Alapon

ইসলামি গানের শিল্পী ও শ্রোতা: আমাদের ইয়ো ইয়ো প্রজন্ম




ইসলামি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে শিল্পীর যেমন অভাব নেই তেমনই শ্রোতামণ্ডলীও একেবারে কম নয়। আলাদা আলাদা গুণসম্পন্ন শিল্পী যেমন আছেন, একই সাথে আছেন আলাদা শ্রোতাও। কোন শ্রোতাদের জন্য কী ধরণের গান আমরা নির্মাণ করবো অথবা কেমন পরিবেশনা রাখবো তা নিয়ে বলা যায় একটা গবেষণা প্রয়োজন। প্রতিনিয়তই গানের গুণগতমান, বিষয়, পরিবেশনার ধরণ প্রকৃতি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। এতে কারা লাভোবান হচ্ছে তা ভেবে হয়তো আমাদের কোনো লাভ হবে না, তবে আমরা যে পিছিয়ে পরছি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আজকে লেখার চেষ্টা করবো শিল্পী শ্রোতার ধরণ প্রকৃতি এবং এর সামাজিক প্রভাব।

পৃথক সাংস্কৃতিকধারা: বর্তমানে বাংলাদেশে কোনো নির্দিষ্ট সংস্কৃতির মধ্যে আবদ্ধ নয়। বলা যায় ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির সাথে ভিন্ন ভিন্ন মুখ। চীন জাপান কোরিয়ায় যেমন সবগুলো মুখ কাছাকাছি, বাংলাদেশ তার উল্টো। এখানে চেহারার যেমন ভিন্নতা, সাংস্কৃতিক ভিন্নতা যেন তার থেকেও বেশি।

১. কোন এক বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলনায়তনে চলছে লাল হলুদ বাতি। হর্স্য ধ্বনিতে মুখোরিত চারপাশ। একটু পরেই আসবে কাঙ্খিত শিল্পী। যার পরিবেশনার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে আমাদের শিক্ষার্থীরা। হ্যাঁ শিল্পী আসলেন, গানের সাথে সাথে চমৎকার নিত্য পরিবেশনায় মুগ্ধ করলেন-
“তুমি তামাক ধরো তামাক ছাড়ো আগুন জ্বালিয়ে দাও”।
গানের সাথে সাথে পুরো মিলনায়তনের সবার নিত্য পরিবেশনা যেন চারিদিকে একটা উন্মাদনা ছড়িয়ে দিল। বর্তমানে এইধরণের গানের পরিবেশনাও বাংলাদেশের সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

২. সবুজ সামিয়ানার নিচে টুপি মাথায় হাজার হাজার মুসলমান পিনপতন নিরবতা নিয়ে বসে আছেন। তাদের মাঝে নেই কোন উন্মাদনা। কোন কারিগরি সহায়তা ছাড়াই তারা আজ সুশৃঙ্খল। তাদেরও অপেক্ষা শিল্পী আসবেন আর তাদেরকে হৃদয় উজাড় করে গান শুনাবেন। হ্যাঁ এইতো ঘোষণা শেষ হলো, শিল্পী তার সুলোলিত কণ্ঠে পরিবেশন করছেন-
নবী মোর পরশ মনি
নবী মোর সোনার খনি
নবী নাম জপে যে জন সেইতো দোজাহানের ধনি।

প্রত্যেকেই আল্লাহ ও রাসূলের ভালোবাসা নিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে বাড়ি ফিরল । পরিবেশটা কী সুন্দর। কী মায়ামোহ। এমন গানের পরিবেশনাও বাংলাদেশের সংস্কৃতির অংশ।

৩. নিভৃত এক পল্লী। মেঠোপথ বয়ে গেছে দূরে। পাশেই বটতলায় একটু বিশ্রামের জন্য একতারা হাতে এক বাউল গেয়ে যাচ্ছে- “খাচার ভেতর অচীন পাখি কেমনে আসে যায়”। এটাও বাংলার সংস্কৃতি।

