Alapon

তরুণ-তরুণীদের মাঝে নাস্তিকতা : কারণ ও করণীয়




যা বলতে চেয়েছি :


আল্লাহর মনোনীত একমাত্র দীন আল-ইসলাম। [১] পরিপূর্ণ জীবন বিধান। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা তা পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন আমাদের জন্য। [২] ব্যক্তি থেকে সমাজ, রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে বিশ্বব্যবস্থা—সব কিছুর নীতিমালা খুলে বলা আছে এতে। যেসব বিষয়ে অন্যান্য মতোবাদ মৃতপ্রায়, নীরব—ইসলামের রয়েছে সেখানে সরব উপস্থিতি। স্পষ্ট দিকনির্দেশনা। ইসলামের মূল উৎস আল-কুরআন। সেখানে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লার বাণী হলো,
“এটা এমন একটা কিতাব, যাতে রয়েছে প্রতিটা বস্তুর সুস্পষ্ট বর্ণনা।” [৩]

এই পূর্ণাঙ্গ দীন-ইসলাম প্রচার প্রসার প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বেশি রক্ত ঝরছে, শ্রম দিয়েছে, লড়াই ছিলো যাদের, তারা হলো যুব সমাজ। যাদের উত্তাল তরঙ্গের মতো ঈমানের কাছে শির নোয়াতে বাধ্য হতো যতোসব কুফরি শক্তি। আর তাই সব সময় কুফুরি শক্তি চেয়েছে তাঁদেরকে আগে পথভ্রষ্ট করতে। এখনো করে যাচ্ছে। বর্তমান বিশ্বের মাঝে এবং আমাদের দেশেও এই যুব সমাজের ঈমানী ইমারাতে যে মহা কয়েকটা হামলা-সমস্যায় জর্জরিত তার মাঝে একটা হলো আল্লাহ দ্রোহী —নাস্তিকতা!

এই নাস্তিকতা আমাদের গাও-গ্রামেও প্রভাব ফেলছে এখন। উঠতি বয়সী, তরুণ-যুবকদের মন-মগজ-মানসিকতাকে বিপর্যস্ত করে তুলছে! প্রতিটা বিষয়ে সন্দেহ-সংশয়, খুঁতখুঁতে ভাব; একেবারে ঈমান আমল ইবাদতের স্বাদকে রিতীমত বিনষ্ট করে দিচ্ছে। অসংখ্য সব তরুণ এসবের ভুক্তভোগী। বাস্তব সাক্ষী এবং সে অভিজ্ঞতা আছে নিজেরও।

তো কেনো ঈমানি ইমারাতের এই ভয়াল ধ্বস, কেনো নাস্তিকতার কৃষ্ণ-গহ্বরে এভাবে পড়ে যাচ্ছে তরুণ-যুবসমাজ, কেনো পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়কারী হয়েও পরে গিয়ে হারিয়ে যায় নাস্তিকতার চোরাবালিতে? কেনো বিঁধে যায় আমাদের বুকে নাস্তিক্যবাদ নামক অভিশপ্ত সেই তলোয়ার আর করে ফেলে আমাদের বুককে খন্ড-দ্বিখন্ড? সে বিষয় এবং তার প্রতিকার নিয়ে সামান্য কিছু নিজস্ব এবং কিছু তরুণ ভাইদের থেকে প্রাপ্ত যে চিন্তে, সে চিন্তার বিনিময় করবো ইন শা আল্লাহ!


যেসব কারণে নাস্তিকতায় ঝুঁকে পড়ে তরুণ-যুবসম্প্রদায় :


০১. ইসলাম ও ইসলামি বিধি-বিধান সম্পর্কে উদাসীনতা :


মোটাদাগে বলতে গেলে আমরা এমন সমাজ-রাষ্ট্র ও পরিবারিক-ব্যবস্থায় বেড়ে উঠি, যেখানে সবাই মুসলিম হলেও রাজ্যের উদাসীনতা এই ইসলাম এবং ইসলামের বিধি-বিধান নিয়ে; সে উদাসীনতা থেকে ধীরেধীরে নিজের নীতিনৈতিকতা, আদর্শ, চিন্তাধারা পুরোদমে উল্টে পড়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। এর ফলে আমাদের ঝোঁক-প্রবণতা গিয়ে আছড়ে পড়ে সেক্যুলারদের লাইফস্টাইলের দিকে। যার চূড়ান্ত ফলাফল হলো ধীরেধীরে দ্বীন বিমুখতা থেকে শুরু করে অবিশ্বাসী ও আল্লাহদ্রোহী নাস্তিক প্রজন্ম।

২. ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা :


জন্মেছি মুসলিম পরিবারের। বাইবর্ন মুসলিম। কিন্তু মুসলমানিত্বকে পরিপূর্ণভাবে যে ধারণ ও পোষণ করতে হবে, দীন হিসেবে ইসলামকে যে শিখতে হবে, এর জ্ঞান যে যথোপযুক্তভাবে হাসিল করতে হবে, হৃদয়ের কন্দরে যে দীনের সৌন্দর্যের চাষাবাদ করতে হবে— এমন ভাবনা চিন্তে নেই। যার জন্য আমরা ইসলাম বিরোধীদের অপপ্রচারের সহজ শিকারে পরিণত হই। গঠনমূলকভাবে জ্ঞানের রাজ্যে বিচরণে আমাদের রাজ্যের অনীহা। ফলাফল, নাস্তিকদের সামান্য যুক্তিতেই কাত হয়ে পড়ি। অথচ পৃথিবীতে প্রায় চার হাজার দুইশো প্লাস (৪,২০০+) ধর্ম আছে, ইসলাম এবং একমাত্র ইসলামই আমাদেরকে সবার আগে পড়তে উৎসাহ ও উদ্দীপনা দেয়। আল-কুরআনের প্রথম অবতীর্ণ আয়াতটাই হলো ইক্বরা ( اِقۡرَاۡ) তথা পড়ো।[০৪] অথচ আমরা তা জানতে চাই না। চেষ্টা করি না। পড়ি না।


৩. সামাজিক কুসংস্কার ও কিছু মুরুব্বি এবং সমাজপতিদের অপরিনামদর্শী আচরণ :


