Alapon

“শবে-বরাত ও সংস্কৃতি : কিছু প্রশ্ন কিছু কথা”



০১. আমাদের কোনো কোনো দীনি ভাই বলেন যে আমাদের শবে বরাত জৌলুশ হারানোর কারণে আমরা পিছিয়ে পড়েছি। আমাদের পতন হয়েছে। আমরা আত্মপরিচয় বিস্মৃত হয়ে পড়েছি। এক্ষেত্রে আমার কিছু কথা আছে। সেটা হচ্ছে, আমাদের শবে বরাত তো ঈদানীং জৌলুশ হারিয়েছে। তো যখন উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে আমাদের শবে বরাত পালিত হতো, তখন আমরা কী অর্জন করতে পেরেছি? আমাদের অর্জনের খাতায় কতোটুকুনই-বা যুক্ত হয়েছিলো? বৃটিশদের গোলামির পূর্বেও তো এটা ভীষণ উদ্দীপনার সাথে পালিত হতো। বৃটিশদের থেকে আজাদির পরেও হতো। অথচ খাইরুল কুরুন তথা সর্বশ্রেষ্ট প্রজন্ম আসহাবে রাসুলগণের সময় তো উৎসবের নামে এমন কিছু পালন ও লালন হতো না। অথচ দেখুন, তখন দিকে দিকে কী দারুণভাবেই না আমাদের বিজয় কেতন উড়েছে। কতো অল্প সময়ের মধ্যেই-না অর্ধ্ব পৃথিবী আমাদের করতলগত হয়েছে। এমন কথিত সাংস্কৃতিক উৎসব ছাড়া আমরা পৃথিবীকে নেতৃত্ব দিয়েছি। আর এদিকে আমাদের হাত থেকে যখন আমাদের সর্বশেষ অংশটুকুনও চলে গিয়েছে, মানে আমরা যখন খিলাফতের সর্বশেষ অংশটুকুনও হারিয়েছি; তখনও কিন্তু আমরা এই জৌলুশময় উৎসব পালন করতাম। এই যে শবে বরাতের জৌলুশ হারিয়ে যাওয়া নিয়ে একশ্রেণির ভাইয়েরা হাহুতাশ আর কান্নাকাটি করছেন, তাদের তো এটা জানা উচিৎ যে, এর জৌলুশ তো দীর্ঘদিন ধরেই চালু ছিলো। কমলে বা হারালে তা হারিয়েছে ইদানীংই।

আমার খুব স্পষ্টভাবেই মনে আছে যে, আমরা নিজেরাও ছোটোকালে গোসল করে মসজিদে যেতাম। জিলাপি হাতে নিয়ে বাড়ি আসতাম। আমাদের অনেক খেলার সাথি, আমাদের অনেক বন্ধুবান্ধব বাজি-পটকা ফোটাতো। মসজিদে গিয়ে হৈহুল্লোড় ও দৌড়াদৌড়ি করা হতো, নারিকেল গাছ-সুপারিশ গাছের ডগায় ডগায় অনেকেই চড়ে বেড়াতো। সবাই মিলে ডাব পেড়ে ডাব খেতো। এই মসজিদ থেকে ওই মসজিদ, এই বাড়ি থেকে ওই বাড়িতে আমরা ঘুরে বেড়াতাম।

এতো গেলো আমাদের শৈশব-কিশোর থাকাবস্থার কথা, এদেশের একজন বিখ্যাত এবং নন্দিত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদও তাঁর সময়ের শবে বরাতের উল্লেখ করেছেন তাঁর একটা গল্পে। যেখানে তিনি বলেছেন-

