Alapon

মকবুল আহমাদ রাহিমাহুল্লাহ আমাদের রাহবার




কিছু মানুষের চির বিদায় অনেক কষ্টের, বেদনার। কিন্তু এটিই নির্মম বাস্তবতা। ঠিক তেমনি আমাদের ছেড়ে পরওয়ার দিগারের ডাকে সাড়া দিয়ে গত ১৩ এপ্রিল ২০২১ ইং একজন প্রিয় মানুষ চলে গেলেন। তিনি জনাব মকবুল আহমাদ। তিনি আমাদের রাহবার,অগ্রজ ও অবিভাবক। সংগঠনের জনশক্তির প্রতি তাঁর দরদ, আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল, সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্থ ও ফরহেজগারী যা কখোনো ভোলার নয়। তিনি আমাদের হৃদয়ের গহীনে বেঁচে থাকবেন কাল থেকে কালান্তর। আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর সকল নেক আমল সমুহ কবুল করুন। আমীন।

২০১২ /১৩/১৪/১৫ সালে ছাত্র সংগঠনের একজন নগন্য কর্মী হিসাবে ওনার সাথে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। তিনি সেই কঠিন সময়ে সংগঠনের জিম্মাদারীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কতিথ যুদ্ধপরাধ ইস্যু নিয়ে সারাদেশে সংগঠনের জনশক্তিদের রাতের আঁধারে ধরে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা, অমানুষিক নির্যাতন, গ্রেপ্তার, ঘর বাড়ীতে হামলা, ডজন ডজন মিথ্যা মামলা ছিল প্রতি ঘন্টার খবর। এহেন কঠিন পরিস্থিতিতে একজন নেতার পক্ষে স্থির থাকা মামুলি ব্যাপার নয়। ওনার সাথে যখনই ছাত্রদের উপর যুলুম নির্যাতনের বিষয় গুলো নিয়ে বলতাম তিনি আমাদের সাহস দিতেন। তিনি বলতেন-" ধৈর্য ধারণ কর। আল্লাহর চাইতে ওরা শক্তিশালী নয়। আল্লাহর পাকড়াও থেকে জালিমরা বাঁচতে পারবেনা।আল্লাহ একটা বিহিত করবেন, ইনশাআল্লাহ। "

জনাব মরহুম মকবুল আহমাদ আমীরে জামায়াত হিসাবে ওনার সাথে যখনই দেখা করতে যেতাম অথবা উনি আমাদেরকে তাঁর সাক্ষাতের জন্য ডাকতেন তিনি কিছু ফটোকপি পেপারস বা কিছু পেপার কাটিং দিতেন। তিনি বলতেন, এগুলো তোমরা পড়বা, আর ফটোকপি করে তোমাদের বন্ধুদেরকে দিবা এবং পরবর্তী সাক্ষাতে তিনি জিজ্ঞেস করতেন পূর্বের সাক্ষাতে দেয়া সেই পেপারস গুলো নিজেরা পড়েছি কিনা, বা বন্ধুদের মাঝে বিতরণ করেছি কীনা। তিনি বলতেন -"অপপ্রচারের মোকাবেলায় আমাদের টেলিভিশন নাই কিন্তু প্রচারের ক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যেক জনশক্তি এক একটি টেলিভিশন বা মিডিয়া হিসাবে কাজ করতে হবে । তিনি আমাদেরকে সমাজের বিত্তবান ব্যক্তিদের দাওয়াত দেয়ার ব্যাপারে তাগাদা দিতেন। তিনি বলতেন, সমাজের এসব লোকদের পরিবর্তন করতে পারলে সমাজের অনেক পরিবর্তন হবে।
২০১৫ সালের দিকে তিনি আমাকে একটি বইয়ের পান্ডুলিপি দিয়েছিলেন। বইয়ের শিরোনাম ছিল- “স্বৈরীশাসকদের পরিণিতি“। তিনি বইটি দিয়ে বলেছিলেন বইটি পড়ে কোন তথ্যগত ভুল থাকলে আমাকে জানাবে। পান্ডুলিপিতে দুনিয়ার ৫০ জন স্বৈরশাসকের জীবন, কর্ম ও শেষ পরিণিতি নিয়ে লিখেছিলেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন- এই বই লেখার উদ্দেশ্য হলো- মানুষের মধ্যে এই অনুভূতি জাগ্রত করার চেষ্টা করা যে-কারো ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয় এবং যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি যত অমানবিক হবেন দুনিয়াতেও আল্লাহ তা'য়ালা তাকে তেমনিভাবে লাঞ্চিত করবেন। পরে আমি ২০১৭ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার পর তিনি বইয়ের পান্ডুলিপিটি ড. রেজাউল করিম ভাইকে দিয়েছিলেন। হয়ত কখনো বইটি প্রকাশিত হবে। এই বইটি পড়ে মনে হয়েছিল যে, এই বইটি পড়ে যে কোন অবিবেচকের বিবেকের দুয়ার খুলতে পারে।