এই সমাজে ইসলামের নাম দিয়ে নানাবিধ জঘন্য কুসংস্কার চালু আছে। ইসলাম অসমর্থিত সেই কুসংস্কারকে ইসলামের মোড়কে উপস্থাপন করা হচ্ছে। তখন বিষয়গুলোকে ইসলাম ভেবে ইসলামের ওপর ত্যক্ত-বিরক্ত হয় একটা শ্রেণি। শোনা যায় নাস্তিকদের পূজনীয় আরজ আলী মাতুব্বরও নাকি এমন অপরিনামদর্শী আচরণের শিকার হয়েছিলেন। এবং তার অনেকগুলো (বেশিরভাগ) অভিযোগই ইসলামের নামে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। সে এসব কুসংস্কারকেই ইসলাম ভেবে ইসলামের বিরুদ্ধে কলম চালিয়েছে।


৪. আলিমদের গণমুখী না হওয়া :


আলিমগণ আমাদের মাথার তাজ। আমরা ইসলামের আলো আলিমদের মেহনতের বদৌলতেই পেয়েছি। কিন্তু এখন দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, আমাদের ওলামারা মানুষের পাশে কমই দাঁড়ায়। গণমুখী চরিত্রের অধিকারী নয় তাঁরা। যুবক-তরুণদের কাছে তাঁরা ভিড়ছে না। তাঁদের মধ্যে এমন আচরণ আর ব্যবহার, এমন সমন্বিত চিন্তা ও কর্ম অনুপস্থিত—যে আচার-ব্যবহার, যে কর্ম-কৌশোল ও চিন্তার বদৌলতে তরুণ-যুবকরা নিজেদের সমস্যাগুলো নিয়ে আলিমদের শরণাপন্ন হবে। আলিমদের কাছে এমন স্পেস না থাকায় কিংবা কম থাকায় তরুণ-যুবকেরা সেক্যুলার মোটিভেশনাল স্পীকারদের শরণাপন্ন হয়, তাদের কাছে যায়। এক পর্যায়ে তাদের আদর্শে ধীরেধীরে অনুরক্ত হয়ে যায়। কারণ, তাদের আছে যুবক-যুবতীদের আকর্ষিত করার নানাবিধ আয়োজন। যেমন ম্যাথ অলিম্পিয়াড, ক্যারিয়ার গাইডলাইন, লাইফ-লীড করার জন্যে মোটিভেশানাল প্রোগ্রাম। বিপরীতে আমাদের সম্মানিত ওলামায়ে কেরামের তরুণদের উপযোগী অতোটা উদ্যোগ-আয়োজন নেই, এবং তাদের উপযোগী করে, তাদের সমস্যা নিয়ে কথাও বলছে না ( যদিও এখন সার্বিকভাবে এই চিত্রের পরিবর্তন ঘটেছে। অনেক সম্মানিত ওলামায়ে কেরাম বলছে তাদের উপযোগী কিছু কথাবার্তা। ছুটে যাচ্ছে বিপদ-আপদে মানুষের পাশে)।


৫. ইসলামপন্থীদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব- সংঘাত ও রেষারেষি :


আমাদের সবচেয়ে বেশি হতাশাজনক বিষয় হলো ওলামাদের পরস্পরের মধ্যে ঘৃণার চাষাবাদ। পারস্পরিক রেষারেষি। যেখানে ইউটিউবের ওয়াজ নসীহাগুলো শুনে ইসলামকে জানবো-শেখবো, ইসলামি মূল্যবোধের প্রতি অনুরক্ত হবো; সেখানে আমরা বা আমাদের তরুণ-যুবসমাজের অনেকেই ওয়াজ-নসীহাগুলো দেখে হতাশ হয়ে পড়ে। যদি ইসলাম সত্য হয়ে থাকে, তাহলে কেন অতো অসহনশীল এই ইসলামের প্রচারকরা? এই প্রশ্ন অসংখ্য দীনের পথে ফিরতে আগ্রহী অগণিত ভাই-বোনদের। অনেকেই এটাকে ওভার কাম করে আসতে পারলেও অনেকে পারে না। যারা পারে তারাও আফসোসে ভোগে আমার মতোন। যেমন জনন্দিত পাঠকপ্রিয় লেখক আরিফ আজাদ ভাইয়ের সম্পাদিত “প্রত্যাবর্তন” নামক একটা বইতে ডাঃ নিশাত তামমিম নামক একজন বোন তার মনের আকুলতাটা ফুটিয়ে তুলেছেন এভাবে,
“.... যাকেই জিজ্ঞেস করি, সে নিজের দিক থেকে উত্তর দেয়, অন্যদেরকে ধুয়ে দেয়। এত সুন্দর একটা জীবনব্যবস্থা,অথচ মানুষগুলো এত অসহনশীল কেন? গন্তব্য যদি একটাই হয়, তবে পথগুলো নিয়ে এত রেষারেষি কেন ?”


এই যে কলজে ভরা বড়ো একটা দীর্ঘশ্বাস, চাপা চাপা মানসিক যন্ত্রণা—এটা ক'জন আর পারে মোকাবিলা করতে? ক'জন পারে এভাবে ওনার মতো নিজের প্রশ্নের জবাব নিজেই খুঁজে নিতে? ইসলামিস্টদের মধ্যে এই যে তীব্র রেষারেষি, সেই রেষারেষির যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়ে তিনি ফিরে যাননি, থেমে যাননি। একজন পথিক হয়ে তিনি খুঁজে গিয়েছেন সত্য পথ। তাঁর ভাষায় পড়ি চলুন,
“....... অতঃপর সিদ্ধান্ত গাঁটবেধেই নিলাম—আমার প্রশ্নের উত্তর আমাকেই বের করতে হবে, পড়তে হবে, জানতে হবে, জানাতে হবে।”[৫]

কিন্তু এভাবে আর কয়জন পারে? বিশ্বাস করুন এই বিষয়টা সবাই পারে না। সবাই নিশাত তামমিম আপুদের মতো হয় না। কিছু মানুষ ভিন্নও হয়। তারা এমন রেষারেষি, পারস্পরিক বিদ্বেষ আর অসম্মানজনক ও অসৌজন্যমূলক আচরণের জন্য আল-ইসলাম হতে ছিঁটকে পড়ে।