“আমি যখন ছোট ছিলাম তখনো শবে বরাত উৎসব হতো, এখনো হচ্ছে। তবে উৎসব পালন প্রক্রিয়ায় গুণগত পরিবর্তন হয়েছে। একালের ছেলেমেয়েদের আমাদের সময়কার উৎসবটির কথা বলতে ইচ্ছে করছে।
আজ আইন করে পটকা ফুটানো নিষেধ করা হচ্ছে। আমাদের সময়ে এই আইনের প্রয়োজন হয়নি। এক সপ্তাহ আগে থেকেই পাড়ায় পাড়ায় পটকার দোকান। ছোটদের প্রিয় ছিল তারাবাতি, কাঠির আগায় পটকা, মার্বেল পটকা। একটু বখাটে ধরনের ছেলেদের জন্যে মরিচ বাতি। কাঁচা মরিচ সাইজের হাউই। দেয়াশলাই-এ আগুন লাগাতে হয়—আগুন লাগানোমাত্র শাঁ করে আকাশে উড়ে যায়।

সে সময় ছেলেমেয়েদের বাবারা পটকা কিনে দিতেন। কিছু তারাবাতি, কিছু লাঠিপটকা, কিছু মার্বেল পটকা। মনে আছে, কাঠি-পটকা হাতে আমরা গম্ভীর ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়াতাম। কিছুক্ষণ পর পর গোণা হতো-মোট কয়টা পটকা আছে। তারাবাতির প্যাকেট থাকত বুক পকেটে। যখন-তখন পকেট থেকে তারাবাতির প্যাকেট বের করে বাতির সংখ্যা গোণা ছিল অবশ্যকর্তব্যের একটি।

পটকার দোকানে মোমবাতিও বিক্রি হত। শবে বরাতের সন্ধ্যায় মোমবাতি জ্বালিয়ে আলোকসজ্জা। হালুয়ার ব্যাপারটা ছিল কিনা মনে পড়ছে না, হয়তো ছিল। তবে গোশত-রুটির কথা মনে আছে। চালের আটার রুটি এবং প্রচুর ঝাল দিয়ে রাধা গরুর মাংস। ঝোলে কব্জি পর্যন্ত ডুবিয়ে রুটি খাওয়া শবে বরাতের অবশ্য করণীয় কর্মকাণ্ডের একটি।
রাতের খাওয়ার পরই গোসল। হাড় কনকনে শীতে গোসল সারতে হতো। গরম পানি না, পুকুরে। কারণ গোসল করে পাড়ে উঠার পর গা থেকে গড়িয়ে পড়া পানিতে যত ঘাস ভিজত তত সোয়াব। সোয়াব বাড়ানোর জন্যে ভেজা গায়ে ঘাসের উপর ঘাসের উপর ।” [ বই : সকল কাঁটা ধন্য করে]

ওপরের লেখাটা পড়ে একটা চিত্র আশা করি স্পষ্টভাবেই ধরতে পেরেছেন। এবং একটা বড়োসড়ো সাংস্কৃতিক চিত্র বুঝতে পেরেছেন। তো এই যে এমন উৎসবমুখর পরিবেশ, এই জৌলুশপূর্ণ উৎসব হারানোই যদি উম্মাহর পতনের একটা কারণ হয়ে থাকে, আমাদের আত্মপরিচয় বিস্মৃত হবার উপাদান হয়ে থাকে, তাহলে আমার প্রশ্ন হচ্ছে আমরা সেই জৌলুশ থাকাবস্থাতেই কেন আমাদের পতনের সাক্ষী হয়েছি? আসহাবে রাসুল কোন উৎসবের শক্তিতে আধা জাহান জয় করেছেন? কোন জৌলুশের জোরে পারস্য এবং রোমান সভ্যতার মতো শক্তিশালী সভ্যতার পতন ঘটিয়ে ইসলামের বিজয় কেতন আধা জাহানে উড়িয়েছেন?

