Alapon

আয়িশা রা. ও আলী রা.-এর মধ্যেকার ভয়াবহ যুদ্ধ



আলী রা. খিলাফতের দায়িত্ব নেয়ার পর সাহাবাদের মধ্য থেকে প্রথমে তালহা রা. ও যুবাইর রা. খলিফা হত্যার কিসাস দাবী করেন। আলী রা. তাদের বুঝালেন এবং বললেন, যেহেতু বিদ্রোহীরা মদিনার সর্বত্র বিরাজ করছে এবং তাদের সাপোর্টে একটা বড় সংখ্যক জনগণ রয়েছে তাই এটা সাবধানে করতে হবে। আগে রাষ্ট্রের সংহতি নিশ্চিত হোক, রাষ্ট্র কন্ট্রোলে আসুক তারপরে হত্যাকারীদের শনাক্ত ও শাস্তি দেওয়া যাবে। তালহা রা. ও যুবাইর রা. বুঝলেন ও ফিরে গেলেন।

তৎকালে মদিনার সাহাবীরা তিনটি দলে ভাগ হয়ে যান। একদল ছিল আলী রা.-এর পক্ষে। এরা মূল দল। তারা আলী রা.-এর সিদ্ধান্ত ও শাসনে খুশি ছিলেন। এদের মধ্যে প্রায় সবাই উসমান রা.-এর হত্যার বিচার চান। তবে পরিস্থিতি পূর্ণরূপে আলী রা.-এর নিয়ন্ত্রণে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে রাজি ছিলেন। উসমান রা.-এর সময়ের মিসরীয় ও বসরার বিদ্রোহীরাও আলী রা.-এর পক্ষে ছিলেন।

দ্বিতীয় দল কতিপয় সাহাবী রা.-এর নেতৃত্বে ছিল। এদের মধ্যে আয়িশা রা., যুবাইর রা., তালহা রা., মুয়াবিয়া রা. ছিলেন উল্লেখযোগ্য। উসমান রা.-এর হত্যার কিসাস তারা এখনই কার্যকরের ব্যাপারে আগ্রহী। আলী রা. এই সিদ্ধান্ত নিতে সময় নিচ্ছেন বিধায় তারা আলী রা.-এর বিদ্রোহী হয়ে উঠলেন। উমাইয়া পরিবারের প্ররোচনায় এই দলের কেউ কেউ আলী রা.-কে উসমান রা.-এর হত্যাকারী এবং হত্যাকারীদের শেল্টারদাতা হিসেবে মনে করতে লাগলেন। এখানে লক্ষ্যণীয় আবু বকর রা.-এর দুই সন্তান মুহাম্মদ ও আব্দুর রহমান রা. ছিলেন আলী রা.-এর পক্ষে অন্যদিকে অন্য সন্তান আয়েশা রা. ছিলেন বিপক্ষে।

তৃতীয় দল কোনো কিছু বুঝে উঠতে সক্ষম ছিলেন না। তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না বিধায় তারা নিরপেক্ষ থাকলেন। এদের সা'দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা., আবু হুরাইরা রা. এবং আবু মুসা আশআরি রা. ছিলেন উল্লেখযোগ্য। তারা কোনো পক্ষে অবস্থান না করে নিজের ঘরে অবস্থান করাটাকে শ্রেয় মনে করেছেন।

আলী রা. প্রথমে রাষ্ট্রীয় শৃংখলা ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনায় এবং বিদ্রোহীদের সংখ্যাধিক্যের কারণে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কিছুটা বিলম্ব করেন। এতে কেউ কেউ আলী রা.-এর প্রতি রুষ্ট হন। অন্যদিকে হজ্জের মওসুম হওয়ায় রাসূল সা.-এর স্ত্রীগণ সহ বহু সাহাবী হজ্জ পালনের জন্য মক্কায় ছিলেন। এভাবে চার মাস অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পর তালহা ও যুবায়ের রা. আলী রা.-এর ওপর বিরক্ত হয়ে মক্কায় গমন করেন। উম্মুল মুমিনিন আয়িশা রা. উসমান রা.-এর খুনীদের শাস্তির দাবীতে মক্কার হাতিমে অবস্থান ধর্মঘট শুরু করেন।