মকবুল আহমাদ সাহেব এক অনন্য চরিত্রের অধিকারী নেতা ছিলেন। আমি ছাত্রজীবন থেকে একটু-আধটু লেখা-লেখি করতাম। তিনি কোন ভাবে তা জানতেন। দৈনিক সংগ্রামে আমার একাধারে ১২ পর্বে ১টি বড় লেখা "তথ্য সন্ত্রাসের শিকার ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলন" শিরোনামে ধারাবাহিক ভাবে ছাপিয়েছিলো। একদিন তিনি আমাকে ফোন করে আমার কাঁচা লেখার প্রশংসা করেছিলেন এবং লেখার ব্যাপারে উৎসাহিত করে বলেছিলেন তোমার লেখাগুলো পাঠাও একটি চটি বই বের করে ফেলো! আমি আরো অবাক হলাম, এবং ওনাকে বিনয়ের সাথে বলেছিলাম আরো তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে পরে ছাপবো,ইনশাআল্লাহ। এভাবে ছোট কোন কাজকেও উৎসাহিত করার বিষয়টি মরহুম মাওলানা একেএম ইউসুফের কাছেও দেখেছি, তিনি জেলে যাওয়ার পূর্বে বেশ ক'য়েকবার আমার লেখা কলাম পেয়ে তিনি আমাকে ফোন দিয়ে আরো লেখার ব্যাপারে উৎসাহিত করেছিলেন,যা আজো প্রেরণার।

জনাব মরহুম মকবুল আহমাদ আমাদের প্রায়শই সব প্রোগ্রামে বলতেন- মানুষ লোকভয়, রাজভয় ও মৃত্যু ভয়ের কারণে হকের পথে চলতে পারেনা। এই তিনটি ভয় মানুষ জয় করতে পারলে মানুষ আল্লাহর পথে চলতে সহজ হয়। কিন্তু এই ভয় থেকে বেরিয়ে আসা সহজ ব্যাপার নয়।

আমাদের রাহবার মরহুম মকবুল আহমদ সাহেবের ব্যাপারে যুদ্ধপরাধ ট্রাইবুনাল যখন তদন্ত করেছিল তখন কেন্দ্রীয় জামায়াতের পক্ষের আইনজীবীদের সাথে ওনার এলাকায় গিয়েছিলাম। ওনার বাড়ীর পাশে বেশ কিছু হিন্দুবাড়ী ছিল। আমরা তাদের কাছে আমরা যাই, তারা ওনার প্রসংসা করেন এবং তিনি ফেনীতে সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক হিসাবে তারা মতপ্রকাশ করেন। সরকারী ট্রাইবুলানের অভিযোগকে তারা বানোয়াট ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে মত দিয়েছিলেন। ট্রাইবুনালের পক্ষ থেকে মিথ্যা স্বাক্ষী-সাবুদ নেয়ার চেষ্টা হচ্ছে বলে তারা জানিয়েছিল,তাই তারা প্রকাশ্যে সবার সমনে মত প্রকাশ করতে চাইছিলোনা। ওনার বাড়ীতে গিয়ে দেখেছি,ওনার বাড়ী জীর্ণশীর্ণ! নেই কোন দালান কোঠা। অথচ দুনিয়ার অন্য কোন জাগতিক দলের নেতা হলে তাদের কী এমন জৌলুসহীন অবস্থা হতো?

তাঁর ইন্তেকালের দিন রাতে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ঐদিন লক ডাউন ঘোষনা করা হয়েছিল। তাঁর গ্রামের বাড়ীর মসজিদের পাশে খোলা প্রসস্থ মাঠে গভীর রাতে দলমত নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত হয়েছিলেন। আগত মুসল্লিরা তাঁর কথা শ্রদ্ধার সাথে স্বরণ করেছিলেন। কেউ কেউ কান্না জড়িত কন্ঠে বলছিলেন "ওনার মত মানুষ হয়না"।

তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই, তিনি রেখে গেছেন লাখো মুজাহিদের দীপ্ত কাফেলা। তিনি সফল, কারণ তিনি ছিলেন আমাদের প্রেরণার বাতিঘর। তিনি রাজনৈতিক কারণে বাসা থেকে বের হতে না পারলেও রাসুলের সুন্নাহ মোতাবেক জীবন-যাপনে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি অল্পে তুষ্ট ছিলেন,ছাত্র হিসাবে আমাদেরকেও অল্পে তুষ্ট থাকতে নসিহত করতেন। তিনি গভীর রাতে তাহাজ্জুদ গুজারে অভ্যস্থ ছিলেন। বৃদ্ধ বয়সেও নিয়মিত কমপক্ষে ৪০ মিনিট ব্যায়ম করতেন, খুব কম আহার করতেন,কম কথা বলতেন। ওনার জ্ঞান পিঁপাসা আমাকে ভাবাত। এই বয়সেও প্রচুর পড়তেন । তিনি প্রতিসাক্ষাতেই পড়ার কথা বলতেন। তিনি যখন সর্বশেষ ঢাকার উত্তরায় একটি বৈঠক থেকে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তখন তিনি ছিলেন,একেবারে স্বাভাবিক। ওনাকে হাত কড়া পড়িয়ে কোর্টে হাজির করা হয়েছিল, কি অপূর্ব জান্নাতি হাসি! লেসমাত্র ভাবনা নেই!

তিনি ডিবির হাজতে ছিলেন,সেখানেও দাওয়াতি কাজ করেছেন নির্ভিগ্নে। যে কোন অবস্থায় তাঁর দাওয়াতি কাজের চরিত্র ছিল অনন্য। তিনি দীর্ঘ দিন অসুস্থ ছিলেন, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন। আল্লাহ তা‘য়ালা মরহুম জনাব মকবুল আহমদের সকল নেক আমল সমূহ কবুল করুন। আল্লাহ তা‘য়ালা তাকে শহীদ হিসাবে কবুল করুণ। আমীন।


~মুহাম্মদ আবদুল জব্বার
[email protected]
ঢাকা,৬/২২/২১

পঠিত : ১৮৯ বার

মন্তব্য: ০