আন্দালুস: হারানো ফিরদাউস
তারিখঃ ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ২২:৫০
১৪৯২ সালের আজকের তারিখ, অর্থাৎ ২ জানুয়ারি গ্রানাডার পতনের মাধ্যমে স্পেনের মাটিতে মুসলিমদের প্রায় ৮০০ বছরের শাসনামলের পতন ঘটে। মুসলিম স্পেন পরিচিত ছিলো ‘আন্দালুস’ নামে। বর্তমানে স্পেনিস লা-লিগায় যেসব শহরের নামে দল খেলে, সেই গ্রানাডা, ব্যালেন্সিয়া, কর্ডোভা, মালাগা, সেভিয়া, মাদ্রিদের রাজত্ব করতো একসময় মুসলিমরা।
মুসলিম শাসনামলে আন্দালুস ছিলো শিক্ষা, চিকিৎসা, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিতে ইউরোপের তীর্থস্থান। এখন যেমন মুসলিম দেশগুলোর শিক্ষার্থীরা জ্ঞানার্জনের জন্য, চাকরির জন্য পাড়ি জমায় ইউরোপ-আমেরিকায়, তখনকার সময়ের শিক্ষার্থীরা পাড়ি জমাতো কর্ডোভায়। ইউরোপের খ্রিস্টান লাইব্রেরিতে বইয়ের সংখ্যা ছিলো যখন মাত্র ৬০০ টি, মুসলিম শাসিত কর্ডোভায়ই তখন ছিলো ৬০০ টি লাইব্রেরি। তারমধ্যে সবচেয়ে বড়ো লাইব্রেরিতে বইয়ের সংখ্যা ছিলো প্রায় ৪,০০,০০০।
আন্দালুসের রাজধানী কর্ডোভা এমন সমৃদ্ধ এক শহর ছিলো যে, বিশ্ববাসী সেই শহরকে সুন্দর একটি ডাকনাম দেয়- ‘The Ornament of the World’ বা পৃথিবীর অলঙ্কার-রত্ন।
দশম শতাব্দীতে ক্যাথোলিক চার্চের নেতা, পোপ সিলভেস্টার দ্বিতীয় পড়ালেখা করার জন্য যান আন্দালুসে। জ্ঞান-বিজ্ঞানে আন্দালুসের খ্যাতি ছিলো জগদ্বিখ্যাত।
এরকম একটি সমৃদ্ধশালী শাসনামলের পতন হয় যতোটা না বহিঃশত্রু দ্বারা, তারচেয়ে বেশি ঘরের শত্রু ‘মীর জাফরদের’ দ্বারা। ক্ষমতার মোহে একেক অঞ্চলের শাসকরা একেক অঞ্চলের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হতেন। কখনোবা মুসলিম শাসককে পরাজিত করার জন্য ডেকে আনতেন পার্শ্ববর্তী খ্রিস্টান শাসককে। খ্রিস্টানদের সাথে হাত মিলিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তেন আরেক মুসলিম শাসকের বিরুদ্ধে। খ্রিস্টান বন্ধুর (!) সাথে হাতে হাত মিলিয়ে যুদ্ধে বিজয় লাভ করার পর খ্রিস্টান বন্ধুটি বিজেতা মুসলিম বন্ধুকে একটি চমক দিতো। বিজেতা মুসলিম শাসককে হত্যা করে একসাথে দুটো রাজ্য লাভ করে নিতো সে! ১৪৬৯ সালে ইতিহাসের অন্যতম একটি বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। ইসাবেলা অব ক্যাস্তিলিয়ার সাথে ফার্ডিন্যান্ড অব অ্যারাগনের বিয়ে। বিয়েটি পড়ান স্বয়ং পোপ! এই জুটিটি মুসলিম স্পেনের কফিনে শেষ পেরেকটি ঢুকায়।
আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ দ্বাদশ, স্প্যানিয়ার্ডের কাছে পরিচিত ছিলেন বোয়াব্দিল নামে। তিনি ছিলেন শাহজাদা। ইসাবেলা-ফার্ডিন্যান্ড জুটি আবু আব্দুল্লাহকে বানায় খেলার চাল। পিতা আবুল হাসানের বিরুদ্ধে পুত্রকে ক্ষেপিয়ে তোলা হয় রাজ্য দেবার আশায়। ১৪৮২ সালে আবু আব্দুল্লাহ বাবাকে উৎখাত করে গ্রানাডার আমির হোন! ১৪৮৬ সালে চার বছর পর তাকেই বন্দী করে ক্যাস্তিলিয়রা। পুত্রের বন্দীদশায় বাবা আবার ক্ষমতায় আরোহণ করেন।
