Alapon

মুসলিমদের প্রতি জাতিসংঘের এতো বৈষম্য কেন...?




প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ববাসীকে যুদ্ধ এবং নৈরাজ্য থেকে মুক্তির দেয়ার জন্য ১৯১৯ সালে "লীগ অব নেশন" নামে একটি দল প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু বৃহৎ রাষ্ট্রসমূহের অবাধ্যতা এবং সাম্রাজ্য বিস্তারের নেশায় বিশ্বসংস্থা 'লীগ অব নেশন' তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে যুদ্ধ-হানাহানি বন্ধ না হয়ে বরং আরো বেড়ে যায়, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংগঠিত হবার পথ প্রশস্ত করে তোলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসলীলার পরে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ ও অশান্তি দূর করার জন্য ১৯৪৫ সালের ২৪শে অক্টোবর আরো একবার একটি দল প্রতিষ্ঠা করা হয়, যার নাম "জাতিসংঘ"।

মজার ব্যাপার হলো, এই জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পেছনে মূল উদ্যোক্তা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ব্রিটেন, চীন এবং ফ্রান্স। আর এখানেই আসল টুইস্ট!

দেশে দেশে বিদ্যমান সংঘাত, সংঘর্ষ এবং যুদ্ধকে স্থায়ীভাবে বন্ধ করে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা হলেও বাস্তবতার নিরিখে জাতিসংঘ তার সেইসব উদ্দেশ্য পূরণে পুরোপুরি সফল হতে পারেনি। বরং জাতিসংঘ ব্যবহৃত হয়েছে বৃহৎ রাষ্ট্রসমূহের আধিপত্য বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে। মূলকথা, "বিজয়ী শক্তিবর্গের আধিপত্য স্থায়ীভাবে চূড়ান্ত করার জন্যই জাতিসংঘের জন্ম।"

ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলছি, এই সংস্থা প্রতিষ্ঠার সময় ভাবা হয়েছিল সাধারণ পরিষদ, বিশেষত তার বার্ষিক সাধারণ বিতর্ক হবে সেই ফোরামে, যেখানে শুধু বিশ্বের চলতি সমস্যা আলোচিত হবে তা–ই নয়, তার সমাধানেরও পথনির্দেশ করা হবে। পারস্পরিক মতবিনিময়ের মাধ্যমে বিশ্বনেতারা অভিন্ন কর্মপন্থা নির্ধারণ করবেন। শান্তি ও নিরাপত্তা প্রশ্নে প্রধান ভূমিকা নিরাপত্তা পরিষদের, কিন্তু ভেটো ব্যবস্থার কারণে তার চরিত্র প্রবল অগণতান্ত্রিক।

পাঁচটি বৃহৎ শক্তি নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় তাকে নিজেদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। সাধারণ পরিষদে কারও কোনো ভেটো শক্তি নেই, সবাই সমান, সবার একটি ভোট। কিন্তু সুযোগ থাকলেও গুরুত্বপূর্ণ এই সংস্থা তার কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালনের বদলে তা অনুষ্ঠানসর্বস্ব হয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে ডেভিড মিলিব্যান্ড হয়তো ঠিকই বলেছেন, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বার্ষিক অধিবেশন গ্যাবফেস্ট বা বক্তৃতাবাজির উৎসব ছাড়া আর কিছু নয়। বিশ্বনেতারা ১৫ মিনিটের ভাষণ দিয়ে চলে যান, দিন যেতে না যেতেই সেসব কথা সবাই ভুলে যায়।

কাগজে-কলমে সবাই জাতিসংঘের মূল সনদের সাথে ঐক্যমত পোষণ করলে ও বাস্তবিক প্রেক্ষাপটে বৃহৎ শক্তিসমূহ বরাবরই পালন করেছে উল্টো ভূমিকা। নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থকে চরিতার্থ করার জন্য এবং অপরের ওপর আধিপত্য বিস্তারের জন্য এসব বৃহৎ শক্তি সবসময় গায়ের জোরে নিজেদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করেছে এবং নিজেদের স্বার্থে সবসময় জাতিসংঘকে ব্যবহার করেছে। অন্য রাষ্ট্রের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান দেখানো জাতিসংঘের মূল সনদের নির্দেশনা হলেও জাতিসংঘকেই পাশ কাটিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে শক্তির জোরে দখল করেছে ইরাক এবং আফগানিস্তান, যে দু'টি রাষ্ট্রই জাতিসংঘের সদস্য। এক্ষেত্রে জাতিসংঘ সম্পূর্ণ অসহায় এবং ব্যর্থ। এবার বুঝুন, জাতিসংঘের দৌড় কতদূর!

এখানেই শেষ নয়।

১৯৪৮ সালে জাতিসংঘে গণভোটের ভিত্তিতে কাশ্মীরের ভাগ্য নির্ধারণের সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছিল। অথচ জাতিসংঘের সেই সিদ্ধান্ত আজো বাস্তবায়িত হয়নি? কেন হয়নি? এর মূল কারণ বৃহৎ শক্তিসমূহের অনিহা।

সেই ১৯৪৮ সালে ইসরাইলের প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের ওপর যে নির্মম বর্বরতা চালিয়ে যাচ্ছে বর্বরতা তা বিশ্ববাসীর কাছে দিবালোকের মতো পরিষ্কার।

