Alapon

শাকসবজির পুষ্টি ও ভেষজগুণ

অনেকেই খাদ্য এবং পুষ্টিকে একই মনে করেন। আসলে এটি ভুল ধারণা। কারণ খাদ্য পুষ্টিকর নাও হতে পারে, তবে পুষ্টি অবশ্যই খাদ্য। সুস্থ-সবলভাবে বেঁচে থাকতে পুষ্টিকর খাবার খেতেই হবে। এর চাহিদা পূরণে শাকসবজির অবদান অনন্য। শাকসবজিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও খনিজ পদার্থসহ অন্যান্য অনেক পুষ্টি উপাদান। সে সাথে আঁশে ভরপুর। এসব পুষ্টি উপাদান শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, খাবারে রুচি আনে। এ ছাড়া হজমশক্তি বৃদ্ধিতে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূরীকরণে যথেষ্ট সহায়তা করে। পুষ্টিবিদদের মতে, একজন পূর্ণবয়স্ক লোকের দৈনিক ২ শত গ্রাম শাকসবজি খাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু আমরা খাই মাত্র ৬০-৭০ গ্রাম। তাও আলুসহ। তাই চাওয়া-পাওয়ার এ গড়মিলে আমাদের দেশের অধিকাংশ লোক দৈহিক এবং মানসিক অসুখে ভুগছেন। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই হচ্ছেন শিশু ও নারী। মোট জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ লোক, বিশেষ করে মেয়েরা লৌহের অভাবে রক্তস্বল্পতার শিকার। একমাত্র ভিটামিন-এ’র অভাবে বছরে ৩০ হাজারেরও অধিক শিশু অন্ধ হয়ে যায়। চোখে কম দেখার সংখ্যা আরও বেশি। তবে সুস্বাস্থ্যের জন্য পুষ্টির ঘাটতি যতটুকু তার চেয়ে বড় বাধা পুষ্টির উৎস সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা এবং অসচেতনতা। যারা দিন আনে দিন খায় তারাই কেবল পুষ্টিতে ভোগে তা কিন্তু নয়। বিত্তশালী শিশুরাও আজকাল শাকসবজি না খেয়ে রাতকানায় ভুগছে; যে কারণে ওরা চোখে চশমা পরতে বাধ্য হচ্ছে। অথচ হাতের কাছে পাওয়া কচুশাক, কলমিশাক, হেলেঞ্চা, সজিনাসহ নানারকম শাকসবজি অভাবী মানুষের পুষ্টি সরবরাহ করে। সেজন্য বিভিন্ন শাকসবজির পুষ্টি ও ভেষজগুণ সম্পর্কে জেনে নেয়া দরকার।


টমেটো
শীতকালীন সবজির মধ্যে টমেটো অন্যতম। পুষ্টিসমৃদ্ধ এ সবজিকে গ্রামাঞ্চলে অনেকেই বিলাতি বেগুন নামে চেনে। টমেটো (পাকা) দেখতে খুবই আকর্ষণীয় এবং খেতেও সুস্বাদু। কাঁচা ও রান্না উভয় অবস্থায় খাওয়া যায়। টমেটো দিয়ে টক তরকারি, সালাদ এবং প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি করা যায় সস, স্যুপ, জ্যাম, জেলি, কেচাপ, মোরব্বা এসব লোভনীয় খাবার। এর রয়েছে বহু গুণ। প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা টমেটোতে ভিটামিন-এ ও ভিটামিন-সি আছে ৩৫১ মাইক্রোগ্রাম এবং ২৭ মিলিগ্রাম আর ভিটামিন-বি, শর্করা, আমিষ, ক্যালসিয়াম ও লৌহের পরিমাণ যথাক্রমে ০.৩৩ মিলিগ্রাম, ৩.৬ গ্রাম, ১.১ গ্রাম, ৪৮ মিলিগ্রাম এবং ০.৪ মিলিগ্রাম। প্রোস্টেট ক্যান্সার প্রতিরোধে টমেটো ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান- লাইকোপেন, যা দেহকোষ থেকে বিষাক্ত ফ্রিরেডিক্যালকে সরিয়ে প্রোস্টেট ক্যান্সারসহ মূত্রথলি, অন্ননালি এবং অগ্নাশয়ের ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে। পাশাপাশি হৃদরোগকে করে প্রতিহত। টমেটো হজমের জন্য বেশ উপকারী। এর রস স্কার্ভি রোগ প্রতিরোধ করে দেহ ও দাঁতকে নিরোগ রাখে। টমেটোর রস কেবল স্কার্ভিই নয়, রিকেটস এবং বেরিবেরির মতো কঠিন রোগেরও নিরাময় ঘটায়। টমেটো বার্ধক্য রোধে সহায়তা করে দেহকে সজীব রাখে। এ ছাড়া শরীরের মেদ নিয়ন্ত্রণ করে এবং দেহের শক্তিকে রাখে অটুট।