৬. মিডিয়ার কু-প্রভাব :

কালপ্রিট মাস মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া, সব জায়গায় পরিকল্পিত ইসলাম বিধ্বংসী, ইসলামি আদর্শ-মূল্যবোধ বিরোধী প্রচারণা। এসবের দ্বারাও মোটা অংশ প্রভাবিত হয়। পুরোপুরি নাস্তিক না হলেও ইসলাম নিয়ে, ইসলামি জীবনপদ্ধতি নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগে। সংশয়ের চাপে পড়ে কেউ কেউ হয়ে যায় ঘোষিত মুরতাদ! আবার কেউ সামাজিকতার খাতিরে চেপে রাখে নিজের ইরতাদের খবর।


৭. পরিবর্তনশীল বিজ্ঞানকে ধ্রুব সত্য মনে করা :

কতিপয় তরুণ-তরুণীদের অবস্থা এমন — তারা বিজ্ঞান যা বলবে তা-ই ধ্রুব সত্য বলে মনে করে। স্রষ্টা আর স্রষ্টার ওহীর জায়গায় স্থান দিচ্ছে বিজ্ঞানকে। দীন-ধর্মকে বিশ্বাস করা, মানা ঈমান আনা যাদের কাছে প্রগতিশীলতার বিরোধী, সেই তাদের কাছেই আবার বিজ্ঞানের ওপর শর্ত ছাড়া ঈমান আনা, বিজ্ঞান যা বলে চোখ বুজে মেনে নেয়াটা হলো স্মার্টনেস, প্রগতিশীলতা। কিন্তু বিজ্ঞানের প্রতিটি থিওরির পিছনে যারা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাল চালে, বস্তুবাদের বিরুদ্ধে গেলে বিজ্ঞানীদের গবেষণাগুলোকে যে টুটি চেপে ধরা হয়, ধর্মের পক্ষের যে সকল থিওরি থাকে, সেগুলো প্রচার করা তো দূরের কথা, সেগুলোর দিকে যে পশ্চিমের বিজ্ঞানী মহল এবং বিজ্ঞান একাডেমি যে নজরও দেয় না; সেগুলোর খবর তো আধুনিক-প্রগতিশীল-স্মার্ট তরুণ-তরুণীরা জানে না। পশ্চিমা-সাইন্স একাডেমি বিজ্ঞানের মড়কে পুঁজিবাদের পক্ষে যায় যেসকল থিওরি, সেগুলোকেই পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ানো হয়, প্রচার করানো হয় পুঁজিবাদীদের পুঁজি বাড়ানোর জন্য, সেগুলোর দিকেও খেয়াল করে না আমাদের কথিত স্মার্ট আর প্রগতিশীল তরুন-যুবক-যুবতীদের বড়ো একটা অংশ । যাকে টোটালি বিজ্ঞান পুঁজোই বলা যায়। অথচ এরাই এক আল্লাহর দাসত্বকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয় এবং দিতে চায়। ঈমানদারদের ঈমান নিয়ে, বিশ্বাসীদের বিশ্বাস নিঃসৃত আমল নিয়ে ট্রল করে। হাসাহাসি করে। অথচ তারা যে বিজ্ঞানের ওপর ঈমান আনয়নকারী, সেই বিজ্ঞান নিজেই একগাদা বিশ্বাসের ওপর দিয়ে পথ চলে। [০৬]

নাস্তিক ও তাদের অনুসরীদের জীবনাচরণে ধর্ম আর স্রষ্টা ছাড়া কেউ নৈতিকতার লাগাম দিতে পারে না, তাই তারা প্রকৃতিবাদ, বস্তবাদের ওপর অন্ধবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে চলতে চায়, স্রষ্টার ধারণা মুছে ফেলার জন্য তারা হাস্যকর, শিশুতোষ নানান থিউরিকেো আঁকড়ে ধরে সমানে এগোতে চায়। [০৭] তারা শুধু স্রষ্টা নয়, স্রষ্টার দিকে ইঙ্গিত করে এমন বিষয়কেও ঝেড়ে ফেলতে চায়।[০৮] আর আমরা বা আমাদের মানুষেরা সেই বিজ্ঞানকে ও বিজ্ঞানীদের কথাকেই না বুঝে আর না জেনে বসিয়ে রাখছি স্রষ্টার আসনে।

তারা স্রষ্টাকে বিশ্বাস করতে চায় না, করে না। কিন্তু, স্রষ্টা যে নেই, আমাকে যে স্রষ্টার অস্তিত্ব অস্বীকার করতে হবে বা অবিশ্বাসী হতে হবে — সে জন্য তো (দৃঢ়) প্রমাণ লাগবে; সেই প্রমাণ বা বিশ্বাসের বিষয়েও (মানে স্রষ্টা বলে কেউ নেই, সেই প্রমাণ) নিশ্চিত নয় বলেই মত দিয়েছেন নাস্তিকদের অন্যতম গুরু-ঠাকুর রিচার্ড ডকিন্স [০৯]!


৮. পশ্চিমা বস্তুবাদী জীবন-দর্শনকেই আইডল হিসেবে গ্রহণ করা :


বর্তমানে মুসলিমরা পরাজিত জাতি। অন্য কারো দোষ না, নিজেদের দোষেই। এই পরাজয় নিজেদের হাতের কামাই। আমরা পরাজিত বলে আমাদের মাঝে বড়ো হওয়া তরুণ-তরুণীদের অনেকেই বিজয়ী সভ্যতা, পশ্চিমা বস্তুবাদী দর্শনকে অনুসরণ করে তাদের মতো চলতে চায়; যার চূড়ান্ত ফলাফল স্বরূপ এক সময় তাদের মধ্যে নিভু নিভু করে জ্বলা ঈমানের পিদিমটা পরিপূর্ণভাবেই নেভে যায়। এরপর এক সময় গিয়ে তারা নাস্তিকতাকে বেছে নেয়।

