Alapon

পর্দা নিয়ে মা-বাবার ভূমিকা...



[১]
আজকাল পরিবার-সমাজের ছেলেমেয়েদের মধ্যে পর্দা চালু না থাকার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে পর্দার প্রতি মা-বাবার চরম উদাসীনতা। মূলত, পর্দাহীন পরিবেশে থাকতে থাকতে পর্দার প্রতি সন্তানদের অনীহা সৃষ্টি হয়ে যায়। তারা পর্দার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারে না। ফলে পরবর্তীতে বুঝানোর চেষ্টা করলেও তারা পর্দার বিষয়কে খুব একটা পাত্তা দিতে চায় না বরং এড়িয়ে চলে। মা-বাবা হিসেবে সন্তানদেরকে তাদের সূচনা লগ্নি থেকেই পর্দার যেরকম শিক্ষা দেওয়ার কথা ছিল সেরকম শিক্ষা অধিকাংশ মুসলিম পরিবারেই দেওয়া হয় না। বরং বড়ো হয়ে পর্দা করবে-এরকম উদ্ভট মানসিকতা লালন করে চলেন।

বিশেষ করে ছোটো ছোটো বাচ্চাদেরকে তাদের ছোটো অবস্থা থেকেই পর্দায় অভ্যস্ত করানো উচিত। তাদেরকে পর্দা না করার ভয়াবহতার পাশাপাশি পর্দা করলে আল্লাহর কাছে অনেক মর্যাদাবান হয়ে উঠার এবং অকল্পনীয় পুরষ্কার পাওয়ার ব্যাপারগুলোও তুলে ধরা উচিত। তখন তারা পর্দার ব্যাপারে আরও বেশি উৎসাহ পাবে। তাদেরকে যে বিষয়ে যতো বেশি উৎসাহ দেওয়া হবে দেখবেন তারা সে বিষয়ের প্রতি ততোই লেগে থাকবে, সেটা চালিয়ে যেতে ততোই মজা পাবে। মনে রাখবেন, কোনো বাচ্চাকে ছোটো অবস্থায় যা যা শিখানো হয় তাই তাদের শার্প মস্তিষ্কে সহজে গেঁথে থাকে। ফলে পরবর্তীতে আর তাদেরকে জোরাজুরি করতে হয় না। আল্লাহর রহমতে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বুঝতে শুরু করে, মানতেও শুরু করে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের মা-বাবারা তাদের ছেলে- মেয়েদেরকে মাহরাম এবং গায়রে মাহরাম তথা পর্দার পূর্ণাঙ্গ বিষয় গুরুত্বের সাথে বুঝিয়ে বলেন না। কেবল বাইরের অপরিচিত কেউ আসলে পর্দা করতে হয় এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি সমাজে চালু করে রেখেছেন। সেই পর্দাও আবার শুধু মাথায় কাপড় দেওয়া পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। ফলে তাদের সন্তানেরা তাদের কাজিনদেরকে ‘আপন’ মনে করে তাদের সাথেও অনায়েসে স্বাভাবিক মেলামেশা করতে থাকে। এদের সাথেও যে পর্দা রক্ষা করে চলতে হয় তা আর তারা বুঝতেই পারে না। অথচ তাদেরকে এখান থেকেই পর্দার শিক্ষা দেওয়া উচিত ছিল।

নিজেকে একটু প্রশ্ন করুন তো, মা-বাবা হয়েও যদি আপনি আপনার সন্তানদেরকে গায়রে মাহরাম কাজিনদের সাথে মিশতে দেন তবে তারা পর্দা শিখবে কী করে? মা-বাবা হয়েও যদি আপনি আপনার সন্তানদেরকে ফ্রি মিক্সিং যুক্ত নাটক, সিনেমা ইত্যাদি দেখতে দেন এমনকি নিজেরাও তাদরকে সাথে নিয়ে সম্পূর্ণ পর্দাহীন এবং ক্ষেত্রবিশেষে অর্ধনগ্ন সম্পন্ন বিভিন্ন তথাকথিত বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান দেখতে থাকেন তবে সন্তানেরা পর্দার প্র্যাকটিকেল শিক্ষা পাবে কোথায়?