৪. ছায়ানটের মঞ্চে রঙিন শাড়ি পরে শিল্পী গেয়ে উঠছেন ক্লাসিক্যাল ঢংয়ের রবীন্দ্র অথবা নজরুল সংগীত। “আমারও পরাণ যাহা চায় তুমি তাই” অথবা “মোর প্রিয়া হবে এসো রানী দেব খোঁপায় তারার ফুল”।

বাংলাদেশ এবং বাংলা গান: কোন অনিসলামি দেশে যখন ইসলাম আসে, তখন তাদের পুরো সংস্কৃতিকে একদম বাতিল করে না। যেমন পোশাকের ব্যাপারে ইসলাম ঢিলেঢালা মার্জিত ও সুন্দর পোশাক অনুমোদন করে। কেউ এমন পোশাক পরলেই সেটা সুন্নাত হিসেবে পরিগণিত হবে। সেই কারণে প্রায় অধিকাংশ দেশের আলেমগণ তাদের জাতীয় পোশাকই পরিধান করেন। কারণ এটাই তাদের সংস্কৃতি। তেমনই গানের ব্যাপারেও বাংলাদেশের রয়েছে আলাদা সংস্কৃতি। ভিন্ন ভিন্ন ঢংয়ের গান। যা আমাদের জাতীসত্তা বিকাশে সহায়ক হবে বলেই মেনে নিতে হবে। বাংলার আদি সংস্কৃতির কথা বললেই লোকসংগীতের কথা আসে। আর লোকসংগীত মানেই- জারি, সারি, মুর্শিদি, ভাটিয়ালী, পল্লীগীতি, গম্ভিরা ও ভাউয়াইয়ার কথা উঠে আসে। বলা যায় দেশের একেক অঞ্চল একেক ধরণের গানের জন্য বিখ্যাত ছিল। একবার দেখুন আর ভাবুন কী চমৎকার! ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জকে ভাটি অঞ্চল বলা হয়। আর এই ভাটি অঞ্চলের গানগুলো ভাটিয়ালি নামে পরিচিতি পায়। যেখানে নদী মা মাটির কথা উঠে আসে। বলা যায়, বাংলা গানের সম্ভার একদম ছোট নয়। দেহ বিশ্লেষণে যে গান তা দেহদত্ত্ব। মারফত বিষয় নিয়ে য়ে গান তাকে মারফতি গান। আবার যে গানের পালা অর্থাৎ পরস্পর প্রতিযোগিতা হয় তাকে বলে পালা গান। এক অর্থে বলাই যাই- জানা অজানা সংস্কৃতির মাঠ বাংলাদেশ।
পাহাড় থেকে কলসি কাকে নেমে আশার যে তাল সৃষ্টি হয় সেই তাল নিয়েই পাহাড়ী গানের আলাদা এক ধরণ তৈরী হয়েছে। রংপর আর আসামের কোচবিহারে চলে ভাওয়াইয়া। এখানে “ও কী গাড়িয়াল ভাই..” গানের টান থেমে থেমে আটকে আসে, এতে বোঝা যায় গাড়িয়ালের গলা গরুর গাড়ির ওঠা নামায় থেমে যাচ্ছে। এই কারণেই ভাওয়াইয়ার সুরটা এইরকম। সব মিলিয়ে বলা যায়, বাংলা গানের একটি নির্দিষ্ট জায়গা আছে যেখানে বিচরণ করার মাঠ একদম ছোট নয়।

ইসলামি গান কেমন হবে:

