Alapon

সালামের সংস্কৃতি ও ইসলামী ছাত্রশিবির




ছাত্রশিবিরের ভাইদের যে জিনিসটি আমার কাছে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে আজকে তা আপনাদের সাথে শেয়ার করবো, ইন শা আল্লাহ!

গতানুগতিক আরো আট-দশজনের মতো আমিও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নেগেটিভাবেই জেনেছি বা তাদের সম্পর্কে নেগেটিভ বার্তাটা পেয়েই প্রথমদিকে তাদেরকে জেনেছি । কিন্তু সেটা খুব বেশি ভয়াবহরকম অবস্থার ছিলো না। এর পেছনে অবশ্য কয়েকটা কারণ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো, সে সময় মিডিয়া আজকের মতো এতোটা এভেইলেবেল ছিলো না। সোশ্যাল মিডিয়া তো বলতে গেলে একেবারেই ছিলো না। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ছিলো, কিন্তু গ্রামের দিকে সবখানে কারেন্টও আবার ছিলো না। ছিলো না ডিশ-এন্টেনাও।

আবার অন্যদিকে সাংগঠনিক কাজ কিংবা দাওয়াতও খুব জোরালো ছিলো না আমাদের গ্রামে, আমাদের ইউনিয়নে (অবশ্য এখনো তেমন নেই)। যার কারণে কোনোরকম জানাশোনা হয়নি পজিটিভলি। আবার নেগেটিভ বার্তাটাও সব সময় আহামরি কানে বাজেনি। যেভাবে ২০১১ থেকে ১৪-১৫ এর দিকের উঠতি তরুণদের কানে বাজতো আরকি।

মনে হয় এলাকায় একবার রাজনৈতিক গণ্ডগোল বাঁধায় এলাকার মানুষ শিবির সম্পর্কে ভীষণ ভীতিকর কিছু আলাপ তুলেছিলো বা কথাবার্তা বলতেছিলো, কোনোভাবে সে আলাপগুলোই এসেছে আমার কানে। মনে হয় আমার প্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় মেজো আপুর কাছ থেকেই স্পষ্টভাবে সেই বার্তাগুলো প্রথম পেয়েছি আমি। মানে তারা রগ-টগ কেটে দেয়, খুনোখুনি করে। খুব ভয়ানক তারা, বা এই ধরনের কিছু আরকি।

অবশ্য আমাদের থেকে কয়েক বছরের জুনিয়র প্রজন্ম বা আমাদেরই সামসময়িক শহুরে প্রজন্ম মিডিয়ার হলুদ সাংবাদিকতার কল্যাণে তাদেরকে বর্বর জঙ্গি-সন্ত্রাসী, দেশ বিরোধী স্বাধীনতার শত্রুসহ ইত্যাদি নানান রকম ভয়ানক রূপে জেনেছে বিভিন্ন কাটছাঁট করা সংবাদ তথ্য-উপাত্ত ও ভিডিওর মাধ্যমে । যাকগে, সেটা ভিন্ন আলাপ।

আমি তাদেরকে সেবারই প্রথম জানলাম আরকি। সম্ভবত ২০০২/৪ সাল হবে তখন। তো জানার পর এভাবেই কেটে গেলো অনেকগুলো দিন। এবার আমি বাবা-মায়ের সিদ্ধান্তে এবং আমার সম্মানিত নানাজানের আগ্রহে প্রাইমারি স্কুল থেকে মাদরাসায় ভর্তি হই মহাগ্রন্থ আল-কুরআন হিফয করতে। সেখানেও একটা পর্যায়ে দুয়েকজন শিক্ষক জামায়াতে ইসলামী এবং ছাত্রশিবির সম্পর্কে নেগেটিভ বার্তাই দিয়েছেন। তবে প্রধান শিক্ষক পজিটিভ ছিলেন। কখনো নেগেটিভ বার্তা ছড়াননি। মাদরাসাটি যে এলাকায়, সেখানে ইসলামী ছাত্রশিবিরের ভাইদের আনাগোনা বা চলাচল ছিলো ব্যাপকতর। যেহেতু পাশেই বাজার এবং সেখানে শিবিরের অফিসও।

