‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর ব্যাখ্যা
তারিখঃ ১ মার্চ, ২০২৩, ১১:৩৩
‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর সঠিক অর্থ কি
আপনার জানা আছে? আপনি যে অর্থটি জানেন সেটা কি সঠিক? মৃত্যুর পূর্বে একটু যাচাই করে দেখুন।
আমরা যারা বাঙালি তথা অনারব তাদের অধিকাংশ মুসলিম ভালো করে কালেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর অর্থ কি, তা জানে না। অনারব অধিকাংশ মুসলিম যারা সজ্ঞানে এ কথার সাক্ষ্য দেয়, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, তারা প্রকৃত পক্ষে এই বাক্যটির সত্যিকার অর্থ কি তা জানে না। বরং অনেক সময় দেখা যায়, তারা সম্পূর্ণ উল্টো বা বিপরীত অর্থটাই জানে।
যেমন কাউকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়-
‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র অর্থ কি?
সে জবাব দেয়- ‘আল্লাহ্ ছাড়া কোন ইলাহা নেই’ অথবা ‘আল্লাহ্ ছাড়া কোন মাবূদ নেই’।
কিন্তু ‘ইলাহা: এবং ‘মাবূদ’ দুটোই আরবী শব্দ। আসলে ‘ইলাহ’ শব্দটির মানেই তারা বুঝে না। এখানে তারা পুরো বাক্যটার অনুবাদ কিন্তু করেনি। তারা “ইলাহা” এবং ‘মাবূদ’ আরবী শব্দদ্বয়ের অনুবাদ করেনি। তাহলে এই ‘ইলাহ’ শব্দটির আসল অর্থ কি?
কেউ কেউ বলে- “আল্লাহ্ ছাড়া কোন সৃষ্টিকর্তা নেই”। এটাও ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র আসল অর্থ নয়। কেননা ‘সৃষ্টিকর্তা’ এর আরবী ‘খালিক’। তাই এখানে সৃষ্টিকর্তা- ‘ইলাহ’ শব্দটির সঠিক অনুবাদ নয়।
‘ইলাহ’ শব্দটির অনুবাদকে অনেকে সৃষ্টিকর্তা হিসেবে ধরে বলে যে- আমি তো আল্লাহ্-কেই সৃষ্টিকর্তা হিসেবে বিশ্বাস করেছি। তাহলে আমার তো ঈমান আছে, আমি তো ঈমানদার।
যদি আল্লাহ্-কে সৃষ্টিকর্তা হিসেবে বিশ্বাস করলেই ঈমানদার হওয়া যেতো তাহলে নাবী (সা.) এর যুগের আরবের মুশরিকরাও আপনার চাইতে বড় ঈমানদার ছিল। কিন্তু তারপরেও আল্লাহ্ তাদের জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব করেছেন। আপনার কি বিশ্বাস হচ্ছে না?
আরবের মুশরিকরা আপনার চাইতে বড় ঈমানদার ছিল!
দেখুন কুরআন নিজেই তার প্রমান-
“তোমরা যদি এসব লোকদের জিজ্ঞেস করো: যমীন ও আসমান কে সৃষ্টি করেছে, তাহলে এরা নিজেরাই বলবে, ঐগুলো সেই মহাপরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী সত্তা সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা যুখরুফ, আয়াত: ৯)
"যদি তোমরা এদের জিজ্ঞেস করো, কে এদের সৃষ্টি করেছে তাহলে এরা নিজেরাই বলবে, আল্লাহ। তাহলে কোথা থেকে এরা প্রতারিত হচ্ছে?” (সূরা যুখরুফ, আয়াত: ৮৭)
“যদি তুমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করো পৃথিবী ও আকাশসমূহ কে সৃষ্টি করেছেন এবং চন্দ্র ও সূর্যকে কে নিয়ন্ত্রিত করে রেখেছেন তাহলে অবশ্যই তারা বলবে আল্লাহ, এরপর এরা প্রতারিত হচ্ছে কোন দিক থেকে?” (সূরা আনকাবুত, আয়াত: ৬১)
