Alapon

মাওলানা আবুল আ’লা মওদুদির তিনটা গুরুতর অপরাধ...



একজন জিজ্ঞেস করেছেন, মওদুদির ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী? কওমী আলেমরা তাঁর সমালোচনা করেন কেন? আমি বললাম, আবুল আলা মওদুদির হয়ত অনেক ভুল আছে। সেগুলো গবেষকদের গবেষণার বিষয়। তবে আমার দৃষ্টিতে মওদুদির এরকম তিনটি ভুল আছে, যা খুবই অমার্জনীয়। এই ভুলগুলো না করলে তিনি কওমী আলেমদের কাছে গ্রহণযোগ্য হলে হতেও পারতেন। গ্রহণযোগ্য না হলেও বর্তমানে যেভাবে মওদুদিকে প্রত্যাখাত মনে করা হয়, এতটা মনে করা হতো না।

১. মওদুদির অন্যতম গুরুতর ভুল হলো, তিনি দেওবন্দি নন। তিনি দেওবন্দে পড়াশোনা করলে তাঁকে নিয়ে এত সমালোচনা হতো না, এ ব্যাপারে আমি মোটামুটি নিশ্চিত। দেওবন্দি ঘরানার অনেকেই ভিন্ন চিন্তা লালন করতেন এবং এখনো করেন। তাঁদেরকে কওমী অঙ্গন সম্মিলিতভাবে প্রত্যাখান করে না। যেমন: উবায়দুল্লাহ সিন্ধি অনেক ক্ষেত্রেই প্রচলিত ধ্যান-ধারণার চেয়ে ভিন্ন চিন্তা লালন করতেন, তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের সাফাই গেয়েছেন বলে অনেক ঐতিহাসিকের দাবি। এই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বামপন্থী লেখক যতীন সরকার তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তবু কওমী অঙ্গনের কেউ তাঁর ব্যাপারে সমালোচনা করেছেন বলে শুনি নি। অনেক ক্ষেত্রে আকাবিরের নামের তালিকায় তাঁকেও দেখেছি।

মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) বর্তমান প্রচলিত তাবলীগের প্রতিষ্ঠা করেছেন। আমরা ধারণা, দেওবন্দ ঘরানার বাইরের কেউ এই সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা করলে কওমী মহলে এতটা বরিত হতো না। একইভাবে হলের চরমোনাই সম্পর্কেও একই কথা। চরমোনাইয়ের মরহুম পীর কওমী ঘরানার না হলে ব্যাপক বিরোধিতার সম্মুখীন হতেন। কারণ তাঁদের অনেক তৎপরতা সাধারণ কওমীদের চেয়ে ভিন্নতর। মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ অনেক বিষয়েই ভিন্নমত জানান, মাওলানা ওবায়দুল্লাহ ফারুক খিলাফাহ সম্পর্কে ভিন্নমত স্পষ্ট করেছেন। তবু তাঁদের নিয়ে খুব জোরালো সমালোচনা হয় না। এঁদের সম্পর্কে যে সমালোচনা হয় না, তা নয়। কেউ কেউ সমালোচনা করলেও তাঁদেরকে সম্মিলিতভাবে প্রত্যাখান করা হয় না। তবু আমাদের লোক— তাঁদের ক্ষেত্রে এরকম একটা মনোভাব কাজ করে।

২. মওদুদির আরেকটা গুরুতর ভুল হলো, তিনি ভুল সময়ে জন্মগ্রহণ করেছেন। তিনি এমন এক সময় লেখালেখির ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছেন, যখন ধর্মীয় ক্ষেত্রে আলেমরা কট্টর অবস্থানে ছিলেন। সেই সময় হয়ত সেটাই স্বাভাবিক ছিল। তাঁরা পরম্পরা ভিত্তিক প্রতিষ্ঠিত মতের বাইরের কিছু বরদাশত করতেন না। তাঁরা চিন্তার ক্ষেত্রে সৎ ছিলেন।