তো প্রায়শই ভাইদেরকে দূর থেকে দেখতাম। কখনো কাছাকাছিই দেখা হতো। দেখেই খুব বেশি ভালো লাগতো। যদিও চেহারা-সুরত এক্সট্রিমলি হ্যান্ডসাম বলতে যা বুঝায়, সেরকম কিছুই ছিলো না। কিন্তু তাদের চেহারায় আলাদা একটা নূর অনুভব হতো, ভালো লাগতো। তাদের সাথে দেখা হলে বা সামনে পড়লে আমাদেরকে তাঁরাই আগে সালাম প্রদান করতেন। মিষ্টি করে “হাফেজ সাহেব ভাইয়া” বলে ডাক দিতেন। কুশালাদি বিনিময় করতেন। আমরা কখনোই তাঁদেরকে আগে সালাম দিতে পারিনি। তাঁরাই বরং আগে সালাম দিয়ে দিতেন। মাঝেমধ্যে কিশোরকন্ঠ নিয়ে আসতেন। পড়তে বলতেন। (তবে, মাদরাসায় কিশোরকণ্ঠ পড়া বা রাখা মোটামুটি নিষেধই ছিলো। সুযোগ পেলে অবশ্য আমরা কিশোরকণ্ঠ ক্রয় করে রাখতাম, এবং চুপচাপ পড়তামও।) কখনো কখনো কিশোরকন্ঠ নিয়ে গেইটে দাঁড়িয়ে থাকতেন তাঁরা। আর সাথে মুখে মিষ্টি হাসি তো একদম ফ্রি। লেগেই থাকতো। এই যে কিশোর কন্ঠ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, এই যে মিষ্টি হাসির মাদকতায় কুশলাদি বিনিময়ের মাধ্যমে আমাদের মন ভরিয়ে রাখা, এটা বেশিরভাগ বিকেলেই হতো। কারণ, তখন খেলার সময়।

আমি ছোট্ট মানুষ। একটা অবুঝ কিশোর। তাঁদের বিপ্লবী মন-মানসিকতা, তাঁদের কুরবানি, দীন আর আদর্শের জন্য তাঁদের ডেডিকেশনের আগাগোড়া কিছুই জানিনা। বরং যেটুকুন জানি, সবটাই খারাপ। তো সেসব না বুঝলেও কিন্তু তাঁদের একটা জিনিস খুবই মন কাড়তো, হৃদয়টা ছুঁয়ে যেতো। সেটা হচ্ছে তাঁদের অমায়িক ব্যবহার। আমি এত্তো ছোট্ট হবার পরেও তাঁরাই আগে সালামটা দিয়ে দিতেন। এবং সালামটাও দিতেন পূর্ণভাবে, সুন্দর করে। কৃত্রিমতাহীন।

অথচ আমাদের সমাজে সালামের বিষয়টা ধরা হয় এমন যে, অভিজাত লোকেরাই শুধু নিম্নশ্রেণীর মানুষের কাছ থেকে সালাম পাবে! এগুলোই আমরা দেখে এসেছি বা এখনো দেখে যাচ্ছি এমনটা! এদিকে আবার যারা দুজনই সামসময়িক বা সমানে সমান, তারা আবার ইগোর কারণে আগে সালাম প্রদান করতে পারেনা। সালাম করতে তাদের মনে যেনো রাজ্যের অনীহা এসে বাসা বাঁধে। এরপর আবার শহুরে জীবনে অভ্যস্ত যারা, তারা তো স্রেফ পরিচিতজনকেই কেবল সালাম করে। এর বাহিরে তারা কখনো ভাবেনা। চিন্তাও করেনা। অথচ রাসুল স. বলেছেন,
‘যে আগে সালাম করে সে অহংকার মুক্ত’।
এবং তিনি আরো বলেছেন
“আল্লাহর কাছে উত্তম আমল হচ্ছে পরিচিত অপরিচিত সকলকেই সালাম করা, এবং ক্ষুধার্তকে খাবার খাওয়ানো”।