একবছর পর খ্রিস্টানরা আবু আব্দুল্লাহকে ছেড়ে দেয়। তবে ছেড়ে দেবার আগে তার কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করে নেয়। আবু আব্দুল্লাহ খ্রিস্টানদের রাজনৈতিক আনুগত্য করবেন। আবু আব্দুল্লাহ যদি খ্রিস্টানদের আনুগত্য করেন, বিনিময়ে খ্রিস্টানরা তাকে গ্রানাডার আমির বানাবে। আবু আব্দুল্লাহ এবার বিদ্রোহ করলেন আপন চাচার বিরুদ্ধে! খ্রিস্টানদের কবল থেকে মালাগাকে রক্ষা করতে যেই চাচা আল জাগাল প্রাণপণে লড়ে যাচ্ছেন, সেই চাচার বিরুদ্ধে আবু আব্দুল্লাহর বিদ্রোহ! ১৪,০০০ মানুষকে হত্যার মাধ্যমে খ্রিস্টানরা মালাগা বিজয় করে। বাকি থাকলো গ্রানাডা, মুসলিম স্পেনের শেষ আশ্রয়স্থল। এই গ্রানাডাকে পাবার লোভে আবু আব্দুল্লাহ বাপ-চাচার বিরুদ্ধে খ্রিস্টানদের সাথে জোট বেঁধেছিলেন।
কথায় আছে- ঋণের শেষ, আগুনের শেষ, শত্রুর শেষ রাখতে নেই। খ্রিস্টানরা পুরো আন্দালুস শাসন করবে, আর মাঝখানে একাংশ মুসলিমদের জন্য ছেড়ে দিবে? তারা যদি আবার মাথাচড়া দিয়ে উঠে?
২৫ নভেম্বর ১৪৯১, ফার্ডিন্যান্ড আবু আব্দুল্লাহর বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠায় গ্রানাডা দখলের জন্য। যেই খ্রিস্টান ‘বন্ধুর’ প্রতিশ্রুতি পেয়ে আবু আব্দুল্লাহ নিজের বাপ-চাচার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন, সেই খ্রিস্টান বন্ধু কিনা এবার তাকে উৎখাত করতে চাচ্ছে! আবু আব্দুল্লাহ হয়তোবা ভুলে গিয়েছিলেন কুরআনের নির্দেশনা, যে নির্দেশনা মনে থাকলে তার এমন পরিণতি হতো না।
“হে মুমিনগণ! তোমরা ইহুদি ও খ্রিস্টানদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু।” [সূরা আল-মায়িদাহ ৫: ৫১]
১৪৯২ সালের ২ জানুয়ারি, আগের রাতে মানুষ ঘুমিয়েছিলো আল-হামরার প্রসাদে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র পতাকা উড়তে দেখে। ঘুম ভেঙ্গে তারা দেখতে পেলো আল-হামরার প্রসাদে সেই পতাকাটি নেই, সেখানে ঝুলানো রূপার তৈরি ক্রুশ। ১৪৯২ সালের ২ জানুয়ারি, আজকের এই দিনে আল-হামরা প্রসাদে সর্বেশষ উড়েছিলো তাওহীদের পতাকা। সেদিন সকালবেলা মুসলিমরা আত্মসমর্পণ করে। আবু আব্দুল্লাহ তার পুরনো ‘বন্ধু’ ফার্ডিন্যান্ড আর ইসাবেলার হাতে তুলে দেন আল-হামরার চাবি।
বাপ-চাচার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে গ্রানাডার আমির হওয়া আবু আব্দুল্লাহকে যেদিন গ্রানাডা থেকে বের করে দেওয়া হয়, সেদিন তিনি বারবার পেছনে ফিরে তাকাচ্ছিলেন। তার এমন কাপুরুষতা, বিশ্বাসঘাতকতা দেখে তার মা আয়েশা বলেছিলেন:
“পুরুষ হয়ে তুমি যা রক্ষা করতে পারোনি, নারীর মতো কেঁদে তা ফিরে পাবার আশা করো না।”
আবু আব্দুল্লাহ গ্রানাডার পতনের ৪০ বছর পর পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। গ্রানাডা থেকে নির্বাসিত হবার সময় গ্রানাডায় রেখে এসেছিলেন তার বড়ো ছেলে আহমদকে। রাজবন্দী হয়ে রাজ দরবারেই থেকে যান আহমদ। আহমদ, যার দাদা ছিলেন আন্দালুসের মুসলিম শাসক, সেই আহমদ পরবর্তীতে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেন!
