Alapon

ইসলামী সমাজ বিনির্মাণে ইমাম ও খতিবদের ভূমিকা


প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমাজের সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি হচ্ছেন মসজিদের ইমাম ও খতিব। সুন্দর একটি সমাজ বিনির্মাণে তাঁদের ভূমিকা অগ্রগণ্য। বরং আমি মনে করি সমাজ পরিবর্তনে তাঁদের ভূমিকাই প্রধান ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

'ইমাম' শব্দটি আমাদের সমাজে বেশ অবহেলিত একটি শব্দ। আমরা যেমন এর সঠিক মর্যাদা দিতে পারিনি তেমন‌ই এই অবস্থানটির গুরুত্ব‌ও উপলব্ধি করতে পারিনি‌। ফলশ্রুতিতে ইমাম সাহেবগণ‌ও নিজেদেরকে সেভাবে উপস্থাপন করতে পারেননি বা অনেকাংশেই পারেন না।

'ইমাম' মানে 'নেতা' এই বুঝটাই অধিকাংশ মানুষের মধ্যে নেই। আবার অধিকাংশ ইমাম নিজেও এটা অনুভব করেন না। তাঁরা মনে করেন যে তাঁরা 'চাকরি' করেন। নিছক নামাজ পড়ানো ছাড়া তাঁর আর কোনো কাজ নেই। কোনো দায়িত্ব নেই।‌ নেই নূন্যতম কোনো দায়বদ্ধতাও।

সমাজের অগণিত অন্যায়-অপরাধ, জাহেলী চিন্তা ও কর্মকাণ্ড দেখেও নিজেকে বহিরাগত ভেবেই চেপে যান বেশিরভাগ অংশটা। অথচ সমাজকে জাহেলিয়াতের কলূষমুক্ত করে একটি সুন্দর আলোকিত সমাজ গড়ার জন্য তাঁরা সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারেন এবং এটা তাঁদের দায়িত্ব‌ও বটে।

আর যাই হোক, মানুষ অন্তত জুমুয়ার দিনে মনোযোগ সহকারে খুৎবা (প্রচলিত সমাজে খুৎবাপূর্ব আলোচনা) শুনে থাকে। অধিকাংশ মানুষ বেশ আগে আগেই মসজিদে চলে যায়। বেশ আগ্রহ সহকারে আলোচনা শুনে থাকে। কিন্তু আফসোসের বিষয় হচ্ছে এই খুৎবাগুলো সমাজ পরিবর্তনে খুব বেশি ভূমিকা রাখতে পারছে না। কারণ অধিকাংশ মসজিদের জুমুয়ার খুৎবাগুলো অনেকটা দায়সারা। সমাজের প্রকৃত চিত্রটা খুৎবায় উঠে আসে না। জহেলী কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে মানুষকে যথাযথভাবে সতর্ক করা হয় না। বেশিরভাগ মুসলমান তো ইসলাম ও জাহেলিয়াতের পার্থক্য‌ই বুঝে না‌। ইসলামের অনেক মৌলিক বিধান সম্পর্কে কোনো ধারণাই রাখে না। দ্বীনের সঠিক মেজাজ সম্পর্কে তারা নিতান্তই গাফিল। খুৎবায় এই বিষয়গুলো ভালোভাবে স্পষ্ট করা হয় না। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মানুষদের মাঝে দ্বীনের বুঝ খুব‌ই নড়বড়ে।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মফস্বলের অধিকাংশ ইমাম‌ই অল্পশিক্ষিত। আর তারা নিয়মিত জ্ঞানচর্চাও করেন না। যার ফলে ইসলামের বুনিয়াদি শিক্ষা ও সমাজের প্রকৃত সমস্যা সমাধানের ফর্মুলা তারা স্বাভাবিকভাবেই উপস্থাপন করতে অপারগ। ইমামদের নিয়ে তেমন কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও নেই‌। এজন্য আদর্শ সমাজ‌ বিনির্মাণে তাঁরা বিশেষ কোনো ভূমিকা পালন করতে পরাছেন না।

সমাজের অধিকাংশ মুসলিম যে বিষয়ে অজ্ঞ বা জ্ঞানের অপ্রতুলতা রয়েছে এবং যেসব বিষয়ে আলোচনাও কম হয়, এমন কিছু বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করবো। একটি আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে এই বিষয়গুলোর উপর ইমাম-খতিবসহ আলেমশ্রেণির সুক্ষ্ম দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।

✓দ্বীনি জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব
✓কুর‌আন শিক্ষা, কুরআন বুঝা ও কুরআনের বিধান অনুযায়ী গোটা জীবন ও সমাজব্যবস্থা পরিচালনার গুরুত্ব
✓ইসলামের দৃষ্টিতে দুনিয়া ও আখিরাতের মাঝে সম্পর্ক (কোনোভাবেই এই দুটো একে-অপরের প্রতিদ্বন্দী নয়, বরং পরিপূরক)
✓তাওহিদ, রিসালাত, আখিরাত ও শিরক-বিদ‌আতের ব্যাপারে সু্স্পষ্ট ধারণা
✓ইসলাম ও জাহেলিয়াতের পার্থক্য স্পষ্ট করা, ধরে ধরে একটা একটা জাহেলী কর্মকাণ্ড সমাজ থেকে দূরীভূত করার চেষ্টা করা
✓পর্দার বিস্তারিত বিধান বিশেষ করে দৃষ্টির হেফাজত, ঘরে প্রবেশের বিধান, মাহরাম-গায়রে মাহরাম, পোষাক ইত্যাদি (এই বিষয়ে আলোচনা হয় না বললেই চলে)
✓যাকাতের সু্স্পষ্ট বিধান, যাকাতের খাত ও প্রকৃত উদ্দেশ্য এবং আদায়ের নিয়ম
✓ওশর বা ফসলের যাকাত (এই ব্যাপারে অধিকাংশ মুসলিম অজ্ঞ এবং গাফেল)
✓সিরাতে রাসূল (স.)
✓সিরাতে সাহাবা (রা.) (সিরাতে রাসূল ও সিরাতে সাহাবার পরিবর্তে বিভিন্ন ওলীদের নামে চটকদার সব ঘটনা/গল্প বলা হয়ে থাকে, যা একেবারেই নিষ্প্রয়োজন)
✓দ্বীন প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব ও এর জন্য সংঘবদ্ধতার প্রয়োজনীয়তা
✓সমাজের প্রকৃত সমস্যা সমাধানে ইসলামের বিধান স্পষ্ট করা ও নেতৃত্বের ভূমিকায় থেকে তা সমাধানের চেষ্টা করা

উপরোক্ত বিষয়গুলোতে সম্মানিত ইমাম ও খতিব সাহেবদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। বিশেষ করে পর্দার প্রকৃত রূপ, ওশর ও যাকাতের বিষয়ে আলোচনা খুব‌ই কম হয় এবং যা-ও বা হয় তা দায়সারা ও অন্তঃসারশূন্য। এই বিষয়গুলোতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কুরআন-সুন্নাহ ও ইসলামের সোনালী ইতিহাসে এর প্রয়োগের ব্যাপারে জনসাধারণকে সচেতন করা ও এর আলোকে সমাজ বিনির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করাই ইমাম-খতিবদের প্রধান কর্তব্য বলে মনে করি।

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন। আমাদের সমাজকে রাশেদার সোনালী সমাজে পরিণত করে দিন।

✍️মাসুম বিল্লাহ বিন নূর
২০-০৪-২০২৩ খ্রি.

পঠিত : ৩৪৩ বার

মন্তব্য: ০