তোমার কালেমা তোমার রুটি জোগায়, আমার কালিমা আমাকে ফাঁসিতে ঝোলায় – সাইয়েদ কুতুব শহীদ রহ.
তারিখঃ ৩ মার্চ, ২০২৩, ০৯:৫৫
যে বই লেখার কারণে সাইয়েদ কুতুবকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়
মিশরের প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ, দার্শনিক ও ইসলামী আন্দোলনের প্রবাদতম প্রাণপুরুষ সাইয়েদ কুতুব রহ. আরব বিশ্বসহ গোটা দুনিয়ায় পরিচিত এক নাম। তার রচিত বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ তাফসীর ফি জিলালিল কুরআন অতি পরিচিত এক তাফসীর। আরবী ভাষায় রচিত এ তাফসীর ইংরেজি, উর্দু, ফারসী, জার্মানী, ফ্রেন্স বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে।
কারাগারে সাইয়েদ কুতুব রহ.
এমনকি বাংলা ভাষায়ও এ তাফসীর অনুদিত হয়ে কুরআন প্রেমিদের কাছে অতি প্রিয় তাফসীর গ্রন্থ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এ তাফসীর গ্রন্থের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ নিয়ে পৃথক একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন যার আরবী নাম
معالم فى الطريق ইংরেজি ভাষায় বইটির নাম
THE MILE STONE, ইংরেজি হতে বইটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মরহুম আবদুল খালেক। বাংলা ভাষায় বইটির নাম দেয়া হয়েছে ‘‘ইসলামী সমাজ বিপ্লবের ধারা’’।
সাইয়েদ কুতুব রচিত তাফসীর ‘তাফসীরে ফি জিলালিল কুরআন’
এ বইয়ের কিছু অংশের ব্যাপারে তৎকালীন মিশর সরকার আপত্তি জানায় এবং বইয়ের কিছু ভাষা ও বাক্য পরিবর্তন করতে বলে। যে সসকল বিষয় পরিবর্তন করতে বলা হয় তা হচ্ছে :
১. তিনি তৎকালীন সমাজের নানা অনাচার, অপসংস্কৃতি, পাশ্চাত্য সভ্যতার অনুকরণ ও প্রচলিত সভ্যতা ও রীতি নীতিকে জাহেলিয়াত আখ্যা দিয়ে তা কুরআনের আলোকে পরিবর্তনের জন্য আহ্বান জানান।
২. সমাজতান্ত্রিক ও সেক্যুলার মতবাদকে কুফরী মতবাদ আখ্যা দিয়ে তা পরিত্যাগ করার জন্য মিশরের জনগণকে আহ্বান জানান।
৩. প্রচলিত রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে কুফরী রাষ্ট্য ব্যবস্থা আখ্যা দিয়ে তাকে পরিবর্তনের জন্য সর্বাত্মক সংগ্রামে ঝপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান।
৪. কালেমা বিশ্বাসী কোনো মানুষ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো মত,মতবাদ ও রাজনীতি মেনে নিতে পারে না। তিনি কালেমা বিশ্বাসের ভিত্তিতে সমাজ ও রাষ্ট্রকে গঠন করার আহ্বান জানান।
[i]সাইয়েদ কুতুব রচিত মূল আরবী কিতাব معالم فى الطريق যে বই লেখার কারণে সাইয়েদকে ফাঁসি দেয়া হয়[/i]
এ ধরনের কিছু বিষয় সরকারের তরফে বাদ দেয়ার জন্য বলা হয়। তিনি অস্বীকৃতি জানালে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণার অপরাধে তাকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর তার ওপর চলে বর্বর নির্যাতন। এক পর্যায়ে মিশরের তৎকালীন সামরিক সরকারের ক্যাঙ্গারু ট্রাইবুনাল এক ফরমায়েশী রায়ের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ দেয়।