তাঁকে কেন্দ্র উসমান রা.-এর হত্যার বদলা চাওয়া লোকেরা জমায়েত হতে শুরু করলো। আয়িশা রা. আলী রা. বিরোধী শিবিরের অঘোষিত নেতা হয়ে গেলেন। তাদের দাবী উসমান হত্যার বদলা না নিয়ে এক মুহূর্তও শাসন ক্ষমতায় থাকা থাকা যাবে না। আগে খলিফা হত্যার বিচার করতে হবে। মদিনা থেকে মিশরীয় বিদ্রোহীদের শাস্তি দিয়ে বিতাড়িত করতে হবে ইত্যাদি। এদিকে বসরায় একদল লোক উসমান রা.-এর হত্যার প্রতিশোধ নিয়ে দল গঠন করলো। তাদের সাথে যুক্ত হতে চাইলেন মক্কায় খুনের বদলা নিতে চাওয়া লোকেরা। উসমান হত্যার ক্বিসাস গ্রহণের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য বসরায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং আয়েশা রা.-এর নেতৃত্বে মক্কা থেকে তালহা রা., যুবায়ের রা. প্রমুখ সাহাবী বসরার পথে রওয়ানা হন।

পথিমধ্যে আয়িশা রা. বসরার নিকটবর্তী ‘হাওআব’ নামক স্থানে পৌঁছলে কুকুর ঘেউ ঘেউ করতে থাকে। তখন তাঁর রাসূল সা.-এর হাদীসের কথা মনে পড়ে যায়। একদা রাসূল সা. তাঁকে বলেন, ‘তোমাদের মধ্যকার একজনের অবস্থা কেমন হবে, যখন হাওআবের কুকুর তার বিরুদ্ধে ঘেউ ঘেউ করবে? (হাকেম হা/৪৬১৩; আহমাদ হা/২৪২৯৯; ছহীহাহ হা/৪৭৪)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (ছাঃ) বলেন,

‘তোমাদের মধ্যে উটে আরোহণকারিনীর অবস্থা কি হবে, যখন সে বের হবে? অতঃপর তার বিরুদ্ধে হাওআবের কুকুরগুলি ঘেউ ঘেউ করবে? তার ডানে ও বামে বহু মানুষ নিহত হবে। এরপর কোন মতে সে প্রাণে রক্ষা পাবে’ (মুসনাদে বাযযার হা/৪৭৭৭; মাজমাঊয যাওয়ায়েদ হা/১২০২৬, সনদ সহীহ)। তখন আয়িশা রা. বাড়িতে ফিরে যাওয়ার মনস্থ করলেন। এমন সময় যুবায়ের রা. বললেন, না বরং আপনি সামনে অগ্রসর হন। লোকেরা আপনাকে দেখে হয়ত সন্ধিতে চলে আসবে। আল্লাহ আপনার মাধ্যমে হয়তো বিবদমান দু’টি দলের মধ্যে মীমাংসা করে দিবেন। তখন তিনি সামনে অগ্রসর হন’ (হাকেম হা/৪৬১৩; আহমাদ হা/২৪২৯৯; ছহীহাহ হা/৪৭৪)।

এই ঘটনাগুলো ৩৬ হিজরির কথা। ৩৫ হিজরিতে আলী রা. খলিফা হন। এরপর সিরিয়ার গভর্নর আলী রা. নির্দেশ না মানলে তিনি সিরিয়ায় সফর করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বসরায় সংগঠিত বিদ্রোহ ঠেকাতে তিনি সিরিয়ার দিকে না গিয়ে বসরার দিকে রওনা হন।

