Alapon

সেকুলারদের মৃত্যুতে কি জান্নাতের দুয়া করা যায়?




নবিজির এক সাহাবি ছিলেন যার পিতা জাহিলিয়্যাতেই মারা যান। তিনি নিজে যেহেতু ইসলাম গ্রহণ করেন, স্বাভাবিক কারণেই তার পিতার পরকালীন পরিণতি নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। সম্ভবত তার পিতা পরোপকারী ভালো মানুষ ছিলেন। তিনি হয়তো আশা করছিলেন তার পিতার এসব সৎগুণাবলী তাকে পরোকালে ক্ষমা এনে দিতে পারে। সংশয় দূর করা ও ভালো উত্তর শোনার আশায় রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ আইনা আবী-- আমার পিতা কোথায় আছেন? রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “আবুকা ফিন নার--তোমার পিতা জাহান্নামে”। লোকটা এই উত্তর শুনে বেদনা ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ফিরে যাচ্ছিল। রাসূলুল্লাহ (সা.) বিষয়টি লক্ষ্য করে তাকে ডেকে বললেন, “ইন্না আবী ওয়া আবাকা ফিন নার--আমার পিতা তোমার পিতা উভয়েই জাহান্নামে”।

আমাদের যারা নবির ছবি কেবল "সেক্যুলারদের বয়ানমতে" দয়ার নবি মায়ার নবি হিসেবে এঁকেছি তাদের কাছে ঘটনাটা একটু কেমন কেমন লাগতে পারে! কিন্তু বর্ণনাটি এমনই এবং সন্দেহাতীতভাবে বিশুদ্ধ প্রমাণিত। সহীহ মুসলিমে সঙ্কলিত। ইসলামিক ফাউন্ডেশন হাদীস নং ৩৯৪, আন্তর্জাতিক নাম্বার ২০৩)

শিরক কুফরের সাথে যে জাহান্নামের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত এটা স্পষ্ট করতে নবি (সা.) একটুও ইতস্তত করেননি। বিষয়টি নিয়ে যেন কোনো অস্পষ্টতা বা সন্দেহ সংশয় না থাকে এজন্য ইচ্ছে করে নিজেকে ব্যক্তিগতভাবে ঘটনায় জড়িয়ে নিজ পিতার জাহান্নামি হওয়ার কথা বলেছেন। শিরক কুফরের ভয়াবহতা দ্ব্যার্থহীনভাবে বুঝানোর জন্য অনেকসময় আমি এভাবে বলে থাকি, “সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত সুস্পষ্ট কুফর কিংবা সর্বসম্মত শিরকে আকবারে লিপ্ত অবস্থায় কোনো ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলে সে চিরকাল সেভাবে জাহান্নামে থাকবে যেভাবে রবি ঠাকুর চিরকাল জাহান্নামে থাকবে”।

প্রিয়নবিও তাঁর সাহাবিকে শান্তনা দেওয়ার জন্য ইনিয়ে বিনিয়ে একথা বলেননি যে, "আহা বলা তো যায় না, আল্লাহর দয়া হলে মাফ করেও দিতে পারেন; কিংবা হতেও তো পারে তোমার পিতা পূর্বের নবির উপর হয়ত ঈমান এনেছিলেন"। শিরকের ভয়াবহতা স্পষ্ট করার পর তাকে শান্তনা দেওয়ার জন্য তিনি নিজেও যে সেই একই কষ্টের মধ্যে আছেন সেটা তার সাথে শেয়ার করেছেন। পক্ষান্তরে এটাও স্পষ্ট করেছেন যে দেখো আমি স্বয়ং আল্লাহর রাসূল হওয়া সত্ত্বেও আমার নিজ পিতা হওয়া সত্ত্বেওও কিছু করার নেই; যেখানে প্রশ্ন মহান আল্লাহ্‌র সাথে শিরক কুফরের সেখানে অন্য সবকিছুই মূল্যহীন।

