্যক্তিগত জীবনে চেঙ্গিস খুব দয়ালু ও কোমল হৃদয়ের ছিল। শিশুদের প্রতি সে ভালোবাসা দেখাতো। কিন্তু একজন যোদ্ধা হিসেবে, শাসক হিসেবে, নেতা হিসেবে তার মত নির্মম ও কঠোর ব্যক্তি ইতিহাস আর দেখেনি।’

চেঙ্গিস তার নির্মমতাকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিল। ভয় ও ত্রাস সৃষ্টিতে তার কৌশল ছিল, পুরো শহরের সবাইকে হত্যা করা। তার পর এদের কাটামুন্ডুগুলো দিয়ে শহরের বাইরে পিরামিড বানানো। এ কৌশল কতটা কাজে আসত? এ শহরের পাশের শহরের নাগরিক, শাসক ও বাহিনির মনে এই ভয় ঢুকে যেত, ‘চেঙ্গিসের সামনে দাঁড়িয়ে পরাজিত হলে কেউ বাচবেনা, সবাই মরবে!’ ফলে তারা বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পন করত।

- আরিফুল ইসলাম

পঠিত : ৪৫৭ বার

মন্তব্য: ০