Alapon

প্রসঙ্গ : মুসলমান অথচ আরবী ভাষা জ্ঞান নেই


সুপ্রীম কোর্ট এপিলিয়েট ডিভিশনের আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ জনাব তৈমুর আলম খন্দকারের লেখা ‘‘মুসলমান অথচ আরবী ভাষা জ্ঞান নেই’’ শীর্ষক একটি লেখা গত ৩১ মার্চ দৈনিক নয়াদিগন্তে প্রকাশিত হয়েছে। দেশ জাতি ও উম্মাহর নানান সমস্যাবলী নিয়ে তিনি লিখছেন নিয়মিত। দেশীয় পত্রিকা ব্যতীত বিদেশী দুটি জার্নালেও লিখেন বলে তিনি জানিয়েছেন। অদ্যপান্ত রাজনীতির মানুষ হলেও লিখছেন দেশ ও জাতির নানান বিষয় নিয়ে। জনাব তৈমুর আলম খন্দকার আরবী ভাষার পন্ডিত নন, আরবী ভাষার শিক্ষকও নন। এরপরও তার এ লেখা আমাদেরকে চিন্তার অনেক খোড়াক যোগাবে। তিনি তার লেখায় লিখেছেন
‘‘দেশে ধর্মের অনুশীলন, বিশেষ করে ৯২ শতাংশ মুসলমানের এ রাষ্ট্রে ইসলামী রীতিনীতি, ধর্মীয় অনুশাসন ও সংস্কৃতি ব্যাপক আকারে পালিত হচ্ছে। কিন্তু অসৎ মানুষ, ভ‚মিদস্যু, মজুদদার, মুনাফাখোর, সুদখোর, ভেজাল খাদ্য প্রস্তুতকারী, লোক দেখানো ইবাদতকারী, মানুষের অধিকার ছিনতাই বা অন্যের জমি দখলকারীর সংখ্যা তো কমছে না; বরং বৃদ্ধি পাচ্ছে। রমজান মাসে রোজা থেকে এক ফোঁটা পানি পান করতে আল্লাহকে যে মুসলমান ভয় পায়, সে মুসলমান অন্যের জমি দখল করতে, এতিমের হক নষ্ট করতে বা অন্যায়-অবিচার, অত্যাচার, জুলুম-নির্যাতন করতে বা সৃষ্টিকর্তার আদেশ অহরহ অমান্য করতে ভয় পায় না কেন? আল্লাহ ইসলামকে শুধু নামাজ রোজার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি।’’
এখানে অনেকগুলো বার্তা আছে :
১. মসজিদের সংখ্যা বেড়েছে, নামাজীর সংখ্যা বেড়েছে কিন্তু ইবাদাতের চেতনায় যেমন আদর্শ, সৎ ও আল্লাহভীরু মানুষ তৈরী হওয়ার কথা ছিলো তা হয়েছে কি না ?