“আর যদি তুমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, কে আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছেন এবং তার সাহায্যে মৃত পতিত ভূমিকে সঞ্জীবিত করেছেন, তাহলে তারা অবশ্যই বলবে আল্লাহ। বলো, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য কিন্তু অধিকাংশ লোক বোঝে না।” (সূরা আনকাবুত, আয়াত: ৬৩)
“যদি তাদেরকে জিজ্ঞেস করো: এ পৃথিবী এবং এর মধ্যে যারা বসবাস করে তারা কার? তারা নিশ্চয় বলবে, আল্লাহর। যদি তাদেরকে জিজ্ঞেস করো: সাত আসমান ও মহান আরশের অধিপতি কে? তারা নিশ্চয়ই বলবে, আল্লাহ। যদি তাদেরকে জিজ্ঞেস করো: কার কর্তৃত্ব চলছে প্রত্যেকটি জিনিসের ওপর? আর কে তিনি যিনি আশ্রয় দেন এবং তাঁর মোকাবিলায় কেউ আশ্রয় দিতে পারে না? তারা নিশ্চয়ই বলবে এ বিষয়টি তো আল্লাহরই জন্য নির্ধারিত।” (সূরা মুমিনূন, আয়াত: ৮৪-৮৯)
“যদি তাদেরকে জিজ্ঞেস করো: “কে তোমাদের আকাশ ও পৃথিবী থেকে রিযিক দেয়? এই শুনার ও দেখার শক্তি কার কর্তৃত্বে আছে? কে প্রাণহীন থেকে সজীবকে এবং সজীব থেকে প্রাণহীনকে বের করে? কে চালাচ্ছে এই বিশ্ব ব্যবস্থাপনা?” তারা নিশ্চয়ই বলবে, আল্লাহ।” (সূরা ইউনুস, আয়াত: ৩১)
“যদি তুমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করো: পৃথিবী ও আকাশমণ্ডলী কে সৃষ্টি করেছেন, তাহলে তারা নিশ্চয়ই বলবে আল্লাহ।” (সূরা লোকমান, আয়াত: ২৫)
“তোমরা যদি এদের জিজ্ঞেস করো: যমীন ও আসমান কে সৃষ্টি করেছে? তাহলে এরা নিজেরাই বলবে, আল্লাহ।” (সূরা যুমার, আয়াত: ৩৮)
এমন আরো বহু আয়াত প্রমান করে যে- সেই সময়ের মুশরিকরা আল্লাহ্কে শুধু ‘সৃষ্টিকর্তা’ হিসেবেই মান্য করত না বরং আরো অনেক কিছুর মালিক হিসেবে-ই বিশ্বাস করতো।
তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে ঐ মুশরিকরা আল্লাহ্কে ‘সৃষ্টিকর্তা’ এবং আরো অনেক কিছুর মালিক হিসেবে-ই বিশ্বাস করার পরও আল্লাহ্ কেনো তাদেরকে ধ্বংস করলেন? আল্লাহ্ কেন তাদেরকে চিরকাল জাহান্নামে শাস্তি দিবেন?
উত্তর হচ্ছে- তারা আল্লাহ্কে ‘ইলাহ’ হিসেবে মানতো না।
আসুন ‘ইলাহ’ শব্দটির সঠিক অর্থটি বুঝার চেষ্টা করি।
‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ অর্থ ‘আল্লাহ্ ছাড়া কোন মাবূদ নেই’। এখানে ‘মাবূদ’ শব্দটি আরবী, এই শব্দটি এসেছে ‘ইবাদাহ’ শব্দ থেকে যার অর্থ হচ্ছে গোলামী করা।
অর্থাৎ আমাদেরকে একমাত্র আল্লাহ্র ইবাদাত করতে হবে। আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো ইবাদাত করা যাবে না। আসলে ইবাদাত শব্দটি আমরা সচারচর ব্যাবহার করলেও শব্দটিও কিন্তু আরবী। ইবাদাত শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘গোলামী করা’। ইবাদাত শব্দের আরেকটি অর্থ হয়- উপাসনা করা, আরাধনা করা ইত্যাদি।
তাহলে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে- আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো গোলামী করা যাবে না, আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো হুকুম মানা যাবে না, আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো কথা শোনা যাবে না, আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো কথা মানা যাবে না, বাবা-মায়ের কথা মানা যাবে না, নেতার কথা মানা যাবে না, শাসকের কথা মানা যাবে না, এককথায় আল্লাহর হুকুম আহকামের বিপরীতে আর কারো কথা মানা ও শোনা যাবে না। এমনকি নিজের কথাও না।
