Alapon

“আজানের শহিদ-খ্যাত শাসক যিনি”




০১.

নাম তাঁর আলি আদনান এরতেকিন মেন্দারেস। বিশ্বে তিনি আদনান মেন্দারেস নামেই অধিক পরিচিত। তাঁর বাবার নাম ইব্রাহিম এতহেম এবং মায়ের নাম তেউফিক হানিমি। তাঁর দাদা ছিলেন ইউক্রেনের ক্রিমিয়ার বাসিন্দা। সেখান থেকে আসেন তুর্কীর আইদিন প্রদেশে। সেই সূত্রেই তিনি জন্মেছেন তুরস্কের আইদিন প্রদেশে। তাঁর জন্ম সাল ছিলো ১৮৯৯।

সর্বপ্রথম তাঁর রাজনীতির হাতেখড়ি হয় ১৯৩০ সালে। অখ্যাত একটি দলের মাধ্যমে। সেই দলটি ছেড়ে তিনি পরের বছরই যোগদান করেন কুখ্যাত মুরতাদ-কিং কামাল পাশার ইসলাম বিদ্বেষী দল সিএইচপিতে । উক্ত দল থেকেই টানা তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু পরবর্তীতে ১৯৪৫ সালে এই কট্টর ইসলাম বিদ্বেষী সেকুলার দলটি ত্যাগ করেন আদনান মেন্দারেস। আরো তিনজন ত্যাগ করেন উক্ত দল। মোট তাঁরা চারজন। এই চারজনই পরবর্তীতে গড়ে তোলেন সেকুলারনদ্ধতামুক্ত, একটু উদার, ডানপন্থী একটি দল। দলের নাম ডেমোক্রেটিক পার্টি।

১৯৪৬ সালে তুরস্কে আসে নির্বাচনের মওসুম। সেই নির্বাচনে আলি আদনান এরতেকিন মেন্দারেস পুনরায় নির্বাচিত হন। নবগঠিত তাঁর সেই দল নির্বাচনে পায় ৬৪-টি আসন। ১৯৫০ সালে তুরস্কে পুনরায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত নির্বাচনে আলি আদনান মেন্দেরেসের দলকে সমর্থন জানান তুরস্কের ইসলামি পুনর্জাগরণের অন্যতম কারিগর ও ত্রানকর্তা, বিশিষ্ট আলিমে দীন, দা’ঈ ইলাল্লাহ বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসী রহিমাহুল্লাহ।

নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন আলি আদনান মেন্দারেসের দল ডেমোক্রেটিক পার্টি। এভাবে ১৯৫৪ এবং পরবর্তী নির্বাচনেও তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন, এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত দল বিজয়ী হয়ে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়।

০২. ডেমোক্রেটিক পার্টি ক্ষমতায় আসার পূর্বে তুরস্কের ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন খিলাফত বিলুপ্তকারী ব্যক্তি কুখ্যাত মুরতাদ-কিং মোস্তফা কামাল পাশা। শুধু ক্ষমতা কুক্ষিগত আর খিলাফত বিলুপ্তই নয়, বরং সে ইসলামের ঐতিহ্য মণ্ডিত এই জনপদে চালায় প্রচন্ড রকম ভয়াবহ বর্বরতা। নিষিদ্ধ করে দেয় আজান। বন্ধ করে দেয় শত-সহস্র মসজিদ। আরবি হরফে কুরআন লেখা বন্ধ করে দেয়। চালু করে ল্যাটিন বর্ণমালা। শিশুদের ইসলাম শিক্ষার সার্বিক ব্যবস্থা নস্যাৎ করে দেয়। দেয় সকালের মক্তব বন্ধ করে, দাড়ি-টুপি, হিজাব-নিকাবের ওপর চালায় দুর্দমনীয় অভিযান। গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-নগরে চালু করে ইসলামি আদর্শ বিরোধী নাচ-গান, নাটক-সিনামা। শুধু আইন করেই মসজিদ বিমুখ করার বন্দোবস্ত করেননি কামাল পাশার দল সিএইচপি। বরং যুবক-তরুণরা যেন মসজিদমুখী না হয়, সেজন্য শহরে এবং গ্রামে চালু করে পাবলিক হাউজ এবং পাবলিক হোম। এক কথায় ইসলামকে ধরে ধরে জবাই করতে যা যা প্রয়োজন, সবই করেছে, সব উদ্যোগই নিয়েছে এই কুখ্যাত মুরতাদ।