লাউ
লাউ অতি জনপ্রিয় সবজি। অত্যন্ত সুস্বাদু এ সবজিটি গ্রামাঞ্চলে কদু নামে পরিচিত। এর আকার-আকৃতি হয় নানা রকম। ছোট-বড় বিভিন্ন সাইজের লাউ কোনটি দেখতে গোল, কোনোটি আবার লম্বাটে। কচি লাউয়ের তরকারি খেতে বেশ। ডালের সাথেও এটি রান্না করা যায়। এছাড়া লাউ দিয়ে তৈরি হয় পায়েশ, হালুয়া, মোরব্বা এসব লোভনীয় খাবার। লাউ এ রয়েছে অনেক পুষ্টি। এর প্রতি ১০০ গ্রামে শর্করা, আমিষ, চর্বি, ক্যালসিয়াম, লৌহ, ভিটামিন-সি, ভিটামিন-বি এবং খাদ্যশক্তি আছে যথাক্রমে ১৫.১ গ্রাম, ১.১ গ্রাম, ০.০১ গ্রাম, ২৬ মিলিগ্রাম, ০.৭ মিলিগ্রাম, ০.০৩ মিলিগ্রাম, ৪ মিলিগ্রাম এবং ৬৬ কিলোক্যালরি। লাউশাকে রয়েছে আরো বেশি পুষ্টি। এর প্রতি ১০০ গ্রামে ক্যারোটিন ৭১৯৬ মাইক্রোগ্রাম এবং ভিটামিন-সি আছে ৯০ মিলিগ্রাম করে। অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের মধ্যে শর্করা ৬.১ গ্রাম, আমিষ ২.৩ গ্রাম, চর্বি ০.৭ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ৮০ মিলিগ্রাম এবং খাদ্যশক্তি রয়েছে ৩৯ কিলোক্যালরি। আয়ুর্বেদ মতে, লাউ হচ্ছে মধুরস। লাউ খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়। এ ছাড়া শরীর ও মস্তিষ্ককে ঠা-া রাখে। তাই আমাদের বেশি করে লাউ খাওয়া প্রয়োজন।


ফুলকপি
ফুলকপি শীতের সবজি। পুষ্টিসমৃদ্ধ এ সবজি দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি খেতেও সুস্বাদু। এর ভাজি আর তরকারি খেতে দারুণ। ফুলকপির তৈরি সিঙ্গারা, চপ, ফুলরি, পুরি এসব খাবার খুবই মজাদার। ব্রোকলি ছাড়া অন্য যে কোনো সবজির তুলনায় ফুলকপিতে ভিটামিন-সি’র পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, এর প্রতি ১০০ গ্রামে ভিটামিন-সি রয়েছে ৯১ মিলিগ্রাম। অথচ করল্লায় এর পরিমাণ হচ্ছে ৬৮ মিলিগ্রাম, সাজিনায় ৪৫ মিলিগ্রাম, ওলকপিতে ৫৩ মিলিগ্রাম, মুলায় ৩৪ মিলিগ্রাম এবং টমেটোতে আছে ৩১ মিলিগ্রাম। ফুলকপিতে ভিটামিন-কে’র পরিমাণও রয়েছে যথেষ্ট। এর অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের মধ্যে আমিষ, শর্করা, চর্বি, ক্যালসিয়াম, লৌহ, ক্যারোটিন ও ভিটামিন-বি আছে যথাক্রমে ২.৬ গ্রাম, ৭.৫ গ্রাম, ০.১ গ্রাম, ৪১ মিলিগ্রাম, ১.৫ মিলিগ্রাম, ৩০ মাইক্রোগ্রাম এবং ০.০৫৭ মিলিগ্রাম। শরীর সুস্থ রাখার জন্য মানবদেহে ভিটামিন-সি খুবই দরকারি।


