Alapon

শিক্ষাব্যবস্থা : ইসলামী দৃষ্টিকোণ



১৯৩৫ সনে এই প্রশ্নটি বেশ জোরালোভাবেই উত্থাপিত হয়েছিল যে, মুসলমানদের নিজস্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে নাস্তিক; নাস্তিকতা ভাবাপন্ন এবং প্রকৃতিবাদে বিশ্বাসী ও তার প্রচারক এত অধিক সংখ্যায় বের হচ্ছে কেন? বিশেষ করে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে অভিযোগ ছিলো, এখান থেকে সনদপ্রাপ্ত শতকরা ৯০ ভাগ শিক্ষার্থীই নাস্তিকতা ও প্রকৃতিবাদের পূজারী!

উপমহাদেশে মুসলিমদের নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান গঠনের প্রাক্কালে উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ মুজাদ্দিদ মাওলানা মওদূদী রহ. রাজনৈতিক সংস্কারের পাশাপাশি শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের দিকে গভীর মনযোগ দেন। মুসলিমদের রাষ্ট্র পাকিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থা কেমন হতে পারে এর পাশাপাশি বর্তমান পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থার গলদ ও মৌলিক ত্রুটি আলোচনা করেছেন। ইংরেজদের শিক্ষানীতির সমস্যাগুলোর পাশাপাশি সমাধানমূলক অনেকগুলো বক্তব্য ও প্রবন্ধ লিখে একটি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাব্যবস্থার প্রস্তাবনা করেছেন মাওলানা মওদূদী। সেই বক্তব্য ও প্রবন্ধগুলো সংকলন করে একটি বই প্রস্তুত করা হয়েছে।

অনেকটা শিক্ষা বোর্ডের মতো বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যার কাজ হলো শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা করা ও সে অনুযায়ী পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক তৈরি করা। সেই প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ 'ইসলামী এডুকেশন সোসাইটি' মাওলানা মওদূদীর শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে লেখা বইটি বাংলায় প্রকাশ করে। বইটির বাংলা নাম 'শিক্ষাব্যবস্থা : ইসলামী দৃষ্টিকোণ'।
বইটি অনুবাদ করেন মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক ও হাফেজ আকরাম ফারুক।

আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতিকে সামনে রেখে মাওলানা প্রথমেই আলোচনা করেন তৎকালীন ইংরেজ সরকারের আমলে পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা ও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মৌলিক ত্রুটিগুলো কী কী? মুসলিমদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে এই বিচ্যুতির সয়লাব ঠেকাতে পারে সেই বিষয়ে আলোচনা করেন।

এরপর তিনি মুসলমানদের জন্য নতুন শিক্ষানীতি ও কর্মসূচীর ব্যাপার আলোকপাত করেন। এখানে তিনি যে বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দেন তা হলো,
(১) মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দী থেকে ফিরিংগীপনার মূলোৎপাটন একান্ত জরুরী।
(২) শিক্ষাঙ্গনে ইসলামী চেতনা ও প্রাণপ্রবাহ সৃষ্টি
(৩) বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থায় আরবীকে বাধ্যতামূলক ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

এই অধ্যায়ে মাওলানা প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজ স্তরে পড়াশোনা কেমন হওয়া উচিত তার একটি নাতিদীর্ঘ বর্ণনা দিয়েছেন।

এরপর মাওলানা প্রস্তাবিত ইসলামী শিক্ষাপদ্ধতি বাস্তবায়নের পন্থা নিয়ে আলোচনা করেন। এই নিয়ে তিনি ৭ দফা পরিকল্পনা ব্যক্ত করেন।

এরপর এই বইটিতে মাওলানার একটি সনদ বিতরণী অনুষ্ঠানের বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়েছে। মাওলানা মুসলিম হিসেবে ইসলামী জ্ঞানর্জনের জন্য তিনিটি পরামর্শ দেন।
প্রথমতঃ আপনারা যতটা সম্ভব আরবী ভাষা শিখতে চেষ্টা করুন।
দ্বিতীয়তঃ পবিত্র কুরআন, হযরত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন কথা এবং সাহাবায়ে কিরামের জীবন চরিত্র অধ্যয়ন করা ইসলামকে বুঝবার জন্য অপরিহার্য।
তৃতীয়তঃ ইসলাম সম্পর্কে ধারাবাহিক ও নিয়মিতভাবে পড়াশুনা করুন।

ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা ও তার বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে মাওলানা লাহোরে বরকত আলী মোহামেডান হলে ছাত্রদের এক সমাবেশে ১৯৫২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারী বক্তব্য দেন। সেখানে, প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থা, পাশ্চাত্য শিক্ষা ও এর কুফল আলোচনা করার পর বলেন,

আমাদের সত্যিই যদি ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করার ইচ্ছা থেকে থাকে তাহলে কেবল জোড়াতালি ও মেরামত দ্বারা কার্যসিদ্ধি হবে না, বরং সেজন্য একটা বিপ্লবী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এই কথাটা উপলব্ধি করানোর জন্যই আমাদের এ আলোচনার অবতারণা। আসলে প্রচলিত দু’টো শিক্ষাকেই অর্থাৎ পুরনো ধর্মীয় শিক্ষা এবং বৃটিশ প্রবর্তিত আধুনিক শিক্ষাকে বাতিল করে দেয়া এখন অপরিহার্য হয়ে ‍উঠেছে। এই উভয় ব্যবস্থার পরিবর্তে একটা নতুন একক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে। প্রচলিত দুটো শিক্ষাব্যবস্থার যাবতীয় দোষত্রুটি থেকে নতুন শিক্ষাব্যবস্থাকে মুক্ত হতে হবে এবং একটা মুসলিম স্বাধীন ও উন্নয়নকামী জাতি হিসেবে আমাদের যাবতীয় চাহিদা ও প্রয়োজন পূরণের নিশ্চয়তা তার আওতাভুক্ত থাকতে হবে। এই নয়া শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ও তা বাস্তবায়নের পদ্ধতি এখন আমি আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।

