Alapon

"একজন শহীদ তিতুমীর এবং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম"



০১. তিতুমীর! বাঁশেরকেল্লা! এদুটো শব্দ একটি আবেগের নাম। একটি শক্তিশালী চেতনার নাম।

০২. বিপ্লব। জিহাদ-সংগ্রাম। তিতুমীর। এই শব্দগুলো যেনো একে অপরের সাথে ভীষণ অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তির বিরুদ্ধে নিজের সবটুকুন উজাড় করে দিয়ে কীভাবে ঈমানের তপ্ত-বারুদ জ্বালিয়ে বিদ্রোহ করতে হয়, কীভাবে জিহাদের জ্বালাময়ী জজবা প্রজ্জ্বলিত করতে হয়— তার উজ্জ্বল উদাহরণ হলেন এই তিতুমীর।

০৩. শহীদ মাওলানা তিতুমীর রহিমাহুল্লাহ শুধু মুসলমানদের নিকটই নয়, সারা পাক-ভারত উপমহাদেশের সকল মজলুমের নিকটই একটি চেতনার নাম। একটি সংগ্রামী চিত্রের নাম। পরিশুদ্ধ প্রেরণার প্রতিচ্ছবি নাম।

তিনি আমাদের হারানো স্বাধীনতাকে পুনরুদ্ধারের প্রবল আকাঙ্ক্ষায়, বৃটিশ দস্যুদের এই ভূখণ্ড থেকে উচ্ছেদের জন্য, এবং তাদের মদদপুষ্ট হিন্দু জমিদারদের নিপীড়ন থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে ১৮৩১ নারিকেলবাড়িয়ায় স্বাধীনতাকামী, ঈমানের শক্তিতে বলিয়ান একদল ঈমানদার মুজাহিদদের নিয়ে একটি মুজাহিদ শিবির স্থাপন করেন। ইতিহাসের সোনালি পাতায় তা ‘তিতুমীরের বাঁশেরকেল্লা’ নামে পরিচিত। বাঁশেরকেল্লার মুজাহিদদের এই বাহিনীকে তিনি প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। জিহাদের প্রেরণায় উজ্জীবিত করেন। সহজ কথায় আমরা যেটা জানি, সেটা হচ্ছে মাওলানা তিতুমীর নারিকেলবাড়িয়ায় বাঁশেরকেল্লা নির্মাণ করেন। সেখানেই তিনি বৃটিশ শাসন এবং তাদের মদদপুষ্ট হিন্দু জমিদারদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। শহীদ হন।

০৪. মূলত, মাওলানা তিতুমীর যখন বৃটিশ ডাকাত আর তাদের সেবাদাস তৎকালীন হিন্দু জমিদারদেরকে প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে নারিকেলবাড়িয়ায় বাঁশেরকেল্লা নির্মাণ করেন মুজাহিদদের প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্যে, তখনই বৃটিশ ডাকাতরা মাওলানা তিতুমীর রহিমাহুল্লাহ এবং তাঁর এই বিপ্লবী মুজাহিদ বাহিনী ও তাঁর কেল্লাকে দমন করতে উদ্যত হন। তদানীন্তন বড়লাট উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক এই বীর পুরুষ ও তাঁর অধীনে সংঘবদ্ধ জিন্দাদিল মর্দে মুজাহিদীনে কিরামকে দমন করার জন্য ১৮৩১ সালে ১৭ নভেম্বর লেফটেন্যান্ট কর্নেল স্টুয়ার্টের নেতৃত্বে বিরাট এক সামরিক বাহিনী প্রেরণ করেন। তাদের সাথে অত্যাচারী জমিদার গোবরডাঙার কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়, তারাগোনিয়ার রাজনারায়ণ, নাগপুরের গৌরীপ্রসাদ চৌধুরী এবং গোবরা-গোবিন্দপুরের দেবনাথ রায় ও তাদের পাইক-পেয়াদাদের একটি বড়ো বাহিনীও মিলিত হয়। একপর্যায়ে তারা তথা ইংরেজ ও তাদের তাবেদাররা আধুনিক মারণাস্ত্র ও গোলা দিয়ে আক্রমণ করেন সাহসী বীর শহীদ তিতুমীর এবং তাঁর মুজাহিদ বাহিনীর ওপর।

তাদের আঘাতে একপর্যায়ে শহীদ তিতুমীরের বাঁশেরকেল্লার প্রতিরোধ ক্ষমতা ভেঙে পড়ে। তবুও বীর মুজাহিদ তিতুমীর আত্মসমর্পণ বা পলায়ন করেননি। জালিমের বিরুদ্ধে বক্ষে বারুদ নিয়ে বীরবিক্রমে সিংহ-গর্জনে লড়াইটা চালিয়ে যেতে লাগলেন। একপর্যায়ে মাওলানা তিতুমীর ও তাঁর ৪০ জন অনুসারী সম্মুখ সমরে জিহাদ করতে করতে, প্রাণপণে লড়াই করতে করতে শহীদ হন।