বাঁধাকপি
খাদ্যমান বিবেচনায় বাঁধাকপি একটি পুষ্টিকর সবজি। এতে প্রচুর পরিমাণ ক্যারোটিন ও ক্যালসিয়াম বিদ্যমান। পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে, এর প্রতি ১০০ গ্রামে শর্করা ৪.৭ গ্রাম, আমিষ ১.৩ গ্রাম, চর্বি ০.২ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ৩১ মিলিগ্রাম, লৌহ ০.৮ মিলিগ্রাম, ক্যারোটিন ১২০০ মাইক্রোগ্রাম, ভিটামিন-বি ০.১১ মিলিগ্রাম এবং ভিটামিন-সি রয়েছে ৩ মিলিগ্রাম করে। ভিটামিন-এ’র অভাবে আমাদের বিভিন্ন সমস্যা যেমন- রাতকানা, হজমের অসুবিধা, ঘন ঘন অসুস্থতা, শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। পাশাপাশি ক্যালসিয়ামের অভাবে অস্থি ও কংকাল গঠনে বিঘœ ঘটে, শিশুদের রিকেট রোগ এবং অন্তঃসত্ত্বা নারীর উদরস্থ শিশুর দৈহিক গঠন অসম্পূর্ণ হতে পারে। এসব প্রতিরোধে বাঁধাকপি অনন্য। বাঁধাকপি বহুমূত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে।


গাজর
গাজর অত্যন্ত পুষ্টিসমৃদ্ধ মূল জাতীয় সবজি। কাঁচা ও রান্না উভয় অবস্থায়ই এটি খাওয়া যায়। গাজর বেশ জনপ্রিয় খেতে সুস্বাদু। দেখতেও চমৎকার। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, এর প্রতি ১০০ গ্রামে ১০৫২০ মাইক্রোগ্রাম ক্যারোটিন রয়েছে। অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের মধ্যে আমিষ ১.২ গ্রাম, শর্করা ১২.৭ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ১৭ মিলিগ্রাম, চর্বি ০.২ গ্রাম, লৌহ ২.২ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-বি ০.০৯ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-সি ৬ মিলিগ্রাম এবং খাদ্যশক্তি আছে ৫৭ কিলোক্যালরি। এ ছাড়া গাজরের পাতায় ক্যারোটিন, আমিষ, শর্করা, ক্যালসিয়াম, চর্বি, লৌহ, ভিটামিন-বি, ভিটামিন-সি ও খাদ্যশক্তি রয়েছে যথাক্রমে ৫৭০০ মাইক্রোগ্রাম, ৫.১ গ্রাম, ১৩.১ গ্রাম, ৩৬০ গ্রাম, ৫.১ গ্রাম, ১০ গ্রাম, ০.০৬ মিলিগ্রাম, ৭৯ মিলিগ্রাম এবং ৭৭ কিলোক্যালরি। সালাদ ছাড়াও গাজর দিয়ে তৈরি করা যায় স্যুপ, চপ, বড়া, হালুয়া, পায়েস আরো কত কি! নিরামিষভোজীদের কাছে গাজর অতি প্রিয়। কেবল খাদ্য হিসেবেই নয়, রূপচর্চায়ও এর তুলনা নেই। রুক্ষ আর খসখসে ভাব দূর করে, গাজর ত্বককে রাখে সজীব, সতেজ। এজন্য গাজর ছেঁচে রস বের করে সারা শরীরে মাখতে হবে। এভাবে কমপক্ষে ১৫/২০ মিনিট রেখে পরে গোসল করা উচিত। মুখ ও শরীরের কালো দাগ দূর করার জন্য গাজর কেটে শুকিয়ে গুঁড়া করে এর সঙ্গে পরিমাণমতো ময়দা ও দুধের সর মিশিয়ে সাবানের মতো ব্যবহার করতে হয়। গাজরের আছে আরো গুণ। কাঁচা গাজর কৃমিনাশক। এছাড়া প্লীহাবৃদ্ধি রোধ এবং আমাশয়ে বেশ কার্যকর। সস্তা, সহজলভ্য এ সবজি আমাদের অনেক উপকারে আসে।