হুমায়ুন আহমেদের বাবারা তাদেরকে এরকম জৌলুশপূর্ণ পরিবেশে বড়ো করার পরেও তারা কেন দীনের নিশানাবরদার হিসেবে গড়ে উঠেনি? কেন তাহলে তাঁর (হুমায়ুন আহমেদের বাবা) ঘর থেকে সুকৌশলে নাস্তিকতা ছড়িয়ে দেওয়ার প্রবাদ-প্রতিম পুরুষ জাফর ইকবাল ফয়দা হয়েছে? শুধু হুমায়ন স্যার আর জাফর ইকবালই নয়, আপনি প্রত্যেক বঙ্গীয় সেকুলার বুদ্ধিজীবী-চিন্তক-সাহিত্যিকদের হিস্ট্রি ও পারিবারিক ঐতিহ্য ঘেটে দেখুন, প্রত্যেকেই তাদের শৈশব-কৈশরে এমন উৎসবমুখর-জৌলুশপূর্ণ শবে বরাত পালনের মাধ্যমেই বড়ো হয়েছে। কিন্তু তবুও তারা দীন থেকে বিচ্ছুত। এখন যদি তারা এটাকে একটা ইবাদাত হিসেবে শেখতো-জানতো, তাহলে হয়তো এরকম না-ও হতে পারতো। আমরা এখন আবার এসব বলে (শবে-বরাতকে সংস্কৃতি বলে) কি আমরা ইসলামের মূল প্রাণসত্তাকেই হারিয়ে ফেলছি না? দীনের প্রাণ সত্তা বুঝি উম্মাহর শ্রেষ্ট প্রজন্মরা যা করেনি তার মধ্যেই নিহিত?

০২. আমার অনেক শ্রদ্ধেয় এবং স্নেহপরায়ন আদর্শিক-সহবস্থান সম্পন্ন ভাইয়েরাও দেখি ইদানীং এসব নিয়ে অতি আবেগধর্মী লেখালেখি করছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। তাঁরা বলতেছেন এটা হচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি, এটা ইবাদাত না। শ্লোগান দিচ্ছেন এরকম— ‘শবে বরাত, আমাদের সংস্কৃতি।’ আমার কথা হচ্ছে শবে বরাত কোন দৃষ্টিতে সংস্কৃতি হতে যাবে? শবে-বরাত মুবারাক বলে আবার নতুন করে সম্ভোধন প্রক্রিয়া চালু হচ্ছে, এটা কোন ধরনের সংস্কৃতি? শবে-বরাত কি আসলেই উৎসব-উদ্দীপনার দিবস? নাকি এটা হলে ইবাদাতেরই দিবসই হতে পারে? এক ধরনের সালাফি বিদ্বেষ থেকে সালাফি-ব্যাশিং করে এটাকে কালচার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়াটা আসলে কতোটা কল্যাণকর মুসলিম উম্মাহর জন্যে? আপনার-আমার পূর্ব পুরুষেরা আসলেই কি এটাকে সংস্কৃতি হিসেবে দেখতো? না-কি এটাকে ইবাদাত হিসেবেই দেখতো? এই প্রশ্নটা নিজে নিজে একটু ভেবে দেখবেন।

শবে-বরাত বা নিসফি মিন শাবান নিয়ে যদিও অনেকেই অনেক প্রান্তিকতার আশ্রয় নেয়, কিন্তু আমি এসব প্রান্তিকতার (যেমন এটা কী আমলের রাত না প্রত্যাখ্যান করার বিষয়, এরাতে ইবাদাত করা কি সহীহ না বিদ'আত ইত্যদি) ধারেকাছেও কখনো ঘেঁসতে চাই না। যদিও মানবিক দুর্বলতার কারণে আমার ভেতরেও মাঝেমধ্যে প্রান্তিকতা চলে আসে, এবং সেটা অনেকটা প্রকাশও হয়ে যায়! তবে এক্ষেত্রে আমার কথা হচ্ছে, শবে বরাত সহীহ কী বিদ’আত সেটার বিতর্কে না গিয়ে আমি মনে করি যে, যেসব সাধারণ মানুষ এ রাতকে কেন্দ্র করে মসজিদে আসছে বা আসে, সেসব মানুষকে মসজিদে আসার পরে পরিকল্পিতভাবে টার্গেট নিয়ে কুরআন-সুন্নাহর বাণী শোনানোর কাজ আন্তরিকতার সাথেই করা উচিৎ। অন্যান্য সময় যেখানে তাদেরকে ডেকেও মসজিদে আনা যায় না, এখন তাঁরা যেহেতু নিজ উদ্যোগেই মসজিদে আসছে, তাই মানুষের মসজিদে থাকার এই সময়টুকুকে পরিকল্পিতভাবেই দীনের দা’ঈদের কাজে লাগানো উচিৎ।

