Alapon

“বদলে যাও বদলে দাও”



অসাধারণ হ্যান্ডসাম, দুর্দান্ত স্মার্ট আবুজার আল গিফারি (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) একবার কোনো একটা কাজ করতেছিলেন। কিংবা যেকোনো কারণেই হোক একজন গরিব-দাসের সাথে কথা বলতেছিলেন। কথা বলা অবস্থায় কোনো এক কারণে রেগেমেগে তিনি তাকে গালি দিলেন। তার মা’কে জড়িয়েই গালিটা দিলেন। কেউ কেউ বলেন তিনি গরিবদের মধ্যে সম্পদ বন্টন করছিলেন; এমনই সময় সে লোকটি বললো হে আবুজার! আপনি এভাবে বন্টন না করে ওভাবে করলে ভালো হয়। তখন আবুজার (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) কিছুটা ক্ষেপে উঠলেন। বলে ওঠলো—এই কালো মহিলার বাচ্ছা!

আজকে আমাদের সমাজপতিদের সামনে কোনো দুর্বল অবস্থা সম্পন্ন মানুষ নিজ দায়িত্ববোধ থেকে ভালো কিছু বললে যেভাবে বলা হয়—অমুকের ছেলে কোথাকার! তুই আমার মুখের ওপর কথা বলিস? এত্তো বড় সাহস তোর!! এরকম একটা পরিস্থিতি ঘটেছিলো আরকি তখন।

আচ্ছা, আবুজার গিফারি কালো মহিলার বাচ্ছা বলে যাঁকে এভাবে বকা দিলেন, তিনি কে জানেন? তিনি আর কেউ নন, তিনিও আরেকজন বিখ্যাত সাহাবি, ইসলামের ইতিহাসের প্রথম মুয়াজ্জিন, সাঈয়িদুনা বিলাল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু। তাঁকে যখন আবুজার গিফারি কালির ছেলে বলে গালি দিলেন, তখন সেই গালি শুনে তিনি চলে গেলেন রাসুল সল্লালাহু আলাহি ওসাল্লামের কাছে। গিয়ে আবুজার আল-গিফারির বিরুদ্ধে নালিশ করলেন। এই শুনে রাসুল (সা.) আবুজরকে ডেকে পাঠালেন নিজের কাছে।

প্রিয় নবিজির জীবনে রাগ তো ওরকম ছিলো না। কিন্তু তিনি তাঁর জীবনে যেই সময়গুলোতে অত্যধিক রাগে রাগান্বিত হয়েছেন, তারমধ্যে এইদিনটিও অন্যতম। সেদিন রাসুলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম এতোটাই বেশি রাগান্বিত হয়েছেন যে, তিনি রাগ আর গোস্বার ছোটে তাঁর দিকে মুখ করে কথা পর্যন্ত বলেননি। কথা বলেছেন তাঁর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে। মনে হয় অবস্থাটা এমন হয়েছিলো যে, নবীজির সফেদ শরীর টুকটুকে লাল হয়ে শরীরের নীল রঙের রগ পর্যন্ত বের হয়ে এসেছিলো! তিনি আবুজার গিফারিকে ডেকে এনে জিজ্ঞেস করলেন জানেন? জিজ্ঞেস করলেন—
হে আবুজার! তুমি কি বিলালকে গালি দিয়েছো?
আবুজার বললেন : হ্যাঁ।
তিনি বললেন : তুমি কি তার মা তুলে গালি দিয়েছো?
আবুজার বললেন : হ্যাঁ।
রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম বললেন : তোমার জন্যে আফসোস আবুজার! আইয়ামে জাহেলিয়াতের মূর্খতা ও জাহালাত এখনো তোমার মনে বাসা বেঁধে আছে ! জাহিলি যুগের স্বভাব-চরিত্র তোমার ভেতর এখনো বিদ্যমান রয়েছে!!

আবুজার আল গিফারি রাসুলে কারিম সল্লল্লাহু আলাইহি ও’সাল্লামকে বললেন ইয়া রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! এই বৃদ্ধ বয়সে এখনো আমার মধ্যে জাহিলিয়াতের স্বভাব বিদ্যমান?
রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ও’সাল্লাম জবাব দিলেন হ্যাঁ, এখনো বিদ্যমান! তুমি তার মা তুলে গালি দিয়েছো। গায়ের রঙ নিয়ে খোঁটা দিয়েছো। অথচ জাহিলিয়াতের সময়েই উঁচু-নীচু, সাদা-কালো, ধনি-গরিব, বংশ-গোত্র ইত্যাদির ভিত্তিতে মানুষকে মূল্যায়ন করা হতো। কাউকে সম্মান দিলে এসবের ভিত্তিতেই সম্মান দেওয়া হতো।