আরেকটা বিষয় হচ্ছে, এক সময় দেখতাম ফোন করলে সবাই “হ্যালো” বলে সম্বোধন করতো। কিন্তু ছাত্রশিবিরের ভাইয়েরা হ্যালোর বদলে “আসসালামু আলাইকুম” বলতো। এভাবে মোবাইল ফোনের যুগে তাঁরা সালামের সংস্কৃতিকে চালু করেছে ব্যাপকভাবে । সালামকে তাঁরা এতোটাই ব্যাপক করেছে যে, মানুষের ঘরের দরজা, বাসা-বাড়ির গেইটে ইংরেজি-আরবি এবং বাংলাতে সালাম সম্বলিত স্টিকার লেগে থাকতো। সালাম সম্বলিত নানান ধরনের ডিজাইনের স্টিকার-কার্ড পর্যন্ত তৈরি করেছে তাঁরা। এমনকী আমরা ছোট্টবেলায় ভাইদের থেকে সেসব স্টিকারগুলো গিফটও পেতাম। পরবর্তীতে ঘরের দরজায় সেটা সেঁটেও দিতাম। অবশ্য একপর্যায়ে দেখলাম চরমোনাইয়ের পীর সাহেবের ছাত্র মুরিদানও এমন স্টিকার তৈরি করে ছাত্রসমাজের কাছে ছড়িয়ে দিয়েছে।

এরপর ফেসবুক কিংবা মেসেঞ্জারের যুগেও অন্যান্যরা যখন হুট করেই সালাম ছাড়া কথাবার্তা শুরু করে দিতো, সে সময়ও কিন্তু বিকল্প দেখেছি ছাত্রশিবির করে আমাদের এমন ফ্রেন্ডদেরকে। তারা আগে সালাম প্রদান করেই ম্যাসেজ করতো। এরপর শুরু হতো বাকি আলাপ।

ওহ, একটা কথা ! এখন তো আবার “হায় ব্রো, হায় মাম্মা” ইত্যাদির যুগ। এটাতে তরুণ তো বটেই, এমনকী তরুণীরাও একে অন্যকে এখন এভাবেই সম্বোধন করে কথা বলে বা তাদের কনভারসেশন শুরু করে। যা থেকে অবশ্য শিবিরের বহু বহু জনশক্তিরাও হয়তো মুক্ত নয়। ইভেন ক্রিয়েটিভ-ইন্টেলেকচুয়াল সাজতে চাওয়া কওমি ছাত্রদের মধ্যেও অবশ্য এর ভাইরাস ঢুকে পড়েছে। এই ভাইরাস বিমুক্ত হোক মুসলিম উম্মাহ। শুদ্ধতার প্রাণ প্রবাহে ভরে ওঠুক সবার হৃদয়। সবার অন্তর। এটাই কামনা মন থেকে।


সালামের ব্যাপারে উৎসাহ দিতে, সালামের সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দিতে ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক বিভাগ “সমন্বিত সাংস্কৃতিক সংসদ- সসাস” এর উদ্যোগে একটা গানও তৈরি করেছে ২০১৫ সালে। যা ‘লাল ফড়িং’ নামক একটা অ্যালবামে ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয়েছে। এবং গানটা খুবই জনপ্রিয় ছিলো। গানটি অবশ্য লিখেছেন কবি ও শিশু সাহিত্যিক শ্রদ্ধেয় বেলাল হোসাইন নূরী ভাই। সুর করেছেন মুহতারাম আল মিযান। গানটা হচ্ছে এই-


দেখা হলেই সালাম করো
সালাম হলো ভালো থাকার দোয়া।
প্রথমে যে সালাম করে
হৃদয়টা তার জোসনা দিয়ে ধোয়া॥

