Alapon

ভ্যালেন্টাইন ডে কি বানিজ্যিক ফাঁদ....?



১.
একবার আমাদের এক স্যার ক্লাসে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের মধ্যে কারা কারা কবিতা লিখ?
কয়েকজন হাত তুলল।
স্যার হাসি হাসি মুখে বললেন 'আমি যদি তিনটা শব্দ বাদ দিয়ে কবিতা লিখতে বলি, তোমাদের কবিতা লিখা বন্ধ হয়ে যাবে। আর লিখতেই পারবে না।‘
ক্লাসের সবাই উৎসুক চোখে চাইল।
স্যার চোখ নাচিয়ে বললেন 'সে তিনটি শব্দ হল, আমি তুমি আর..ভালবাসা'
.
২.
আমাদের সেকুলার, তথাকথিত প্রগতিশীল নারীবাদীরা আলেম উলামা ও ইসলামী জীবন বিধান দু চোখে দেখতে পারে না।
এর নাম শুনলেই তারা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেন।
আমি ঠান্ডা মাথায় ভাবি, তাদের এত গোস্বা করার কারন কি?
পরে ভেবে দেখলাম, এর প্রধান কারন দুটো:
ক. নিজেদের ভোগাবাদিতা, যেমন তেমন চলতে চাওয়া, চলতে যাওয়ায় বাধা
খ. বানিজ্য।
একটু ব্যাখ্যা করি।
আলেম উলামারা নারী পুরুষ এর ফ্রি মিক্সিং এর বিরুদ্ধে কথা বলেন। জনস্মমুখে নারীর 'বানিজ্যিক ব্যবহার' এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হন।
অথচ, আমাদের এই তথাকথিত শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির দুনিয়ার বিশাল ভিত্তি, ভোগবাদীতা ও নারীর বানিজ্যিক ব্যাবহারের উপরে দাঁড়িয়ে। নাটক, সিনেমা, সাহিত্যে নারীর আবেদনময়ী উপস্থিতি না থাকলে গোটা ইন্ডাস্ট্রিই যে মুখ থুবড়ে পড়বে।
আজকের কথাই ধরা যাক। আজ ১৪ ই ফেব্রুয়ারি। সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন ডে।
এই উপলক্ষে সারা দেশে কোটি কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়েছে, হচ্ছে। চকলেট ও অন্যান্য গিফট সামগ্রিও বিক্রি হচ্ছে অঢেল।

চ্যানেলে চ্যানেলে থাকছে অসংখ্য নাটক, সিনেমা। থাকছে তারকা দম্পতিদের 'ভালবাসার আলাপ', টক শো, কনসার্ট। টিআরপি হিসেব করে স্পন্সর কোম্পানীগুলো এতসব অনুষ্ঠান এর পেছনে শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করে।
বিনিময়ে তরুন তরুনীদের 'ভালবাসার সবক' দিয়ে নানা কৌশলে তাদের কাছ থেকে কাড়ি কাড়ি টাকা হাতিয়ে নেয়।

ভেবে দেখুন, নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা যদি না হত, বিনোদন ও প্রচার মাধ্যমে নারীকে আবেদনময়ী হিসেবে উপস্থাপন করার সুযোগই যদি না থাকত, এভাবে খেয়াল খুশিমত ভোগবাদীতার চর্চা না থাকত, তাহলে কি সারা বিশ্বব্যাপী এত বিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার এর বানিজ্য হত?
.
৩.
অনেকেই হয়তো বলবেন, ব্যবসার প্রচার প্রসার তো ভাল জিনিস। এর সঙ্গে লক্ষ কোটি মানুষের রুজি রোজগার জড়িত। তাহলে এটা নিয়ে এত কথা বলার, এত আপত্তি করার কি আছে?

সত্যি বলতে, বানিজ্য কোন খারাপ বিষয় নয়। কিন্তু দেখার বিষয়, বানিজ্যটা কি নিয়ে হচ্ছে? সে বানিজ্য দিন শেষে আমাদের জন্য কি বয়ে আনছে? লাভ না ক্ষতি?
ধরুন, সারা পৃথিবীতে ড্রাগস, মাদক এর পেছনেও ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার এর বিজনেস জড়িত। এর সাথেও জড়িয়ে আছে লক্ষ কোটি মানুষ এর জীবন ও জীবিকা।
আমাদের দেশের সীমান্তবর্তী এলাকায়ও বহু মানুষ মাদক ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করেন।

এখন, বানিজ্য আর জীবন জীবিকার অজুহাতে কি আমরা মাদক ব্যবসা মেনে নিব? নাকি চাইব, এ ব্যবসার বহুল প্রসার হোক? পত্র পত্রিকা, টিভি মিডিয়ায় দ্বার তাদের জন্যও উম্মোচিত হোক (!) তারাও অবাধে তাদের পণ্যের প্রচারনা চালাক?