পশ্চিমা সভ্যতা আমাদের কথিত মুক্তচিন্তার সবক দেয়, স্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতার সবক দেয়, সমতার শিক্ষা দেয়, কথিত নারী মুক্তির সবক দেয়, কোনটা বর্বর কোনটা মানবিক সেটা শিক্ষা দেয়; আমরাও মুখ বুজে লুফে নিতে চাই বা নিয়ে নিই সেগুলোকে। সেটাকে পাল্টা আঘাত করে চিন্তার ঝট খোলার কোশেশ না করেই হুমড়ি খেয়ে পড়ি তাদের মুখরোচক বাৎচিতে । এভাবে তারা মুখরোচক কিছু কথাবার্তার মাধ্যমে — মুক্তচিন্তা, বাকস্বাধীনতা— এক সময় আমাদের মুসলিম সমাজে ঈমান বিধ্বংসী ধর্মনিরপেক্ষতা, নাস্তিকতা, নারীবাদ ইত্যাদি আমদানি করে থাকে। যার প্রভাব এবং ফলাফলে আমাদের বিশাল একটা অংশ তরুণ-যুবক ঈমানহারা হয়।


৮. তরুণদের স্বাধীনচেতা মনোভাব :


এই বয়সটাই হলো “ বিশ্বজগত দেখবো আমি আপন হাতের মুঠোয় করে” টাইপ বয়স। সবখানে একটা অসীম স্বাধীনচেতা সাহসী তেজোময় মনোভাব। আর স্বভাবজাত এই বিষয়টাকেই কাজে লাগায় নাস্তিকরা। ইসলাম বিদ্বেষীরা । তারা স্বাধীনতার ভুল থিউরি কপচায়, ভুল মানে শেখায় আমাদের। আমরা একটা স্বাধীন রাষ্ট্রে আছি, তবুও আমাদের মাথার ওপর বহু আইন-কানুন আছে। কতোগুলো নিয়মনীতি আছে। এখন যেহেতু তারা ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা, যুদ্ধব্যবস্থা বিচারবিষয়ক নিয়ম-পদ্ধতি আচার-আচরণ সম্পর্কে জানে-ই না, সেহেতু মনে করে ধর্ম মানুষকে সব কিছুতে বাধা দেয়। তাই তারা ধর্ম বিরোধী হয়ে উঠে। পুঁজিবাদী ফিতনা, সমাজতন্ত্রের ফিতনা, নারীবাদের ফিতনা এগুলোকে সঠিক মনে করে সদ্য-স্বাধীন চিন্তার কারণে। যেহেতু এইসব ফিতনা ধর্মবিরোধী তাই তারা মনে করে ধর্মটা ভুল তারাই সঠিক।


৯. পূর্ণাঙ্গ ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত না থাকা :

অনেক বিষয় আছে রাষ্ট্রের কাজ। রাষ্ট্র উদ্যোগ নিলেই তা সম্ভব। যেমন শিক্ষা ব্যবস্থায় বিজ্ঞানের মোড়কে ডারউইনের পঁচা বিবর্তনতত্ত্ব পড়ানো। আল-কুরআন, আল-হাদিস, ইসলামি জীবনদর্শন না শেখানো, না পড়ানো বা সিলেবাস ভুক্ত না থাকা। রাষ্ট্রের আয়োজনে সেক্যুলার শিক্ষা বাস্তবায়ন, রাষ্ট্রের দ্বারা সেক্যুলার নাগরিক তৈরি। তো ইসলাম যদি পূর্ণাঙরূপে প্রতিষ্ঠিত থাকতো, তখন ছোটো বেলা থেকেই ইসলাম সম্পর্কে মোটামুটি রকমের একটা পূর্ণাঙ্গ ধারণা তৈরি হতো, নাস্তিকতার কালো থাবা খুব সহজে ছোবল মারতো না।


১০. নফসের খায়েশ মেটাতে :


মূলত নফসের কাজই হলো মন্দের দিকে উৎসাহ-উদ্দীপনা দেয়া। [১০] এই পয়েন্টটার সাথে অনেক কিছুই যুক্ত। যেমন পার্থিব সুযোগ-সুবিধা, জীবন-মান উন্নত করার লোভী প্রবণতা। নিজের কুপ্রবৃত্তিকে কোনো অপরাধবোধ ছাড়া চালানোর মানসিকতা। মানে হলো বর্তমানে চারিদিকেই হারাম। হারামের উপাদানগুলো পানির মতো সহজলভ্য। তো চারিদিকের সবকিছুই হারাম হওয়ায় ( নফসের দাস) তরুণরা তার মন মতো কিছু করতে পারে না। (নফসের উদগ্র খায়েশ মেটানোর মতো) সব কাজেই একটা বাধা হচ্ছে ধর্ম। সে কারণেও বিরাট একটা অংশ নাস্তিকতাকে বেছে নেয়। কারণ, সেখানে তার মন যা চায় সেটাই করতে পারার একটা কথিত বুলি আওড়ানো হয়। সে সুযোগ কিছুটা আছেও, নীতি-নৈতিকতার জলাঞ্জলি দিয়ে।


১১. নিজেকে আলাদা প্রদর্শন করার মানসিকতা :

ঢাকার উদয়ন কলেজের এক ছোটো ভাই, ভালোই প্র্যাটিসিং মুসলিম। (বর্তমানে ঢাবির মাইক্রোবায়োলজীতে পড়ে) তার অনেকগুলোই ফ্রেন্ডই নাস্তিক। তাকে জিজ্ঞেস করছি নাস্তিকতার এই কারণ সম্পর্কে, তার কথা বা জবাব ছিলো এরকম— এটা একটা ট্রেন্ড। আমাদের পোলাপানদের মধ্যে একটা ট্রেন্ড চালু হয়ে গেছে যে, নিজেকে অন্যদের চেয়ে একটু আলাদা প্রদর্শন করতে হবে। অন্যের চেয়ে নিজেকে ব্যতিক্রম হিশেবে উপস্থাপন করতে হবে। এই মানসিকতার কারণেও একটা অংশ নাস্তিকতার খপ্পরে পড়ে। আবার, ইসলামি জীবনাচারণ নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগাও একটা কারণ। সেজন্য ট্রেন্ড ফলো করা, নিজেকে একটু ব্যতিক্রম হিশেবে উপস্থাপনের জন্য দীন ত্যাগ, এটাই তাদের কাছে স্মার্টনেস। অথচ এটাও তো একপ্রকার দাসত্ব। ট্রেন্ডের দাসত্ব।