মিষ্টিকুমড়া
মিষ্টিকুমড়া এ দেশের অন্যতম জনপ্রিয় সবজি। সারা বছর পাওয়া যায় এবং পাকা অবস্থায় এটি বহুদিন সংরক্ষণযোগ্য। এর ফল, ফুল ও ডগা অত্যন্ত সুস্বাদু। পুষ্টিকরও বটে। ভাজি এবং তরকারি ছাড়াও এ দিয়ে তৈরি করা যায় বিভিন্ন মুখরোচক খাবার। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, প্রতি ১০০ গ্রাম মিষ্টিকুমড়ায় ভিটামিন-এ ৭২০০ মাইক্রোগ্রাম, ভিটামিন-সি ২৬ মিলিগ্রাম এবং ক্যালসিয়াম আছে ৪৮ মিলিগ্রাম করে। অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের মধ্যে শর্করা, আমিষ, লৌহ, চর্বি, ভিটামিন-বি ও খাদ্যশক্তি রয়েছে যথাক্রমে ৪.৫ গ্রাম, ১.৪ গ্রাম, ০.৭ মিলিগ্রাম, ০.৫ গ্রাম, ০.১৩ মিলিগ্রাম এবং ৩০ কিলোক্যালরি। এ দেশে ভিটামিন-এ’র অভাব যথেষ্ট। এটি সবচেয়ে বেশি দেখা দেয় শিশু, গর্ভবতী এবং দুগ্ধদানকারী মায়েদের মধ্যে। এতে শিশুরা রাতকানায় আক্রান্ত হয়। তবে চিকিৎসা না করলে পুরোপুরি অন্ধ এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। এ ছাড়া এদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বুদ্ধির বিকাশে হয় বাধাপ্রাপ্ত। পাশাপাশি বড়রাও হচ্ছে নানা রোগের সম্মুখীন। অথচ মিষ্টিকুমড়াসহ অন্যান্য ক্যারোটিনসমৃদ্ধ সবজি নিয়মিত খেলে এসব সমস্যা প্রতিরোধ সম্ভব।


বেগুন
সারা বছর পাওয়া যায় এমন সবজির মধ্যে বেগুন একটি। এর আকার-আকৃতি হয় নানা রকম। কোনটি দেখতে লম্বাটে, কোনোটি গোলাকার (অনেকটা), কোনোটি আবার সরু। বর্ণও হয় একাধিক। কারণ বেগুনে রয়েছে যথেষ্ট পুষ্টি। এর প্রতি ১০০ গ্রামে ভিটামিন-এ আছে ৮৫০ মাইক্রোগ্রাম। অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের মধ্যে আমিষ ১.৮ গ্রাম, শর্করা ২.২ গ্রাম, চর্বি ২.৯ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ২৮ মিলিগ্রাম, লৌহ ০.৯ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-বি ০.২ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-সি ৫ মিলিগ্রাম এবং খাদ্যশক্তি রয়েছে ৪২ কিলোক্যালরি। ভাতের সাথে বেগুন ভাজি আর মুড়ি দিয়ে গরম গরম বেগুনি খেতে দারুণ! বিশেষ করে রমজানের ইফতারিতে বেগুনির জুড়ি নেই। কেবল খাদ্য হিসেবেই নয়, এর ঔষধিগুণও আছে যথেষ্ট। বেগুন যকৃতের জন্য উপকারী এবং ডায়াবেটিক রোগীর ভালো পথ্য। কফ নিরাময়ে এর কার্যকারিতা বেশ। পাশাপাশি দেহের চর্বি কমাতেও সহায়তা করে। এজন্য বেগুন আগুনে পুড়ে পরিমাণমতো লবণ মেখে নিয়মিত খেতে হবে।


