Alapon

"ইউরােপের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলাের ভিত্তি ছিল মাদ্রাসা"



মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে কেউ কেউ নাক সিটকায়।পাশ্চাত্যের খৃস্টান-ইহুদিরা যখন মাদ্রাসাকে সমালােচনা করে তখন কিছুটা বােধগম্য, কিন্তু তথাকথিত মুসলমানরা যখন করে, তখন দুঃখ হয়। তবে এই হতভাগারা ইসলাম ও মুসলিম সভ্যতা সবকিছু নিয়েই নাক সিটকায়। শরিয়াহ, কোরআন, হাদীস, ফেকাহ, বােরকা, হিজাব, পর্দা, ফতওয়া, মােল্লা (তারা পণ্ডিত, আচার্য, পুরােহিত, পাদ্রি, ভিক্ষুতে নাক সিটকায় না) পীর, তরিকা, তাসাউফ, খানকা, মাদ্রাসা, তাবলীগ, দাওয়া, হজ্জ, হাজী, টুপি, পাগড়ি, তসবিহ, আজান, মিনার, জিহাদ (তবে ক্রুসেড চলবে), জাকাত, ফিতরাহ, কাফফারা, কোরবানি, ওয়াকফ, হেরেম, হারাম, হালাল, গুনাহ ইত্যাদি ইসলামী পরিভাষা উচ্চারিত হলে কোন কোন আধুনিক মুসলমান নাক সিটকায়। যারা এসব উচ্চারণ বা পালন করে তারা যেন মানুষই নয়। এ কোন মানসিকতা? সেকুলার বা সমাজতন্ত্রী হলেই কি মুসলমান হয়েও মুসলমানি সংস্কৃতি ও তৎসংশ্লিষ্ট পরিভাষাকে ঘৃণা করতে হবে? ইতালীর সােভিয়েতপন্থী বাম সমাজতন্ত্রী মহিলা সাংবাদিক (বর্তমানে নিউইয়র্কে বসবাসরত) উরিয়ানা ফাল্লাচি তাে খৃস্টান সংস্কৃতি ও পরিভাষাকে ঘৃণা করেন না। তিনি তার ‘দ্য রেজ এন্ড দ্য প্রাইড' বইয়ে লিখেছেন, 'প্রায় দুই হাজার বছর ধরে ইতালীর পুরাে সংস্কৃতির ভিত্তি হচ্ছে খৃস্টান ধর্ম । আর আছে ক্যাথলিক চার্চ...। আমি পছন্দ করি আর না-ই করি, ক্যাথলিক চার্চের সাথে অনেক কিছুতেই আমার মিল আছে। সে মাফিক যদি কিছু করেও থাকি, তাতে আমার দোষ নেই। আমি কিভাবে পুরােপুরি উপেক্ষা করতে পারি? আমার জন্ম হয়েছে গির্জা, গম্বুজ, সন্ন্যাসি, যিশু, ম্যাডােনা, সেইন্ট, ক্রস আর ঘন্টা পরিবেষ্টিত একটা পরিবেশে।...আমার ধর্ম বিরােধিতা, আমার মােল্লাতন্ত্র বিরােধিতা, আমার নাস্তিকতার পরও আমি ক্যাথলিক সংস্কৃতি দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত এবং এই ক্যাথলিক সংস্কৃতির প্রভাব পড়েছে আমার কথা এবং লেখা দু'ভাষাতেই। ... গির্জার ঘন্টাধ্বনি এখনাে আমার ভেতরটা চূর্ণবিচূর্ণ করে। তারপরও আমি ওকে ভালবাসি। ক্রাইস্টের অনুপম পেইন্টিং, ম্যাডােনা, সেইন্টদেরও আমি ভালবাসি। প্রাচীন এইসব আইকন আমার সংগ্রহের তালিকায়ও আছে। মঠ, খিলান, সন্ন্যাস, আশ্রমও আমার ভাল লাগে। এসব কিছু আমার ভেতর এক ধরনের প্রশান্তি ভাবের উদ্রেক করে এবং এসবের মধ্যে যারা থাকেন তাদের প্রতি আমার এক প্রকার ঈর্ষাভাবও আছে। পাশাপাশি আমাদের স্বীকার করা উচিত যে, মসজিদের চেয়ে আমার ক্যাথড্রাল, সিনাগগ, বুদ্ধ মন্দির, প্রােটেস্ট্যান্ট সিমেট্রি। সেইসব (খৃস্টান তথা ক্যাথলিক) রূপকগুলােই আমার হৃদয় জুড়ে আছে। আছে আমার সংস্কৃতি জুড়ে। আপনারা জানেন, তুসকানিতে আমাদের গ্রামের বাড়িতে ছােট্ট একটা প্রার্থনা ঘর আছে । আমার যাজকতন্ত্র বিরােধিতার পরও কেমন যেন শান্তি পাই ওখানে এবং আমি বাজি ধরতে পারি যে, অধিকাংশ ইতালিয়ান এই কথাই স্বীকার করবে। (পৃ: ৯২-৯৪)।