এ ব্যাপারে মাওলানা ৩ টি পয়েন্টে কথা বলেন,
১. শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নির্ধারণ
২. ধর্ম ও দুনিয়াদারীর পার্থক্য ঘোচাতে হবে
৩. চরিত্র গঠন

বইটির শেষভাগে একটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপরেখা দেওয়া হয়েছে। সবশেষে নারী শিক্ষার ব্যাপারে মাওলানার একটি প্রবন্ধ সংযুক্ত করা হয়েছে।

নারীর শিক্ষা পুরুষের মতই জরুরী। নারীদের অজ্ঞ ও অনগ্রসর রেখে পৃথিবীতে কোন জাতিই উন্নতি ও অগ্রগতির পথে অগ্রসর হতে পারে না। এজন্য মুসলিম পুরুষদের মত মুসলিম নারীদের শিক্ষার জন্যও যতদূর সম্ভব উন্নত ব্যবস্থা করা উচিত। এমনকি তাদের সামরিক ট্রেনিং দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কেননা আমাদেরকে এমন সব অত্যাচারী ও আধিপত্যবাদী জাতির সাথে পাল্লা দিয়ে থাকতে হচ্ছে, যারা মানবতার কোন সীমানা লংঘনেই সংকোচবোধ করে না। খোদা না করুন, তাদের সাথে কোন যুদ্ধ বিগ্রহ বেধে গেলে তারা কি কি ধরনের বর্বরতার পরিচয় দিবে, তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। কাজেই আমাদের কর্তব্য নারীদেরকে আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত করা।

তবে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, আমরা মুসলিম। সুতরাং আমরা যা কিছু করবো তা যেন আমাদের ঈমানের পরিপন্থী না হয় এবং যেসব মূল্যবোধ ও সভ্যজনোচিত বিধি-নিষেধ মানতে আমরা ইসলাম কর্তৃক আদিষ্ট, তারও খেলাফ না হয়।

পাশ্চাত্য সভ্যতা ও আমাদের সভ্যতার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে, সে কথা আমাদের মনে রাখতে হবে। এ দুটোর মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য পার্থক্য এই যে, নারী যতক্ষণ পুরুষ সেজে পুরুষোচিত দায়িত্ব পালনে এগিয়ে না আসে, ততক্ষণ পাশ্চাত্য সভ্যতা নারীকে সম্মান দেয় না এবং তার কোন অধিকার স্বীকার করে না।

কিন্তু আমাদের সভ্যতা ও শিক্ষা নারীকে নারী রেখেই তার যথোচিত সম্মান ও অধিকার প্রদান করে। তার উপর শুধুমাত্র সেইসব সামাজিক দায়িত্বই অর্পণ করে যা স্বয়ং প্রকৃতি তার উপর স্বাভাবিক নিয়মে অর্পণ করেছে। সুতরাং আমাদের নারীদের শিক্ষাব্যবস্থাটা তাদের স্বভাবের দাবী ও প্রয়োজন অনুসারে হতে হবে এবং পুরুষদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হতে হবে। এক্ষেত্রে সর্বনিম্নস্তর থেকে নিয়ে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত কোথাও সহশিক্ষার প্রশ্নই উঠতে পারে না।

এ ছাড়া নারীদের শিক্ষায় এ কথাটা বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা দরকার যে, তাদের আসল ও স্বাভাবিক দায়িত্ব হলো গার্হস্থ্য জীবন পরিচালনা ও মানুষ গড়া, কৃষি খামার, কল-কারখানা, অফিস আদালত চালানো নয়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার কাজ হবে নারী জাতিকে একটা সাচ্চা মুসলিম জাতি গঠনের যোগ্য করে তোলা যে জাতি দুনিয়ার সামনে স্রষ্টার রচিত কল্যাণকর ও স্বাভাবিক জীবনব্যবস্থার বাস্তব দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারবে।

১৯৪৭ সালে আমরা ইংরেজদের থেকে স্বাধীনতা লাভ করলেও দীর্ঘ মুসলিম শাসনেও আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ইসলামের আলোকে করতে সমর্থ হইনি। ইংরেজ আমল থেকে কিছু কিছু ব্যাপারে আমাদের আরো খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। যেমন ১৯৭১ সালের পর থেকে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় হিন্দুয়ানী কালচার ঢুকে পড়েছে।

যারা দ্বীন প্রতিষ্ঠার কর্মী তাদের ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার স্বরূপ জানা উচিত। আর এই জানার জন্য মাওলানা মওদূদীর এই বইটি বেশ সহায়ক হবে বলে আমি মনে করি। যদিও মাওলানা ইংরেজ আমলের প্রেক্ষাপটে লিখেছেন তবুও এটি বর্তমান সময়ের জন্য বেশ প্রাসঙ্গিক।

#বুক_রিভিউ
বই : শিক্ষাব্যবস্থা : ইসলামী দৃষ্টিকোণ
লেখক : সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী
অনুবাদক : মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক ও হাফেজ আকরাম ফারুক
প্রকাশনী : ইসলামিক এডুকেশন সোসাইটি
পৃষ্ঠা : ১১৯
মুদ্রিত মূল্য : ৬০
জনরা : শিক্ষা ও গবেষণা

পঠিত : ৩৭৭ বার

মন্তব্য: ০