কিন্তু, একে বিদ’আত বলে পুরোদমে এগ্রেসিভ ওয়েতে প্রত্যাখ্যান করা, কিংবা একে ধর্মীয় দৃষ্টিতে বৈধতা দিতে না পেরে সংস্কৃতির নামে আরেকাট জাহিলিয়াতের পথকে প্রশস্ত করা কখনো কল্যাণ বয়ে আনবে না। আপনি যদি একে সংস্কৃতি হিসেবে চিহ্নিত করেন, তবে এই সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা কার্যক্রমকেও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। আর এসব করা মানেই দীনের প্রাণ সত্তাকে ধীরে ধীরে খুইয়ে ফেলা। ইসলামকেও হিন্দু-খ্রিস্টানদের ধর্মের মতো অনেকটা উৎসব-সর্বস্ব ধর্মে পরিণত করে ফেলা।

আবারও বলি, শবে-বরাতকে কেন্দ্র করে যে উৎসব-জৌলুশ-সংস্কৃতি ইত্যাদি বলা এবং প্রচার করা হয়ে থাকে, এই কথিত উৎসব উদযাপনের পেছনে “খাইরুল কুরূন” তথা সর্বশ্রেষ্ঠ প্রজন্ম সাহাবাদের থেকে শুরু করে তাবে'ঈ কিংবা তাবেতাবে'ঈ পর্যন্ত কারোই কোনো কর্ম বা সমর্থন নেই। এমনকী তাঁরা কেউ কাউকে দেখে এদিনে কোনো সম্ভোধন ( শবে বরাত মোবারক বা এমন কিছু) করেছেন বলে প্রমাণের ছিঁটেফোটাও নেই। তাঁরা ঈদ উপলক্ষ্যে একে অন্যকে সম্ভোধন করতেন, কিন্তু শবে বরাত বা নিসফি মিন শাবান উপলক্ষ্যে নয়। তবে এই রাতে আল্লাহর ইবাদাতে মগ্ন থাকার নজির আমাদের পূর্ববর্তী বহু ওলামায়ে কেরাম ও মুজতাহিদ ইমামদের থেকে প্রমাণিত। কিন্তু আপনারা এটাকে ইবাদাতের সময়, আল্লাহর দরবারে ধর্না দেবার রাত বানানোর পরিবর্তে সংস্কৃতি বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নামে একটা সেকুলার কৃষ্টি চালু করার কাজ করছেন। আপনারা যারা এটা করেন, তাদের প্রতি আমার বিনীত নিবেদন হচ্ছে, আপনারা মেহেরবানী করে পূর্বের সেই জাহিলিপূর্ণ কর্মগুলো বা বিকৃতিগুলোকে প্রশ্রয় দিয়ে দীনকে আরো বেশি বিকৃতির দিকে ঠেলে দেবেন না। আপনারা হয়তো ভালো উদ্দেশ্য নিয়েই করেছেন বা বলতেছেন এসব, কিন্তু এর চূড়ান্ত ফলাফল কিন্তু ভালো হবে না। আর মূলত এটা করে আপনারা সেকুলাদের বয়ানকেই বৈধতা দিচ্ছন। তাদের বেঁধে দেওয়া ফ্রেমে থেকেই চিন্তা করছেন। প্রশ্ন হতে পারে সেটা কীভাবে? বিষয়টা হচ্ছে রকম— সেকুলাররা হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি নামে রমনার বটমূলে যায়, পান্তা-ইলিশ খায়, মঙ্গল-শোভাযাত্রার মতো হরেক রকম অপকর্ম করে। আপনারাও সেকুলারদের মুখ আর মগজ থেকে বের হওয়া বাঙালি সংস্কৃতির বিকল্প হিসেবেই তাদের উসুল ফলো করে বা তাদের মগজে, তাদের বেঁধে দেওয়া কাঠামোতেই চিন্তা করে বলতেছেন যে, ওরা যেহেতু হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির নাম দিয়ে এটা-ওটা করে; আমাদেরও তাহলে আরো কিছু উৎসব লাগবে, আমাদেরও কিছু সংস্কৃতি লাগবে, যেটার নাম হবে বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতি ! ক্যান ভাই, কমিউনিস্ট-সেকুলারদের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে আমাদেরকেও “বাঙালি মুসলিমদের সংস্কৃতি” নাম দিয়ে এমন একটা জিনিস বের করতে হবে কী কারণে, যেখানে আবার ইসলামের বাতাবরণে অনৈসলামিক কার্যকলাপ চর্চা হবে? একজন নিখাঁদ মুসলিমের জন্যে আল্লাহ প্রদত্ত রাসুলে করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম প্রদর্শিত সাংস্কৃতিক কার্যক্রমই কি যথেষ্ট নয়?