আলী রা. কা'কা' রা.-কে বসরায় তালহা ও যুবায়র রা.-এর কাছে দূতরূপে পাঠালেন সম্প্রীতি ও ঐক্যবদ্ধতার প্রতি আহ্বান জানিয়ে এবং বিভেদ-বিভক্তি ও দলাদলিকে ভয়ংকর সাব্যস্ত করে। কা'কা' রা. বসরায় পৌঁছেছে প্রথমে আয়েশা রা.-এর কাছে গিয়ে তাঁকে বললেন, আম্মাজান! আপনি কেন এদেশে এলেন? তিনি বললেন, 'প্রিয় বৎস! মানুষদের মধ্যে আপোস-মীমাংসার উদ্দেশ্যে। কা'কা' রা. তালহা ও যুবায়র রা.-কে ডেকে আনার আবেদন করলেন। তাঁরা উপস্থিত হলে কা'কা' রা. তাঁদের বললেন, “আমি উম্মুল মু'মিনীনকে এখানে আগমনের হেতু জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বলেছেন, মানুষদের মধ্যে আপোসরফা করার উদ্দেশ্যে। তারা দু'জন বললেন, আমরাও একই উদ্দেশ্যে এসেছি।

কা'কা' রা. বললেন, তবে আপনারা আমাকে অবহিত করুন, এ আপোসের পন্থা কী হবে? কিসের ভিত্তিতে হবে? আল্লাহর কসম! তা আমাদের বোধগম্য হলে আমরাও আপোসে সাড়া দিব। তারা দু'জন বললেন, উসমান হত্যাকারীদের বিষয়টি। কেননা, এটি বর্জন করা হলে তা হবে কুরআন বর্জন করা। কা'কা' বললেন, তাঁর হত্যাকারীদের মধ্যে বসরার লোকদের আপনারা হত্যা করেছেন। কিন্তু তাদের হত্যা করার পূর্বে আপনারা আজকের স্থিরতার চেয়ে অধিক স্থির পরিস্থিতির নিকটবর্তী ছিলেন। আপনারা ছয় শত জনকে হত্যা করলে ছয় হাজার তাদের পক্ষে দাঁড়িয়ে আপনাদের বর্জন করেছে এবং আপনাদের মধ্য হতে বের হয়ে গিয়েছে।

আপনারা হুরকুস ইবন যুহায়রকে (বসরার বিদ্রোহী নেতা) পাকড়াও করার জন্য সন্ধান করলে ছ'হাজার লোক তাকে রক্ষা করার জন্য দাঁড়িয়েছে। এখন যদি আপনারা তাদের ছেড়ে দেন তবে অন্যদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তুলেছেন আপনারা সে অপরাধে দায়ী হলেন। আর যদি আপনারা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং তারাও পাল্টা আঘাত হানে তবে তো আপনারা যে উদ্দেশ্যে সমবেত হয়েছেন এবং যা প্রতিরোধে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে আমি দেখতে পাচ্ছি তার চেয়ে যে বিষয়ের ভয়ে আপনারা ভীত-সন্ত্রস্ত তা অনেক সঙ্গীন রূপ ধারণ করবে। অর্থাৎ আপনাদের দৃষ্টিতে আপনাদের কাঙ্ক্ষিত বিষয় তথা উসমান হত্যাকারীদের হত্যা করা একটি কল্যাণকর্ম । কিন্তু তাতে এমন অকল্যাণ ও বিশৃংখলা জন্ম নিবে যা উক্ত কল্যাণের চেয়ে অধিক ভয়ংকর।

আর আপনারা যদি হুরকুস ইবন যুহায়র হতে উসমান হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে এ কারণে অক্ষম হয়ে থাকেন যে, তার হত্যাকারীদের হাত হতে তাকে সুরক্ষার জন্য ছয় হাজার লোক প্রস্তুত রয়েছে তবে তো চলমান পরিস্থিতিতে বর্জন করার ক্ষেত্রে আলী রা.-এর অপারগতা অধিক গ্রহণযোগ্য। তিনি তো উসমান হন্তাদের উপর কর্তৃত্ব বিস্তারে নিশ্চিন্ত হওয়া পর্যন্ত তাদের হত্যা করার পরিকল্পনা মুলতবি করেছেন মাত্র। কারণ, জনতার মনোভাব ও বক্তব্য বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন হয়ে রয়েছে। কা'কা রা. তাদের একথাও অবহিত করলেন যে, সংঘটিত এ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কারণে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে রাবী'আ ও মুযার গোত্রের এক বিশাল বাহিনী সমবেত হয়ে রয়েছে।”