এখন একজন ইসলামি গানের শিল্পীর করণীয় কী? বা তিনি কোন ধরণের গান গাইবেন? মুসলিম হওয়ার সাথে সাথেই কী তাকে আরবের গানগুলো আওড়াতে হবে? শুধু “তালায়াল বাদরু আলাইনার” মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবেন? বাংলা সকল গান তার জন্য হারাম হয়ে যাবে? না শুরুতেই বলেছি ইসলাম কোনো জাতীর সকল সংস্কৃতিকে বাতিল করে না। সেই সকল সাংস্কৃতিক কার্যক্রমই বাতিল করে যাতে শিরক আছে, যা কিছু খারাপ, যা কিছু উগ্রতাকে উস্কে দেয়, যা ধর্মীয় আবেগের বিপরীত অথবা ধর্মীয় বিশ্বাসকে বাতিল করে ইসলাম তাকেও বাতিল করে দেয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হচ্ছে যা ধর্মীয় বিশ্বাসের বিপরীত অথবা ধর্মীয় বিশ্বাস বাতিল করার পরিবেশ সৃষ্টি করে। এবার এখানে মূল যে বিষয় তা হচ্ছে ইসলামি পরিবেশনাগুলোও হতে হবে সেই অঞ্চলের মানুষের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বা সংগতিপূর্ণ। পশ্চিমা কোন সংস্কৃতির মত কিছু বানিয়ে সেখানে ইসলামি বিষয় ঢুকালেও সেটাকে ইসলামি পরিবেশনা বলা বাহুল্য। সর্বচ্চো সেটাকে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বলা যেতে পারে। কারণ পশ্চিমা হিপহপ অথবা র্যাপ সংগীত আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির সাতে সামঞ্জস্যশীল নয়। এই সকল বিষয় গানের কথা ও সুর দুটোর জন্যই বিবেচ্য।

গানের বিভাজন এবং আমাদের সমস্যা: এখানে বাংলাদেশে গানের মৌলিক পার্থক্য করতে গেলে দুইভাগে ভাগ করা যায়। এক. মিউজিক ছাড়া, দুই. মিউজিকসহ। এই পার্থক্য গড়ে দিয়েছেন কবি মতিউর রহমান মল্লিক। এক সময়ে গান শোনা একেবারে হারাম পর্যায়ে ধরা হতো। আলেমগণ এমনই বলতেন। সেটাও আমাদের বাংলাদেশের মানুষের বিশ্বাস এবং ভালোবাসার জায়গার কারণেই। কিন্তু কবি মল্লিকের মিউজিক ছাড়া গান এই সময়ে এসে তমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এখন আমাদের যে সমস্যাটি প্রতিনিয়তই সামনে আসছে তা হচ্ছে মিউজিক্যাল গানের নেগেটিভিটি। যারা মিউজিক ছাড়া গান শুনেন তারা মিউজিকসহ গানের বিপরীতে কথা বলেন। আবার যারা মিউজিকসহ গান করছেন তারাও তাদের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। এতে পরস্পর বৈরী পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। মিউজিকের পজিটিভ দিক বললে বলতে গেলে- মিউজিক তাল লয় সুরের ঝংকার তৈরী করে, বৈচিত্র আনে। আর নেগেটিভ দিক হচ্ছে কেউ মিউজিকসহ গান শোনায় অভ্যস্ত হলে তার কাছে গানের ভালো মন্দের আর কোন ফাঁরাক থাকে না। অর্থাৎ তার কাছে সকল গানই গান হয়ে যায়। এখানে এই ব্যাপারটা কোনো শ্রোতাই বুকে হাত দিয়ে এটা অস্বীকার করতে পারবেন না। এখন অপেক্ষাকৃত কোনটা কল্যাণকর সেটা বেছে নিতে হবে। সময় এবং বিশ্বাসের আলোকে।

শিল্পী কাদেরকে গান শুনাতে চান? তার শ্রোতা কারা? এই বিষয়টা আগে নির্দিষ্ট করে নেওয়া দরকার। আমরা আসলে সকল বিষয় একাই করতে চাই। আমি ক্লাসিক্যাল গানের শিল্পী মঞ্চে গিয়ে গাইবো “ইয়া নাবী সালাম আলাইকা”। আবার কেউ লোকসংগীত ভালো গায় তিনি গিয়ে গাইবেন “তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়”।

আমাদের বেছে নিতে হবে আমি কি ধর্মপ্রাণ মানুষের জন্য গাইব? তাহলে তারা কী গান শুনতে ভালোবাসেন? মিউজিক ছাড়া না মিউজিকসহ? মিউজিক ছাড়া হলে আবার সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাহলে তারা কী লোকসংগীত ভালোবাসে? নাকি নজরুলের ক্লাসিক্যাল? যেটাই ভালোবাসুক! আপনাকে একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে সেই অনুযায়ী পরিবেশনা চালিয়ে যান।