এই হলাে ইতালিয়ান সমাজতন্ত্রী, বামপন্থী, সেকুলার সাংবাদিকের অবস্থান। অথচ মুসলমানদের ভেতরের সেকুলারগণ ‘মাের ক্যাথলিক দ্যান। দ্য পােপ’ । এই মনােভাবের জন্য মুসলমান সেকুলারগণ পশ্চিমের প্ররােচনায় মাদ্রাসার মত প্রতিষ্ঠানকে ব্যঙ্গ করছেন। অথচ তাদের ভেবে দেখা উচিত যে, সাদ্দাম হােসেনের মত সেকুলারকে পাশ্চাত্য এত পায়রােবি করার পরও তাকে ধ্বংস করেছে। মুসলমান নিজের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে ব্যঙ্গ করে পাশ্চাত্যের নিকট সাময়িকভাবে প্রিয় হলেও পরিণতি সাদ্দাম হােসেনের মত হওয়া অবশ্যম্ভাবী।

কথা হলাে, মাদ্রাসা নিয়ে ব্যঙ্গ করা হচ্ছে পাশ্চাত্য ও তাদের এ দেশীয় মিত্র সেকুলারদের দ্বারা। অথচ আমরা বহু ঐতিহাসিক বইয়ে পড়েছি যে, মাদ্রাসাকে কপি করে পাশ্চাত্যে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলাে গড়ে উঠেছে। মাদ্রাসা এসেছে আগে, আর পশ্চিমা কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পরে। অস্ট্রেলিয়া সফরের সময় সেখানকার বইয়ের দোকান ও পাঠাগারগুলােতে বই নিয়ে প্রচুর ঘাটাঘাটি করেছি। একটা চমৎকার বই হাতে এল ক্যাম্বুিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সােস্যাল এনথ্রপলজির এমিরেটাস প্রফেসর জ্যাক গুডির লেখা 'দ্য থেফট অব হিস্টরী'। ২০০৬ সালে ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে প্রকাশিত প্রায় সাড়ে তিনশ পৃষ্ঠার এই চমৎকার বইটিতে প্রফেসর জ্যাক গুডি বিস্তারিতভাবে প্রমাণ করেছেন, মাদ্রাসার কারিকুলাম ও ব্যবস্থাপনার ওপর ভিত্তি করেই ইউরােপে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। তিনি বলেন যে, আর যারা বলতে চান যে, প্রাচ্যের কোন অবদান নেই ইউরােপের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টিতে তারা ইতিহাস চুরি করেছেন। বইটির একটি চমৎকার পরিচ্ছেদ হলাে, ‘দ্য থেফট অব ইনস্টিটিউশন, টাউনস এন্ড ইউনিভার্সিটি।

প্রফেসর জ্যাক গুডি লেখেন, 'ইউরােপে রেনেসাঁর আগে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে মাদ্রাসার মতাে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান সমূহের এবং তাদের কারিকুলামের আদলে। যদিও সেসব প্রতিষ্ঠানে ধর্ম প্রাধান্য বিস্তার করত, অন্য বহু বিষয়ও তাতে অন্তর্ভুক্ত থাকতাে। (পৃ: ১২৯)। রেনেসা সম্পর্কে ইলাস্ট্রেটেড অক্সফোর্ড ডিকশনারি বর্ণনা করছে, ‘(ইউরােপে) চৌদ্দ থেকে ষােল শতকে কলা ও সাহিত্যের পূণর্জন্ম’ । (পৃ: ৬৯৫)। আসলে রেনেসাঁর আগেই পশ্চিম ইউরােপে মাদ্রাসার অনুকরণে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। প্রেরণা এসেছে মুসলিম স্পেন, পর্তুগাল, সিসিলি থেকে, মধ্যপ্রাচ্য থেকে ক্রুসেডারদের মাধ্যমে। স্পেন, পর্তুগাল, ও দক্ষিণ ইতালিতে তখন মুসলিম শাসন। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার পরে পশ্চিম ইউরােপে রেনেসা এসেছে। ইউরােপে মুসলমানদের আগমনের পূর্বে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ই ছিল না। এ ধারনা মুসলমানরাই প্রথম ইউরােপকে দেয়।