আদনান মেন্দারেস নির্বাচনের সময় ঘোষণা করেছিলেন যে, নির্বাচনে বিজয়ী হলে তিনি আযানকে পুনরায় আরবিতে চালু করবেন। এরপর ১৯৫০ সালের মে মাসের নির্বাচনে আদনান মেন্দারেস বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসেন। বিজয়ী হবার পরে যেই কথা সেই অনুযায়ী কাজ করেন তিনি। তাঁর দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পুনরায় আরবিতে আযান করেন।

শুধু এটাই না, ক্ষমতায় এসে শিশুদের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইসলাম শিক্ষা চালু করেন। ইসলাম বিমুখ করার যাবতীয় কামালবাদী কার্যক্রমের অনেকটাই বন্ধ করেন। আজান চালু করেন। হিজাব-নিকাব, দাড়ি-টুপির ওপর সকল প্রকার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু আদনান মেন্দারেসের এসব সংস্কার কার্যক্রম তুর্কী শাহবাগীরা সহ্য করতে পারেনি। তাই তার বিরুদ্ধে ভেতর ভেতর ওরা ষড়যন্ত্র করে। বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। ভাঙচুর অগ্নিসংযোগ করে সরকারকে আদনানের ডেমোক্রেটিক পার্টিকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়। এভাবে ধারাবাহিকভাবে বিক্ষোভ চলতেই থাকে কামালিস্টদের। একপর্যায়ে ১৯৬০ সালের ২৭ মে বিক্ষোভের চূড়ান্ত পরিণতিতে কামাল আতাতুর্কের অবৈধ আদর্শিক সন্তানেরা আদনান মেন্দারেসকে ক্ষমতাচ্যুত করে। দখল করে নেয় অবৈধভাবে তুরস্কের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা।

০৩. যেই তুরস্ক ইসলানি ঐতিহ্য আর মূল্যবোধের আঁতুড়ঘর ছিলো, সেই তুরস্ক যখন ইসলামের চরম দুশমনে পরিণত হয়ে মুসলমানদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিলো, সেই অবস্থান থেকে আদনান মেন্দারেস এবং তাঁর দল দশ বছর ক্ষমতায় থেকে পুনরায় ইসলামের আবাদের উপযুক্ত ভূমিতে পরিণত করেন। কিন্তু কামালবাদী মুরতাদ সেনারা পুনরায় ক্ষমতা দখল করে তুরস্ক থেকে আবারও ইসলামের আলোকে নির্বাসনে পাঠাবার বন্দোবস্ত করে।

আজান চালু করা, আরবির ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা, প্রাথমিক পর্যায়ে ইসলামি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা, হিজাব-নিকাব, দাড়ি-টুপির ওপর সেকুলারন্ধ মানসিকতার কামাল আতাতুর্কের অবৈধ আদর্শিক সন্তানেরা যে অন্যায় আদেশ জারি করে রেখেছিলো, সেগুলোকে তুলে নেওয়ার কারণে বামপন্থী তুর্কী শাহবাগী সেনারা এবার খড়গহস্ত হয়ে পড়েছিলো আদনান মেন্দারেসের ওপর। তারা তাঁর বিরুদ্ধে এসব পুনরায় চালু করার কারণে সেকুলার চেতনার অবমাননা ও সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে গ্রেফতার করে বন্দী করে। শুধু তাঁকেই নয়, দেশের সকল বিভাগের প্রায় ছয়শত জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বিরুদ্ধে সেকুলার চেতনার ওপর আঘাত হানার অপরাধে মামলা করে। ট্রাইবুনাল গঠন করে। এরমধ্যে ২৯০ জনের বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ প্রদান করে। ১৭ ই সেপ্টেম্বর ১৯৬১ সালে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয় আদনান মেন্দেরিস এবং তাঁর আরো কিছু দলীয় নেতা এবং মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীকে। ইন্না-লি-ল্লাহি ওয়া-ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

