Alapon

১৪ ফেব্রুয়ারি : রক্ত ঝরার দিন



১৯৮৫ সাল থেকে চট্টগ্রামে স্বৈরাচার এরশাদের সন্ত্রাসী ছাত্র সংগঠন 'ছাত্রসমাজ' ইসলামী ছাত্রশিবিরের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। একের পর এক খুন করতে থাকে তারা। ছাত্রশিবির প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের ভয়ংকর সন্ত্রাসের মুখোমুখি হয়।

স্বৈরাচার এরশাদ এসব সন্ত্রাসীদের একাংশকে টাকা ও ক্ষমতার বিনিময়ে তার দলে ভিড়িয়ে নেয়। ১৯৮৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম পলিটেকনিকের হোস্টেলে গভীর রাতে খুন করে চট্টগ্রাম পলিটেকনিকের ছাত্রশিবির নেতা জাফর জাহাঙ্গীর ভাই ও বাকী বিল্লাহ ভাইকে।

জাফর ভাই ও বাকী ভাইকে ছাত্রসমাজের খুনীরা খুন করে ব্রাশফায়ারের মাধ্যমে। তাঁরা যথাক্রমে ১৪ ও ১৫ তম শহীদ। দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে দুই শিবির নেতার শাহাদাতের খবর। এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে ছাত্রসমাজের তান্ডব ও হত্যাকাণ্ড চললেও পুলিশ নীরব থাকে। সন্ত্রাসীরা গুলি করতে করতে ক্যম্পাস ছেড়ে গেলে তারা এসে জাফর ভাইয়ের লাশ ছিনিয়ে নিয়ে যায়। সারা শহরের শিবিরের নেতা-কর্মীরা চট্টগ্রাম মেডিকেলে জড়ো হয়। পুলিশ পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করে নি।

জালেম এরশাদ সরকার এই দুই শহীদের লাশ কাউকে দেখার সুযোগ পর্যন্ত দেয়নি। শহীদের সাথীরা তাদের প্রিয় ভাইদের সামনে নিয়ে জানাজা পড়তে পারেননি। শহীদ জাফর জাহাঙ্গীরের পরিবারবর্গ বাস করেন চট্টগ্রামের পোর্ট কলোনিতে কিন্তু তাদের কাছে লাশ হস্তান্তর না করে তাঁর গ্রামের বাড়ি ফেনীর ছাগলনাইয়াতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কড়া পুলিশ পাহারায়। সেখানেই গ্রামের কিছু লোককে ডেকে জাফর ভাইয়ের দাফন সম্পন্ন করে। আর বাকী বিল্লাহ ভাইয়ের লাশ পাঠিয়ে দেওয়া হয় বরিশালের মুলাদিতে। সেখানেই তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়।

এর প্রতিবাদে পরদিন বৃহত্তর চট্টগ্রামে হরতাল ডাকে ছাত্রশিবির। এই নিষ্ঠুর জোড়া খুনের পর দেশব্যাপী নেমে আসে শোকের কালোছায়া। ১৫ তারিখ রাজধানীতে আয়োজিত বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ বিনা উসকানিতে কাঁদুনে গ্যাস শেল ফাটায় ও ব্যাপক লাঠিচার্জ করে। জালেমের লেলিয়ে দেয়া পুলিশের লাঠির আঘাতে শিবিরের তৎকালীন অফিস সম্পাদক (পরে কেন্দ্রীয় সভাপতি) আমিনুল ইসলাম মুকুল এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের সভাপতি আনোয়ারুল ইসলামসহ অনেকে আহত হন।

বৃহত্তর চট্টগ্রামে জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালন করে। কক্সবাজারে হরতাল পালনের সময় পুলিশ বিনা উসকানিতে শিবিরের মিছিলের ওপর চড়াও হলে সংঘর্ষে অনেকে আহত হয়। পুলিশ মিছিলের ওপর ১৫ রাউন্ড গুলি ও অন্তত একশ’ টিয়ার গ্যাস শেল নিক্ষেপ করে। শামসুল আলম ও জসীম উদ্দিন নামে দুই ভাই মাথায় গুলিবিদ্ধ হন।

বছর গড়িয়ে পরের বছর ১৯৮৭ সাল এলো। পুরো একবছরে ছাত্রসমাজ জালিম এরশাদ সরকারের সহায়তায় প্রতিটি ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবিরের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছিল। ১৯৮৭ সালে বহু চট্টগ্রামের বহু ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর প্রোগ্রাম করতে পারেনি। পটিয়ায় ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদের ব্যাপকভাবে পিটিয়েছে ছাত্রসমাজ।