মা-বাবা নিজেরাই যদি মাহরাম তোয়াক্কা না করে পরপুরুষ বা পরনারীর সাথে অনায়াসে কথা বলে যান তবে সন্তানেরা প্র্যাকটিক্যালি পর্দার গুরত্ব বুঝবে কীভাবে? কারো বিয়ের সময় গায়ে হলুদের নামে এক ধরনের নগ্নতার পরিবেশে যদি তাদেরকে সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে যান তবে কেমনে তারা পর্দার মর্যাদা বুঝবে? দুলাভাই-ভাবীদের সাথে যদি হাসি-তামাশার বারণ না করে তাদরকে বরং আরও সুযোগ করে দেওয়া হয় তবে কেমনে তারা পর্দার প্রতি আকৃষ্ট হবে?

সর্বোপরি, মা-বাবাই যদি নিজেকে অনুকরণযোগ্য করে তোলার মাধ্যমে সন্তানদের পর্দার বিষয় প্র্যাকটিক্যালি না শিখান তবে সন্তানেরা কীভাবে পর্দা মেনে চলার তাগিদ অনুভব করবে? পরিবারের মতো অভ্যন্তরীণ পরিবেশ থেকেই যদি পরিপূর্ণভাবে পর্দা করা শিখা না হয় তবে আর কোথা থেকে শিখা হবে? আপনি সমস্ত বেপর্দার পরিবেশ উন্মুক্ত রেখে সন্তানদের কাছে পর্দার আশা করবেন-এটা কি এমন ইঙ্গিত দেয় না যে, আপনি সত্যিকার অর্থে আপনার সন্তানেরা পর্দার ফরজ বিধান মেনে চলুক সেটা চাচ্ছেনই না?

[২]
আপনার মেয়েকে যে দুলাভাইয়ের কাছে বসে দাঁত খিলিয়ে হাসি ঠাট্টা করার সুযোগ দিচ্ছেন, সেটা না করলে বরং তাকে আনস্মার্ট, আনসুস্যাল মনে করছেন, আপনার স্ত্রীকে যে দেবরের সাথে খুনসুটি করতে দেখে আপনি নিজে মিটমিট করে হাসছেন, আপনার স্বামীকে যে ভাবির সাথে মশকরা করতে দিচ্ছেন তার ব্যাপারে রাসূল (সাঃ) কী বলেছেন তা কি আপনার অবগতিতে আছে? তিনি বলেছেন,শালী-দুলাভাই, দেবর-ননদ প্রমুখ এরকম গায়েরে মাহরামরা মৃত্যু সমতুল্য। [১]

'মৃত্যু সমতুল্য' কথাটির মানে কী,তা কি আমরা বুঝতে পারছি? শব্দদ্বয় গভীর অর্থ বহন করে। এর মানে হচ্ছে, মৃত্যু যেমন ভয়ঙ্কর একটি বিষয় ঠিক তেমনি শালী-দুলাভাই, দেবর-ননদের মতো গায়রে মাহরামদের সাথে পর্দাহীন চলাফেরাও মৃত্যুর মতোই ভয়ঙ্কর একটি বিষয়। ফলে মৃত্যু থেকে যেমন মানুষ পালিয়ে বাঁচতে চায় ঠিক তেমনি তাদের থেকেও পালিয়ে বাঁচতে হবে। আমরা রাসূল (সাঃ) এর এমন কড়া হুশিয়ারির কথা জেনেও কি মৃত্যুর মতো দুলাভাই, দেবরদের কাছ থেকে পর্দা পালনের মাধ্যমে পালিয়ে বাঁচতে চাইবো না? নিজেদের অধীনস্থদের বাঁচাবো না? কী, বাচাঁবো না?