মুসলিম শাসনামলে আন্দালুসে অবস্থানরত ইহুদি-খ্রিস্টানদের সাথে মুসলিমরা সহনশীল আচরণ করেছে। এমনকি ১৪৯২ সালে ফার্ডিন্যান্ড-ইসাবেলা খ্রিস্টান রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে সেখানকার ইহুদিদেরকে নির্বাসনে পাঠায়। নির্বাসিত ইহুদিদের জন্য দরজা খুলে দেন অটোম্যান সুলতান দ্বিতীয় বায়োজিদ। নির্বাসিত ইহুদিদেরকে পরবর্তীতে থাকতে দেন ইস্তাম্বুল।
গ্রানাডার পতনের সময় আন্দালুসের মুসলিমদের সংখ্যা ছিলো ৬-৭ লক্ষ। নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে ইসাবেলা-ফার্ডিন্যান্ড প্রথম দিকে মুসলিমদের প্রতি সহনশীন আচরণের চেষ্টা করেন; রাজ্যটি গড়ে তুলতে মানবসম্পদের দরকার আছে।
মুসলিমদের মধ্যে যারা স্বেচ্ছায় খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করতে চায়, তাদেরকে নানারকম প্রণোদনা দেওয়া হতো। তাদেরকে স্বর্ণ, ঘোড়া সহ বিভিন্ন মূল্যবান উপহার দেওয়া হতো। কিন্তু দেখা গেলো, কিছু কিছু মুসলিম লোক দেখানো খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করে, উপহার পেয়েও লুকিয়ে লুকিয়ে নামাজ পড়তে থাকে!
১৫০২ সালে বিজেতা খ্রিস্টান শাসকরা সহনশীলতার মুখোশ ছুঁড়ে ফেলে তাদের আসল রূপ দেখাতে লাগলো। মুসলিমদের উপর তারা চড়াও হতে লাগলো। মুসলিমদেরকে দেওয়া হলো তিনটি অপশন।
খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করা
স্পেন ছেড়ে চলে যাওয়া
মৃত্যুবরণ করা।
মুসলিমদের সংখ্যালঘু হিশেবেও নির্বিঘ্নে ধর্ম পালনের কোনো সুযোগ ছিলো না, মুসলিমদের মসজিদগুলোকে চার্চে পরিণত করা হয়। অনেকেই খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য হয়, কেউ কেউ প্রকাশ্যে খ্রিস্টান, গোপনে মুসলিম থেকে যাবার চেষ্টা করলো। খ্রিস্টানরা বিভিন্ন আইন করে মুসলিমধের অধিকার হরণ করতে থাকে।
১৫১১ সালে ইসলামি নিয়মে পশু জবাই নিষিদ্ধ করা হয়।
১৫১৩ সালে মুসলিম মহিলাদের মুখ ঢাকা নিষিদ্ধ করা হয়।
১৫২৩ সালে ‘মুসলিমদের মতো’ পোশাক পরিধান নিষিদ্ধ করা হয়।
মুসলিমরা যাতে লুকিয়ে নামাজ পড়তে না পারে, সেজন্য শুক্রবারে সবার ঘরের দরজা খোলা রাখতে বলা হয় ১৫২৬ সালে আরবি ভাষার ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়, সবাইকে বাধ্য করা হয় ক্যাস্তিলিয়ান ভাষায় কথা বলতে; এমনকি ঘরের মধ্যেও।
এতো কিছুর পরও মুসলিমদের নাম-নিশানা শেষ করা যাচ্ছিলো না। গোপন মুসলিম থেকেই যাচ্ছিলো। তারা বাধ্য হয়ে রোববার চার্চে যেতো, বাসায় ফিরে নামাজ পড়তো, কুরআন তেলাওয়াত করতো। যে প্রজন্ম ইসলামকে চিনেছে, শিখেছে তারা না হয় এভাবেই ধর্মপালন করে গেলো। কিন্তু তাদের পরবর্তী বংশধরদের তো সেই আবেগ থাকবে না, কারণ তারা বড়ো হবে খ্রিস্টান পরিচয়ে।
১৬০৯ সাল, আন্দালুসের পতনের ১১৭ বছর অতিক্রান্ত হবার পরও যেসব মুসলিমরা জেদ ধরে নীরবে ইসলাম পালন করে যাচ্ছিলেন, তাদের ব্যাপারে শেষ সিদ্ধান্তে আসেন রাজা তৃতীয় ফিলিপ। তিনি নির্দেশ দেন স্পেনের মাটিতে আর কোনো মুসলিম থাকতে পারবে না; নামে হোক বা বেনামে।
৩ দিনের সময়। মুসলিমরা যেনো তল্পিতল্পা নিয়ে হয় অটোম্যান সাম্রাজ্যে চলে যায়, নতুবা উত্তর-আফ্রিকায়। প্রায় ১০০ বছর আগে আন্দালুসে মুসলিমদের সংখ্যা ছিলো যেখানে ৬-৭ লক্ষ, ১০০ বছর সেখানে মুসলিমদের আর কোনো অস্তিত্বই রইলো না!
আন্দালুস: হারানো ফিরদাউস
আরিফুল ইসলাম

মন্তব্য: ০