এর প্রতিবাদে ও গত বছরে দুই ভাইয়ের খুনীদের শাস্তির দাবিতে ১৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে হরতাল আহ্বান করে ছাত্রশিবির। হরতাল পালনের জন্য তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের ভাই চট্টগ্রামে আসেন। ছাত্রশিবির লালদিঘী ময়দানে সমাবেশের ঘোষণা দেয়। কেন্দ্রীয় সভাপতি তাহের ভাইয়ের নেতৃত্বে মিছিল আন্দরকিল্লা অতিক্রম করে যখন জেনারেল হাসপাতাল পার হচ্ছিল তখন মিছিলের পেছন দিক থেকে পুলিশ ও ছাত্রসমাজের সন্ত্রাসীরা একযোগে হামলা চালায়।

সন্ত্রাসীরা ১২ টি শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় ও ব্রাশফায়ার করতে থাকে। বহু মানুষ রাস্তার ওপরে পড়ে যায়। ছাত্রশিবিরের মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। বিভিন্ন অলি গলি থেকে ছাত্রশিবির আবারো সংগঠিত হয়ে সন্ত্রাসীদের ধাওয়া দেয়। সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। আহত হয় অজস্র মানুষ। এর মধ্যে নিহত হন দুই জন। একজন হলেন নোয়াখালীর ছেলে ও চট্টগ্রাম রেলওয়ে কলোনি উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র আমীর হোসাইন। আমীর হোসাইন ছাত্রশিবিরের জানবাজ কর্মী ছিলেন। তিনি চট্টগ্রামে তাঁর স্কুলে ও তাঁর বাড়ি নোয়াখালীর ভাটিরটেকে ছাত্রশিবিরের গোড়াপত্তন করেন। তিনি ছাত্রশিবিরের ১৬ তম শহীদ।

শহীদ আমীর হোসাইন ভাইয়ের নাম মুখস্ত করে আমরা নোয়াখালীতে ছাত্রশিবিরের কর্মী হয়েছি। তিনি নোয়াখালীতে জন্ম নেওয়া ১ম ছাত্রশিবিরের তালিকাভুক্ত শহীদ।

২য় জন হলেন চট্টগ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তির ছেলে শহীদ হাফেজ আব্দুর রহীম। বাইতুশ শরফ দরবার শরীফের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা শাহ সুফী আব্দুল জব্বারের ছেলে ছিলেন তিনি। চুনতি হাকিমিয়া আলিয়া মাদ্রাসা থেকে ১৯৭৭-৭৮ সালে সালে কুরআন হিফজ শেষ করেন শহীদ। এরপর প্রাথমিক পর্যায়ে পড়াশোনা করেন কুমিরাঘোনা আখতারুল উলুম মাদ্রাসায়।

পরে ১৯৮২ সালে বায়তুশ শরফ আদর্শ মাদ্রাসায় পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ওই মাদ্রাসা থেকেই বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ১৯৮৬ সালে দাখিল পরীক্ষায় হিফজুল কুরআন বিভাগে সপ্তম স্থান অধিকার করেন। মাদ্রাসাটির ছাত্রদের মধ্যে তিনিই প্রথম বোর্ডের বৃত্তিধারী ছিলেন। মেধাবী আব্দুর রহীম মাদ্রাসা ছাত্রাবাসের ১ নম্বর কক্ষে থাকতেন এবং শহীদ হওয়ার প্রাক্কালে আলিম প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। শহীদ হাফেজ আব্দুর রহীম ভাই ছাত্রশিবিরের ১৭ তম শহীদ।

অল্প বয়সেই তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত লেখনী সবার দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়। তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা-সাময়িকীতে নিয়মিত লেখালেখি করতেন। তাঁর ‘জিহাদের যৌক্তিকতা’, ‘জাগো মুসলিম’ ইত্যাদি প্রবন্ধ সবাইকে দ্বীনের পথে উদ্বুদ্ধ করে। শহীদ আব্দুর রহীমের সাংগঠনিক মান ছিল কর্মী। তিনি বায়তুশ শরফ আদর্শ কামিল মাদ্রাসা শাখার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি (১৯৮৩-১৯৮৪)। শহীদ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আলিম উপশাখার সভাপতি ছিলেন।