আমরা অনেকেই মনে করি, শালী, দুলাভাই,ভাবী,দেবর, ননদ, কাজিন প্রমুখ এরা তো আমার আপনজন। তাই এদের সাথে আবার পর্দা কী। দেখুন, কে আপন আর কে পর কিংবা কাদের সাথে পর্দা করতে হবে না করতে হবে সেটা আমরা আল্লাহর বলা অনুসারে চলবো, নিজের মনগড়া নয়। যারা মনগড়া চলে তারাই মূলত পথভ্রষ্ট। আল্লাহ তাদের সাথে পর্দা করতে নির্দেশ দিয়েছেন তাই তাদের সাথেও বিনাবাক্য পর্দা করতেই হবে। এতেই আমাদের মঙ্গল রয়েছে। এখানে কারণ খুঁজতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করা যাবে না। সবকিছুর কারণ নিজের মস্তিষ্কে ধরতে না পারাটার মানে সেটা ভুল হয়ে যাবে কিংবা সেটা ভিত্তিহীন হয়ে পড়বে এমনটা মনে করা অজ্ঞতা ছাড়া কিছুই নয়।

আপনি সমাজের দিকে তাকিয়ে দেখুন না, যে স্বামী তার স্ত্রীকে দেবরের সাথে পর্দা ভঙ্গ করে হাসি ঠাট্টা করার সুযোগ দেয় সে স্বামীর স্ত্রী কিন্তু একসময় পরকীয়ার মতো বড়ো পাপে লিপ্ত হয়ে পড়ে। একইভাবে, শালী-দুলাভাই, দেবর-ভাবির বেলায়ও এমন ঘটনা অহরহ ঘটেই চলছে। যদি আমাদের সমাজের ভাষ্যমতে, তাদের সাথে আপনজন হওয়ার দোহাই দিয়ে পর্দা না করাটা ভালো হতো তবে কীভাবে তারা এতো নিকৃষ্ট কাজে জড়াতে পারে? এতো নীচে নামতো? এজন্য আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন করলে এ ধরণের গজব হবেই হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

[৩]
বর্তমানে এমনিতেই বাইরের পরিবেশ পর্দার প্রতিকূলে অবস্থান করছে। ফলে নিজেদের এবং সন্তানদের মঙ্গলের জন্যই মা-বাবাকে পর্দা নিয়ে বাড়তি সতর্ক হতে হবে, তাদেরকে প্রকৃত পর্দার পরিবেশ করে দিতে হবে, পর্দায় অভ্যস্ত করে তুলতে হবে। অন্যথায়, মহান আল্লাহর কঠিন পাকঁড়াও থেকে বাঁচা সম্ভব হবে না। কেননা আল্লাহর নিকট অধীনস্থ হিসেবে ছেলেমেয়েদের কর্মকান্ডের জবাবদিহিতা করতে হবে।