সত্যি কথা বলতে, গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া সমাজের আর কেউ এতে সম্মত হবে না। কারন আমরা জানি, যতই এর সাথে জীবন জীবিকা আর বানিজ্যের সম্পর্ক থাকুক না কেন, এটা মানব সমাজের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।

মাদক শুধু একজন ব্যক্তি নয়, গোটা একটা পরিবার, গোটা একটা সমাজ ধ্বংস করে ফেলে।

ঠিক একইভাবে নারী পুরুষ এর ফ্রি মিক্সিং, বিনোদন মাধ্যমে নারীর খোলামেলা, আবেদনময়ী উপস্থিতি, সমাজ, পরিবার ও মানব সভ্যতাকে একইভাবে হুমকিতে ফেলে।
নারী পুরুষ এর নিয়ন্ত্রিত সহাবস্থান পরিবার গঠনে সহায়ক। অনিয়ন্ত্রিত সহাবস্থান পরিবার ধ্বংসের নিয়ামক।

নারী পুরুষ একে অপরের প্রতি দুর্দমনীয় আকর্ষন অনুভব করে। এটা মানব প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য। আর এই আকর্ষণ যথাযথভাবে পরিপুরন করার জন্য আল্লাহ দুজন নারী পুরুষ এর মধ্যে বিয়ের বিধান রেখেছেন।

বিয়ের মাধ্যমে একটা পরিবার গঠন হয়। কিছু শর্ত সাপেক্ষে দুজন নারী পুরুষ একে অন্যের অধিকার, মর্যাদা রক্ষায় সচেষ্ট হয়। সন্তান সন্ততি হয়। দুজন এর স্নেহ ভালবাসার ছায়ায় একটা প্রজন্ম বেড়ে উঠে।

বিয়ে মানে দায়িত্ব। বিয়ে মানে জীবনের শৃংখলা। কিন্তু বিয়ে না করে, কোন দায়িত্ব না নিয়ে, নিজের কামনা বাসনা পুরন এর সুযোগ থাকলে, লোকের মধ্যে বিয়ে নিয়ে অনিহা তৈরি হয়। মানুষ ভাবে, এইতো ভাল আছি। অত দায় দায়িত্বের মধ্যে জড়ানোর প্রয়োজন কি?

এতে দেখা যায়, সম্পর্কগুলো হয় খুবই ঠুনকো। একে অন্যের প্রতি কোন কমিটমেন্ট থাকে না। দায় দায়িত্ব থাকে না। আজ ভাল লাগছে বলে দুজন একসাথে আছি। কাল ভাল না লাগলে ব্রেক আপ।

আজকাল তাই, যখন তখন সম্পর্ক ভাংগে। কথায় কথায় ব্রেক আপ হয়। ফলশ্রুতিতে বিশাল একটা প্রজন্ম দারুন হতাশা আর ডিপ্রেশন এ চলে যায়। এছাড়াও প্রেমের ফাদে ফেলে ধর্ষণ, নারী পুরুষ একে অন্যকে ব্ল্যাকমেইল করার অসংখ্য ঘটনা ঘটে। এর সবকিছুই দীর্ঘমেয়াদে ভয়ংকর। ক্ষতিকর। এতো গেল একটা দিল। অন্য আরেকটা দিকও আছে, যা আমাদের আলোচনার বাইরেই থেকে যায়।

নারী পুরুষ এর অবারিত মেলা মেশার সুযোগ অবৈধ প্রেম, পরকীয়ায় সুযোগ তৈরি করে। বিবাহিত নারী পুরুষ নিজের সংগীর সাথে অন্যদের তুলনা করে। ভাবে আমার স্বামী/স্ত্রী নাটক সিনেমার মানুষটার মত সুন্দর নয়। রোমান্টিক নয়। এতে সম্পর্কের বাধন দিন দিন দিন আলগা হয়ে যায়। অনেকে নিজের সংগীকে বাদ দিয়ে অন্যের মাঝে মুগ্ধতা খোজে, পুর্নতার সন্ধান করে। ফলে অবৈধ প্রেম, পরকীয়ার ঘটনা ঘটে। বাড়ে বিয়ে বিচ্ছেদের মত ঘটনা।