প্রফেসর জ্যাক গুডি বলেন, এই যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনা হলাে এর সাথে হয়েছিল ১১০০-১২০০ সালে লেখাপড়ার পুনঃপ্রবর্তন, যা এসেছিল মুসলিম সিসিলি ও আরব, স্পেন থেকে। তিনি বলেন, দশম ও একাদশ শতকে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে মাদ্রাসাগুলাে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর তখন মুসলিম ও খৃস্টান পাশ্চত্যের ভেতর শিক্ষার তাৎপর্যপূর্ণ সাদৃশ্য ছিল । গুডি বলেন, বরং কোন কোন বিদ্বান (যেমন মাদ্রিদের জে রি বেরা) বলেন, মধ্যযুগের ইউরােপীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলাে আরব শিক্ষা ব্যবস্থার নিকট বহুলভাবে ঋণী। গুডি বলেন, ইসলামী ওয়াকফের ওপর ভিত্তি করে কলেজ শিক্ষা ইসলামের নিজস্ব অবদান। জেরুজালেম ফেরত এক তীর্থযাত্রী পশ্চিম ইউরােপের প্যারিসে প্রথম একটা কলেজ তৈরি করেন ১৯৩৮ সালে । এটা সম্ভবত মাদ্রাসার একটি কপি ছিল, বলেন প্রফেসর গুডি। গুডি বলেন, জে সি মাকদিসি তার ‘দ্য রাইস অব কলেজেস; ইলাস্ট্রেশন অব লারনিং ইন ইসলাম এন্ড ওয়েস্ট' (১৯৮১) বইয়ে স্বীকার করেছেন যে, মাদ্রাসার পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠিত পাশ্চাত্যের কলেজগুলােতে ইসলামী শিক্ষার সাদৃশ্য ও প্রচুর প্রভাব বিদ্যমান ছিল। (পৃ:২২৮)। প্রফেসর গুডি বলেন, সে সময় ইউরােপীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মাদ্রাসার শিক্ষা পদ্ধতি ও কারিকুলাম একই প্রকারের ছিল। (পৃ: ২২৯)। প্রফেসর গুডি বলেন, ইসলামের প্রথম শিক্ষা ব্যবস্থার শুরু মসজিদ থেকে আট শতকে। দশম শতকে বাগদাদে ছাত্রাবাসসহ মসজিদ-মাদ্রাসা ছিল। এরপর এল নিজামিয়া মাদ্রাসা যা ১০৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত বলা হলেও এটা পূর্বর্তন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্থানেই পূনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। (পৃ: ২২৯)।

মাকদিসি আবার মাদ্রাসাকে বিশ্ববিদ্যালয় বলতে চান না এই কারণে যে, মাদ্রাসাগুলাে ওয়াকফের অর্থে চলে, এটা পশ্চিমের করপােরেশনের মত নয়। করপােরেশন অর্থ ব্যবসায়িক গােষ্ঠী। মাকদিসির এই ব্যাখ্যা কি কোন ব্যাখ্যা হলাে? আর্থিক লেনদেন থাকলে হবে বিশ্ববিদ্যালয়, আর দান ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হলে তা বিশ্ববিদ্যালয় হবে না। অথচ হার্বার্ড, অক্সফোর্ড প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে এত দান জমা পড়েছে যে, বিনা পয়সায় সব ছাত্রকে পড়ানাে যেতে পারে।