১২. সাহিত্য-সাংস্কৃতিতে সেক্যুলারদের রাজত্ব :

আমাদের হাতে আছে সবচেয়ে নান্দনিক সাহিত্য মানে উন্নত-সমৃদ্ধ আলকুরআন ও আরবি ভাষা। সে ভাষা আর সাহিত্যের উপাদান কাজে লাগিয়ে আমরা আমাদেরকে বাংলা সাহিত্যের নেতৃত্বে নিয়ে আসতে পারি। কিন্তু আমাদের ইসলামপন্থীরা এক্ষেত্রে নিদারুণ পিছিয়ে আছে। ( যদিও কিছুটা হলেও অনেকেই এগিয়ে আসছে এখন) তো জাহিলরা যেখানে নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব চালাবে সেখানে জাহালাতের স্পষ্ট চাপ প্রতীয়মান হওয়াটা তো স্বাভাবিকই। ইসলামপন্থীরা, ওলামায়ে কিরাম যদি এগিয়ে আসে তাহলে সেখানে তাওহিদের চাপ থাকাটাও স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা নেই। সেজন্যে আমরা মুসলিমরা এবং আমাদের মুসলিম ঘরের সন্তানেরা সেক্যুলার সাহিত্যে ও সেক্যুলার চিন্তায় বুদ হয়ে থাকি। হারিয়ে ফেলি নিজ দীন-ধর্ম-আদর্শ।


১৩. হতাশা ও আবেগ:

নানাবিধ হতাশায় জীবন যখন বিষিয়ে ওঠে, প্রাণ যখন ওষ্ঠাগত হয়ে যায়, তখন আল্লাহ আমাদের আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন,
‘ আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। মুমিন হয়ে থাকলে হতাশ হয়ো না, মন মরা হয়ো না।’ [১১]

কিন্তু এই মোটিভেশানগুলো তো শহুরে মধ্যবিত্ত ও এলিটশ্রেণি পায় না। ( বেশিরভাগ) আলিম-ওলামারা তো অতোটা তরুণমুখী নয় এবং সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থায় তো এই শিক্ষাগুলো অনুপস্থিত; যার কারণে তারা হতাশা হতে নাস্তিকতা-ধর্মবিরোধিতায় চলে যায়।

প্রেমে ব্যর্থতা হতে হতাশা, চাকুরি, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং এমন কিছু লোকও দেখেছি যে, যারা (চোরা লাইনে) বিদেশ-পাড়ি দিতে গিয়েও ব্যর্থ হয়ে ক্ষোভ আর হতাশা ঢালে ধর্মের ওপর। আর মূলত বয়সটা তো আবেগের, আবেগ যেদিকে ছুটে সেদিক থেকে কামব্যাক করা খুব মুশকিল। সেখানে যদি বিজ্ঞানের মোড়কে স্রষ্টা ও ধর্ম বিরোধিতার আয়োজন থাকে, আর ডারউইনের বিবর্তনতত্ত্বকে সহীহ প্রমাণ করার কোশেশ থাকে, তখন তো উত্তাল আবেগে সেদিকে ঝুঁকে পড়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। এবং অনেকে আবেগের বশবর্তী হয়ে জ্ঞানহীনভাবে (ধর্ম ও বিজ্ঞানের ) নাস্তিকতার চোরাবালিতে আটকে পড়ে।


নাস্তিকতা রোধে করণীয় :
----------------------------------------


যেখানে আলো আছে সেখানেই আসবে আঁধার। আলোর উপস্থিতিতেই আঁধার টুটে যায়। যাবে। সত্য-মিথ্যার দ্বন্ধ-সংঘাত অনিবার্য। এই সংঘাত চিরস্থায়ী। তাই বিশ্বাসী মানুষের সাথে আল্লাহদ্রোহীদের চিরায়ত সংগ্রামের সমাপ্তি কিয়ামত অবধি চলবে। পশ্চিমাকাশে সূর্যোদয় হওয়া অবধি চলতে থাকবেই। এটাই বাস্তবতা। তবে মোটের ওপর উপরের আলোচনায় সমস্যাগুলোর পাশাপাশি সমাধানের ইঙ্গিতও করা হয়েছে। এখানে কয়েকটা পয়েন্ট তুলে ধরবো শুধু।


⛔ দাওয়াত :


প্রথমত এই নাস্তিকতার বিষবৃক্ষ আর যেনো আমাদের তরুণ তরুণীদের ওপর ডালপালা না মেলে সেজন্যে যা করতে হবে, তা হলো গণহারে ইসলামের দাওয়াত সুন্দর ও যুক্তিগ্রাহ্য পন্থায় তুলে ধরতে হবে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা আমাদের এটাই বলেছেন আল-কুরআনে। [১২] আবার, রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও বলেছেন যে, তাঁর পক্ষ থেকে দীনের একটি বাণী হলেও অপরের নিকট পৌঁছে দিতে। [১৩] তো ইসলামের শিক্ষা সঠিকভাবে পৌঁছালে নাস্তিক ও ধর্মবিদ্বেষীদের ভুল ব্যাখ্যা, অপপ্রচার রোধ করা সম্ভব হবে। আমরা আলো নিয়ে এগোলে আঁধার টুটবেই। ইন শা আল্লাহ!