এ পর্যায়ে উন্মুল মু'মিনীন আয়েশা রা. বললেন, তোমার মতামত কি? কা'কা রা. বললেন, আমি বলতে চাই, যা কিছু ঘটেছে তার প্রথম ওষুধ হলো পরিস্থিতি শান্ত ও নিয়ন্ত্রণ করা। পরিস্থিতি শান্ত হলেই ওরা ধরা পড়বে। কাজেই আপনারা আমাদের বায়'আত মেনে নিলে তা হবে কল্যাণের প্রতীক, রহমানের সুসংবাদের বার্তা ও হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের সময় চলে আসবে। আর যদি আপনারা হটকারীতাই করতে থাকেন এবং নতুন নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে থাকেন তবে তা হবে অকল্যাণের প্রতীক ও ইসলামের বিদায় ঘণ্টা। কাজেই শাস্তি-শৃংখলাকে অগ্রাধিকার দিন, তা প্রাপ্তির সুযোগ গ্রহণ করুন এবং যেমন পূর্বেও ছিলেন, কল্যাণের চাবিকাঠি হোন। আমাদের বিপদের মুখে ঠেলে দিবেন না, তাতে আপনারাও তার সম্মুখীন হবেন এবং মহান আল্লাহ্ আমাদের ও আপনাদের ধরাশয়ী করবেন।

তাঁরা বললেন, তুমি সুন্দর বলেছ ও সঠিক বলেছ। এখন ফিরে যাও। আলীও তোমার অনুরূপ মতামত নিয়ে আগমন করলে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। তখন কা'কা' রা. 'আলী রা.-এর কাছে ফিরে গিয়ে তাঁকে সব বিষয় অবহিত করলে বিষয়টি তাঁর মনঃপূত হলো এবং সমবেত জনতা আপোস-সন্ধির দিকে অগ্রণী হলো। যারা (অন্তরে) তা অপছন্দ করল তারা অপছন্দ করল এবং যারা পছন্দ করল তারা পছন্দ করল। আয়েশা রা. ও আলী রা.-এর কাছে এ মর্মে দূত পাঠালেন যে, তিনি আপোস-সন্ধির জন্যই এসেছেন। এতে উভয় পক্ষ আনন্দিত হলো। আলী রা. লোকদের সামনে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিলেন। ভাষণে তিনি জাহিলী যুগ ও তার অকল্যাণের কথা ও অপকর্মসমূহের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন এবং ইসলাম ও মুসলমানদের সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি ও দলবদ্ধতার সৌভাগ্যের কথা উল্লেখ করলেন।

তিনি আরও বললেন, আল্লাহ্ তা'আলা তাঁর নবীর ওফাতের পরে এ উম্মতকে খলীফা আবূ বকর সিদ্দীক রা.-এর নেতৃত্বে একত্রিত করে দিয়েছিলেন। তাঁর পরে উমর ইবনুল খাত্তাব রা.-এর নেতৃত্বে, তারপর উসমান রা.-এর নেতৃত্বে। তারপর এ দুর্ঘটনার সূত্রপাত হলো যা সমগ্র উম্মতকে ঘিরে ফেলেছে। একদল লোক দুনিয়ালোভী হয়ে মহান আল্লাহ্ বাদের দুনিয়ার নিয়ামত দান করেছেন তাদের প্রতি মহান আল্লাহ্ যে মাহাত্ম্য ও মর্যাদা দিয়ে অনুগ্রহ করেছেন তার প্রতি হিংসায় আক্রান্ত হলো। তারা ইসলামকে ও এ বিষয়গুলোকে পিছনে সরিয়ে নেওয়ার ইচ্ছা করল; মহান আল্লাহ্ অবশ্যই তাঁর কর্ম সম্পন্ন করবেন। পরে তিনি বললেন, শোন! আমি আগামী দিন সফর শুরু করব, তোমরাও বেরিয়ে পড়বে। যারা উসমান হত্যায় কোন কিছু দিয়ে কোন প্রকার অংশগ্রহণ করেছে তারা আমার সঙ্গে যাবে না।

