Alapon

| গ্লুকোমা : নীরব ঘাতক |




পূব আকাশ ভেদ করে ক্রমেই এগিয়ে আসছে লালচে সূর্য। তুলোর মতো উড়ছে শ্বেতকায় মেঘগুলো। ভোরের স্নিগ্ধ সমীরণে সবুজ পত্রপল্লব দোল খাচ্ছে। ঘাসের ডগায় শিশির বিন্দু সূর্যের সমস্ত রঙ ধারণ করে চিকচিক করছে। হালকা কুয়াশা শুভ্রতা ছড়িয়ে যাচ্ছে। এরপর বেলা গড়িয়ে তপ্ত দুপুর, শ্রান্ত বিকেল, শান্ত গোধূলি বা কোটি নক্ষত্রপুঞ্জ ঘেরা বিশাল আকাশ। কিংবা রিমঝিম বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটার ধরিত্রীর সংস্পর্শে যাওয়া! রঙবেরঙের কত কী না আছে এই দুনিয়া জুড়ে। সবুজ গাছপালা, ফসলের মাঠ, পাকা সোনালী শস্য, নীল আকাশ, নানারঙের মেঘ, বাহারি রঙের পোশাকাদি, হরেক রঙের নানান জিনিস।
বোধকরি এত এত রঙের জন্যই পৃথিবীটা এত সুন্দর। যেই মানুষটা জন্ম থেকেই দেখতে পারে না তার পৃথিবী পুরো অন্ধকার। রঙ নেই, নেই আলো, চারপাশে সবই কালো। কী ভীষণ কষ্টে তারা জীবন কাটান। চোখ খুলে একটি বারের জন্য মাকে দেখতে পারে না, পারে না বাবাকে দেখতে। ভাই-বোন, স্ত্রী, সন্তান কাউকেই দেখা হয় না। আচ্ছা এই আঁধার জগতের মানুষরা কী কল্পনা করতে পারে? তারা কি বুঝবে নীল রঙ কেমন, বা লাল রঙ কেমন? হয়তো না! অসহনীয় এক কষ্টের মাঝে জীবন পার করে দেয় তারা।

আপনি আলহামদুলিল্লাহ চোখে দেখেন। চোখ মেলেই মাকে দেখেছেন, বাবাকে দেখেছেন, দেখেছেন সকল কিছু। হঠাৎ যদি আপনার চোখের আলো নিভে যেতে শুরু করে, কমে আসে আপনার দৃষ্টি, অন্ধকার হয়ে যায় দুনিয়া? এক নীরব ঘাতক যদি আপনার চোখে বাসা বাঁধে! ফলে ধীরে ধীরে আপনি হারিয়ে যান অন্ধকারের অতল গহব্বরে! আর তাই যদি আর মাকে দেখতে না পান, দেখতে না পান আদরের সন্তানকে? দেখতে না পান লাল, নীল রঙ, ভোরের সূর্য, মেঘের ভেলা, সবুজ বৃক্ষ, যদি না দেখেন কিভাবে বৃষ্টির ফোঁটা মাটি স্পর্শ করে, যদি না দেখেন সাতরঙা রঙধনু, বাহারি রঙের প্রজাপতি, পশু-পাখি, নানানরকম ফুল ফল যদি আর রঙের আভা ছড়িয়ে আপনাকে যদি আনন্দ না দেয়? কেমন লাগবে তখন?
আপনার নতুন এই অবস্থার সাথে খাপ খাওয়াতেও পাড়ি দিতে হবে বন্ধুর পথ। যখন আপনার প্রিয় মানুষটি দেখবে আপনি নিজ হাতে কিছু ধরতে পারছেন না যতক্ষণ না আপনার হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে, আপনাকে তারা আর নতুন জামা পরে দেখাতে পারবে না, জিজ্ঞেস করতে পারবে না মানিয়েছে কিনা? তখন তাদেরই বা কেমন লাগবে? বিশ্বাস করুন তাদের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মত না। তাদের কষ্ট অবর্ণনীয়! যেহেতু তারাও জানে না কিভাবে একজন চোখ হারা মানুষকে সহায়তা করতে হয়, কিভাবে সাহারা হতে হয়? ফলে তাদেরও কষ্ট হবে মানিয়ে নিতে।

মানুষ সাধারণত দুর্ঘটনা, ছানি আর এক নীরব ঘাতকের কারণে। ছানির অপারেশন করে চোখ ঠিক করা গেলেও নীরব ঘাতকের কবল থেকে আর ফেরানো যায় না চোখকে। কোন সেই নীরব ঘাতক যা দৃষ্টি শক্তি কেড়ে নিয়ে যায় স্থায়ী অন্ধত্বের দিকে, আলোহীন করে দেয় রঙীন দুনিয়াকে?