⛔ জ্ঞানার্জন :


দ্বিতীয়ত হলো জ্ঞানার্জন। ইসলামের বিধি-বিধানসমূহ জানতে এবং মানতে চেষ্টা করা। মূলত জানলেই মানার আগ্রহ জাগে। আমাদের প্রতিটি মুসলিমের জন্য ইলম অর্জন করা ফরজ [১৪]। রাসুলে করিম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সীরাহ জানলে, ইসলাম ঠিকঠাকভাবে জানলেই নাস্তিকতার কোমর ভেঙে যাবে।


⛔ ইসলামপন্থীদের পারস্পরিক দূরত্ব ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত দূর করা :

তৃতীয়ত হলো গিয়ে ইসলামপন্থীদের পারস্পরিক দূরত্ব, দ্বন্দ্ব-সংঘাত ঝেটিয়ে বিদেয় করে দিতে হবে। পারতপক্ষে কমিয়ে আনা উচিত। একাডেমিক্যালি যেসব বিষয় আলোচনার মতো সেগুলো পাবলিক প্লেসে না আনা। ছোটো খাটো বিবেদ ও মতবিরোধকে উস্কে না দেওয়া, সামনে না আনা। যেমন রাফউল ইয়াদাঈন, জোরে আমীন-আস্তে আমীন, ইমামের পেছনে সুরা ফাতিহা পড়বো কী পড়বো না; এই ধাঁচের যা আছে সব।


⛔আলিমদের সামাজিক কর্তৃত্বে ও সমাজ সেবায় এগিয়ে আসা :


চতুর্থত হলো গিয়ে ওলামায়ে কেরামকে গণমানুষের সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসা। মানুষের সুখে-দুঃখে পাশে থাকা। তারুণ্যের সমস্যা ও সমাধান নিয়ে কাজ করা। তাদের উপযোগী বিভিন্ন কাজকারবারের আয়োজন করা। তাদের হৃদয়ের ভাষা বুঝতে চেষ্টা করা। সেভাবে কথা বলা। ইসলামপন্থীদেরও যুবকদের বেকারত্বের সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করা, তরুণদের ক্যারিয়ার গাইডলাইন দেয়া। তরুণরা যেনো আলিমদের কাছে আসতে পারে বা কাছে আসে— আলিমদের সে ধরনের মেজাজ, সেরকম আচরণ অর্জন করা। বয়ানের ইসলামকে বাস্তবের ইসলামে পরিণত করা।


⛔️পশ্চিমা চিন্তা-দর্শনের অসারতা ফুটিয়ে তোলা :

পঞ্চমত হলো পশ্চিমা চিন্তার অসারতা ফুটিয়ে তোলা। তাদের ভন্ডামিপূর্ণ চিন্তা-দর্শনকে পাল্টা আঘাত করা। ডিপেন্সিভ অবস্থান বর্জন করা। যেমন, তারা নারী স্বাধীনতার কথা বলে। কিন্তু আসলেই কি তারা নারীদের স্বাধীন করে? নাকি পরাধীনতার শেকলে আবদ্ধ করে? যেমন একটা গাড়ি বিক্রয় হবে। নামি-দামি ব্র্যান্ডের। তো সেখানে গাড়ির পাশেই একজন অর্ধলোঙ্গ নারীকে রাখতেই হবে কেন? তার সৌন্দর্য প্রদর্শন করে গাড়ির বিজ্ঞাপন করতে হবে কেন? এটা কি নারীকে স্রেফ একটা পন্যসামগ্রিই করে তুলছে না? আই পি এল/ বিপিএল-সহ নানাবিধ খেলা হবে, তো সেখানে খেলার মাঝে কী কারণে নারীর নগ্ন-অর্ধনগ্ন দেহ প্রদর্শনী করা হবে? সেই নগ্ন নারীদের দ্বারা কেন নাচাতে হবে? মানুষের চোখ রঞ্জন করতে হবে কেন নারী দেহ দ্বরা? এটা কী করে নারী স্বাধীনতা হলো? নাকি নারীর সম্মান, ইজ্জত আব্রুকে শিকেয়তোলা হলো? কই, এভাবে তো কখনো কোনো অর্ধলোঙ্গ পুরুষদের দ্বারা তাদের কোনো ইভেন্টে নর্তন-কুর্দন করা হয় না?

সেক্যুলার আইনে দেশ চালানো, শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনা করা, সে আইনকে অমান্য করলে শাস্তির দাবি তোলাটা, শাস্তি দেয়াটা সেক্যুলারন্ধ হয় না, কিন্তু যখনই কেউ ইসলামি আইন-শৃঙ্খলা, ইসলামি শিক্ষা-সমাজ ব্যবস্থার দাবি তোলে, তখন তাকে বলা হয় ধর্মান্ধ। নাস্তিক-সেক্যুলারদের দাবি হলো— তারা সবার চাহিদার প্রতি, সবার মতামতের প্রতি, সবার দাবির প্রতি শ্রদ্ধাশীল; কিন্তু কোনো মুসলিম যখন ইসলামি আন্দোলন, ইসলামি জীবন বিধান, ইসলামি যুদ্ধনীতি বা জিহাদের কথা বলে তখন তাকে বা তাদের মৌলবাদী-জঙ্গী ইত্যাদি নানারকম অদ্ভুত কিসিমে’র ট্যাগ দেওয়া হয় কেন? তাদেরকে ডিহিউম্যানাইজ করা হয় কেন? এভাবে হাজারো কিছু আছে। এমন করে তাদের ভন্ডামি, তাদের চটুলতা, তাদের জীবনবোধের অসরতা ফুটিয়ে তুলতে হবে। সাথে সেটার ভিত্তি মূলে আঘাত হানতে হবে। তবে আগে পূর্ণরূপে কুরআন-হাদিস-ফিকহ নিয়ে মোটামুটি অনেক কিছু জানাশোনা লাগবে। তাহলে গিয়ে নাস্তিকতা, ধর্মবিরোধিতা সেক্যুলারিজম, সোশ্যালিজম হালে পানি পাবেনা। নিজেকে রক্ষায় ব্যতিবস্ত হয়ে পড়লে নাস্তিকতা প্রচারের সুযোগ কোথায়?