যে কোন সচেতন মনোবিজ্ঞানী জানেন, সম্পর্কের এমন ভাংগা গড়ার খেলা মানুষের মন ও শরীর এর উপর কতটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বাচ্চাদের উপরেও এর প্রভাব হয় অত্যন্ত মারাত্মক।

শুধু তাই নয়, সম্পর্কগুলো যখন ঠুনকো হয়ে যায়, তখন আর কেউ সহজে বাচ্চা নিতে চায় না। বাচ্চা লালন পালনকে মনে হয় বিরাট ঝামেলা, বিরাট বোঝা। এতে সমাজে জন্মহার কমে। অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

আজকের চীন ও উন্নত দেশগুলো এর জ্বলন্ত উদাহরন। ভোগাবাদীতায় আকন্ঠ ডুবে থাকা দেশগুলো আগামী দিনে কর্মক্ষম লোক কমে যাওয়ার আশংকায় এখন দারুনভাবে উদ্বিগ্ন।
তাই, তথাকথিত ‘ভালবাসা’র সাময়িক ফাঁদ, আমাদের জন্য কি নিয়ে আসছে, তা ভেবে দেখা দরকার।
.
৪.
তত্বকথা অনেক হল। এবার বাস্তব প্রেক্ষাপটে চোখ বুলাই। সকাল বিকেল হুজুরদের গালাগালি দেয়া সেকুলার কুলিন ও তথাকথিত প্রতিশীল, মুক্তমনাদের অবস্থা কি? খেয়াল করলে দেখা যায়, তাদের উল্লেখযোগ্য অংশেরই ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবন এর অবস্থা তথৈবচ।

খুব বেশি যাওয়ার দরকার নেই। নাটক সিনেমা আর সংস্কৃতি অংগন এর মানুষদের দিকে তাকালে এর সত্যতা টের পাওয়া যায়। যারা সিনেমার পর্দায় প্রেমিকার জন্য মাথা ফাটায়, স্ত্রীর অধিকারের দাবীতে আন্দোলন করে, এই তারাই গোপনে বিয়ে করে স্ত্রীকে স্বীকৃতি দিতে চায় না। বাচ্চা নষ্ট করতে, মায়ের পেটে থাকা জীবন্ত শিশুকে হত্যা করতে স্ত্রীকে চাপ দেয়।

বাচ্চার জন্ম হলে তার কথা সমাজে বলতে চায় না। পাছে তাদের ক্যারিয়ার নষ্ট হয়।
তাদের এই শোনা যায় গভীর প্রেম চলছে। আবার এই শোনা যায়, চুপি চুপি অনেক আগেই তাদের বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছে। নায়ক-নায়িকা, গায়ক-গায়িকা...যারা সারাক্ষন ভালবাসার কথা গানে দর্শক শ্রোতাদের মাতিয়ে রাখেন, তাদের নিজেদের জীবনেই সম্পর্ক আর ভালবাসার ‘রোলার কোষ্টার’ অবিরত চলতে থাকে।

অনেকেই আবার এত ঝুট ঝামেলায় না গিয়ে ‘চিরকুমার’ হয়ে বসে থাকেন। দু দিন পর পর মুক্তমনা নারীদের প্রকাশিত ‘আত্মজীবনী’তে এইসব চিরকুমারদের থলের বিড়াল বেরিয়ে আসে।

খেয়াল করলে দেখা যায়, এদের চাইতে গালাগাল খাওয়া ‘হুজুর’দের জীবনই বরং অনেক ভাল। তথাকথিত গ্লামার নেই, জিবনে কিস ডে, হাগ ডে, ভ্যালেন্টাইন ডে উদযাপন নেই। কিন্তু তাদের সম্পর্কের মধ্যে আস্থা আছে, নির্ভরতা আছে। আছে চুপিচুপি ভালবাসা। আছে সুখে দুখে একে অন্যের পাশে থাকার ব্যাকুলতা। তাই, তথাকথিত ভ্যালেন্টাইন ডে কি ‘ভালবাসার ছাদ’ নাকি ‘বানিজ্যিক ফাঁদ’...সে প্রশ্ন কিন্ত রয়েই যায়।

পঠিত : ২৭৮ বার

মন্তব্য: ০