Alapon

তারাবীহ নামায : কেবল কোয়ান্টিটি রক্ষা নয়; কোয়ালিটিই মুখ্য!!!



সাইয়িদুনা ইবনু আব্বাস রা. বলেন,
"অন্তরের ভাবলেশহীন সারা রাত ইবাদতের চেয়ে অন্তরের ভাব ও মনোযোগ সহকারে ভারসাম্যপূর্ণ দু রাকআত নামাযই শ্রেয়।"


গত প্রায় এক পক্ষকাল ধরে ফেবু খুলতেই নজর কেড়েছে তারাবীহ নামাযের রাকআত সংখ্যা নিয়ে বহছ, তর্কবিবাদ । কিন্তু রাসূল সা. ও তাঁর প্রিয় সাহাবীগণ এ নামায কীভাবে আদায় করতেন, পক্ষান্তরে আমাদের এ নামায আদায়ের ধরন কী, আমরা কীভাবে তা আদায় করছি - এ বিষয়ে খুব কম লেখাই নজরে পড়েছে।

এটা অবশ্যই প্রশংসনীয়, এ বহছে তারাবীহের প্রতি আমাদের ব্যাপক আগ্রহ ফুটে ওঠেছে। কিন্তু ভাবনার বিষয় হলো, আমরা যে মাত্রায় এ নামাযের রাকআত-সংখ্যার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছি, এ নামাযের বৈশিষ্ট্য রক্ষার প্রতি আমাদের আগ্রহ কতটুকু?
হাদীস থেকে যতটুকু জানা যায়, এ নামাযের একটি বৈশিষ্ট্য হলো, সাহাবীগণ দীর্ঘ সময় ধরে অত্যন্ত ধীরসুস্থে ও একাগ্রতার সাথে এ নামায আদায় করতেন।

খলীফা উমর (রা.)-এর সময় সাহাবীগণ প্রায়ই এ নামায শেষ করে বাড়িতে সাহরি খেতে ফিরতেন। তাঁরা এক একটি রাকআতে দীর্ঘ সময় ব্যয় করতেন: দীর্ঘ কিরাআত, দীর্ঘ রুকু, দীর্ঘ সিজদা। দীর্ঘ কিরাআতের কারণে কেউ কেউ লাঠির ওপর ভর দিয়েও দাড়াঁতেন। এক এক রাকআতে দীর্ঘ সময় ব্যয় করার কারণে তাঁদের কেউ কেউ শারীরিকভাবে কিছুটা অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়তেন বলে তাঁরা প্রতি চার রাকআত অন্তর অন্তর কিছুক্ষণ (মসজিদে নববী থেকে সাল' পর্বত পর্যন্ত দূরত্ব অতিক্রমের সময় [প্রায় ১০ থেকে ১৫ মিনিট]) বিশ্রাম নিতেন বা নানাভাবে নিজেদের অবসাদ দূর করার চেষ্টা করতেন। এ কারণে এ নামায 'সালাতুত তারাবীহ' নামে পরিচিতি লাভ করে।

পক্ষান্তরে আমাদের তারাবীহ নামাযের কী করুণ অবস্থা! আমার মনে হয়, বর্তমানে এ নামায ছাড়া অন্য কোনো নামায এতো দ্রুত পড়া হয় না। তাড়াহুড়া করতে গিয়ে অনেক হাফিয কুরআন বহু শব্দ সঠিকভাবে উচ্চারণও করেন না। রুকু, সিজদা, দুআ ও তাসবীহ সর্বক্ষেত্রেই তাড়াহুড়া, একেবারে ক্ষিপ্রগতিতে। এখানে হৃদয়ের স্পন্দন নেই বললে অত্যুক্তি হবে না।

বর্তমান অবস্থাদৃষ্টে (অনেকাংশে) এটি আর সালাতুত তারাবীহ নেই; বরং 'সালাতুত তা'জীল' (ক্ষিপ্রগামী নামায)-এ পরিণত হয়েছে। ফাতাওয়া আলমগীরীতে রয়েছে, "দ্রুত গতিতে কিরাআত পড়া এবং তাড়াহুড়া করে নামাযের রুকনগুলো আদায় করা মাকরূহ (তাহরীমী)।"
যে কেউ বর্তমানের তারাবীহ নামাযের সাথে সলফে সালিহীনের নামাযের তুলনা করলে দেখতে পাবে, বর্তমানে এ নামাযের আসল প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য অনেকটাই হারিয়ে গেছে; কেবল তার খোলসটাই প্রাধান্য লাভ করেছে।

হয়তো নামাযের এরূপ অবস্থা দেখেই সাইয়িদুনা আনাস ইবনু মালিক (রা.) দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে কেঁদেছিলেন। ইমাম যুহরী রাহ. বলেন,
একদিন আমি দিমাশকে আনাস ইবনু মালিক (রা.)-এর নিকট প্রবেশ করে দেখতে পেলাম, তিনি কাঁদছেন। আমি তাঁকে কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলাম। তিনি জবাব দিলেন,

"(রাসূল সা.-এর সময়) আমি লোকদেরকে যেসব বিষয় আমল করতে দেখেছি, তন্মধ্যে কেবল এই নামায ছাড়া অন্য কিছুই এখন চিনতে পারছি না। তদুপরি এ নামাযও নষ্ট হয়ে গেছে।" (বুখারী)

অর্থাৎ নামায যা অবশিষ্ট আছে তাও অনেকাংশে তার বাহ্যিক খোলসটা। মূল বৈশিষ্ট্য ও প্রাণ তাতেও পুরো বিদ্যমান নেই।
মনে রাখতে হবে, প্রাণই হলো প্রত্যেক কিছুর মূল। প্রাণবিহীন দেহ গুরুত্বহীন। উল্লেখ্য, নামাযেরও প্রাণ আছে। আর সেই প্রাণ হলো খুশু (চিত্তের বিনয়াবনত ভাব)।

ইমাম গাযালী রাহ. বলেন,
নামাযের একান্ত অবলম্বন হলো, খুশু, একান্ত মনোনিবেশ সহকারে কুরআন তিলাওয়াত ও গভীর উপলব্ধিসহ আল্লাহর স্মরণ।

কাজেই নামায থেকে কাঙ্ক্ষিত ফযীলত ও উপকারিতা লাভ করতে হলে পূর্ণ নিষ্ঠা, আল্লাহর প্রতি পূর্ণ ভালোবাসা, বিনয়, ভয়, আশা, একাগ্রতা, ভাব-গাম্ভীর্য ও ধীরসুস্থতার সাথে তা আদায় করতে হবে।

আল্লাহ তাআলা বলেন,
"নিশ্চিতভাবে সফলকাম হয়েছে সেসব মুমিন, যারা নিজেদের নামাযে বিনয়াবনত হয়।"

হাসান বসরী রাহ. বলেন,
"যে নামাযের মধ্যে অন্তর উপস্থিত থাকে না, সেই নামায দ্রুত শাস্তির দিকে নিয়ে যাবে।"

পঠিত : ১৮৭ বার

মন্তব্য: ০