২. এত মসজিদ, এতো নামাজ রোযা কিন্তু দূর্নীতি, দুরাচার, অন্যায় অনাচার, চোরাকারবারীর সংখ্যা বেড়েই চলছে।
জনাব তৈমুর আলম খন্দকারের আক্ষেপের জবাব তো এটাই যে, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যে উদ্দেশ্যে মানুষের জন্য এই সকল ইবাদাত আবশ্যক করেছেন, সে উদ্দেশ্যকে মানুষ বুঝতে চায় না, সেটা ধারণ করে না এবং সে উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের ইচ্ছা এবং আকাঙ্খাও তাদের মধ্যে অনেকাংশে অনুপস্থিত। অধিকাংশ জনগণ ইবাদাতের আনুষ্ঠানিকতাকেই ইবাদাত বলে মনে করে। কিন্তু এই আনুষ্ঠানিক ইবাদাত মূল উদ্দেশ্য নয়। মানুষের ¯্রষ্টা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষকে তার দাসত্ব বা ইবাদাত করার জন্য। এ ইবাদাতের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষ সর্বান্তকরণে মহান আল্লাহর সন্তোষ অর্জনে তার জীবনের প্রতিটি কার্য সম্পাদন করবেন। ¯্রষ্টার ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাবেন। তিনি যেভাবে চান, মানুষ তার গোটা জীবনকে সেভাবে সাজাবে। এটা করতে পারলেই মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবন সফলকাম হবে। দুনিয়া হতে বেইনসাফী, অন্যায়, জুলুম, অনাচার, পাপ পঙ্কিলতা দূও হবে। কিন্তু মানুষ ইবাদাতের উদ্দেশ্য না বুঝে যখন শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করে তখন সে ইবাদাতের উদ্দেশ্য বুঝতে পারে না এবং ¯্রষ্টার বানীর মর্মার্থও তার কাছে স্পষ্ট হয় না। এ কারণেই নামাজী এবং রোজাদার বাড়লেও ভালো মানুষের সংখ্যা বাড়ছে না।
তিনি তার নিবন্ধে লিখেছেন
‘‘যেহেতু ইংরেজি একটি আন্তর্জাতিক ভাষা এবং অনেক গবেষণামূলক বই ইংরেজিতে প্রকাশিত, সেহেতু দুনিয়াবি একটি সফল জীবন যাপনের জন্য ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী হওয়া আবশ্যক। এখানে একটি বিষয় অনুধাবনযোগ্য যে, আরবি মুসলমানদের ধর্মীয় ভাষা। প্রতিটি মানুষেরই তার ধর্মীয় ভাষাজ্ঞান থাকা অপরিহার্য্য। নতুবা ধর্মের যে গুরুত্ব তা সে উপলব্ধি করতে পারবে না। ফলে মুসলমানরা শতভাগ ধর্ম পালন করলেও বাস্তবে ধর্মীয় অনুশাসন থেকে অনেক দূরে। মাদরাসাপড়–য়া ছাত্ররা মুখস্ত করে কুরআনে হাফেজ হয় বটে, আরবি ভাষায় পারদর্শী বলে মনে হয় না। আমাদের সমাজে নিজ সন্তানদের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারলে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করে।-’’
এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা। আমার বাংলা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছি কিন্তু সঠিক বাংলা উচ্চারণ এবং লেখার চেষ্টা আমাদের অনেকেরই নেই। আর মুসলমান হিসেবে আরবী ভাষা শেখার চিন্তা করার লোক খুবই কম। একজন মুসলমান হিসেবে তাকে যে বিষয়টি অনুধাবন করতে হবে তা হচ্ছে, আল্লাহ মানব জাতির পথ নির্দেশনার জন্য যে বিধান নাযিল করেছেন, সেই মহাগ্রন্থ আল কুরআন আরবী ভাষায় নাযিল হয়েছে। কুরআনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি মুহাম্মদ সা. এর মূখ নিসৃত বাণী, তার গোটা জীবনাচার তথা