গ্লুকোমা! রঙ মুছে দেয়া এক নীরব ঘাতক! চিরস্থায়ী কৃষ্ণ গহ্বরের প্রবেশ দ্বার। আলোহীন দুনিয়ায় নিয়ত ঠোকর খাওয়ায় যে ঘাতক ! গ্লুকোমা প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে চিকিৎসা চালিয়ে নিয়ে আমৃত্যু চোখের জ্যোতি ধরে রাখা যায়। আর যদি একদম শেষ পর্যায়ে এসে ধরা পড়ে তখন কিছুই করার থাকে না। অনেক কারণেই গ্লুকোমা হতে পারে। কারো কারো জন্মগত গ্লুকোমা থাকে, কারো বংশগত কারণে হয়। আবার দীর্ঘ দিন ধরে চোখে ছানি থাকলে, উচ্চ রক্তচাপ থাকলে এমন কি চোখের প্রেশার বেশি থাকলেও গ্লুকোমা হয়।

আমাদের দুই চোখের দৃষ্টি সম্মুখ ভাগে তো থাকেই আবার পাশেও অনেকখানি দেখতে পাই আমরা। প্রায় ১৮০° পর্যন্ত। কিন্তু গ্লুকোমা হলে প্রথমে চারপাশের দৃষ্টি কমে আসে। পাশ দিয়ে যদি কোনো মানুষ হেঁটে যায় বা কোনো যানবাহন যায় একজন গ্লুকোমা রোগী বুঝতে পারে না। একই ভাবে দরজা দিয়ে বেরুতে লাগলে বুঝতে পারে না দরজার চৌকাঠ কোথায়, প্রায়ই দরজা দিয়ে বেরুনোর সময় হাতে বাড়ি খায়। এভাবে দৃষ্টি কমতে কমতে একসময় ক্ষীণ হয়ে আসে। বরাবর সামনে সামান্যই দেখতে পায়। ধীরে ধীরে দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যেতে থাকে। চিকিৎসা না করালে একসময় অবশিষ্ট দৃষ্টিটুকুও চিরতরে হারিয়ে যায়।

আমরা অনেকেই চোখের প্রেশার সম্পর্কে ধারণা রাখি না। চোখের চাপ সম্পূর্ণ আলাদা একটি বিষয় এটি রক্তচাপ নয়। চোখের নরমাল প্রেশার হয়ে থাকে ১০-২০ মারকিউরি। এর চেয়ে বেশি হলে গ্লুকোমা হতে পারে। গ্লুকোমায় চোখের অপটিক স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কাপের মত সৃষ্টি হয় অপটিক নার্ভে।

বছরে অন্তত দুইবার চোখের ডাক্তার এর কাছে গিয়ে চোখের প্রেশার সহ অন্যান্য বিষয় পরীক্ষা করানো উচিৎ। আর বয়স যদি চল্লিশ হয় তাহলে তো বাধ্যতামূলক করে নেয়া উচিৎ নিয়মিত চোখ পরীক্ষা। চল্লিশের পরেই গ্লুকোমা সহ অন্যান্য জটিল রোগ বাসা বাঁধতে শুরু করে। পৃথিবী জুড়ে ছানির পরে সবচেয়ে বেশি মানুষ অন্ধত্ব বরণ করে এই গ্লুকোমার জন্য। বিশেষ করে বয়স্ক মানুষেরা আক্রান্ত হন বেশি। বর্তমানে দুনিয়া জুড়ে গ্লুকোমা রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৬৭ মিলিয়ন।

গ্লুকোমাকে চিকিৎসকগণ নীরব ঘাতক হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। একে এই কারণে নীরব ঘাতক বলেছেন যে রোগী নিজেই বুঝতে পারে না সে যে গ্লুকোমায় আক্রান্ত। তিলেতিলে নীরবে দৃষ্টি শক্তি নিঃশেষ করে দেয়। গ্লুকোমা সচেতনতায় দেশ জুড়ে এমন কি সারা বিশ্বেই নানানরকম সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড হয়ে থাকে। গ্লুকোমা সোসাইটি রয়েছে। গ্লুকোমা দিবস পালন করা হয় প্রতি বছর সপ্তাহ জুড়ে।

এতকিছুর পরও আমরা অনেকটাই অজ্ঞাত এই রোগ সম্পর্কে। এটি একটি অনেক বড় সামাজিক সমস্যা। আমাদের সচেতনতাই পারে এর ক্ষতি থেকে নিজেকে ও সমাজকে রক্ষা করতে। একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে আমাদের এই সমস্যার বিরুদ্ধে, নিজের ও পরিবারের সবাইকে নিয়মিত ডক্টর এর কাছে গিয়ে পরীক্ষা করাতে হবে। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহন করতে হবে। সময় থাকতেই চিকিৎসা করিয়ে রঙীন দুনিয়ার রঙ ধরে রাখা সম্ভব। অন্যথায় নিকষ কালো আঁধারে হাবুডুবু খেয়ে অন্যের উপর বোঝা হয়ে থাকতে হবে।


~ সাবিরা মুন্নী

পঠিত : ২০৬ বার

মন্তব্য: ০