একটু আমাদের বর্তমান সামাজিক কনটেক্সট এ একটু ফিরে আসি।

বিংশ শতাব্দিতে ইসলামধর্ম ত্যাগ করে যে ধর্মটি গ্রহণ করে মানুষ সবচেয়ে বেশি মুরতাদ হয়েছে সেটি হলো সেক্যুলারিজম। আমি মনে করি বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড়, কার্যকর, নিকৃষ্টতর ও শক্তিশালী ধর্ম হলো সেক্যুলারিজম। সেক্যুলারিজম বস্তুত পৌত্তলিকতা, বৌদ্ধ, ইহুদী, খৃষ্টান কিংবা যে কোনো আস্তিক ধর্মের চেয়ে নিকৃষ্টতর; কারণ, এসব ধর্মগুলো আল্লাহ্‌র সাথে শরিক সাব্যস্ত করলেও অন্তত একজন মহাস্রষ্টার অস্তিত্ব স্বীকার করে; পক্ষান্তরে সেক্যুলারিজম স্বয়ং স্রষ্টার অস্তিত্বকেই ফান্ডামেন্টালি অস্বীকার করে। অথচ আমাদের ধর্মীয় অথরিটির ব্যক্তিবর্গ এই নিকৃষ্টতম মতবাদটির ভয়াবহতা গণ পরিসরে মোটেই স্পষ্ট করে তুলে ধরতে পারেননি। তাই সেক্যুলারিজমকে আদর্শিক ও রাজনৈতিকভাবে গ্রহণ করে নেওয়ার ইরতিদাদ বা ধর্মত্যাগের এই প্রবল ঢেউয়ের দায় তারা এড়াতে পারেন না। আদর্শিক বা রাজনৈতিকভাবে সেক্যুলারিজমকে গ্রহণ করে নেওয়া যে পৌত্তলিক, ইহুদি, খৃষ্টান, বৌদ্ধ কিংবা অন্য যে কোনো ধর্ম গ্রহণের মতো একই পরিণতি বয়ে আনে এবং এর মাধ্যমে যে একজন মানুষ সম্পূর্ণ ইসলামের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে যায় তা তারা জাতির সামনে দ্ব্যর্থহীনভাবে স্পষ্ট করেননি।

চার্চ থেকে রাষ্ট্রকে পৃথক করার পেছনে তো খৃস্টধর্মের পুরোহীতদের ভয়ানক প্রত্যক্ষ অপরাধ ছিলো। তারা মেয়াদোত্তীর্ণ ও বিকৃত খৃস্টধর্মের নামে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান-গবেষনার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল নিজেদের কর্তৃত্ব রক্ষা করার জন্য। তাদের মধ্যে তো একটা দন্দ্ব-সংঘাত অন্তত লেগেছিল; চার্চের কর্তৃত্বের পরাজয় ও সেক্যুলার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই যার মিমাংসা হয়। পক্ষান্তরে আমাদের এখানে সেক্যুলারদের সাথে ধর্মীয় অথরিটির কোনো প্রকার সংঘর্ষই লাগল না। কিভাবে তারা বিপরীতমুখী এই দুই ব্যবস্থার ধারক হয়েও গলায় গলায় ভাব নিয়ে এত দীর্ঘদিন একসাথে চলছেন তা এক প্রশ্নই বটে! চার্চের মতো ভয়ানক ভুমিকায় ইসলামি ইতিহাসে কেউ নামেনি সত্য, কিন্তু ইসলামের সাথে সেক্যুলারিজমের দন্দ্ব তো একেবারেই মৌলিকভাবেই বিদ্যমান; সেহেতু ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও ধর্ম ও সেক্যুলারিজম নিজ নিজ জায়গায় ঠিক থাকলে একটা দন্দ্ব অনিবার্য ছিলো, কিন্তু আমাদের এখানে সেটা হয়নি।