০৩. আপনারা যারা বলেন যে, শবে বরাতকে বিদ’আত বলায় বাংলাদেশের যুবকদের জন্য দুর্গাপূজা, হলি উৎসব ছাড়া আর কোনো উৎসবই বাকী থাকলো না; তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বিনয়ের সাথে আমি বলতে চাই— একজন সচেতন মুসলিম ছেলে-মেয়ে কি কখনো দুর্গোৎসবে শামিল হবে বা হয়েছে? হলি নাচে কি দীনের বুঝ আছে, তাওহিদের জ্ঞান আছে, এমন কোনো ছেলে-মেয়ে যুক্ত হয়েছে? যদি না-ই হয়ে থাকে, তাহলে আপনাদের মূল কাজ কী ছিলো? যুবকদেরকে তাওহিদের বিশুদ্ধ চেতনায় উদ্ভুদ্ধ করা নয় কি? সেটা না করে কেন আমরা সেকুলার ও অমুসলিমদের অনুকরণে একটার পর একটা কপি-পেস্ট চিন্তা প্রয়োগ করি? আমাদের কি এসবই করা উচিৎ, না-কি সমস্যার মূলেই হাত দেয়া উচিৎ? আমাদের কি উচিৎ নয় ইসলাম সম্পর্কে, দীনের বিধান সম্পর্কে, তাওহিদ আর শিরক সম্পর্কে যুবকদের জ্ঞান দান করা, সচেতন করা? আমাদের এসব সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক উৎসব তো পতনকালে আরো বেশিই ছিলো, সেটা কি ইসলামের জন্যে উপকারী ছিলো? সেই উৎসবের বদৌলতে কি আমরা আমাদের বিজয় আর গৌরব ফিরিয়ে আনতে পেরেছি?

এই যে যেসব ভাইয়েরা শবে-বরাতকে সংস্কৃতি বা কালচার বানাতে সোৎসাহে আর সাগ্রহে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, এতে করে তাঁরা দুটো জিনিসই স্পষ্ট করেন এবং মনের অজান্তেই স্বীকৃতি দেন যে-

এক. শবে-বরাত পালনের কোনো ভ্যালিডিটি নেই। মানে ধর্মীয়ভাবে এর স্বীকৃতি নেই।

দুই. আল্লাহর দাসত্বের চেয়ে আমরা সংস্কৃতি-কালচার, জৌলুসময় উৎসব ইত্যাদির দাসত্বই করছি। অথচ মুসলিম হিসেবে আমাদের উচিৎ ছিলো কালচার-জৌলুশপূর্ণ উৎসবের পরিবর্তে আল্লাহর দাসত্বকে-ই বরণ করে নেওয়া।


এছাড়াও এর দ্বারা আমরা আরো একটা বাড়াবাড়িকে বৈধতা দিচ্ছি— সেটা হচ্ছে অনেককেই দেখবেন সারা বছর বেনামাজি থাকে, হালাল-হারাম বেছে চলে না। কিন্তু কেবলই একটা রাতকে কেন্দ্র করে বাড়াবাড়ি করে। যেমন দুইজন ভাইয়ের কিছু কথোপকথন দেখুন:

একজন মৌসুমী ইবাদাতকারী আরেকজন নিয়মিত সালাত আদায়কারী ভাইকে এসে বললো শবে বরাত নিয়ে আপনার মতামত কী?

