Alapon

ঘরে প্রবেশ করার পদ্ধতি



ঘর একটি নিরাপদ আবাসস্থল। অফিসের, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের, মাঠের, ঘাটের, কিংবা বাইরের – এককথায় দিনের যাবতীয় ব্যস্ততা শেষ করে যখন আমরা নিজ ঘরে ফিরি, তখন নিজেদের মতো করে আমরা বিশ্রাম নিই, গা টাকে এলিয়ে দিই বিছানার সাথে।সারাদিনের ক্লান্তি গুলো দূর করে একটু শান্তি খুঁজার চেষ্টা করি।
তাই সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে আমাদের শান্তির মুহূর্তটা যেন কারো অন্যায় হস্তক্ষেপের কারণে অশান্তিতে পরিণত না হয় সেজন্য ইসলাম বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেছেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা’আলা জানিয়ে দিলেন, কারো গৃহে প্রবেশ করার নিয়ম। এছাড়া আমাদের ঘরগুলোতে যেহেতু সবসময় মহিলারা থাকে, সেজন্য পর্দার বিষয়টি যেন লঙ্ঘিত না হয় সে ব্যাপারেও কুরআন-হাদিসে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

হযরত আদী ইবনে সাবেত থেকে বর্ণিত, জনৈকা এক মহিলা আনসার সাহাবী,রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে বললেন,“হে আল্লাহর রাসূল (সা),আমি অনেক সময় আমার বাসায় এমন অবস্থায় থাকি যখন আমার সন্তান কিংবা আমার পিতা আমার রুমে আসুক তা আমি পছন্দ করি না।” এখন আমি কি করতে পারি?তখন রাসূল(সঃ)এর মাধ্যমে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা গোটা মানবজাতির জন্য তার সমাধান দিয়ে দিছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন—

“হে মুমিনগণ, তোমরা নিজেদের গৃহ ছাড়া অন্য কারও গৃহে প্রবেশ করো না,যতক্ষণ না তোমরা গৃহবাসীদের অনুমতি নিবে এবং সালাম দিবে। এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর। অতঃপর যদি তোমরা সেখানে কাউকে না পাও তাহলে তোমাদেরকে অনুমতি না দেয়া পর্যন্ত তোমরা সেখানে প্রবেশ করবে না। আর যদি তোমাদেরকে বলা হয়, ‘ফিরে যাও’ তাহলে ফিরে যাবে। এটাই তোমাদের জন্য অধিক উত্তম পদ্ধতি।তোমরা যা কর আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক অবগত। যে ঘরে কেউ বাস করে না, তাতে তোমাদের কোন ভোগ্য সামগ্রী থাকলে,সেখানে তোমাদের প্রবেশে কোন পাপ হবে না।আর আল্লাহ জানেন যা তোমরা প্রকাশ কর আর যা তোমরা গোপন কর।(সূরা নূর- আয়াত, ২৭-২৯)

এই তিনটি আয়াতে আল্লাহ তাআলা ঘরে প্রবেশ করার বিধান বর্ণনা করেছেন। এখানে আল্লাহ তাআলা স্পষ্টভাবে বলে দিলেন, যদি অন্য কারো গৃহে প্রবেশ করতে চাও তাহলে দুটি শর্ত পালন করতে হবে। একটা হল বাসার অধিবাসীদের সালাম দিতে হবে, অন্যটি হলো অনুমতি নিতে হবে।

সালাম এবং অনুমতি নেয়ার পরে যদি প্রবেশ করতে বলে তাহলে প্রবেশ করতে হবে। আর অনুমতি না দিয়ে যদি ফিরে যেতে বলে, তাহলে অবশ্যই ফিরে যেতে হবে। যদি কোন বাড়িতে গিয়ে কাউকে পাওয়া না যায়, তখনও আমাদেরকে ফিরে আসতে হবে। এককথায় অনুমতি ব্যতিত কারো ঘরে প্রবেশ করা যাবে না।
এই বিধান এজন্য দিয়েছেন যে,যেন আমাদের শান্তিতে বিশ্রাম নেয়ার সময়টি অশান্তিতে পরিণত না হয়। আমাদেরকে ঘরের মধ্যে অপ্রস্তুত অবস্থায় কেউ দেখে না পেলে এবং আমাদেরকে বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে না হয়। পাশাপাশি আমাদের ব্যক্তি স্বাধীনতায় যেন কেউ অবৈধ হস্তক্ষেপ করতে না পারে।
সালাম কিভাবে দিবেন? সালাম দেয়ার নিয়ম সম্পর্কে হাদিস শরিফে এসেছে, রাসূল (স) যখন কারো বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়াতেন, তখন দরজার দিকে মুখ করে সোজা হয়ে দাঁড়াতেন না।বরং দরজার ডান কিংবা বাম পাশে সরে দাঁড়াতেন এবং সালাম দিয়ে অনুমতি নিতেন। যখন তিনি সালাম দিতেন তখন তিনবার সালাম দিতেন। (সহীহ বুখারী-৬২৪৪)