করলা
উচ্ছে-করলা উভয়েরই গুণাগুণ সমান। ‘কিউকার বিটাসিন’ নামক এক প্রকার পদার্থ থাকায় এর স্বাদ তিতা। খেতে তিতা হলেও খাদ্যমান ও ঔষধিগুণ বিবেচনায় এ সবজি সবার নিকট বেশ সমাদৃত। এর কচি ফল আর চিংড়ির ভাজি দারুণ! মাছের সাথে রেধেও খাওয়া যায়। করলায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন-এ ও ভিটামিন-সি। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, প্রতি ১০০ গ্রামে ১৪৫০ মাইক্রোগ্রাম ক্যারোটিন ও ৬৮ মিলিগ্রাম ভিটামিন-সি আছে। অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের মধ্যে আমিষ ২.৫ গ্রাম, শর্করা ৪.৩ গ্রাম, চর্বি ০.১ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ১৪ মিলিগ্রাম, লৌহ ১.৮ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-বি ০.০৬ মিলিগ্রাম খাদ্যশক্তি রয়েছে ২৮ কিলোক্যালরি। আমাদের দেশের অধিকাংশ মায়েরা গর্ভাবস্থায় এবং শিশুদের দুধ খাওয়ানোর সময় রক্ত স্বল্পতায় ভুগেন। এ সমস্যা এড়াতে ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি তাদের বেশি করে করলা খাওয়া উচিত। পেটে গুঁড়া কৃমি হলে করলাপাতার রস ছেঁচে এর সাথে সামান্য পানি মিশিয়ে বড়দের দুইচা-চামচ এবং শিশুদের আধা চা-চামচ খাওয়াতে হবে। এভাবে ২/৩ দিন সকাল-বিকাল খাওয়ালে দেখবেন কৃমির উপদ্রব একদম নেই। করলা মুখে রুচি বাড়ায়, বাত, এলার্জি, পেটের পীড়াসহ অন্যান্য রোগের জন্য উপকারী।


ঢেঁড়স
ঢেঁড়স সব মৌসুমের অন্যতম প্রধান সবজি। এর অভ্যন্তরে এক ধরনের পিচ্ছিল পদার্থ থাকায় কেউ কেউ ঢেঁড়স খেতে চান না। তবে গ্রামের চেয়ে শহরের লোকের কাছে এর জনপ্রিয়তা বেশি। এর প্রতি ১০০ গ্রামে আহারোপযোগী ভিটামিন-এ ১৬৭০ মাইক্রোগ্রাম এবং ক্যালসিয়াম আছে ১১৬ মিলিগ্রাম। অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের মধ্যে আমিষ ১.৮ গ্রাম, শর্করা ৮.৭ গ্রাম, চর্বি ০.১ গ্রাম, লৌহ ১.৫ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-বি ০.২০ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-সি ১০ মিলিগ্রাম এবং খাদ্যশক্তি ও রয়েছে ৪৩ কিলোক্যালরি। মানবদেহে ভিটামিন এবং ক্যালসিয়ামের অভাব দেখা দিলে যতই শক্তিদায়ক খাবার খাওয়া হোক না কেন, অসুস্থ অবধারিত। এজন্য ভিটামিন ও ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি পর্যাপ্ত ঢেঁড়স খেতে পারেন। এ সবজি ভেজে কিংবা যে কোন মাছ এমনকি গোশতের সাথে রেধেও খাওয়া যায়। নিয়মিত ঢেঁড়স খেলে শরীরের হাড় শক্ত হয়, দাঁতের গঠন ঠিক থাকে। এ ছাড়া হজমশক্তি বৃদ্ধিসহ কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। এতে আয়োডিন থাকায় গলাফোলা রোগ হওয়ার কোনো আশঙ্কা থাকে না।