তিনি জবাবে বললেন আমার কোনো মতামত নেই।

অতঃপর বলা হলো আজকের রাত তো ভাগ্য নির্ধারণের রাত।

-তিনি বললেন, আচ্ছা এ বিষয়টা পরে, আগে আপনি আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর দেন তো...

আপনি আজকে ফজরের নামায পড়েছেন?

- না।

জোহর-আছর?

- না।

মাগরিব তো অবশ্যই পড়েছেন......

-তিনি বললেন না।

জিজ্ঞেস করা হলো কেন?

- একটু সমস্যা আছে।

এশা তো অবশ্যই পড়বেন?

- জবাব এলো হ্যাঁ , তা তো অবশ্যই!

এরপর যখন জিগ্যেস করা হলো কেন এশা পড়বেন?

- শবে-বরাতের নামাজ পড়বো তো, তাই এশাও পড়তে হবে!

এবার জিজ্ঞেস করা হলো আপনি তাহলে শবে বরাতকে উদ্দেশ্য করেই এশার সালাত আদায় করবেন?

- জি।

এরপর তাকে জিগ্যেস করা হলো, তাহলে ফরজ থেকেও আপনার কাছে নফলের গুরুত্ব বেশি?

-তিনি এবার কিছুই বললেন না। চুপ হয়ে গেলেন।

এই যে উপরের কনভারসেশনটা, এটা কিন্তু আমার বানানো বা কল্পিত লেখা না। এই বিষয়টা আমি আমার ফেসবুকের ফ্রেন্ডলিস্টের কাসেম নামক এক ভাইয়ের আইডি থেকেই পেলাম। তিনিই বর্ণনা করেছেন বিষয়টা। আসলে এরকম ঘটনা, এরকম উদাহরণ আপনার আশেপাশে অহরহই পাবেন। এরকম বহুচিত্র আপনি একটু চোখ খুলে তাকালেই দেখতে পাবেন মুসলিম সমাজে।

দেখুন, আমি কিন্তু শবে-বরাত নিয়ে একদেশদর্শী কথা বলতে চাই না। তবে এইটুকুন বলতে চাই— আমাদের তো ফরজকে কেন্দ্র করেই নফল ইবাদাত করার কথা ছিলো। কিন্তু নাহ, সেটা না। বরং আমরা নফলকেই ফরজের সমতুল্য গণ্য করছি, কখনো কখনো ফরজের চেয়েও বেশি প্রাধান্য দিচ্ছি নফলকে। নফলকে কেন্দ্র করে মসজিদে জমায়েত হই, কিন্তু ফরজকে করে ফেলি উপেক্ষিত।

০৪. এই যে যারা আজকে ‘শবে-বরাত আমাদের সংস্কৃতি’ বলে শ্লোগান তুলছে, তারা স্রেফ নিজেকে একটু আলাদা, একটু ক্রিটিকাল থিংকার, একটু ইন্টালেকচুয়াল, একটু সুক্ষ্ম বুঝওয়ালা হিসেবে প্রদর্শন করার জন্যেই তা করছে। এরাই এক সময় শবে-বরাতকে বিদ’আত বিদ’আত বলে শোরগোল করতো। আমাদের দেশের দেওবন্দি আলিমদের সাথে এসব নিয়ে টক্কর ধরতো। কিছু সালাফি আলিমদের ভিডিয়ো-বক্তব্য দিয়ে তাদেরকে এই বলে ব্যাশিং করতো যে, মদিনায় পড়নেওয়ালা আলিমরা দীন-শরিয়ত বুঝে না, শুধু কওমি-দেওবন্দিরাই বুঝে! এরা সংকীর্ণমনা। কুয়োর ব্যাঙ, মূর্খ ইত্যাদি। এরকম নানাবিধ কথাবার্তা বলে তাদেরকে ছোটো করতো। তাচ্ছিল্য করতো। মক করতো। ট্রল করতো। ব্যাশিং করতো।