মসজিদের ইমাম মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল-মুহতামিম সাহেব নামকরা ইসলামি বিদ্যাপীঠ থেকে ফারেগ বিদগ্ধ আলিম, আর মসজিদ কমিটির সভাপতি-সেক্রেটারি নিকৃষ্টতর ইসলামবিরোধী সেক্যুলার রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতা। তারা দু'জন কিভাবে পরস্পরের পারপাস সাকসেসফুলি সার্ভ করে যেতে পারছেন তা নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা হওয়ার দাবি রাখে।

আমরা যেহেতু ভারতীয় উপমহাদেশের লোক তাই এই আলোচনায় আমাদের অঞ্চলে এই ধর্ম ও সেক্যুলারিজমের এই আন্তসম্পর্কীয় কেমিস্ট্রি কিভাবে ডেভেলপ করল তা নিয়ে কিছু কথা বলব। তবে এই আর্টিকেলে বর্ণিত এই প্রেক্ষাপটের আংশিক ভুলশুদ্ধ হওয়া কোনোভাবেই ফলাফলকে নাকচ করে না। ধর্মকে আসমানের উপরের ও জমিনের নিচের কিংবা কেবলই ব্যক্তিগত আবেগ অনুভুতির বিষয়ে পরিণত করা এবং রাষ্ট্র-রাজনীতিকে সেক্যুলার তথা দুনিয়াদারী বিষয়ে পরিণত করা এবং সেক্যুলার ও ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গের গলাগলি বেধে চলার ইতিহাসটি কোন প্রেক্ষাপটে এবং কী প্রক্রিয়ায় রচিত হলো তা একটু খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। বিশ্লেষণ নিয়ে ভিন্নমত থাকতে পারে কিন্তু প্রয়োজন অপরিহার্য্য, বিশেষত যদি আমরা কুফরের এই গর্ত থেকে বেরিয়ে আসতে চাই।

মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের মতো এই উপমহাদেশেও সেক্যুলার ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে কলোনিয়ালিজমের মাধ্যমে। ইংরেজরা প্রথমে সিস্টেমেটিক্যালি ইসলামী ব্যবস্থা (যতটুকু ছিলো) উৎখাত করেছে; তারপর তাদের ব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়েছে।

গৌরবজনক যে অধ্যায়টুকু ইতিহাসের এই পর্বে আমাদের জন্য রয়েছে তা হলো, কলোনিয়ালিজমের বিরুদ্ধে মুসলিম সমাজ থেকে প্রাথমিক যত আন্দোলন (বালাকোট, ফরায়েজি ইত্যাদি) হয়েছিলো সবই মূলত ছিলো ইসলামী শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন। ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য থেকে মুসলিমদের প্রচেষ্টা এই বৃটিশ খেদাও আন্দোলনে এসে পথ হারায়; এখানে এসে আন্দোলনটা অনেকটা আঞ্চলিক জাতিয়তাবাদী আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে।

ইংরেজ খেদাও আন্দোলনে বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আলিম উলামাদের ত্যাগ ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে, যদিও তারা বাহ্যিক সফলতা পাননি। ইংরেজদের ভয়াবহ অত্যাচারের মুখে টিকতে না পেরে পিছু হটার পরবর্তী অধ্যায় থেকে ইসলামধর্ম যে একটা ব্যক্তিগত চর্চার বিষয়ে পরিণত হয় সেই ধারা আজও চলমান। তখনকার দূরদর্শী আলিমগণ সাময়িকভাবে বিদ্রোহ থেকে পিছু হটে মাদ্রাসা-মসজিদ-খানকা প্রতিষ্ঠার যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তা ছিল কেবল কৌশলগত কারণে এবং শক্তি সঞ্চয় করে পূণরায় আক্রমণের উদ্দেশ্যে। কুরআনের ভাষায় যা মুতাহাররিফাল লিক্বিতাল আও মুতাহায়্যিযান ইলা ফিআতিন… সূরা আনফাল, আয়াত ১৫); কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পরবর্তী প্রজন্ম এগুলোকেই তাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য বানিয়ে নেয়; মাদ্রাসাওয়ালাগণ—যেখানে সবচেয়ে বেশি ধর্মচর্চায় নিয়োজিত জনগোষ্ঠি সম্পৃক্ত তারা—তো যথারীতি মাদ্রাসার প্রাচীরের মধ্যে কেবল কিতাবচর্চার জীবনযাপনকে মহিমান্বিত করতে এমন শ্লোগানও তৈরি করে যে—“মাদ্রাসা হায় ওয়াতান আপনা, মরেঙ্গে হাম কিতাবু পর ওয়ারাক হোগা কাফন আপনা...।

ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়, দ্বীন-ধর্মের চর্চাকে মসজিদ মাদ্রাসা আর ব্যক্তিগত জীবনের সীমানার মধ্যে রেখে সন্তুষ্ট থেকে সমাজ-রাষ্ট্র-রাজনীতিকে ধর্মহীন সেক্যুলারদের হাতে ছেড়ে দিয়ে ধর্মকে দ্বিখণ্ডিত করার মাধ্যমে সেক্যুলারদের স্বপ্নই বাস্তবায়িত হলো। ব্যক্তিগত পর্যায়ে ধর্মীয় অথরিটির ব্যক্তিবর্গের অনেকে অত্যন্ত সৎ, দুনিয়াবিমুখ আবিদ হলেও রাজনৈতিক বিষয়ে তাদের অজ্ঞতা-অসচেতনতা জাতিকে এক আদর্শিক দন্দ্বে নিপতিত করেছে এর মধ্য দিয়ে।

হিন্দুস্তানের স্বাধীনতা, ধর্মের ধোকা দিয়ে ইসলামের নামে কার্যত সেক্যুলার পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা এবং ৭১'র মুক্তিযুদ্ধে এদেশের রাজনৈতিক ইসলামের অবস্থান ও পরাজয়ের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সৃষ্টির পর এদেশে সেক্যুলার পন্থা আরও গভীরভাবে সমাজে শেকড় গেড়ে বসে।

ইতিপূর্বে বৃটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশে আসার পর ইসলামের আর্থিক শক্তি ধ্বংস করার জন্য যে ওয়াকফ আইন বাতিল করেছিল তার প্রভাবে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থিক সক্ষমতা ধ্বংস হয়ে যায়। আর্থিক অস্বচ্ছলতা বাড়তে থাকা, মসজিদ-মাদ্রাসা সীমানার মধ্যে যাপিত নির্ঝঞ্ঝাট ও শান্তিপূর্ণ আয়েশী জীবনধারায় আশক্ত-অভ্যস্ত হয়ে পড়ার যুগপৎ পরিণতি হলো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সমাজের ধনিক ও সেক্যুলার রাজনীতিক শ্রেণির উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল হয়ে পড়া।

এই নির্ভরশীলতার কারণে তাদের মধ্যে একটা সামাজিক দহরমমহরম তৈরি হয় এবং উভয় শ্রেণির মাঝে একটা গিভ এন্ড টেইক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এর পরিণতিতে একজন মানুষ সারাজীবন আল্লাহকে অস্বীকারকারী সেক্যুলার রাজনীতি করে, নিজেদেরকে সার্বভৌম আইন রচয়িতা দাবি করে, সুদ-মদ-জুয়া-যিনার মতো সুস্পষ্ট হারামকে বৈধতা প্রদানের মতো আল্লাহ;দ্রোহী তা/গু-তী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার পরও তাকে মৃত্যুর পর জানাযা পাওয়ার নিশ্চয়তা দিয়েছে ধর্মীয় অথরিটির লোকেরা; আর এর বিনিময়ে তাদেরকে ধণিক রাজনীতিকরা দিয়েছে তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান চালিয়ে যাওয়ার নিয়ন্ত্রিত সুযোগ এবং কিছু দান দক্ষিণা।

সচেতন নেককার আলিম-উলামা যে একেবারেই নেই তা নয়। তবে যেসকল হাতেগোনা মহৎপ্রাণ আলিমগণ এই গণ্ডি ভেঙে আপোষহীনতার পথ বেছে নিয়েছেন তাদের সকলেই ঘরে-বাইরে নানারকম সমালোচনা ও নিগ্রহের শিকার হয়েছেন ও হচ্ছেন।