আলু
পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে, আলুতে ভিটামিন ‘এ’ ও ‘সি’ রয়েছে। এছাড়া শর্করা, আমিষ, ক্যালসিয়াম, লৌহ, ভিটামিন-এ, ভিটামিন-বি তো আছেই। একজন পূর্ণবয়স্ক লোক দৈনিক ২০০-২৫০ গ্রাম করে আলু খেলে তাতেই ভিটামিন-সি’র চাহিদাপূরণ হয়ে যায়। গোলআলু একমাত্র সবজি, যা বিভিন্ন ধরনের মাছ গোশত রান্নায় তরকারি হিসেবে ব্যবহার হয়। আলু ভর্তা, ভাজি, চাটনি, লাবড়া এসব নিরামিষভোজীদের অতি প্রিয়। এ ছাড়া এ দিয়ে তৈরি করা যায় চপ, সিঙ্গারা, পুরি, চটপটি এবং চিপসের মতো স্বাদের খাবার। আলু কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। হৃদরোগীরাও আলু খেতে পারেন।


মিষ্টিআলু
মিষ্টিআলু এক প্রকার সবজি বিশেষ। একে বলা হয় ‘গরিবের খাদ্য’। কয়েকটি দেশে চাল এবং গমের পরিবর্তে মিষ্টিআলু ব্যবহার হচ্ছে। মূল জাতীয় শস্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শক্তি উৎপন্ন করে মিষ্টি আলু। প্রতি ১০০ গ্রাম মিষ্টিআলুতে শর্করার পরিমাণ ২৮.২ গ্রাম। অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের মধ্যে আমিষ ১.২ গ্রাম, চর্বি ০.৩ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ২০ মিলিগ্রাম, লৌহ ০.৮ মিলিগ্রাম, ক্যারোটিন ৫৬৫ মাইক্রোগ্রাম, ভিটামিন-বি ০.০৮ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-সি ২ মিলিগ্রাম এবং খাদ্যশক্তি রয়েছে ১২০ কিলোক্যালরি। সাদা ও লাল দুই বর্ণের এ আলু সাধারণত সিদ্ধ, ভর্তা, আগুনে পুড়ে এবং মাছ-গোশতের সাথে রান্ন করে খাওয়া যায়। ইচ্ছে করলে কাঁচাও খেতে পারেন। মিষ্টিআলু নিয়ে হালুয়া, চিপস, পায়েশ এবং আটার সংমিশ্রণে এর গুঁড়া দিয়ে তৈরি হয় বিস্কুট, রুটি, পাউরুটি, পেস্ট্রি, হরেক রকম পিঠা, কেক এসব মুখরোচক খাবার। প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি করা যায় শিশুদের বিকল্প খাদ্য। এর আছে আরও গুণ। গ্লুকোজ, চিনি, সিরাপ, স্টার্চ, পেপটিন এবং এ্যালকোহলের গুরুত্বপূর্ণ উৎস হচ্ছে মিষ্টিআলু। এর কচিপাতা ও ডগা খুব পুষ্টিকর।


কাঁচকলা
সারাবছর পাওয়া যায় কাঁচকলা কেউ কেউ আনাজি কলাও বলে থাকেন। সবজি হিসেবে কাঁচকলা এদেশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কাঁচকলা হচ্ছে মধুরস, যা খেলে মুখে রুচি বাড়ে। তাই রোগীর পথ্য হিসেবে এর জুড়ি নেই। এর প্রতি ১০০ গ্রামে (আহারোপযোগী) শর্করা ১৭.৩ গ্রাম, আমিষ ২.৬ গ্রাম, চর্বি ০.৪ গ্রাম, খনিজ লবণ ১ গ্রাম, ভিটামিন-বি ০.১৫ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-সি ৪ মিলিগ্রাম এবং খাদ্যশক্তি রয়েছে ৮৩ কিলোক্যালরি। আয়ুর্বেদীয় মতে, অন্যান্য কলার মতো এর শিকড়, কন্দ, পাতা, ফুল, ফল, থোড় ও বীজ ঔষধিগুণে ভরপুর। কাঁচকলা আর থানকুনিপাতা বেটে এক সাথে খেলে আমাশয় সেরে যায়। তবে রক্ত আমাশয় এবং জন্ডিস হলে কাঁচকলা সিদ্ধ করে গরম ভাত দিয়ে খেতে হবে। কলার থোড় উচ্চরক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। এছাড়া ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর তৃষ্ণা নিবারণে এবং রক্তবমি বন্ধে সহায়তা করে। কেঁচোকৃমি হলে বয়স অনুযায়ী ৩/৪ চা-চামচ কলাগাছের শিকড়ের রস সকালে খালিপেটে খেতে হবে। এভাবে কয়েক দিন নিয়মিত খেলে কৃমির উপদ্রব কমে যাবে।