⛔️ বিজ্ঞান একাডেমি আর তাদের হর্তাকর্তাদের স্বরূপ তুলে ধরা :


ষষ্ঠত হলো গিয়ে যে বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে নাস্তিকতা ও ধর্মবিরোধিতা করানো হয়, সে বিজ্ঞান একাডেমি আর তাদের হর্তাকর্তাদের স্বরূপ তুলে ধরা। তাদের জালিয়াতি, তাদের একপেশে চিন্তাভাবনা, তাদের ভন্ডামি তুলে ধরা। তারা তাদের প্রকাশিত কোনো গবেষণাপত্রে ভুল হলেও তা এড়িয়ে যায়। পুনরায় খতিয়ে দেখার প্রয়োজনবোধ করে না, এবং দেখেও না। [১৫] অথচ আবেগী পোলাপানদের সামনে যখন ধ্রুব সত্য হিশেবে বিজ্ঞানকে উপস্থাপন করা হয়, তখন তারা দেখে কিছু থিউরি ইসলামের সাথে কন্ট্রাডিক্ট, এটা দেখার পর একটা অংশ আবেগের বশে নাস্তিক হয়ে যায়। কিন্তু দীন-ধর্ম বিরোধী সেই বিবর্তনবাদীরা-ই অকপটে স্বীকার করে যে, বৈজ্ঞানিক সত্য কখনো চূড়ান্ত নয়। আজ যা সাইন্টিফিক ফ্যাক্ট তা ক'দিন পরে বাতিলও হতে পারে [১৬]

এমন আরো বিষয়াদি আছে বিজ্ঞানের, এখন আমাদের কাজ কী? আমরা সে বিষয়াদি দিয়েই সেগুলো মোকাবেলা করবো। এটি খুব সহজেই করা যায়। এ কথা একবার এক বক্তৃতায় বলার পরে এক ছোটো ভাই হেসে হেসে বলে উঠলো— মানে ভাই, সাইন্স দিয়ে সাইন্সকেই রেফ করা যায় আরকি। হো হ করে তখন সবাই হেসে উঠলো।

যাহোক, যেখানে ইসলাম ও বিজ্ঞান হলো একে অপরের পরিপূরক; সেখানে পশ্চিমা দুনিয়ার কথিত বিজ্ঞানের ধারকবাহক আর আমাদের বঙ্গীয় কথিত বিজ্ঞান মনস্করা দুটো জিনিশকে পরস্পর মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে। তো সে জন্য বিজ্ঞানই যে ধ্রুব নয় সেটা বুঝাতেই তাদের বিভিন্ন রকম পরস্পর বিপরীতমুখী বিষয়াদিগুলো সামনে তুলে ধরে তাদেরকে বুঝিয়ে দিতে হবে। এবং সর্বস্তরেই এই বিষয়গুলো করা উচিৎ। মানুষকে সত্যের শাশ্বত বিধি-বিধান জানানো উচিত। যেনো ‘বিজ্ঞান বলেছে তাই ঈমান আনলাম’ এমন না হয়। আর সে কারণে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কিছু আলিমদেরকে বিজ্ঞান-দর্শন নিয়েও পড়াশোনা করা ও সেসবের ওপর গভীরতা অর্জন করা উচিত। সেটা যদি এমন হতো যে, জেনারেল ছাত্ররা ইসলামের মৌলিক বিষয়াবলি ভালো আলিমদের তত্ত্বাবধানে এসে ও থেকে জানবে, আর মাদ্রাসার ছাত্রদের সিলেবাসে মিনিমাম বিজ্ঞান জানাশোনার ব্যবস্থা করা হবে; তাহলে বিষয়টা দারুণ কাজে লাগতো। নাস্তিকতার বিষবাষ্প কম ছড়াতো আমাদের তরুণদের মাঝে। আমাদের মুসলিম সমাজে। মুসলমানদের ঘরে।


⛔️বয়ানের ইসলামকে ইসলামকে বাস্তবের আমলে রূপান্তর করা :

সপ্তম যে বিষয়টা বলবো, তা হলো বয়ানের ইসলামকে বাস্তবের আমলে রূপান্তর করা। নিজেই আগে আমল করা। বয়ান করে আমল না করা, এটা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লারও অপছন্দও। [১৭] কথায় কাজে দা'ঈদের অমিল দেখেও অনেকেই দীন থেকে দূরে সরে যায়। কারণ সবার ঈমান আমান তো আর সমান না।


⛔️ইসলামপন্থীদের সমাজের সর্বস্তরে একটা প্রভাব তৈরি করা :

এই পয়েন্টে যা বলবো তা হলো যে, ইসলামপন্থীদের সমাজের সর্বস্তরে একটা প্রভাব তৈরি করা। নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব করা। যেনো কোনো নাস্তিক প্রফেসর, মোটিভেশনাল স্পীকারের কিংবা সাহিত্যিকদের দিকেই হুমড়ি খেয়ে না পড়ে এদেশের তরুণ-তরুণী ও যুবক-যুবতীরা।

⛔️নিজেদের মিডিয়া ও মিডিয়া-কর্মী তৈরি করা :

আমরা দেখতেই পাচ্ছি যে, মিডিয়ার মাধ্যমে রাতকে দিন, দিনকে রাত করা হয়। এই মিডিয়ার মাধ্যমেই ইসলাম এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কেউ কৌশলে কেউ প্রকাশ্যে ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ায়, বিরোধিতা করে। এরপর ধীরে ধীরে এসবকে মানে মিথ্যুক মিডিয়ার ছড়ানো মিথ্যাচারকে প্রমাণ হিশেবে কাজে লাগিয়ে পুরোদমে নাস্তিকরা মুসলিমদের ঈমানি ইমারাতে ভয়াল ধ্বস নামিয়ে আল্লাহদ্রোহী নাস্তিক বানিয়ে দেয়। তাই ইসলামের অনুসারীদের উচিত সত্য প্রচার ও প্রকাশ করার জন্য নিজেদের অসংখ্য প্রিন্ট মিডিয়া-ইলেকট্রনিক মিডিয়া, সাংবাদিক-সাহিত্যিক-চিন্তক ও বুদ্ধিজীবী তৈরি করা। অন্তত পক্ষে এখন সেটা না পারলেও এসব সেক্টরের সবার মাঝে দাওয়াতি কাজ করা। এই দাওয়াতে পরিপূর্ণ মুসলিম না হলেও যেন ইসলাম ও ইসলামি জীবন-বিধানের প্রতি নমনীয় হয়, ইসলামের হিতাকাঙ্খী, ইসলামের প্রতি দরদী, দীন-ধর্মবিরোধীদের বিরুদ্ধে সজাগ ও সচেতনতা সৃষ্টি হয়।

ইসলামকে যারা বিজয়ী আদর্শ হিশেবে দেখতে চান, তাঁরা যদি সবদিকেই লোক তৈরি করতে পারেন, সব অঙ্গনেই যদি দীনের দাওয়াত পৌঁছে দিতে পারেন; তাহলে নাস্তিকতা ও ধর্মবিরোধিতা হালে পানি পাবে না। ইন শা আল্লাহ!