ফিলিস্তিনের ওপর পরিচালিত ইসরাইলি এই হত্যাযজ্ঞ এবং নির্যাতনও কিন্তু জাতিসংঘ বন্ধ করতে পারেনি। জাতিসংঘে এ-পর্যন্ত যতবারই ইসরাইলের বর্বরতার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোন প্রস্তাব এসেছে ততবারই যুক্তরাষ্ট্র ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে সেই প্রস্তাবকে বাতিল করে দিয়েছে। ঠিক একই কারণে বসনিয়ার দুই লক্ষ মুসলমান প্রাণ হারিয়েছে। এক্ষেত্রেও জাতিসংঘ সার্বদের বর্বরতার হাত থেকে বসনিয়ার নিরপরাধ মুসলমানদেরকে রক্ষা করতে পারেনি।

অভিন্ন কারণে চেচনিয়া আর মিন্দানাওয়ের মুসলমানরা পারেনি স্বাধীনতা অর্জন করতে। অথচ জাতিসংঘ ঠিকই পূর্বতিমুরের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করেছে! সেখানে গণভোটে অনুষ্ঠান করেছে এবং সেই গণভোটের রায় অনুযায়ী পূর্বতিমুরকে স্বাধীন করেছে। পূর্বতিমুর যেহেতু একটি খ্রিস্টান অধ্যুষিত এলাকা এবং এটি যেহেতু মুসলিম প্রধান ইন্দোনেশিয়ার অন্তুর্ভুক্ত, তাই মুসলমানদের কাছ থেকে খ্রিস্টানদের স্বাধীন করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা জাতিসংঘের মাধ্যমে সেখানে গণভোটের মাধ্যমে পূর্বতিমুরকে স্বাধীনের ব্যবস্থা করেছে। একই ঘটনা সুদানের বেলায় বাস্তবায়িত হয়েছে। অথচ কাশ্মীরের ব্যাপারে জাতিসংঘের ভুমিকা সম্পূর্ণ উল্টো। লিবিয়া, ইয়েমেন এবং সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ বন্ধেও জাতিসংঘ চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। মিয়ানমার রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইতিহাসের বর্বরতম জাতিগত নিধনের ঘটনায়ও জাতিসংঘ রোহিঙ্গা মুলনমানদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কোনোরূপ ভূমিকা রাখতে পারেনি।

২১ শতকের কয়েকটি বড়ো যুদ্ধে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর ঐকমত্য ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা কয়েকটি মিত্র ইরাকে হামলা চালায়। একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের ওপর জাতিসংঘের সমর্থন ছাড়া হামলা করা যায় না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র গায়ের জোরে তা করেছে। শান্তির কথা বলে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ চালালেও তা শেষ পর্যন্ত ভয়াবহ শান্তি বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যে কারণে গোটা বিশ্বকে এখন ভুগতে হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আফগানিস্তানে হামলাও আন্তর্জাতিকভাবে বিতর্কিত। এসব হামলা বা যুদ্ধে চীন ও রাশিয়া অংশ নেয়নি। অর্থাৎ জাতিসংঘের সমর্থন ছাড়াই সে দেশে হামলা হয়েছে। বিষয়টি বিশ্বকে উপেক্ষা করার শামিল বলা যায়।

কোনোরকম আন্তর্জাতিক নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ইসরাইল যখন ফিলিস্তিনে একের পর এক হামলা চালিয়েছে, তখন জাতিসংঘ 'দুঃখ প্রকাশ, শোক জানানো' ধরনের বক্তব্য-বিবৃতি দিয়েই দায় শোধের চেষ্টা করেছে। কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ইসরাইলের শাস্তি দাবি করেনি যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। কিন্তু কেন? প্রশ্ন থেকে যায়।

যুক্তরাষ্ট্র যখন সিরিয়ায় হামলা চালানোর জন্য প্রস্তুত বলে ঘোষণা দিলো, তখন তারা জাতিসংঘের সম্মতি নেয়নি। এক্ষেত্রে রাশিয়া স্পষ্ট ভাষায় যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা করে এবং দেশটির মধ্যস্থতায় এক ধরনের সমঝোতা হয়। সিরিয়ার বিদ্রোহীদের অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে যুক্তরাষ্ট্র এটা এখন দিবালোকের মতো সত্য। সিরিয়ার বর্তমান সরকার স্বৈরশাসক হোক বা না হোক, তা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু সেখানে বিদেশি শক্তির কোনো একটি পক্ষকে সমর্থন করা কি সমীচীন? জাতিসংঘ সনদ অন্তত তা বলে না! এই নিশ্চুপ জাতিসংঘই আবার ইউক্রেন যুদ্ধে মানবতার বুলি কপচাচ্ছে! মায়াকান্নার অশ্রু ঝরাচ্ছে! স্ট্রেইঞ্জ!

জাতিসংঘের ৬ যুগের ইতিহাসকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে কেবল দেউলিয়াপনা, ব্যর্থতা এবং পক্ষপাতিত্বের ইতিহাস। বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘের নিরপেক্ষ ভূমিকার কথা থাকলেও তা কখনই পালন করতে পারেনি।

আসলে থলের খবর হচ্ছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত শক্তি জার্মানি আর ইতালি ইউরোপীয় ইউনিয়নের বদৌলতে শক্ত একটা অবস্থান করে নিয়েছে। অপর পরাজিত বৃহৎ শক্তি উসমানি সাম্রাজ্যের উত্তরসূরী মুসলিমরা ওআইসি সংস্থা করেও ঐক্য, সংহতি ও শক্তিশালী হতে পারেনি, বরং বলা ভালো, হতে দেয়া হয়নি। তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ী শক্তিবর্গ তাদের হাতিয়ার জাতিসংঘ দিয়ে 'জোর যার মুল্লুক তার' এর ছরি ঘোরাচ্ছে।

(ইতিহাসের ইতিহাস টিম এ লেখাটি লিখেছে)

পঠিত : ২৮০ বার

মন্তব্য: ০