০৫. তৎকালে ইংরেজ দস্যদুদের কাছে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ থাকলেও তিতুমীর এবং তাঁর বাহিনীর কাছে কোনো ধরনের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ছিলো না। তাঁদের কাছে ছিলো ঈমানের স্ফুলিঙ্গ। তাই তো তিনি ও তাঁর অনুসারীগণ কোনো প্রকার ভয়ডরের বাহুডোরে আবদ্ধ না হয়ে আল্লাহর ওপর ভরসা করে জিহাদে অবতীর্ণ হয়েছেন। জালিমের বিষদাঁত ভেঙ্গে দিতে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। অথচ আজকে আমাদের মুসলমানদের আলাদা স্বাধীন ভূখণ্ড আছে। আছে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রও। কিন্তু নেই ঈমান এবং উম্মাহ কনসেপ্ট! যার কারণে আমরা আজো মার খাচ্ছি। সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তির দালালি করে যাচ্ছি।

০৬. তিতুমীর নারিকেলবাড়িয়ায় শহীদ হলেও, সাময়িক পরাজয় বরণ করলেও আমাদের জন্য সাহসের যে শামিয়ানা টানিয়ে দিয়ে গেছেন, সে শামিয়ানায় শামিল হয়েই কিন্তু আমরা বৃটিশদের এই উপমহাদেশ থেকে বিতাড়িত করতে পেরেছি। তাঁর পথ ধরেই, তাঁর আবেগে উদ্দীপ্ত হয়েই এদেশের মানুষ জুলুমবাজ ও সাম্রাজ্যবাদি বৃটিশদের থেকে আল্লাহর অসীম অনুগ্রহে আমাদেরকে মুক্ত করেছেন। অথচ আজকে আমরা সেই তিতুমীরকেদের ভুলতে বসেছি! আমরা এ-ও ভুলে গিয়েছি যে, হিন্দু জমিদারগণ বৃটিশদের সহায়তায় মুসলিমদের ওপর এতো অধিক পরিমাণেই জুলুম করেন যে, মুসলিমগণ দাড়ি রাখার জন্যেও কর প্রদান করতে হতো।

০৭. তিতুমীর আমাদের নিজ অধিকার আদায়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সাহস আর অনুপ্রেরণার এক অপ্রতিরোধ্য উদাহরণের নাম। আল্লাহ রব্বুল আলামিন আমাদেরকে শহীদ তিতুমীর রহিমাহুল্লাহর মতো ঈমান এবং দেশপ্রেমের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম জারি রাখার তাওফিক দান করুন। আর বীর মুজাহিদ শহীদ তিতুমীর রহিমাহুল্লাহকে জান্নাতুল ফেরদৌসের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় দান করুন। আ-মী-ন।

০৮. আমাদের সাহসের স্ফুলিঙ্গ জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর এই বিপ্লবী সিপাহসালারের নাম সৈয়দ মীর নিসার আলী। তবে তিতুমীর নামেই তিনি সকলের কাছেই পরিচিত এবং সমাদৃত। শহীদ তিতুমীর রহিমাহুল্লাহ ১৭৮২ সালে পশ্চিমবঙ্গের বারাসাত জেলার চাঁদপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে (মতান্তরে বাদুড়িয়া থানার হায়দারপুর) জন্মগ্রহণ করেন। এই সিংস-শার্দুলের বাবার নাম সৈয়দ মীর হাসান আলী এবং মায়ের নাম আবিদা রুকাইয়া খাতুন।

শহীদ তিতুমীরের প্রাথমিক শিক্ষা-গ্রহণ করেন তাঁর নিজ গ্রামেরই একটি স্কুলে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থেকে পরবর্তীকালে তিনি তাঁর এলাকারই একটি মাদ্রাসাতে লেখাপড়া করেন।
তিনি একজন হাফেজে কুরআন। সাথে সাথে হাদিস-শাস্ত্রের একজন উঁচু মানের পণ্ডিতও ছিলেন। তিনি তিনি মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের হাফেজ হন যখন তাঁর বয়স ১৮ বছর, তখন। তিনি বাংলার পাশাপাশি উর্দু, আরবি ও ফার্সি ভাষাতেও সমানতালে ব্যুৎপত্তি লাভ করেন।

১০. এই যে শহীদ তিতুমীরের এতো ইলম, এতো জ্ঞান, এতো যোগ্যতা, তাঁর এই জ্ঞান ও যোগ্যতা তাঁকে কর্মমুখর করেছেন। তাঁর জ্ঞানার্জন কেবলই পুঁথিগত না, প্রায়োগিকও ছিলো। যার কারণে তিনি জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর মহান কাজ করা অবস্থাতেই শাহাদাতের সরাব পান করেছেন।

১১. মহান মালিক আমাদেরকে শহীদ তিতুর সত্যিকারের উত্তরসূরী বানিয়ে দিক। আমরা যেনো তাঁড় লিগ্যাসি বহন করতে পারি আমৃত্যু। আর এই বীর মুজাহিদকে আল্লাহ সুবহানাহু ও'তাআলা ফিরদাউসের মেহমান বানিয়ে দিন। আ-মী-ন!

~রেদওয়ান রাওয়াহা
২৭/০১/২২

পঠিত : ৪৭০ বার

মন্তব্য: ০