⛔️ একটা বাস্তব গল্প :

একটা বাস্তব গল্প দিয়ে লেখার পয়েন্টগুলো শেষ করছি। তা হলো এই, মুহিত ( ছদ্মনাম)। ঢাকা সিটি কলেজের ছাত্র। পড়ছে ঢাকার সামছুল হক খান স্কুলে, মানে আগে পড়তো আরকি। তখন সেখানের এক মেয়েকে ভালো লেগেছে তার। মেয়েটির সাথে প্রেম করার জন্যে আল্লাহর কাছে দু’আও করেছে সে। অনেক সাধনার পর একটা পর্যায়ে এসএসসি পরীক্ষার কিছুদিন আগে রিলেশন হলো তাদের। তো যখন তারা কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে উঠলো, তখন পরিবার জানার পর বাঁধ-সেধে বসলো। যার ফলে তাদের রিলেশন ভেঙে গেলো। আর সে হতাশা থেকে ধীরেধীরে মুরতাদ এখন।


তো এই গল্প দিয়ে যা বুঝাতে চেয়েছি তা হলো—ইসলামি জ্ঞান তার কতো নিচু লেভেলের হলে সে হারাম সম্পর্কের (প্রেমের জন্য) কবুলিয়াতের জন্যে আল্লাহর কাছে দু’আ করতে পারে! অথচ সে শহরের সেরা একটা প্রতিষ্ঠানে পড়ে। যেখানে ইসলামের ন্যূনতম শিক্ষাটা পর্যন্ত পাচ্ছে না। পরিবারে যতোটুকুন ইসলাম আছে তা-ও সে ব্যস্ত জীবনের ক্যারিয়ার গড়ার মন্ত্রে ডুবে পড়ে থাকার কারণে শিখতে পারেনি, শিখেনি। আমার সাথে যে কোনো কারণেই হোক পরিচয় হলো বিধায় আমি বললাম বিয়ে করে নাও উভয়ের বাসায় বলে। অথচ বাসায় বলেছে তারা মানবে না। এখন তারা যদি বিয়েটা সহজ করতো তাহলে হারাম রিলেশন থাকতো না, আবার সে যদি ইসলামের শিক্ষাটা পেতো তাহলে সে এই হারামের জন্য এমনটাও করতো না। আমরা ইসলামের কোনো শিক্ষাটাই কাজে লাগাই না। এটাও একটা বাস্তব প্রমাণ। এভাবে কিন্তু অনেক পোলাপান প্রেমে ব্যর্থ হলে পরীক্ষায় খারাপ হলে পরে আত্মহত্যা ঈমান হত্যা করার নযীর আছে। ভূরি ভূরি। অসংখ্য।


⛔️শেষ কথা :

শেষ পর্যায়ে যা বলতে চাই, সেটা হলো আমি নিজেও সংশয়ের আবর্তে ঈমান হারা হবার যোগাড় ১৭ সালের শেষ দিক এবং ১৮ সালের বিরাট একটা অংশজুড়ে ছিলো। টুকটাক ইসলাম সম্পর্কে কিছু জানতে চাই বলে আজো ঈমানের ওপর কিঞ্চিৎ হলেও অবশিষ্ট আছি। কিন্তু আমার পরিচিত এবং আমার খুব নিকটতম এক ভাই হারিয়ে গেছে যে আজো ফিরে নি। তো আমি তার মাঝে নাস্তিক হবার যে কারণগুলো পেয়েছি এবং আমি নিজের জীবনে যা মোকাবিলা করলাম সেগুলোর আলোকে কিছু লেখতে চেষ্টা করেছি। আর হ্যাঁ আরো বেশি জানা বা অভিজ্ঞতার জন্য এমন কিছু তরুণ ভাইদের সাথে মেসেঞ্জারে চ্যাট করেছি যারা বিষয়টা কিছুটা হলেও মোকাবিলা করেছে।

| তরুণ-তরুণীদের মাঝে নাস্তিকতা : কারণ ও করণীয় |
~রেদওয়ান রাওয়াহা


রেফারেন্স
-----------------
[০১] আল-কুরআন-০৩/১৯
[০২] আল-কুরআন-০৫/০৩
[০৩] আল-কুরআন- ১৬/৮৯
[০৪] তাফসীরে জাকারিয়া- ৯৬/০১
[০৫] প্রত্যাবর্তন -৪৪ নং পৃষ্ঠা
[০৬] অবিশ্বাসী কাঠগড়ায়: ডাঃ রাফান আহমেদ -৩৪ নং পৃষ্ঠা।
[০৭] অবিশ্বাসী কাঠগড়ায়: ডাঃ রাফান আহমেদ-৩৭ নং পৃষ্ঠা।
[০৮] অবিশ্বাসী কাঠগড়ায়: ডাঃ রাফান আহমেদ- ৩৮ নং পৃষ্ঠা।
[০৯] অবিশ্বাসী কাঠগড়ায়: ডাঃ রাফান আহমেদ-৩২ নং পৃষ্ঠা।
[১০] আল-কুরআন-১২/৫৩
[১১] আল-কুরআন-৩১/৫৩ এবং ০৩/১৩৯
[১২] আল-কুরআন-১৬/১২৫
[১৩] সহীহ্ বুখারী :হাদিস নং-৩২৭৪
[১৪] ইবনু মাজাহ হা/২২৪
[১৫] হোমোস্যাপিয়েন্স: ডাঃ রাফান আহমেদ-পৃষ্ঠা নং-৫৫
[১৬]হোমোস্যাপিয়েন্স: ডাঃ রাফান আহমেদ-পৃষ্ঠা নং-৫৬
[১৭] আল-কুরআন-৬১/০৩
[১৮]

পঠিত : ৩৩৮ বার

মন্তব্য: ০