ইসলামে ওয়াকফ ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার অর্থ হলাে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা, যা সবার জন্য উন্মুক্ত। মাকদিসি করপােরেশনের পয়েন্টে এক অদ্ভুত মুল্যায়ন করলেও তিনি স্বীকার করেছেন যে, পশ্চিমের বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার সব কিছুই ধার করা হয়। মাকদিসি বাগদাদের আব্বাসীয় খলিফাদের আমলে (৭৫০-৯০০ সালে বিশেষ করে) চিকিৎসায় ও চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (বিমারিস্থান) পৃথকভাবে চালুর ব্যাপারে লেখেন (সূত্র: গুডি, পৃ: ২৩১)। মাকদিসি অবশ্য মাদ্রাসা ও পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়গুলাের ভেতর কমপক্ষে ঊনিশটি বিষয়ে মিল খুঁজে পেয়েছেন। (পৃ: ২৩০)। প্রফেসর গুডি বলেন, ইউরােপের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হল বােলােগনা বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি বলেন, তা প্রতিষ্ঠার আগেই ইসলামী পদ্ধতিগুলাে বহুভাবে এসেছে যেমন আইন শিক্ষা বিষয়ে। (পৃ: ২৩২)। প্রফেসর গুডি বলেন, পশ্চিম নানাভাবে ঋণী আরব ও ইসলামের নিকট; আর তা শুধু প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে নয়। আর ঋণী শিক্ষার সংগঠনে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, কারিকুলামে, যদিও মাদ্রাসা শিক্ষায় ধর্মীয় শিক্ষার প্রাধান্য রয়েছে। (পৃ: ২৩২)।

কুলহাম কলেজের প্রিন্সিপ্যাল আলফ্রেড গুইলম লিখেছেন বাগদাদের নিজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে, যার প্রতিষ্ঠা ৪৫৭ হিজরীতে। এরপরে নিশাপুর, দামাস্কাস, জেরুসালেম, কায়রাে, আলেকজান্দ্রিয়া ও অন্যান্য স্থানে বহু বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে। খৃস্টান স্পেনে রাজা আলফানসাে দি ওয়াইজ (১২৫২-৮১) মুসলমান বিদ্বান আবু বকর আল রিকুটিকে দায়িত্ব প্রদান করেন তার রাজ্যে একটি আরব বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য। গুইলম লেখেন, ১২৩৪ সালে বাগদাদে মুসতানসিরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে ছিল চারটা আইন স্কুল। ছিল নিজস্ব রান্নাঘর, যা সবাইকে খাবার দিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল লাইব্রেরী, যেখানে ছিল দুষ্প্রাপ্য বইগুলাে। যারা সেখানে পড়ত কাগজ, কলম সরবরাহ করা হতাে তাদের। সেই সাথে ছিল বাতি- জলপাই তেলের বাতি। ছিল পানি ঠান্ডা করার ঘর, হলঘরে ঢুকতে ঘড়ি। ছিল গােসলখানা, হাসপাতাল। মাদ্রাসার গুদামঘরে থাকতাে খাবার, পানীয় ও ঔষধপত্র। এসব তথ্য গুইলস মি. জি লে স্ট্রেনজের বাগদাদ ডিউরি; দ্য আব্বাসিউ ক্যালিফেট (অক্সফোর্ড ১৯০০) নামক বই থেকে উদ্ধৃত করে বিস্ময়ে মন্তব্য করেন, এ সবই ছিল তের শতকের প্রথম দিকে।' (দ্য লিগেসি অব ইসলাম, পৃ: ২৪১-২৪৩)।

গুইলম জোর দিয়ে বলেন, খৃস্টান বিশ্ববিদ্যালয়গুলাে প্রাচ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলাের নিকট স্পষ্টত ছিল নবীনতর, আর মধ্যযুগের বিদ্বানদের সাক্ষ্য থেকে সুনিশ্চিতভাবে এই সত্য প্রমাণিত যে, ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খৃস্টান বিশ্ববিদ্যালয়গুলােকে অনেক উপাদান প্রদান করতাে পড়াশােনা করার জন্য। গুইলম লেখেন, মুসলমানরা দশম ও একাদশ শতকে যে সব বিষয় পড়াশােনা করতাে আর খৃস্টান ছাত্ররা পরবর্তী সময় একাদশ দ্বাদশ শতকে যে পড়াশােনা করতাে, তাতে ছিল খুবই মিল প্রাচ্যের ও পাশ্চাত্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলােতে। বাগদাদেই হােক আর অক্সফোর্ডে কম-বেশি সবই একই রকম ছিল, তা পাঠক্রমের প্রকৃতি হােক, বা ছাত্র অধ্যাপকের সম্পর্ক ফি ও অনুদানের বিষয়, নিয়ম শৃঙ্খলা রক্ষণ, ডিগ্রি প্রদান বা পড়ানাের লাইসেন্স প্রদান বা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অন্যান্য আরাে নানা কার্যক্রম হােক। গুইলম বলেন, অনেক বিষয়েই ছিল মিল,।যেমন মুসলিম অধ্যাপক কর্তৃক ইজাজত' বা লাইসেন্স প্রদান পাঠদানের ব্যাপারে। এই নিয়ম মধ্যযুগে পাশ্চাত্যের (LICENTIA DOCENDI) প্রথম দিককার ডিগ্রি প্রদান আর কি । (পৃ: ২৪৩-২৪৪)।