এজন্য কারো দরজার সামনে গিয়ে চিৎকার চেচামেচি না করে দরজার একপাশে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে তিনবার সালাম দিয়ে অনুমতি নিতে হবে। তিনবার সালাম দেয়ার পরেও যদি ঘরের মালিকের পক্ষ থেকে অনুমতি না মিলে, তাহলে ফিরে যেতে হবে। এ সম্পর্কে হাদিস শরিফে এসেছে,

আবূ সাঈদ খুদরী রাঃ একবার উমরের রাঃ দাওয়াত পেয়ে তাঁর ঘরের দরজায় এসে উপস্থিত হলেন এবং তিনবার সালাম দিলেন। কিন্তু ঘরের অধিবাসীদের পক্ষ থেকে কোন জবাব না পাওয়ায় তিনি ফিরে গেলেন।পরবর্তীতে উমর রাঃ এর সাথে সাক্ষাৎ হলে তিনি বলেন,“তোমাকে দাওয়াত দেয়া সত্ত্বেও তুমি আমার ঘরে আসলে না কেন?” আবূ সাঈদ খুদরী রাঃ বললেন, “আমি তো এসেছিলাম,আপনার দরজায় দাঁড়িয়ে তিনবার সালামও করেছিলাম।কিন্তু কারো কোন সাড়া না পেয়ে আমি ফিরে চলে এসেছি।কারণ, নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের কেউ কারো ঘরে প্রবেশ করার জন্যে তিনবার অনুমতি চেয়েও না পেলে সে যেন ফিরে যায়।” (সহীহ বুখারী-৬২৪৫)

তিনবার সালাম দেয়ার কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে ইমাম হাসান বসরী (রহঃ) বলেন,“তিনবার সালাম দেয়ার মধ্যে প্রথম সালাম তার আগমন সম্পর্কে জানিয়ে দেয়ার জন্য। দ্বিতীয় সালাম প্রবেশের অনুমতি লাভ এবং তৃতীয় সালাম হচ্ছে ফিরে যাওয়ার জন্য। কারণ, তৃতীয়বার সালাম দেয়ার পরও ঘরের ভেতর থেকে কোন জবাব না আসলে বুঝতে হবে ঘরে কেউ নেই। অথবা এমন কোন পুরুষ নেই, যে তার সালামের জবাব দিতে পারে।
এজন্য তিনবার সালাম দেয়ার পরে কোন অনুমতি না মিললে ফিরে আসতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলছেন, ফিরে আসার মধ্যেই মানবজাতির জন্য কল্যাণ নিহিত রয়েছে।
আর সালাম দেয়ার পরও অনুমতি না মিললে বা একবার সালাম দিয়ে অন্য সালামের মধ্যবর্তী সময়ে এদিক-সেদিক ঘরের মধ্যে উঁকি দিয়ে ভেতরে দেখা যাবে না। কারণ, রাসূল (স) বলছেন, কেউ যদি তোমার অনুমতি ছাড়াই তোমার ঘরের মধ্যে উঁকি মারে,তাহলে তার চোখ দুটি পুঁটু করে দাও। (বুখারী-৬৯০২)
এজন্য ঘরের মধ্যে উঁকিঝুঁকি দিয়ে ভেতরে দেখার চেষ্টা করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
বর্তমানে প্রচলিত কলিং বেলও এই নিয়মের অধীন। এক্ষেত্রে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, বারবার কলিং বেল দেয়ার ফলে গৃহবাসী যেন কোনভাবে কষ্ট না পায় এবং তারা বিরক্ত হয়ে না পড়ে। কারণ, ঘরে ঢুকার এই নিয়ম দেয়া হয়েছে মূলত মানুষের কষ্ট লাগব করার জন্য।