এরপর আবুজার আল গিফারি (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) কী করলো জানেন ? আমাদের মতো অধিক আত্মসম্মান নিয়ে বসে ছিলেন? মনে মনে কি এই ভেবেছেন যে, তুই আমার নামে বিচার দিয়েছিস নবীজির কাছে, তোকে দেখিয়েই ছাড়বো! নাহ। আবুজার এগুলো কিছুই করেননি। বরং তিনি হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিয়েছেন। এই কান্নারত অবস্থাতেই তিনি দৌড়ে চলে গিয়েছেন বিলালের কাছে। মাটির ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে তাঁর এক চোয়াল মাটির সাথে মিশিয়ে বিলালের কাছে পেতে দিয়েছেন। আর বলছিলেন ইয়া বিলাল! তুমি আমার গালের ওপর দিয়ে হেটে যাও। আমার গালটা মাড়িয়ে যাও, আর দুনিয়াকে দেখিয়ে দাও তুমি আমার চাইতেও উত্তম এবং শ্রেষ্ঠ। আমার গুনাহ লাঘবের জন্য আমাকে এক্ষেত্রে একটু সহযোগিতা করো! তুমি এমনটা না করলে আমি কখনোই মাটি থেকে উঠবো না।

এই অবস্থা দেখে বিলাল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। আবুজরকে মাটি থেকে টেনে তুলে ভালোবাসার বাহুডোরে বুকের ভেতর পরম মমতায় আগলে ধরলেন। কপালজুড়ে একের পর এক ভালোবাসার চুমো খেতে লাগলেন। আর বললেন ইয়া আবুজার ! আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম।

আচ্ছা, এখানে আবুজার গিফারি আর বিলালের জায়গায় আপনি-আমি বা আমরা হলে কী করতাম? আমরা নিশ্চয়ই এমন একটা ভাব নিয়ে, এমন একটা জেদ নিয়ে বসে থাকতাম যে, কখনোই তোর সম্মুখে আর যাবো না। তোর সাথে কথা বলবো না। এছাড়া প্রচণ্ড প্রতিশোধ পরায়ণ হলে তো কথায়ই নেই! সারাজীবন অপরজনের খুঁত খুঁজে বেড়ানো, দোষ ধরে বেড়ানো, গীবত করা, তুচ্ছ করা, অপমান করা— এক কথায় কষ্ট দেওয়ার সামান্যতম কোনো উপকরণও আমরা হাতছাড়া করতাম না। কিন্তু দেখুন, আবুজার গিফারি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুও এসবের কিচ্ছুই করেননি, আবার বিলালও জেদ নিয়ে বসে থাকেননি। তাঁরা একজন যেভাবে সব অহমিকা ভুলে নিজের অন্তরকে পরিবর্তন করে কৃত ভুলের বদলায় নিজেকে ক্ষমার জন্যে সঁপে দিয়েছে, আবার অন্যজনও সেভাবে মনের ক্ষতটাকে ভুলে গিয়ে খুব সহজেই ক্ষমার চাদরে বুকে জড়িয়ে নিয়েছেন নিজের ভাইকে।

এছাড়াও এ ঘটনার পরে আবুজার গিফারি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু নিজেকে পরিপূর্ণভাবেই সারা জিন্দেগির তরে আপাদমস্তক বদলে ফেলেছেন। নিজের এই ভুল উপলব্ধির পরে সারাজীবন আর কাউকে তিনি রঙ নিয়ে, বর্ণ নিয়ে, বংশ নিয়ে খোঁটা দেননি। গালাগাল করেননি। অধীনস্থদের সাথে, বাসার নিজের অধিভুক্ত কর্মচারীদের সাথে যথেষ্ট উন্নত আর মার্জিত আচরণ করেছেন। এমনকী নিজে যেমন আর যেই মানের পোশাক পরতেন, তাদেরকেও সে একই ধরনের পোশাক পরাতেন। একেবারে রাজকীয়ভাবেই রাখতেন নিজের অধীনস্থ কর্মচারীদেরকে। নিজে যে চাদর গায়ে দিতেন, সে একই চাদর গোলামের গায়েও দিতেন।

মা‘রূর ইবনে সুয়াইদ (রহ.) নামক কুফার অধিবাসী বিশিষ্ট একজন তাবেয়ী আবুজার আল-গিফারির এমন আচরণের রাজ সাক্ষী। তিনি বলেন, আমি আবুজার গিফারির সাথে একদিন সাক্ষাৎ করতে যাই। সেই সাক্ষাতের সময় আমি দেখলাম তাঁর পরনে যে পোশাক, তাঁর গোলামের পরনেও সে একই পোশাক।