এখন যখন দেখেছে এভাবে আর নিজেরে অন্যদের চেয়ে একটু আলাদা প্রদর্শন করা যায় না, শবে-বরাত না পালন করার মধ্যেও একটু মোল্লা মোল্লা ভাব আছে, তাই এখন নফসের খায়েশ বা প্রবৃত্তির পূজা থেকেই আবার পল্টি নিয়ে সালাফি-ব্যাশিং করার জন্যে বলতেছে, ‘এইটা আমাদের বাঙালি মুসলমানদের সংস্কৃতি। সালাফিজম ইসলামটারে নীরস-বিবশ কইরা দিছে। এরা আরবের সংস্কৃতি বাঙালি মুসলমানদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে’, ইত্যাদি।

দেখুন, একই ব্যক্তির দুই দিকে একই পদ্ধতিতে ইউটার্ন—আলিম ব্যাশিং ! আরো কথা বলার পদ্ধতি হচ্ছে শাহবাগীদের মতো। তারা যেমন ইসলামকে আরবের সংস্কৃতি, মরুচারী বেদুঈনদের সংস্কৃতি বলে প্রত্যখ্যান করে, তুচ্ছজ্ঞান করে; এরাও তেমনটাই করে। মানে আল্টিমেটলি তারা তাদের নফসের সাথে যা যায়, বিশাল এক অংশ আলিমদের ব্যাশিং করতে যখন যার থেকে যেটুকু প্রয়োজন, তখন তারা তার থেকে সেটুকুই নেন। আগে ফতোয়া নিয়েছেন সালাফি আলিমদের থেকে, তাও কোন ফতোয়া নিয়েছে—যে ফতোয়ায় ইবাদাত ছিলো না। ইবাদাত করলে বিদ’আত হবার ফতোয়া নিয়েছে। সোজা কথায় ইবাদাত মুক্ত হবার ফতোয়া নিয়ে আমল করেছে। এখনো যেই ফতোয়া বা দৃষ্টিভঙ্গি মেনে নিয়ে তারা কথা বলে— সেটাতেও দীন নেই। সেটা তাদের কাছে কেবলই সংস্কৃতি। তারা সব সময়ই আল্লাহর দাসত্বের চেয়ে যুগের দাসত্ব, নফসের দাসত্ব, মানুষের দাসত্ব করতেই বেশি ভালোবাসে। এ কারণেই দেখবেন তাদের এই উভয় ইউটার্নে কোনো রিচুয়াল এপ্রোচ ছিলো না। আগেরটায় ফতোয়া দিয়ে রিচুয়াল ইবাদাত মুক্ত হয়েছে। এখন আবার যে এটার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, সেখানেও কোনো রিচুয়াল প্রভাব নেই। সম্পূর্ণ রিচুয়াল প্রভাব মুক্ত হয়ে নিজের ইন্টালেকচুয়ালিটি দিয়ে একে জাস্টিফিকেশন করা হয়/হচ্ছে। এর মাধ্যমে তারা এমন আচরণের প্রকাশ ঘটাচ্ছেন, এমন এক দীনের আইডিয়া দিচ্ছেন, যে দীন হচ্ছে সেকুলার দীন। যে দীনে সংস্কৃতি খুঁজতে হয় ইসলামের বাহিরে গিয়ে। ব্যাপারটা আসলেই দুঃখজনক !