নিজেদের ঘরে প্রবেশ করার সময়ও আমাদের সালাম দিয়ে প্রবেশ করতে হবে। এরমধ্যে রয়েছে বরকত, বৃদ্ধি পাবে পারস্পরিক ভালোবাসা। আর হিংসা বিদ্বেষ ও কলহের মত ঘটনাগুলো অধিকাংশই কমে যাবে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি যখন তার স্ত্রীর রুমে যেতেন তখন গলায় হাঁক-ডাক দিয়ে যেতেন।
আমাদের সমাজে বিশেষত গ্রামীণ সমাজে অনেক যৌথ পরিবার রয়েছে। যেখানে পিতা-মাতা, ভাই-বোন একসাথে বাস করে। এইরকম যৌথ পরিবারের ক্ষেত্রেও একে অপরের রুমে প্রবেশ করার সময় অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করতে হবে। এমনকি পিতা-মাতা কিংবা ভাই-বোনের রুমে প্রবেশ করতেও অনুমতি লাগবে।
এক হাদিসে এসেছে, এক ব্যক্তি রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, আমার মায়ের ঘরে যেতে হলেও কি আমাকে অনুমতি নিতে হবে? রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ। সে লোকটি বললো, আমি তো তাঁর সাথে একই ঘরে থাকি। রাসূল সঃ বললেন, তবুও অনুমতি নিতে হবে। তখন লোকটি বললো, আমি তো তার খাদেম। তার খেদমতে নিয়োজিত থাকি। তখন রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,তুমি কি তোমার মাকে উলঙ্গ অবস্থায় দেখাতে পছন্দ কর? অর্থাৎ অনুমতি না নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলে মাকে উলঙ্গ অবস্থায় দেখতে পাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। এজন্য অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করতে হবে। এভাবে পুরুষ পুরুষের রুমে, মহিলা মহিলা মহিলার রুমে প্রবেশ করতেও অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করতে হবে।

তিন সময়ে স্বামী-স্ত্রীর রুমে যাওয়ার জন্য শিশু এবং দাস-দাসীদেরও অনুমতি লাগবে। তা হলো- ফজরের পূর্বে, যোহরের পরে এবং এশার নামাজের পরে।
ইসলাম হচ্ছে মানবজাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে বড় এক নেয়ামত। এটি একটি মানব কল্যাণ ধর্ম। এটি সবসময়ই মানুষের কল্যাণ নিয়ে চিন্তা করে।

দুনিয়ার জীবনে ঘর একটি স্থায়ী নিরাপদ আবাসস্থল। মানুষ বাইরে যেভাবে পরিপূর্ণ কাপড় দ্বারা শরীর আবৃত করে চলাফেরা করে স্বাভাবিকভাবে ঘরে সেটা সম্ভব না। বিশেষকরে মহিলারা বাইরে যেভাবে পর্দা আবৃত হয়ে থাকে ঘরে সেভাবে থাকে না এবং না থাকাটাই স্বাভাবিক। যেহেতু তারা পারিবারিক কাজে ব্যস্ত থাকে।
সুতরাং এই সময়ে যদি কেউ অনুমতি ব্যতিত ঘরে ঢুকে যায় তাহলে ঘরের লোকজন বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যাবে। এছাড়া মহিলাদের বেপর্দা অবস্থায় দেখে ফেললে শয়তানের প্ররোচনায় অশ্লীলতার দিকে ধাবিত হওয়ার সম্ভাবনাও এড়িয়ে যাওয়া যায় না। ফলে পরিবারে অশান্তি এবং কলহ দেখা দিতে পারে। ফলশ্রুতিতে পরিবারে ভাঙ্গন শুরু হয়। যা বর্তমান সময়ে অহরহ ঘটে যাচ্ছে।
এজন্য আল্লাহ তাআলা সমস্যার মূল চিহ্নিত করে আমাদের জন্য বিধান অবতীর্ণ করেছেন। আমরা যদি ঘরে ঢুকার আল্লাহ প্রদত্ত এই বিধান মেনে চলতে পারি, তাহলে সামাজিকভাবে অনেক অশান্তি এবং পারিবারিক কলহ দূর হয়ে যাবে।

পঠিত : ২১৮ বার

মন্তব্য: ০