পাটশাক
পাটের প্রধান ফসল আঁশ হলেও এর পাতার গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়। দেশি পাটশাক সামান্য তিতা তবে তোষা বা বগী পাটশাক খেতে বেশ সুস্বাদু। পুষ্টির দিক থেকে দেশী পাটশাক কিছুটা এগিয়ে। ডালের সঙ্গে কচি পাটশাক খেতে দারুণ। এ ছাড়া ভাজি, ছোট মাছ দিয়ে রান্না করেও খাওয়া যায়। এতে ভিটামিন-সির পরিমাণ কম থাকলেও ক্যারোটিন আছে প্রচুর। এর প্রতি ১০০ গ্রামে শর্করা ১২.৬ গ্রাম, আমিষ ২.৬ গ্রাম, চর্বি ০.০১ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ১১৩ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-এ ১১৭০০ মাইক্রোগ্রাম, ভিটামিন-বি ০.১৯ মিলিগ্রাম এবং খাদ্যশক্তি রয়েছে ৬২ কিলোক্যালরি। একজন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের দৈনিক ৭৫০ মাইক্রোগ্রাম এবং শিশুদের জন্য কমপক্ষে ২৫০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন-এ দরকার, যা পাটশাক হতে অনায়াসেই পেতে পারি।


কলমিশাক
কলমি গ্রাম বাংলার অতি পরিচিত একটি শাকের নাম। এক ধরনের কলমির ডাঁটা লাল আর অন্যটির ডাঁটা দেখতে সাদা-সুবজ। এর প্রতি ১০০ গ্রাম (আহারোপযোগী) শাকে ১০৭৪০ মাইক্রোগ্রাম ক্যারোটিন আছে। অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের মধ্যে আমিষ ১.৮ গ্রাম, শর্করা ৯.৪ গ্রাম, চর্বি ০.১ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ১০৭ মিলিগ্রাম, লৌহ ৩.৯ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-বি ০.৫৪ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-সি ৪২ মিলিগ্রাম এবং খাদ্যশক্তি রয়েছে ৪৬ কিলোক্যালরি। ভিটামিন-এ’র অভাবে আমাদের দেশে প্রতি বছর ৫ লাখ শিশু রাতকানায় আক্রান্ত হচ্ছে। একই কারণে প্রতিদিন গড়ে ১০০ এবং বছরে ৩০ হাজার শিশু একেবারেই অন্ধ হয়ে যায়। অথচ ক্যারোটিনসমৃদ্ধ অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি কলমিশাক খেলে এ জাতীয় রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। শিশুরা যেন পর্যাপ্ত বুকের দুধ পেতে পারে এজন্য মায়েদের কলমিশাক খাওয়া বাঞ্ছনীয়। বোলতা, ভিমরুল বা মৌমাছিতে কামড়ালে কিংবা শিং, ট্যাংরা মাছের কাটা ফুটলে কলমিশাকের পাতা ও ডাঁটা বেটে আক্রান্ত স্থানে প্রলেপ দিলে কিছুক্ষণ পরেই যন্ত্রণা কমে যায়।


অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি প্রতি বেলায় আমাদের শাকসবজি খাওয়া আবশ্যক। তবে তা হতে হবে অবশ্যই বিষক্রিয়ামুক্ত। এ বিষয়ে কৃষকদের যতটুকু আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন, তেমনি দরকার সবজি বিক্রেতাদেরও। তাই আসুন, এ ব্যাপারে নিজে সচেতন হই; অপরকেও করি উৎসাহিত।

তথ্যসূত্রঃ
✔কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস)

ছবিঃ
★Samsung A12 (Phone Camera)

পঠিত : ১৯৩ বার

মন্তব্য: ০