যা ধারণ করতেন, তা বলতে পিছপা হতেন না। কিন্তু ক্রমে আলেমরা এ থেকে অনেকটাই সরে এসেছেন। এখন তো আলেমরা বাইরের অঙ্গনের মানুষের বই-পুস্তক পড়েন, মন্তব্য করেন, ভালোলাগা-খারাপলাগা জানান। সমালোচনাও করেন। কিন্তু বিরোধিতায় উঠে-পড়ে লাগেন না। আমার ধারণা— মওদুদি বর্তমান সময়ে লেখালেখি করলে এতটা সমালোচনার শিকার হতেন না। তাঁর বই-পুস্তক পঠিত হতো। সমালোচনা যেমন থাকত, অনেকে তাঁকে ধারণও করতেন। বিষয়টা এত গুরুতর মনে করা হতো না। যাঁরা মওদুদির সমালোচনা করেন, এর নব্বই শতাংশ সমালোচনা উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হয়েছেন। তিনি সে সময় লেখালেখি না করলে আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে তাঁর সমালোচনা পেতাম না। কাজেই তিনি ভুল সময়ে জন্মগ্রহণ করেছেন। তাঁর উচিত ছিল আজ থেকে বিশ-ত্রিশ বছর আগে জন্ম নেওয়া। তিনি একটু আগে জন্ম নিয়ে ফেলেছেন।

৩. মওদুদি ভুল জায়গায় জন্মগ্রহণ করেছেন— এটা তাঁর আরেকটা গুরুতর অপরাধ। কওমী অঙ্গনের বাইরের সেই লেখকদেরই সম্মিলিত বয়কটের মুখে পড়তে হয়, যাঁরা এই উপমহাদেশের লোক। কিছুটা ভিন্নমত লালন করেন কিন্তু এই উপমহাদেশের নন, তাঁদের ব্যাপারে সমালোচনা থাকলেও সম্মিলিতভাবে প্রত্যাখান করা হয় না। যেমন: সাইয়িদ কুতুব, ইউসুফ কারযাবী প্রমুখ। তাঁদের চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে মওদুদির সাযুজ্য আছে। তবু তাঁরা কওমী অঙ্গনে এতটা প্রত্যাখাত নন। কেউ কেউ তাঁদের সমালোচনা করেন বটে, তবে তাঁদের প্রতি মুগ্ধতা প্রকাশ মওদুদির প্রতি মুগ্ধতা প্রকাশের মতো গুরুতর মনে করা হয় না।

এই তিনটি অপরাধ না করলে মওদুদি মোটামুটি পঠিত ও বরিত হতেন বলে আমার ধারণা। চিন্তার ভুলের কারণেই্ তিনি বর্তমান সময়ে প্রত্যাখাত, এমনটা নয়। আমার ধারণা— মওদুদির ভুল বলে বিবেচিত কিন্তু প্রসিদ্ধ নয় এরকম কিছু কিছু লেখা আকাবির হিসেবে বিবেচিত কারো নামে ফেইসবুকে প্রকাশ করলে অনেকেই ধন্য ধন্য করবে।

মওদুদি বিস্তর লেখালেখি করেছেন। তার সামান্য অংশ বিতর্কিত। যেকোনো লেখকের ক্ষেত্রে এটাই নিয়ম যে, বিতর্কিত বিষয়গুলো বর্জন করা হয়, প্রত্যাখান করা হয় এবং সেগুলোর সমালোচনা করা হয়। কিন্তু লেখকের অন্য রচনাগুলো থেকে উপকৃত হওয়া দোষের মনে করা হয় না। মুফাসসির মাহমূদ ইবন উমর আয-যামাখশারী মুতাযিলা হওয়া সত্ত্বেও তাঁর লিখিত তাফসীর কওমী মাদরাসায় পাঠ্যতালিকাভুক্ত। মওদুদির ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। কারণ তিনি উপরের তিনটা অপরাধ করেছেন। যামাখশারী এই তিনটা অপরাধ করলে তিনিও মওদুদির ভাগ্য বরণ করতেন।

- আবুল কাসেম আদিল

পঠিত : ৩১৯ বার

মন্তব্য: ০