হাদীসগ্রন্থগুলো আরবীতে লিপিবদ্ধ হয়েছে। মুহাম্মদ সা. এবং তার সঙ্গী সাথীদের জীবনী আরবী ভাষায় রচিত হয়েছে। ইসলামী জ্ঞান গবেষণার স্বর্ণযুগে যত বই কিতাব রচিত হয়েছে তাও আরবী ভাষায় রচিত হয়েছে। অতএব একজন মুসলমান হিসেবে আরবী ভাষা বোঝার মতো করে শেখা আমাদের জন্য অপরিহার্য। আমরা অবশ্যই আমাদের মাতৃভাষায় কথা বলবো, মাতৃভাষায় লিখবো, মাতৃভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করবো কিন্তু মুসলমান হিসেবে কুরআনের ভাষা শিক্ষা করা অপরিহার্য। জনাব তৈমুর আলম খন্দকার যে আক্ষেপটি করেছেন, তা হচ্ছে, যারা মাদরাসায় পড়াশোনা করেছেন, কুরআনে হাফেজ হচ্ছেন এতো বড়ো কিতাব মূখস্ত করে বক্ষে ধারণ করছেন, তাদের আরবী ভাষায় যে পরিমাণ দক্ষ হওয়ার কথা ছিলো, তা তারা হচ্ছেন না। মাদরাসায় পড়–য়া আলেম শ্রেনির মধ্যে আরবী ভাষায় দক্ষ লোক অবশ্যই আছেন, কিন্তু তুলনামূলকাবে তারা সংখ্যায় অতি নগন্য। আর ইংরেজি শিক্ষিত লোকদের অবস্থা তো এমন যে, তারা আদৌ আরবী ভাষা শিক্ষা করার কোনো প্রয়োজনীয়তাই অনুভব করেন না।
এ অবস্থার অবসানের জন্য তিনি ইসলামী দল, সংস্থা এবং সংঘ সমিতিগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। মূলত আমাদের দেশে বিদেশী ভাষা শিক্ষার জন্য হাজার হাজার প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। আরবী ভাষা শিক্ষার জন্য সে ধরনের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কম। এ প্রচেষ্টাকে জোরালো করার জন্য তিনি তাগিদ দিয়েছেন। তিনি তার নিবন্ধের শেষ অংশে লিখেছেন ‘‘প্রতিটি স্কুল-কলেজে প্রতিটি মুসলিম শিক্ষার্থীকে আরবি ভাষায় পারদর্শী করার দাবি ইসলামী দলগুলো থেকেই করা উচিত ছিল, যা তারা করছে না। তাদের মধ্যে অনেকেই নিজস্ব মসজিদ-মাদরাসার জন্য সরকার থেকে সুবিধা নিচ্ছে, ফলে সরকারের মুখোমুখি হতে পারে না, অন্যদিকে অনেক ইসলামী চিন্তাবিদ রয়েছেন যারা সরকারের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়ে যাচ্ছেন কিন্তু ইসলাম ধর্মকে পাবলিকলি হৃদয়াঙ্গম করার প্রতিবন্ধকতা কোথায়, তা কি খুঁজে দেখছেন? মাতৃভাষা, আন্তর্জাতিক ভাষা ও ধর্মীয় ভাষাজ্ঞান একজন পরিপূর্ণ মানুষের জন্য সমহারে গুরুত্বপূর্ণ।’’
পুনশ্চ : জনাব তৈমুর আলম খন্দকারের আক্ষেপ এবং আবগের যায়গায় তার বক্তব্য ঠিক আছে, তবে এ প্রচেষ্টা যে একেবারে হচ্ছে না, বিষয়টি এমন নয়। মাদরাসাগুলোতে আরবী ভাষা শেখার ওপর জোর দেয়া হচ্ছে, অনেক নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে যারা আরবী ভাষার কোর্স করাচ্ছে। ব্যক্তি উদ্যোগে আগে শুধু সহীহ কুরআন শেখার ব্যবস্থা করা হতো এখন অনেক বিজ্ঞ আলেম এমন কিছু কারিকুলাম তৈরী করেছেন যে, সহীহ কুরআন শেখার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা আরবী ভাষাও শিখতে পারবে। সবগুলো ইসলামী দলের পক্ষ থেকে এমন ব্যবস্থা না থাকলেও দেশের সর্ববৃহত একটি ইসলামী দলের জনশক্তি এবং দায়িত্বশীলেদের আরবী ভাষা শেখার তাগিদ দেয়া হয় এবং এ ধরনের কর্মসূচীও গ্রহণ করা হয়। তবে এ প্রচেষ্টা আরো বহুগুণ বৃদ্ধি করা দরকার।

পঠিত : ২৪৮ বার

মন্তব্য: ০