আলী রা.-এর এই ঘোষণায় উসমান রা.-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা আড়াই হাজার বিদ্রোহী শঙ্কিত হয়ে পড়ে। আলী রা. বসরা থেকে চলে যেতে উদ্যত হলে তালহা রা. ও যুবাইর রা. বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পরিকল্পনা করে। এরপর আলী রা. তালহা ও যুবায়র রা.-এর কাছে পত্র পাঠালেন যে, তোমরা কা'কা' ইবন 'আমরকে যে কথার উপরে ফেরত পাঠিয়েছিলে তাতে অবিচল থাকলে হাত গুটিয়ে রাখো, যাতে আমরা অবস্থান নিয়ে বিষয়টির প্রতি নজর দিতে পারি। তাঁরা দুইজন পত্রের জবাবে অবহিত করলেন যে, মানুষের মধ্যে আপোসরফার যে কথার উপরে কা'কা' ই আমরকে ফেরত পাঠিয়েছিলাম আমরা তাতে অবিচল রয়েছি। এতে সকল মানুষ শান্ত ও নিশ্চিন্ত হলো এবং উভয় বাহিনীর লোকেরা তাদের সংগী-সাথী ও বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে মিলিত হলো।

সন্ধ্যায় আলী রা. আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন 'আব্বাস রা.-কে অপর পক্ষের কাছে পাঠালেন এবং তারা মুহাম্মদ ইব্‌ন তুলায়বা সাজ্জাদকে আলী রা.-এর কাছে পাঠাল। ফলে জনতা একটি সুখময় রাত অতিবাহিত করলো। তবে উসমান হত্যাকারীরা একটি ভয়ানক রাত অতিবাহিত করল। তারা রাতভর সলা-পরামর্শ করে কাটাল এবং শেষ রাতের আঁধারের মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তে উপনীত হলো।

সিদ্ধান্তমতে ফজরের সময় শুরু হওয়ার আগেই তাদের প্রায় দুই হাজার লোক উঠে পড়ল এবং প্রত্যেক উপদল তাদের আপনজনদের কাছে পৌঁছে তরবারি দ্বারা আক্রমণ চালাল। এতে প্রত্যেক উপদল আত্মরক্ষার জন্য নিজেদের বড় দলের কাছে ছুটে গেল। ঘুম ভাঙ্গা লোকেরা নিজ নিজ অস্ত্র হাতে তুলে নিল। তারা বলতে লাগল, কুফাবাসীরা (আলী রা.-এর বাহিনী) রাতের আঁধারে আমাদের উপর আক্রমণ করেছে এবং আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তারা ধারণা করল যে, আলী রা.-এর সঙ্গে আগতদের কোন একটি দল এ কাজ করেছে। আলী রা.-এর কাছে সংবাদ পৌঁছলে তিনি বললেন, লোকদের কি হয়েছে? লোকেরা বলল, বসরাবাসীরা আমাদের উপর আক্রমণ চালিয়েছে। এতে প্রত্যেক পক্ষ তার অস্ত্রের কাছে ছুটে গেল এবং বর্ম পরিধান করে অশ্বারোহী হলো। তাদের কেউই বাস্তবে কি ঘটেছে তা অনুধাবন করতে পারল না।