আসসালাম- আসসালাম
আসসালামু আলাইকা-আসসালাম

কাউকে যদি সত্যি সালাম করো
দূরের মানুষ কাছের হবে
আপন হবে পরও
ভালবাসার রঙ মেখে ভাই
পাবে তুমি ফেরদাউসের ছোঁয়া॥

সালাম পাবে ছোট-বড় সবে
মা-বাবাকেও সালাম দিতে হবে

কাউকে তুমি চেনো বা না চেনো
সে-ও তোমার সালাম পাবে
ভুল কোরো না যেন
মনটা তখন উদার হবে
থাকবে না আর অহংকারের ধোঁয়া॥


এই যে নানাভাবে নানান উদ্যোগে সালামের সংস্কৃতিকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া, জড়তা-সংকোচ কিংবা অহংকার ছাড়া যে কাউকেই সালাম প্রদান করার মতো সুন্দর গুণাবলি বা উদার মানসিকতা, সাথে মুখে সর্বদা মিষ্টি হাসির মাদকতা লেগেই থাকা; এই বিষয়টির জন্য আমার কাছে ছাত্রশিবিরকে অনেক বেশি ভালো লেগেছে সে সময়ে। যদিও এখন তাঁদের কিছু কিছু সর্বোচ্চ শপথের কর্মীদের মধ্যেও এসব দীনি মূল্যবোধ সম্পন্ন আচরণ বা শুদ্ধ সংস্কৃতির ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে, তথাপি এই সংস্কৃতিকে বাংলাদেশে ছাত্র-সমাজের কাছে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটা কিন্তু তারাই করেছে। আল্লাহ তাঁদের কাজে অগণিত বারাকাহ ঢেলে দিক। ইসলামের পূনর্জাগরণে আরো বেশি বেশি ভূমিকা পালন করার তাওফিক দান করুন।

আমি চাই তাদের মধ্যে এসব দীনি মূল্যবোধ ও সুন্দর সংস্কৃতির আরো বিকাশ ঘটুক। শিবির তাদের সীমাবদ্ধতাগুলোকে কাটিয়ে উঠুক। দ্বীনের পথে পূর্ণভাবে অগ্রসর হোক। অটল থাকুক দীনে মুবিনের ওপর। আ-মী-ন! এবং গ্রামের মতো শহরের মধ্যেও পরিচিত-অপরিচিত সকলকেই সালাম প্রদান করার অভ্যেস সৃষ্টি হোক। এতে আত্মকেন্দ্রীক এই সমাজে মানুষে মানুষে মুহাব্বত বাড়বে। সম্পর্ক মজবুত হবে। আর তা সৃষ্টি হোক ছাত্রশিবিরের ভাইদের মধ্য থেকেই। তাদের হাত ধরেই। কাউকে না কাউকে তো শুরুটা অবশ্যই করতো হবে, তাই না? এই শুরুটা তাদের হাত ধরেই হোক। এই প্রত্যাশা কি বেশি কিছু? মনে হয় না। কারণ, তাঁরা এই ঘুণেধরা সমাজটাকে কিন্তু অনেক কিছু দিয়েছে। সে হিসেবে এই প্রত্যাশা কিন্তু বেশি কিছু না। প্রত্যাশা তো ভালোবাসার মানুষদের কাছেই থাকে। তাই না? চলুন, তাহলে প্রত্যাশার সাথে প্রপ্তির মেলবন্ধনের জন্যে কাজটা শুরু করি। হৃদয়টাকে জোসনা দিয়ে ধুয়ে ধুয়ে আলোকিত করি। আর সে আলোর আবগাহনে পরিশুদ্ধ আর প্রস্ফুটিত হয়ে উঠুক এ ধরা। আলোয় আলোয় ভরে যাক তিমির-কুহেলিপূর্ণ আমাদের এ সমাজ । এই বিশ্ব।


~ রেদওয়ান রাওয়াহা

পঠিত : ৩৮৮ বার

মন্তব্য: ১

২০২৩-০২-০১ ০৭:৫৩

User
polash

apnake fb te dekha jayna onk din.... alapone dheke vhalo laglo.

submit