একমাত্র আল্লাহ্ যেটা বলবেন সেটাই মানতে হবে।
আল্লাহ্ তাআলা বলেছেন- মা-বাবাকে শ্রদ্ধা করতে, তাই আমরা মা-বাবাকে শ্রদ্ধা করি; আল্লাহ্ বলেছেন- রাসূলের আনুগত্য করতে, তাই আমরা রাসুলের আনুগত্য করি; আল্লাহ্ বলেছেন- সত্য কথা বলতে, তাই আমরা সত্য কথা বলি; আল্লাহ্ বলছেন- সালাত কায়েম করতে, তাই আমরা সালাত কায়েম করি।
অথচ ইব্রাহীম (আ.) তার পিতার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেছেন। কিন্তু কেন? কারণ আল্লাহ্ বলেছেন। তাহলে বুঝা গেলো, আল্লাহ্ বললে- বাবা, মাকে শ্রদ্ধা করতে হবে, আবার আল্লাহ্ বললে- পিতা মাতার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করতে হবে। অর্থাৎ আল্লাহর কথাকেই প্রাধান্য দিতে হবে। আল্লাহ্র কথার উপরে কারো মায়া-মুহাব্বত চলে না। এটাই হচ্ছে ‘ইলাহ’ এর বাস্তবতা।
মহান আল্লাহ্ বলেন-
“তুমি কি তাকে দেখো না, যে তারা প্রবৃত্তিকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করে? তবুও কি তুমি তার যিম্মাদার হবে? তুমি কি মনে করো, তাদের অধিকাংশ শোনে অথবা বুঝে? তারা তো চতুস্পদ জন্তুর মতো; বরং আরও পথভ্রান্ত।” (সূরা ফুরকান, আয়াত: ৪৩-৪৪)
তাহলে আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো কথা মানা যাবে না, আল্লাহ্র আদেশের সামনে মাথা নত করে দেয়ার নাম-ই হচ্ছে মুলত আল্লাহ্-কে ‘ইলাহ’ হিসেবে মেনে নেয়া।
অর্থাৎ আল্লাহ্ ছাড়া হুকুম-আহকাম দেয়ার ক্ষমতা কারো নেই। কেউ হুকুম-আহকাম দিলেও আমি তা মানবো না। আমি তো শুধু একমাত্র আল্লাহ্র-ই গোলামী করি। আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো গোলামী আমি করতে পারি না, করলে সেটা শিরক হবে।
এভাবে কোনো একজন মানুষ আল্লাহ্-কে ইলাহ হিসেবে ভালভাবে বুঝে- সজ্ঞানে আল্লাহ্কে ‘ইলাহ’ হিসেবে মনে প্রাণে মেনে নিয়ে অতঃপর মুখে সাক্ষ্য দিলে তবেই সে হবে ঈমানদার।
আর এই বিষয়টাই তৎকালীন আরবের লোকেরা বুঝতো, কারণ তাদের ভাষাই তো আরবী। ফলে তারা আল্লাহ্র গোলামী মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। তাই তারা মুখে মুখে সাক্ষ্যও দিত না। কিন্তু আমরা তো ছোটবেলা থেকে না বুঝে-ই তোতা পাখির মত আল্লাহ্-কে ‘ইলাহ’ হিসেবে মেনে নেয়ার সাক্ষ্য দিই। অথচ আল্লাহ্ ব্যাতিত অন্য কারো হুকুম-আহকাম, বিধি-বিধানও মেনে নিই।
তাই আজ আপনাদের কাছে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর সঠিক অর্থ বুঝিয়ে দেয়ার পর চিন্তা করে দেখুন আপনি কি একমাত্র আল্লাহ্র গোলামী করতে প্রস্তুত আছেন? আপনি কি মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন যে- আল্লাহ্ ছাড়া হুকুম-আহকাম, বিধি-বিধান দেয়ার ক্ষমতা কারো নেই। আল্লাহ্ ছাড়া হুকুম-আহকাম, বিধি-বিধানের সামনে মাথা নত করে দেয়ার মত ইচ্ছা কি আপনার আছে?
তাহলে মন থেকে কালেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর সাক্ষ্য দিন।
লেখক: আলী ওসমান শেফায়েত
ইমেইল:
[email protected]
মন্তব্য: ০