মজার ব্যাপার হলো, সরকার তো আর এভাবে বলতে পারে না যে তিনি এই বই লিখেছেন এ জন্য তাকে ফাঁসি দেয়া হচ্ছে, সরকার প্রথমবার তাকে গ্রেফতার করে রাজনৈতিক সহিংসতার অভিযোগে এবং কিছুদিন কারান্তরীন রাখার পর তাকে মুক্তি দেয়া হয়। এরপর ইখওয়ানকে নিষিদ্ধ করে এবং ইখওয়ানের সকল নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। দ্বিতীয়বার গ্রেফতারের পর ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্টের অনুরোধে তাঁকে মুক্তি দেয়া হয়। এর এক বছর পর জামাল নাসের রাশিয়া সফরে গিয়ে এক বক্তৃতায় বলেন, ইখওয়ানের নেতারা তাকে হত্যা করতে চেয়েছিলো। জামাল নাসেরের এই ঘোষণার সাথে সাথে ইখওয়ানের কয়েক হাজার নেতা কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তৃতীয়বারের মতো গ্রেফতার হন সাইয়েদ কতুব শহীদ। জামাল নাসেরকে হত্যার ষড়যন্ত্রের মিথ্যা অভিযোগে তার বিরুদ্ধে বিচার কাজ শুরু হয়।
সাইয়েদ কুতুব রচিত معالم فى الطريق এর ইংরেজি অনুবাদের একই বইয়ের কভার
উল্লেখ্য যে এই বিচার চলাকালে আসামী পক্ষের আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সূযোগ ছিলো না। এমনকি কোনো আইনজীবীও নিয়োগ করতে দেয়া হয়নি। এমনকি অন্য দেশ থেকে আইনজীবীরা আসামি পক্ষ সমর্থনের আবেদন করেন। কিন্তু মিশর সরকারের তরফে তাও প্রত্যাখ্যান করা হয়। ফরাসি বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি উইলিয়াম থরপ (W.THORP) ও মরোক্কোর দু’জন আইনজীবী আসামি পক্ষ সমর্থনের জন্য রীতিমত আবেদন করেন। কিন্তু তা নামঞ্জুর করা হয়। সুদানের দু’জন আইনজীবী কায়রো পৌঁছে সেই দেশের (মিশরের) বার অ্যাসোসিয়েশনে নিজেদের নাম তালিকাভুক্ত করে আদালতে হাজির হন। পুলিশ তাদের আদালত থেকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় এবং মিসর ত্যাগ করতে বাধ্য করে।
সাইয়েদ কুতুব ও অন্য আসামিরা ১৯৬৬ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে বিচার চলাকালে ট্রাইব্যুনালের সামনে প্রকাশ করেন যে, অপরাধ স্বীকার করার জন্য তাদের ওপর অমানুষিক দৈহিক নির্যাতন চালানো হয়। ট্রাইব্যুনালের সভাপতি আসামিদের কোনো কথার প্রতিই কান দেননি।
ফাসির আগের রাতে কারাগার মসজিদের ইমাম সাহেব সাইয়েদ কুতুবকে তাওবা ও কালেমা পড়ানোর জন্য যায়। ইমাম সাহেব গিয়ে সাইয়েদ কুতুবকে সালাম দেয় এবং বলে যে
‘‘আমি আপনাকে তাওবা ও কালেমা পড়ানোর জন্য এসেছি।’’
সাইয়েদ কুতুব তাকে জিজ্ঞেস করলেন,
আপনাকে কে পাঠিয়েছে ?
ইমাম সাহেব জবাব দিলেন
‘‘ আমি কারাগারের মসজিদের ইমাম। যাদের ফাসি কার্যকর করা হয়, আমি তাদেরকে তাওবা ও কালেমা পড়াই’’
সাইয়েদ কুতুব জিজ্ঞেস করলন,
কে আপনাকে এই দায়িত্ব দিয়েছে ?
ইমাম সাহেব বললেন,
‘‘সরকারের পক্ষ থেকে আমাকে এই কাজের জন্য নিয়োগ করা হয়েছে ’’
সাইয়েদ কুতুব আবার জিজ্ঞেস করলেন,
আপনাকে কি সরকার এই কাজের জন্য বেতন দেয় ?
ইমাম সাহেব বললেন, ‘‘জি’’
তখন সাইয়েদ কুতুব বললেন :
‘‘আমি তো কালেমা বোঝার কারণে এর ব্যাখ্যা লিখেছিলাম। যা সরকারের পছন্দ হয়নি। কালেমা বোঝার কারণেই সরকার আমাকে ফাসি দিচ্ছে। একই কালেমা তোমার রুটি জোগায়, আমার কালিমা আমাকে ফাঁসিতে ঝোলায়।’’
ইংরেজি ১৯৬৬ সালের ২৫ আগস্ট শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ দায়ী ও দীনের নকীব সাইয়েদ কুতুব ও তার দু’জন সঙ্গীকে ফাসির মাধ্যমে হত্যা করা হয়।
( নোট : সাইয়েদ কুতুব ও কারাগার মসজিদের এ কথোপকথন তাঁর ফাসি কার্যকরের কিছু দিন পর ইমাম সাহেব ইখওয়ানের কোনো একজন দায়িত্বশীলের কাছে বলেছিলেন, তার মাধ্যমে বিভিন্ন পত্রিকায় ও বইয়ে প্রকাশিত হওয়ার পর এ বক্তব্য আমাদের কাছে পৌছেছে)
মন্তব্য: ০