অশ্বারোহীরা দ্বন্দ্বযুদ্ধে লিপ্ত হলো। বীর বাহাদুররা চক্কর দিয়ে দিয়ে চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করল। যুদ্ধ তার নখর বসিয়ে দিল। এক সময় উভয়ে মুখোমুখি অবস্থানে দাড়াল।কঠিন যুদ্ধের প্রাক্কালে আলী রা. তালহা রা. ও যুবায়র রা.-এর সঙ্গে কথা বলার জন্য তাদের খোঁজাখুঁজি করলেন। পরে তাঁরা (যুদ্ধক্ষেত্রেই) সমবেত হলেন, এমনকি তাদের ঘোড়াগুলির ঘাড় পরস্পর মিলিত হলো।

আলী রা. যুবায়র রা.-কে বললেন, তোমাকে কে বের করে আনলো (বিদ্রোহী করল)? 'যুবায়র রা. বললেন, তুমিই। এছাড়া এ বিষয়ের জন্য আমি তোমাকে আমার চেয়ে অধিক যোগ্য অধিকারী মনে করি না। আলী রা. তাকে বললেন, সে দিনটির কথা কি তোমার মনে পড়ে যে দিন আমি রাসূলুল্লাহ্ -এর সঙ্গে বনু গুমের এলাকায় পথ চলছিলাম। তখন তিনি আমার দিকে তাকিয়ে হেসেছিলেন, আমিও তাঁর দিকে তাকিয়ে হেসেছিলাম। তখন তুমি বলেছিলে, ইব্ন আবু তালিবের গর্বিত আচরণ আর গেল না। তখন রাসূলুল্লাহ্ বলেছিলেন- “সে অহংকারী নয়, তুমি অবশ্যই তার সঙ্গে যুদ্ধ করবে এবং তখন তুমি তার প্রতি জুলুমকারী হবে।”

যুবায়র রা. বললেন, আল্লাহর কসম, হ্যাঁ (আমার মনে পড়েছে)। আগে তা আমার স্মরণে থাকলে আমি আমার এ সফরে বের হতাম না। এখন, আল্লাহর কসম! তোমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না। তখন যুবাযর রা. সারি ভেদ করে চলে যেতে লাগলেন। একই কথা আলী রা. তালহা রা.-কেও বললেন। তালহা রা.-ও যুদ্ধ না করে ফিরে যেতে চাইলেন। তিনি যুদ্ধ না করে ফিরে যাওয়ার সময় যুদ্ধক্ষেত্রেই একটি অজ্ঞাত তীর তাঁকে আঘাত করল- কথিত মতে মারওয়ান ইবনুল হাকাম সেটি মেরেছিল। মহান আল্লাহ্ সমধিক অবহিত। এই তীরের বিষক্রিয়ায় তিনি শাহদাতবরণ করেন। যুবাইর রা.-ও ফিরে যাওয়ার সময় যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে শাহদাতবরণ করেন।

আয়েশা রা. তাঁর হাওদায় বসে এগিয়ে চললেন এবং বসরার কাজী কা'ব ই সিওয়ারের হাতে একখানি কুরআন শরীফ তুলে তাকে বললেন, লোকদের এর দিকে আহ্বান করো। এটি ছিল সে সময় যখন যুবাইর রা. ফিরে গেলেন এবং তালহা রা. শহীদ হলেন এবং যুদ্ধের তীব্রতা প্রচণ্ড রূপ ধারণ করল। এক পর্যায়ে আয়িশা রা.-এর বাহিনী দুর্বল হয়ে পড়লো। আয়িশা রা. অবরুদ্ধ হয়ে পড়লেন। আলী রা. তাঁর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করলেন।

এ সময় 'আলী রা.-এর ঘোষক ঘোষণা প্রচার করলো- কোন পলাতকের পশ্চাদ্ধাবন করা হবে না। কোন আহতকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেওয়া হবে না, বাড়িঘরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা যাবে না। 'আলী রা. একদল লোককে আয়িশা রা.-এর বাহনটি নিহতদের মধ্য হতে সরিয়ে আনার নির্দেশ দিলেন। তাঁর ভাই মুহাম্মাদ ইবন আবূ বকর রা. ও আম্মার রা.-কে একটি তাঁবু লাগিয়ে দেওয়ার আদেশ দিলেন। ভাই মুহাম্মদ ‘আয়েশা রা.-এর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কোন আঘাত লাগেনি তো? তিনি বললেন, না। আর তাতে তোমার কি এসে যায়? 'আম্মার রা. তাঁকে সালাম করে বললেন, 'মা, কেমন আছেন আপনি? আয়েশা রা. বললেন, 'আমি তোমার মা নই।'