০৪. তবে, কেউ কেউ অভিযোগ তুলবে এই বলে যে, আদনান মেন্দারেসকে কেন দশ বছর পরে আজানের জন্য হত্যা করা হবে? তাদের কাছে আমার বিনীত একটা কথা হলো , এভাবে বিচার করলে তো জামায়াতে ইসলামীর নেতাদেরকে ইসলামি আন্দোলনের জন্য শহিদ করা হয়েছে বলাটাও অমূলক হয়ে যায়। কারণ, ইসলামি আন্দোলনের জন্যই যদি শহিদ করা হবে, তাহলে তো লীগ এরপূর্বেও ক্ষমতায় ছিলো, তখন হত্যা করেনি কেন? আদর্শিক শত্রু যখন সুযোগ পাবে, তখনই তো হত্যা করবে। বাহ্যিকরূপে এখানে কেবলই রাজনৈতিক কারণ মনে হতে পারে, কিন্তু আসলে তো অভ্যন্তরেও বহু ঘটনা থাকে। রাজনৈতিক কারণ, ব্যক্তি ক্রোধ-আক্রোশ যে থাকবে না, বিষয়টা তো এমন নয়।

এরপর আবার হয়তো প্রশ্ন করা হবে যে, তাহলে সিএইচপি পুনরায় ক্ষমতা দখল করে আজান নিষিদ্ধ করেনি কেন? আমার কথা হলো, এটা করে তারা অন্তত তাদের জনপ্রিয়তাকে আরো তলানিতে, অধিকাংশ মানুষের কাছে নিজেদেরকে আরো বেশি ভিলেন করতে হয়তো-বা চায়নি।

এরপর প্রশ্ন আসবে যে, তাহলে আদনান মেন্দারেস কেন শুরুর জীবনে কামাল আতাতুর্কের দল করেছেন? আমার কথা হলো মানুষের প্রতি সুধারণা রাখাটাই উচিৎ। ওই সময় সে হয়তো প্রতিষ্ঠিত সিস্টেমকে কাজে লাগিয়ে কৌশলের মাধ্যমে আরো বেশি কিছু অর্জন করতে চেয়েছিলেন। (হ্যাঁ, এই কৌশল যথাযর্থ কি-না এই প্রশ্ন করা যায়) এছাড়া তখন কামাল আতাতুর্কের দলের অপ্রতিদ্বন্দ্বী কোনো দল বা সংগঠন ছিলো কি-না? যেখানে গিয়ে সে তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার গড়বে? ছিলো না তো বলে মনে হয়। তবে তিনি তো শুরুতে ভিন্ন একটা অখ্যাত ছোটো দল দিয়ে রাজনীতি শুরু করেছেন। কিন্তু সেখানে ভালো করার সম্ভাবনা না থাকায় হয়তো এখানে এসেছেন।

অন্তত বাহ্যিক দৃষ্টিতে তো সে (আদনান মেন্দারিস) মুসলমানদের জন্য কামাল পাশা এবং তার কার্যক্রমের তুলনায় উপকারী ছিলো বৈকি! যেভাবে বাংলাদেশে লীগের বিকল্প হিসেবে ইসলামপন্থীদের জন্য বিএনপি অনেকটা উপকারী। কিংবা এখন যেভাবে এরদোগান ও তাঁর দলকে সিএইচপি তথা কামালিস্টদের চাইতে ভালো দল মনে করে মানুষ, সেরকম আরকি।

এছাড়াও তাঁকে আজানের জন্যে শহিদ করা হয়েছে কী হয়নি, এই প্রশ্নটা তোলার আগে আমাদের নিজেদেরকে জিজ্ঞেস করা উচিৎ তিনি আজান চালু করেছেন কি-না? কট্টর সেকুলারনদ্ধতা থেকে তাঁর দেশের জনগণকে বের করার উদ্যোগ হাতে নিয়েছেন কি-না? ডি-ইসলামাইজেশোন প্রকল্প রোধ করা শাসক ছিলেন কি-না? যদি প্রশ্নের জবাব হ্যাঁ সূচক হয়ে থাকে, তাহলে এ বিষয়ে ফতোয়াবাজী না করাটাই ভালো হবে বলে মনে হয়।


~রেদওয়ান রাওয়াহা
১৫.০৩.২২



তথ্যসূত্র :
> আতাতুর্ক থেকে এরদোয়ান বদলে যাওয়া তুরস্কের ১০০ বছর : পৃষ্ঠা ৬৭-৭১, ১৮৩-১৮৭

পঠিত : ৩৮৭ বার

মন্তব্য: ০