এই হলো প্রিয় নবীজির সহচর। আমাদের মতো তাঁরাও মানুষ ছিলেন। ভুল তাঁরাও করতেন। বিচ্যুত্যি তাঁদেরও হতো। যেহেতু মানুষ ছিলেন তাঁরা, সেহেতু ভুল-বিচ্যুতি হওয়াটাই তো স্বাভাবিক, তাই না? কিন্তু তাঁদের এই একটা দারুণ গুণাবলি ছিলো যে, তাঁরা ভুলকে ফুল মনে করে আত্মঅহংকারের কারণে সেই ভুলকে আঁকড়ে ধরে সেটার ওপর অটল-অবিচল থাকতেন না।

আল্লাহর রাসুলের কাছে বিচার দেওয়ার পরে তিনি ইচ্ছে করলে বিলালকে আচ্ছামত শাসাতে পারতেন। বিরূপ আচরণ করতে পারতেন। কিন্তু তা তো করেন-ই নি, বরং তিনি নিজেকেই সারাজীবনের তরে সমূলে বদলে ফেলেছেন।

এই যে এতোক্ষণ বসে বসে আবুজারের গল্প করলাম, আপনি কি জানেন কে এই আবুজার যার? এই আবুজার হলো সেই আবুজার, উম্মাতের মধ্যে সর্বপ্রথম যিনি রাসুলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লামকে ‘সালাম’ প্রদান করেছেন। এই আবুজার হলো সেই আবুজার, যিনি ইসলামের প্রথমদিকে ঈমান আনয়নকারী একজন ছিলেন। এই আবুজার হলেন সেই আবুজার, যাঁর সম্পর্কে আল্লাহর হাবিব মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ও’সাল্লাম বলেছেন—‘এই ধুসর মাটির উপরে, এই সবুজ আকাশের নীচে আবুজারের চেয়ে বেশি সত্যভাষী আর কেউ নেই।’ আর বিলালের মতো একজন কুচকুচে কালো দাস কিনা এমন একজন মানুষের সম্পর্কে আল্লাহর রাসুলের কাছে অভিযোগ করেছেন, আবার তিনিও কী অদ্ভুত সুন্দরভাবেই না নিজকে সংশোধন করে নিয়েছেন।

হ্যাঁ, প্রিয় বন্ধুরা ! এই হচ্ছে তাঁদের (সাহাবিদের) বৈশিষ্ট্য। দোষ-ত্রুটি সামনে আসার পর তাঁরা অনুতপ্ত হয়েছেন এবং নিজেকে সংশোধন করে নিয়েছেন। দোষ-ত্রুটিকে অবহেলার বিষয় মনে করেননি তাঁরা। এভাবেই আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশনা গ্রহণের মাধ্যমে তাঁরা পরিশুদ্ধ হয়েছেন ও পরবর্তীদের জন্য উত্তম আদর্শে পরিণত হয়েছেন। তাঁরা বদলে গিয়ে সবকিছুর বড়াই, বাড়াবাড়ি আর অহংকারকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছেন। হোক তা ধন-দৌলত, রূপ-সৌন্দর্য বা বংশের গৌরব। সোজা কথায় আমরা বলতে পারি তাঁদের বদলে যাওয়ার জিয়নকাঠি হচ্ছে আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল। কুরআন এবং সুন্নাহ।

আচ্ছা, আমরাও তো বদলে যেতে চাই, বদলে দিতেও চাই; তাই না? আমাদের জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোতেও ‘বদলে দাও বদলে যাও’ শ্লোগান থাকে। কিন্তু সেখানে বদলে যাওয়া ও বদলে দেওয়ার সত্যিকারের এসব আদর্শিক মানদণ্ড থাকে কি? উত্তর হলো থাকে না। অথচ এই হলো ‘বদলে দাও বদলে যাওয়ে’র সত্যিকারের নমুনা। আসুন, আমরাও এই নমুনা অনুসরণ করি। আমরাও এই জিয়নকাঠির ছোঁয়ায় নিজেকে এবং নিজের সমাজ-সংসার ও সভ্যতাকে পরিবর্তন করে ফেলি। পারতপক্ষে সেই চেষ্টাটা তো শুরু করতে পারি। তাই না?


-রেদওয়ান রাওয়াহা

পঠিত : ৪২৩ বার

মন্তব্য: ০