আম্মার রা. বললেন, অবশ্যই, যদিও আপনার অপছন্দ হয়। এ সময় আমীরুল মু'মিনীন আলী রা. তাঁর কাছে এলেন এবং সালাম করে বললেন, মা, কেমন অবস্থায় আছেন? 'আয়েশা রা. বললেন, ভালো। আলী রা. বললেন, আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন! এ সময় অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও গোত্রপতি-দলনেতাগণ এসে উম্মুল মুমিনীন রা.-কে সালাম করতে লাগলেন।

রাত ঘনিয়ে এলে উম্মুল মু'মিনীন আয়িশা রা. বসরা শহরে প্রবেশ করলেন। তখন তাঁর সঙ্গে ছিল তার ভাই ও বিপক্ষ দলের মুহাম্মদ ইবন আবূ বকর রা.। তিনি বসরার বৃহত্তম বাড়ি আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন খালাফ খুযা'ঈর বাড়িতে অবতরণ করলেন। খুঁজে খুঁজে উভয় পক্ষের আহতদের বসরার শহরে নিয়ে যাওয়া হলো। আলী রা. ঘুরে ঘুরে উভয়পক্ষের নিহতদের দেখতে লাগলেন। এর মধ্যে তালহা রা.-এর লাশ দেখতে পেয়ে খুবই কষ্ট পেলেন। তাঁর জন্য প্রশংসাসূচক কবিতা বলতে লাগলেন।

মুসলিমদের জন্য ভয়ংকর খারাপ দিন হলো বসরার এই যুদ্ধ। ইতিহাসে এই যুদ্ধের নাম উটের যুদ্ধ নামে পরিচিত। আয়িশা রা. উটের পিঠে চড়ে এই যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে এমন নামকরণ করা হয়েছে। এই যুদ্ধে অগণিত মুসলিম শাহদাতবরণ করেন। বহু মুসলিমের হাত-পা কর্তিত হয়। অনেকেই মুসলিম ভাইকে খুন না করে হাত-পা কেটে পরাজিত করতে চেয়েছেন। তাই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। যুদ্ধের পরে আয়িশা রা. অনুতপ্ত হয়েছেন। যুদ্ধ না করে আলী রা.-এর সাথে সরাসরি আলোচনা করে কর্মপন্থা নির্ধারণ করা সঠিক হতো বলে রায় দিয়েছেন।

আলী রা.-এর পক্ষে ছিলেন প্রায় ২০ হাজার সৈন্য। তাঁর পক্ষের কমান্ডাররা হলেন, হাসান রা., হুসাইন রা., আম্মার রা., মুহাম্মদ বিন আবু বকর রা., আব্দুর রহমান বিন আবু বকর রা., আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা., আবু কাতাদা রা., আবু আইয়ুব আনসারী রা. ইত্যাদি

অন্যদিকে আয়িশা রা.-এর পক্ষে ছিলেন প্রায় ৩০ হাজার সৈন্য। তাঁর পক্ষের কমান্ডাররা হলেন, মারওয়ান, ওয়ালিদ ইবনে উকবা, আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর রা., মুহাম্মদ ইবনে তালহা রা., উমাইয়া ইবনে খালাফ ইত্যাদি। তালহা রা. ও যুবাইর রা. কমান্ডার ছিলেন কিন্তু তারা যুদ্ধ করেননি।

উভয় পক্ষে মৃত্যুবরণ করেন আড়াই হাজার সৈন্য। আহত হন পাঁচ হাজারেরও বেশি সৈন্য।

পঠিত : ৫২৩ বার

মন্তব্য: ০