Alapon

তিনি হলেন সেই নারী যাকে স্বয়ং আল্লাহ 'সালাম' দিয়েছিলেন জিব্রাইলের (আলাইহি ওয়া আসসালাম) মাধ্যমে...



মক্কার বিত্তশালী নারী (কিভাবে হলেন তা নিয়ে আছে মতপার্থক্য), ব্যবসায়-বাণিজ্যের মাধ্যমে জীবন চালাতেন, কিন্তু কাফেলা তো নিজে নিয়ে যেতে পারতেন না এতো দূরের জায়গায়, এর জন্য দরকার পড়তো লোকের, যে কিনা তার হয়ে কাফেলা পরিচালনা করবে এবং লভ্যাংশের একটা অংশ পাবে কিন্তু লোকেরা ছিলো লোভী, মিথ্যা কথা বলে হাতিয়ে নিতো কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা, বিষয়টা ভাবিয়ে তোলে খাদিজাকে (রাদ্বি আল্লাহু আনহা)। ব্যবসায় কিছুটা ক্ষতিও হয়ে যায় অনেক সময়।
বিশ্বস্ত মানুষের খোঁজে যখন তিনি ব্যস্ত তখন তার কাছে রাসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নাম উঠে আসলো, তিনি তখন নবী ছিলেন না। তিনি তাকে প্রস্তাব দেন কাফেলা পরিচালনা করার এবং রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এতে রাজি হয়ে যান।
.
'আল-আমীন' নামে মক্কাবাসী একজন মানুষেকেই জানতো আর তিনি হলেন আমাদের রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। কাফেলা নিয়ে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সিরিয়ায় গেলেন এবং ব্যবসায়-বাণিজ্য শেষ করে ফিরে আসলেন মক্কায়। কাফেলার মালিক খাদিজাকে (রাদ্বি আল্লাহু আনহা) বুঝিয়ে দিলেন তার প্রাপ্য টাকাগুলো। রাসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিশ্বস্ততায় মুগ্ধ হয়ে গেলেন তিনি!
.
তিনি ততকালীন মক্কার একজন বিচক্ষণ, বুদ্ধিমতী ও দৃঢ়চেতা নারী ছিলেন। তার ধনসম্পদ, ভদ্রতা ও লৌকিকতায় মক্কার সর্বস্তরের মানুষ মুগ্ধ ছিলো। তার স্বামী মারা যাওয়ার পর কুরাইশদের অনেক যুবক বিবাহের জন্য প্রস্তাব পাঠালেও সবগুলোই নাকচ করেন।
রাসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিশ্বস্ততা তাকে প্রচুর মুগ্ধ করে, তাই বান্ধবী নাফিসাকে দিয়ে রাসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান।
অন্যদিকে পিতৃহীন রাসুলুল্লাহর (সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলো না তেমন ধন-সম্পত্তি। নাফিসা তার ঘরে এসে বললেন 'আপনি বিয়ে করছেন না কেনো?' জবাবে বললেন 'বিয়ে করার মতন সামর্থ্য নেই এখন।' নাফিসা তখন খাদিজার (রাদ্বি আল্লাহু আনহা) পাঠানো বিয়ের প্রস্তাবের কথা বললেন এবং রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার চাচার সাথে কথা বলার পর রাজি হয়ে যান এবং খাদিজাকে (রাদ্বি আল্লাহু আনহা) বিয়ে করেন।
.
বিয়ের পনেরো বছর হয়ে গেছে। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হেরা গুহায় যাতায়াত করতেন মাঝেমাঝে সেখানে থেকে যেতেন, মাঝেমাঝে খাদিজাও (রাদ্বি আল্লাহু আনহা) খাবার নিয়ে সেখানে যেতেন। একদিন রাসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সামনে একজন মানুষরূপে কেউ একজন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি তাকে দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি তাকে বললেন 'পড়ুন' রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জবাব দিলেন 'আমি পড়তে পারি না', জবাব শুনে সেই লোক তাকে সজোড়ে জড়িয়ে ধরলেন এবং একই কথা আবার বললেন, রাসুলুল্লাহ আবার একই জবাব দিলেন, আবার তাকে চেপে ধরলেন এবং ছেড়ে দিলেন এবং বললেন 'পডুন' রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবারো বললেন 'আমি পড়তে পারি না' এবার বললেন "পড় তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন......।"
.
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভয়ে দৌঁড়ে হেরা গুহা থেকে বাড়িতে চলে আসলেন এবং বললেন 'আমাকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দাও, আমাকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দাও'। এই কথা শুনে খাদিজা (রাদ্বি আল্লাহু আনহা) দৌঁড়ে এসে রাসুলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঢেকে দিলেন এবং তাকে অভয় দিতে লাগলেন এবং তার ভয় আস্তে আস্তে দূর হলো।