০৫.একজন মুসলিম হিসেবে আমরা যদি এটাকে (শবে-বরাতের বাড়াবাড়িকে) কালচারাল-ওয়ার হিসেবেও নিই, তাহলেও উক্ত ভাইদের এই এপ্রোচটা ধোপে টিকে না। কারণ মুসলমানদের নিকট সংস্কৃতি হচ্ছে এক সার্বিক ব্যবস্থাপনার নাম। ঈমানদারদের কাছে সংস্কৃতি মানে হচ্ছে মানুষকে গাইরুল্লাহর দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে এক আল্লাহ’র দাস হিসেবে বাঁচতে শেখানো। সকল দাসত্বকে পরিহার করে মানুষকে আজাদ দাস হয়ে চলতে শেখানো। ঈমানদেরদের সংস্কৃতি এবং সাংস্কৃতিক কাজ হচ্ছে কুরআন ও সুন্নাহের সাজে নিজে সজ্জিত হওয়াএবং এই জমিনের মানুষকেও সজ্জিত করা। এছাড়া সংস্কৃতির নামে কিংবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নামে যা-ই হোক, যা-ই আসুক, সেগুলো আদতে ইসলামি সাংস্কৃতি নয়। ইসলামি সাংস্কৃতি মানুষকে মুক্তির বারতা দেয়, কল্যাণের পথযাত্রী করে, মানুষের অন্তরে আল্লাহর ভয় জাগ্রত করে, আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। অথচ তাদের এসব কথিত সংস্কৃতিতে না আছে আল্লাহর ভয়, না আছে পরকালের ভাবনা যোগানোর উপাদান, না আছে কোনো আধ্যাত্মিক শক্তির উৎস। যারা কালচারাল-ওয়ারের কথা বলে, তাদের আলোচনায়, তাদের কথাবার্তায়-কাজেকর্মে এসব যদি সম্পূর্ণ অনুপস্থিতই থাকে, তাহলে কোন শক্তি দিয়ে তারা এই অসম ময়দানে বিজয়ী হবেন?

তারা যদি সত্যিই সাংস্কৃতিক বিজয় চাইতো, তাহলে তো তাদের উচিৎ ছিলো শিরকের বিপরীত তাওহিদকে, জাহিলিয়াতের বিপরীত ইসলামকে, ইসলামের মূল স্পীডকে ধারণ করে এবং গুরুত্ব দিয়ে আমাদের সংস্কৃতিকে বিশুদ্ধ তাওহিদী সংস্কৃতি বানানোর কাজ করা ! অথচ তারা করছে ঠিক উল্টোটা......! ফলাফল, ইসলামি চেতনা সমৃদ্ধ সংস্কৃতি আর রাম-বামদের মগজ থেকে বের হওয়া কপি-পেস্ট চিন্তার আলোকে কথিত বাঙালি মুসলিমদের সংস্কৃতি একই বিন্দুতে এসে মিলিত হচ্ছে। এটাকে আমি অবশ্য সেকুলার দীনই বলি। কারণ, তাদের আবিষ্কৃত এ সংস্কৃতি এমন এক সংস্কৃতি, যে সংস্কৃতিতে পড়ে মুসলমান যুবকেরা তাদের মৌলিক মিশন-ভিশনকে চেপে রেখে এমন এক ধরনের জৌলুশপূর্ণ আনুষ্ঠানিকতায় মজে থাকে, যা তাদেরকে তাদের মূল লড়াই ( খোদাদ্রোহী শক্তির বিরুদ্ধে জয়ী হবার জন্যে ঈমান ও তাকওয়ার পারদ বৃদ্ধি করে বাতিলের জন্যে ত্রাশ হয়ে ওঠা) থেকে এক প্রকার দূরেই সরিয়ে রাখে বলা চলা। সে কারণেই আমি মনে করি ঈমানদারদের কাছে সংস্কৃতি এবং সাংস্কৃতিক কাজ কখনোই হালুয়া-রুটির উৎসবকে ইসলামি সংস্কৃতি বানানো নয়। মুসলমানদের জীবন-উদ্দেশ্যের মধ্যেই তার সংস্কৃতি এবং সাংস্কৃতিক কাজ স্পষ্ট হয়ে আছে। এটাকে শুধু খুঁজে বের করে যথাযথভাবে কাজ করতে হবে। কিন্তু তারা এটা খুঁজতে রাজি নয়। বরং সেকুলার কৃষ্টির ইসলামাইজেশনেই তারা ব্যতিব্যস্ত। এর মাধ্যমে (শবে-বরাতের বাড়াবাড়িকে ইসলামি সংস্কৃতি বানানো) তারা এমন চিন্তাধারার প্রকাশ ঘটাচ্ছেন, এমন এক দীনের আইডিয়া দিচ্ছেন, যে দীন হচ্ছে সেকুলার দীন। যে দীনে সংস্কৃতি খুঁজতে হয় ইসলামের বাহিরে গিয়ে।


~রেদওয়ান রাওয়াহা
তাং : ২০.০৩.২২ ইং

পঠিত : ৩৪৪ বার

মন্তব্য: ০