আবার, আপনি যদি মনে করেন আমি সেই যুবকদের জন্য গাইবো যারা পাশ্চাত্যের সংগীতে অভ্যস্ত হয়ে বাংলার নিজস্ব সংগীত ভুলে গেছে। অথবা তারা ভিন্ন এক জগত তৈরী করে নিয়েছে। হ্যাঁ আপনি যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত সন্ধ্যার মাঠ বদল করতে চান তখন আপনি যত ধরণে ইন্সট্রুমেন্ট আছে সব কিছু নিয়ে মিউজিক্যাল গান গাইতে থাকুন। বেশি খারাপের চেয়ে আপনার কাছ থেকে একটু ভালো তো তখন প্রত্যাশা করাই যায়। আপনার এই কাজে কেউ কিছু বলার কথা না। কারণ আপনার শ্রোতা কারা তা আপনি বেছে নিয়েছেন।

আপনি গ্রামের মেলায় গান গাইতে চান? তাহলে একতারাটা হাতে নিয়ে গাইতে থাকুন। আপনি আপনার শ্রোত পেয়ে যাবেন। মন্দের থেকে বেছে বেছে আপনি ভালো পল্লীগীতিগুলো পরিবেশন করুন। আপনার ইসলামি গানের শ্রোতাকে টার্গেট করার কোনো প্রয়োজন নেই। আপনি আবদুল আলিম অথবা একজন আব্বাস উদ্দিন হোন। সাংস্কৃতিক অনেক ক্ষেত্র। সবাইকে একই প্লাটফর্মে কাজ করার কোনো প্রয়োজন নেই।

সমস্যা তো তখন হয়, যখন মার্কেট ধরার জন্য হোক, আর ভালোবাসার জন্যই হোক- না আপনি বিপুল সংখ্যক ইসলামিমনা শ্রোতার লোভ সামলাতে পারছেন। না আবার পুরোপুরি মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির সাথে যুক্ত হচ্ছেন। অর্থাৎ যারা মিউজিকসহ গান শুনতে চান না তাদের জোর করে তা হজম করার জন্য বলছেন! যখন ইসলামি গান বা গজল কি সেটার একটা অলিখিত সংজ্ঞা আমাদের আগে থেকেই মাথায় রয়ে গেছে, তখন নতুন করে নতুন সংজ্ঞা বুঝাতে চাওয়া বাতুলতা ছাড়া আর কিছু নয়।

সমাধান: উপরের আলোচনার জের টানা যায় সিদ্ধান্তের মাধ্যমে। আমার শ্রোতা কারা এবং আমি কী গাইবো! আমি ইসলামি গানের শিল্পী; তাহলে আমার পরিবেশনার সব কিছুতে ইসলামি মূলধারা এবং বাঙালী মুসলমানের আবেগ মিশ্রিত থাকবে। অথবা আমি ইন জেনারেল কাজ করতে চাই। সীমাবদ্ধ থাকতে চাই না। তাহলে ঘোষণা দিয়ে মেইনস্ট্রিম ইন্ডাস্ট্রির সাথে যুক্ত হলেই ব্যাপারটা সহজ হয়ে যায়। এগুলো নিয়ে কোন সমালোচনা আলোচনার কোন অবকাশ থাকবে না।

আর যদি এর বিপরীত কাজ আমাদের দ্বারা হয় তাহলে এটার একটা সামাজিক প্রভাব আছে। কল্পনা করি একজন দায়ী। যিনি দ্বীনের দাওয়াত দিলেন। দাওয়াতী কাজের শেষে এসে রাস্তার মোড়ে একটি গীটার হাতে নিয়ে গাইছে “আমারো পরাণ যাহা চায়”। সাংস্কৃতিক সংগঠনের অফিসে সারিসারি বাদ্য সাজানো। আর বাচ্চারা কোরাস গাইছে ইয়ো ইয়ো ইয়ো। আগামী প্রজন্মকে একটি ইয়ো ইয়ো প্রজন্ম হিসেবে গড়ে তুলতে আমরাই অগ্রজ।


~ আজিজ হাকিম

পঠিত : ২৫০ বার

মন্তব্য: ০