এই ঘটনার পরে ছাত্রশিবির চট্টগ্রাম শহর থেকে পালিয়ে যায়নি। বরং অবস্থান আরো শক্ত করেছে। ১৯৮৭ সালে ১৮ ফেব্রুয়ারি এই জোড়া হত্যার প্রতিবাদে ঢাকার ফুলবাড়িয়া (গুলিস্তান) ও চট্টগ্রামে লালদীঘি ময়দানে প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে। শহরে কয়েক স্থানে ছাত্রসমাজ বাধা দিতে চাইলেও ছাত্রশিবিরের প্রতিরোধে সেটা সম্ভব হয়নি। তবে রাঙ্গুনিয়া থেকে চট্টগ্রাম শহরে আসার প্রাক্কালে রাঙ্গুনিয়া শিবির অফিসে হামলা চালায় ছাত্রসমাজ। সেখানে তারা ছুরি কুপিয়ে ৬ জনকে আহত করে। এই ছয়জনের একজন শহীদ জসিম উদ্দিন চৌধুরী পরদিন অর্থাৎ ১৯ ফেব্রুয়ারি শাহদাতবরণ করেন। তিনি ছাত্রশিবিরের ১৮ তম শহীদ।

চট্টগ্রামের ইতিহাস বড় রক্তাক্ত। সেখানে বহু রক্ত ঝরার মাধ্যমে ইসলামী আন্দোলন ভিত্তি লাভ করেছে। আজকের আলোচনা ১৪ ফেব্রুয়ারি নিয়ে। ১৪ ফেব্রুয়ারিতে আরো দুইজন শহীদ আছেন ছাত্রশিবিরের।

একজন হলেন, শহীদ খুরশিদ আলম। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবিরের ৫ম শহীদ। ১৯৮৫ সালের ১৪ ই ফেব্রুয়ারী তারিখে বায়তুশ শরফের পীর মাওলানা আবদুল জব্বার সাহেবের ফরহাদাবাদ হাইস্কুল মাঠের মাহফিল পণ্ড করতে এবং তাঁকে হত্যা করতে তথাকথিত সুন্নী নামধারী ছাত্র সেনা সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ চক্রের সহায়তায় করা অপকর্ম স্থানীয় লোকদের প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়। মাহফিল থেকে বাড়ী ফেরার পথে শহীদ খুরশিদ ভাইকে মুনিয়া পুকুর পাড়ে সন্ত্রাসীরা ছুরি মেরে তাকে রক্তাক্ত করে এবং মাথায় লাঠির আঘাতে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। তাঁকে ভয়ংকরভাবে নির্যাতন করে হত্যা করে ছাত্রসেনা ও ছাত্রলীগের মিলিত সন্ত্রাসীরা। তিনি চট্টগ্রামের শহীদদের মধ্যে ১ম শহীদ।

১৪ ফেব্রুয়ারির আরেকজন শহীদ দিনাজপুরের মো. মতিয়ার রহমান। তিনি ইসলামী ছাত্র শিবিরের ২২০তম শহীদ। ২০১৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনাজপুরের ডিবি পুলিশ মতিয়ার ভাইকে এরেস্ট করে এবং তাঁর দুই হাঁটুতে দুই গুলি করে তাকে মারাত্মকভাবে আহত করে। হাসপালাতে নিয়ে আসে পুলিশ। দিনাজপুর মেডিকেলের ডাক্তাররা দ্রুত অপারেশন করে গুলি বের করে। অপারেশন সাকসেসফুল। রোগী নিরাপদ।

এমন পরিস্থিতিতে ডিবি পুলিশের হায়েনারা আবারো হাসপাতালে এসে মতিয়ার ভাইকে নিয়ে যেতে চাইলো। ডাক্তাররা বাধা দিলেও তারা তা শুনেনি। ডাক্তাররা বললো শুধুমাত্র ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা রোগীকে আপনাদের হাতে দিতে পারি। পুলিশ ডাক্তারদের লিখিত দিল তারা মতিয়ার ভাইকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাচ্ছে। অপারেশন থিয়েটার থেকে বের করে তারা আবার মতিয়ার ভাইকে নিয়ে গেল ডিবি অফিসে।

সেখানে ভয়ংকর নির্যাতন করে হত্যা করে মতিয়ার ভাইকে। তারপর তারা মতিয়ার ভাইকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গেল। কিন্তু সেই মতিয়ার ভাই আর জীবিত মতিয়ার ছিলেন না।

পঠিত : ২৩২ বার

মন্তব্য: ০