গুইলম মাদ্রাসার ও কলেজের শিক্ষার মিল ও মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে BACCALAUREATE শব্দ নকল করার কথা লিখেছেন রাশদাল নামক এক বিদ্বানের উদ্ধৃতি দিয়ে । এই শব্দ এসেছে আরবী বিবাক্ক আল রিওয়া থেকে অর্থ ‘অন্যের দেয়া সনদে পাঠ প্রদানের অধিকার। এই শব্দের প্রথম ব্যবহার পাওয়া যায় চ্যানসন ডি রােনাল্ড নামক ফরাসি কাব্যে। এই শব্দটি পরবর্তীতে ব্যাচেলরে পরিবর্তিত হয়ে যায়। অর্থাৎ বিএ ইত্যাদি ডিগ্রি মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে এসেছে। (পৃ: ২৪৫)। সােজা কথায় ‘বিএ’ ডিগ্রিটা এসেছে আরব মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এই ডিগ্রি ইউরােপের অবদান নয়।
পিস টিভিতে (যা ইসলামিক টিভিতেও বাংলা ভাষায় তরজমা করে প্রচারিত হয়), মার্কিন পাদ্রি থেকে মুসলমান প্রচারক ইউসুফ এস্টেটস বলেছিলেন, অ্যালমনাই অ্যাসােসিয়েশনের অ্যালমনাই শব্দ এসেছে আলেম শব্দ থেকে। আসলে পাশ্চাত্যের প্রথম যুগের বিদ্বানরা আলেম হতে চেয়েছিলেন। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভােকেশনে আরব শেখদের মত জুব্বা পড়তেন- শেখদের মতাে আলেম হিসাবে পরিচিতি পেতে। স্পেনের গ্রানাডা শহরে রাণী ইসাবেলা রাজা ফার্দিনান্দের কবর ক্যাথিড্রালের পাশে দেখলাম ইংরেজীতে একটা নামফলক মাদ্রাসা (ইউনিভার্সিটি অব গ্রানাডা)। এর অর্থ হলাে সেই প্রাচীন মাদ্রাসা ভবনটিকে গ্রানাডা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের প্রাচীনতম ভবন বলে জাহির করতে গর্ববােধ করছে। ভবনটি ইসলামী স্থাপত্যে আরবী ক্যালিগ্রাফিতে ভর্তি। এমনকি এক দিকে একটা মিহরাবও দেখলাম। পাশ্চাত্যের কেউ কেউ মাদ্রাসা নিয়ে নাক সিটকালেও গ্রানাডার কর্তৃপক্ষ বিশেষ করে গ্রানাডা বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা শব্দকে স্বীকৃতি দিয়ে বিশ্বকে বুঝাতে চেয়েছে মাদ্রাসাই তাে বিশ্ববিদ্যালয়। মাদ্রাসাটির সামনের সৌন্দর্যের জন্য কমলা লেবুর গাছ দেখলাম, যে কমলা লেবুর গাছ মুসলমানরা প্রথমে ইউরােপে নিয়েছে। এখন ইউরােপের কমলা লেবু খেতে তেমন উপাদেয় না হলেও এর চমকার ঘন সবুজ পাতাগুলাে সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিচ্ছে, আর যেন প্রচার করছে মুসলিম সভ্যতার চির সবুজ বৈশিষ্ট্যের।

[লেখাটি মুহাম্মদ সিদ্দিক এর 'সাহিত্য সংস্কৃতি শিক্ষা' গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।]

পঠিত : ২৫৪ বার

মন্তব্য: ০