তিনি খাদিজাকে (রাদ্বি আল্লাহু আনহা) সব খুলে বললেন এবং জীবনের আশংকার কথা ব্যক্ত করলেন। জবাবে খাদিজা (রাদ্বি আল্লাহু আনহা) কি বললেন জানতে চান? তাহলে শুনুন, তিনি বললেন 'আল্লাহ আপনাকে লাঞ্চিত করবেন না। আপনি আত্মীয়তার বন্ধন সুদৃঢ়কারী, গরীব-দুঃখীদের সাহায্যকারী, অতিথিপরায়ণ ও মানুষের বিপদে সাহায্যকারী।'
তারপরে তাকে নিয়ে তিনি ওরাকা বিন নাউফালের কাছে গেলেন, নাউফাল ঘটনা শুনে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে শেষ নবী তার বার্তা দেন।
.
তিনি হলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি সর্বপ্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। সালাত ফরজ না হওয়ার আগেও তিনি রাসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে সালাত আদায় করতেন।তার অর্জিত টাকা পয়সা সব ইসলামের জন্য ব্যয় করেন। মুশরিকদের প্রত্যাখ্যান ও অবিশ্বাসের কারণে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে ব্যথা অনুভব করে ঘরে ফিরতেন, খাদিজার (রাদ্বি আল্লাহু আনহা) কাছে ফেরার পর তা দূর হয়ে যেতো, তিনি রাসুলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অভয় এবং সাহস দিতেন এবং মুশরিকদের এসব কর্মকান্ড তুচ্ছভাবে তার সামনে তুলে ধরতেন।
.
তিনি ৬ জন সন্তান জন্মদান করেন। ১)কাসিম ২)যাইনাব ৩)আব্দুল্লাহ ৪)রুকাইয়্যা ৫)উম্মে কুলসুম ৬)ফাতিমা (রাদ্বি আল্লাহু আনহু আজমাইন)।
.
মক্কার মুশরিকরা যখন মুসলিমদের বয়কটের ঘোষণা দিয়েছিলো তখন খাদিজা (রাদ্বি আল্লাহহ আনহা) তার স্বামীর সাথে অন্য জায়গায় চলে যান যদিও বয়কটের নিয়মানুসারে খাদিজা (রাদ্বি আল্লাহু আনহা) সেটার মধ্যে পরতেন না। সেখানে দুর্দিন পার করেন এতে তিনি অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েন। বয়কট শেষ হওয়ার পর মক্কায় ফিরে আসার কিছুদিন পরেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার নিজ হাতে তাকে দাফন করেন।
.
মক্কার ধনবতী মহিলা হওয়া সত্ত্বেও স্বামীর সেবা করে গেছেন নিজ হাতে। ধনসম্পত্তি সব কিছু সঁপে দিয়েছিলেন স্বামীর কাছে এমনকি তার দাস যাইদ ইবনে হারিসাকেও (রাদ্বি আল্লাহু আনহু)।
সবাই যখন রাসুলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অবিশ্বাস করেছিলো খাদিজা (রাদ্বি আল্লাহু আনহা) তখন বিশ্বাস করেছিলেন, সবাই যখন রাসুলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ব্যথিত করতো খাদিজা (রাদ্বি আল্লাহু আনহা) তখন তার ব্যথিত হৃদয়কে প্রফুল্ল করে দিতেন। খাদিজা (রাদ্বি আল্লাহু আনহা) জীবিতাবস্থায় রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আর কোন বিয়ে করেননি।
.
নবুওতের উপর ওপর প্রথম বিশ্বাস স্থাপনকারী এবং সালাত আদায়কারী ছিলেন না শুধু, ঘোর দুর্দিনে ইসলামের জন্য তিনি যে শক্তি যুগিয়েছেন তা ইসলামের ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণের কালি দিয়ে লিখা আছে।
.
খাদিজার (রাদ্বি আল্লাহু আনহা) মৃত্যুর পর তিনি তাকে ভুলেননি, তার স্মৃতি মনে রাখার জন্য খাদিজার (রাদ্বি আল্লাহু আনহা) আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক রাখতেন, খবর নিতেন। তার কাছে কিছু থাকলে তাদের কাছে উপহার পাঠাতেন। মদিনায় হা'লা (রাদ্বি আল্লাহু আনহা) যখন তার ঘরে বেড়াতে এসেছিলেন তখন তার মন ফিরে গিয়েছিলো মক্কার জীবনে, তাতক্ষণিক খাদিজার কথা মনে পড়ে গিয়েছিলো।
.
দুনিয়ায় থাকা অবস্থাতেই তিনি পেয়েছিলেন জান্নাতের সুসংবাদ এবং তিনি হলেন ইসলামের সর্বপ্রথম জান্নাতের সুসংবাদ লাভকারী ব্যক্তি। রাসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্ত্রীগণের মধ্যে খাদিজা (রাদ্বি আল্লাহু আনহা) হলেন সর্বোত্তম।
.
রাসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভাষ্যমতে পৃথিবীতে অনেক পুরুষ তাদের ঈমান নিখুঁত করেছেন কিন্তু ইতিহাসের পাতায় মাত্র ৪ জন নারী তাদের ঈমান নিখুঁত করেছেন আর তাদের মধ্যে থেকে একজন হলেন 'খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ' (রাদ্বি আল্লাহু আনহা)।
.
'খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ' (রাদ্বি আল্লাহু আনহা)।
.
- ওয়াহিদুল হাদী।

পঠিত : ২৪৬ বার

মন্তব্য: ০