একটি পরিবারে পর্দা চালু হওয়ার জন্য মা-বাবার আন্তরিক ভূমিকা থাকা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পর্দার ব্যাপারে সন্তানদের জন্য মা-বাবার পূর্ণ সমর্থন এবং উৎসাহ দিয়ে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু মা-বাবা নিজেরাই যদি পর্দাহীনভাবে জীবন-যাপন করতে থাকেন তবে অনেকক্ষেত্রে সন্তানদের জন্য পর্দার বিধান মেনে চলা তো দূরের কথা, পর্দা যে একটি ফরজ বিধান সেটিও জানা দুরূহ হয়ে পড়বে। কেননা বর্তমান পরিবেশ-পরিস্থিতি পর্দার অনুকূলে নয়। এছাড়া, বন্ধু-বান্ধব, আত্নীয়-স্বজন এদের বেশীরভাগই পর্দার বিষয়ে বড্ড উদাসীন। আর যারাই পর্দা করেন তাদের সিংহভাগরা আবার পর্দার সহী তরীকা অনুসরণ করেন না বরং পর্দাকে একটি ফ্যাশনে রূপ দিয়ে ফেলেছেন যা আরো ভয়ানক বিষয়।
মা-বাবারা যদি সঠিক পন্থায় পর্দা করেন এবং সন্তানদেরকে শিখান তবে তাদের সন্তানদের জন্যও পর্দা করা আরও সহজ হয়ে যাবে। প্রসঙ্গত, মা-বাবার চূড়ান্ত চেষ্টার করার পরও যদি সন্তানেরা পর্দা না করে তবে অন্তত মা-বাবার আর ত্রুটি রইলো না। সন্তানদের কপালে হেদায়েত না থাকলে তো আর মা-বাবার কিচ্ছু করার নেই-তাই না। তবে চেষ্টার ত্রুটি না রাখার পাশাপাশি তাদের জন্য হেদায়েতের দোয়া যেন অব্যহত রাখা হয়।

আবার, পর্দার প্রতি মা-বাবার চরম অবহেলার দরুন আজকালকার অনেক ছেলে-মেয়েরা বড়ো বেহায়ার মতো সর্বসম্মুখে চোখের যিনার পরিবর্তিত রূপ ক্রাশ শব্দটি অনায়সে ব্যবহার করতে থাকে। অর্থাৎ তারা জানেই না যে, চক্ষু হেফাজত করে চলা পর্দার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কাজেই পর্দার সব দিক নিয়ে পরিবার থেকেই অনুশীলন করাতে হবে।
কিছু মা-বাবা বলে থাকেন যে, সন্তানদেরকে তো বলি পর্দার জন্য কিন্তু তারা পর্দা করে না। দেখুন, সন্তানদেরকে আলস্য স্বরে দায়সারা ভাব নিয়ে বললে তো আর কাজ হবে না। অবশ্যই বলার মতো বলতে হবে। প্রয়োজনে শক্ত করে বলতে হবে। কারণ এখানে জাহান্নামের বিষয় জড়িত রয়েছে। তাই খামখেয়লীপনা একদমই চলবে না।

সন্তানদেরকে শুধু পর্দার কথা বললেই তারা পর্দা করা শুরু করে দিবে এমনটা ভাবাও বোকামী। কারণ আপনি তাদেরকে একদিকে পর্দা করার কথা বলবেন আবার অন্যদিকে বেপর্দার পরিবেশ প্রস্তুত করে রাখবেন তবে তারা কেমন করে পর্দা করবে? এটা কি এক ধরনের প্রহসন নয়?

সুতরাং আমাদের প্রত্যেক মা-বাবাদের উচিত পর্দার মতো ফরজ বিধান পালনের ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়েদেরকে বিন্দুমাত্র ছাঁড় না দেওয়া। তাদেরকে পরিপূর্ণ পর্দার পরিবেশ করে দিতেই হবে। পর্দার ব্যাপারে তাদেরকে উৎসাহ দিয়ে যেতে হবে। বিশেষ করে ছোটো ছোটো বাচ্চাদেরকে এখন থেকেই পর্দায় অভ্যস্ত করে তুলতে হবে। অন্যথায়, সন্তানের পর্দাহীনতার কারণে মা-বাবাকে দাইয়্যূস হয়ে থাকতে হবে যার পরিণাম ভয়াবহ জাহান্নাম। কাজেই পর্দার ব্যাপারে কোনো ধরণের শীথিলতা ও গাফিলতি থাকা যাবে না। একইসাথে, আল্লাহর নিকট সন্তানদের জন্য হেদায়াতের দোয়া করে যেতে হবে।

রেফারেন্সঃ
[১] সহীহ বুখারী, হাদীস নং : ৫২৩২ ও সহীহ মুসলিম, হাদীস নং : ২১৭২

পঠিত : ৪৫৭ বার

মন্তব্য: ০