এই উভয়শ্রেণীর যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত যে “বাঙালি মুসলমান সমাজ” সেখানে সেক্যুলারিজম আর ইসলাম এমনভাবে এক রেখায় মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে যেন মনে হয় এখন এর একটা অন্যটাকে আর নাকচ করে না। একারণে কার্যত পূর্ণ সেক্যুলারিজম চর্চার পরেও এখানে লোকদেরকে বলতে শোনা যায়, “এই সেক্যুলারিজম আর সেই সেক্যুলারিজম এক না”। একজন মানুষ এখানে এখন একইসাথে ধার্মিক এবং সেক্যুলার রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী হয়ে থাকার মতো বিচিত্র এক নতুন ধর্মের জন্ম হয়েছে এখানে। আল্লাহর মনোনীত একমাত্র জীবনব্যবস্থা হিসেবে যে ইসলামকে নবি মুহাম্মাদ (সা.) নিয়ে এসেছিলেন সেই ইসলাম একে কিছুতেই বলা যায় না; হয়তো এটা সেক্যুলারিজম ও ইসলামের ক্রসমিলনে জন্ম নেওয়া নতুন কোনো ধর্ম হতে পারে।

এসব কারণেই আমরা আজকাল দেখতে পাই যে একজন মানুষ আমৃত্যু সেক্যুলার রাজনীতির সেবক থাকা সত্ত্বেও মৃত্যুর পর তার জন্য জান্নাতের উঁচু মাকাম কামনা করা হয়; অথচ আল্লাহর রাসূলকে আজীবন আর্থিক-পারিবারিক-সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে সুরক্ষা দেওয়া সত্ত্বেও; স্বয়ং আল্লাহর রাসূলের অভিভাবক ও চাচা হওয়া সত্ত্বেও, অসম্ভব পরোপকারী, মানবদরদী হওয়া সত্ত্বেও আবু তালিব ইন্তেকালের পর যখন আল্লাহর রাসূল (সা.) তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করেছিলেন তখন আল্লাহ আয়াত নাজিল করে কঠিনভাবে সাবধান করে বলেছেন,

“নবি কিংবা ঈমানদারদের জন্য এটা শোভনীয় নয় যে তারা মুশরিকদের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করবে, তাদের কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর যে তারা জাহান্নামের অধিবাসী; তাতে তারা তাদের যতোই নিকটজন হোক না কেন (সূরা আত-তাওবা, আয়াত ১১৩)।

ঈমান ও শিরকের, ইসলাম ও কুফরের মাঝখানে একটা সুস্পষ্ট সীমারেখা আছে এবং এটা থাকা অপরিহার্য। কারণ এই সীমারেখা লঙ্ঘন কেবল কোনো সাধারণ অপরাধ নয়, যা সামান্য ধমক কিংবা সাময়িক কোনো শাস্তিতে মোচন হয়ে যায় ; এই সীমারেখার এক পাশে চিরস্থায়ী জান্নাত অন্য পাশে চিরকালীন জাহান্নাম। এই সীমারেখাকে মুছে দেওয়া কিংবা অস্পষ্ট করে দেওয়া মোটেই কোনো ছোটো খাটো অপরাধ নয়।

রাজনৈতিক অসচেতন সুফি দরবেশ, জাতে ওঠার নিরন্তর যুদ্ধে রত বার্নআউট কওমিয়ান, ইসলামকে কাটছাট করে বর্তমান সমাজের সাথে খাপ খাওয়ানোর অপচেষ্টায় নিয়ীজিত মর্ডানিস্ট, গণতান্ত্রিক রাজনীতির সিড়ি বেয়ে ইসলাম কায়েমের স্বপ্নে বিভোর দলকানা মুখলিস রাজনীতিকদের প্রায়ই সেক্যুলারিজম ও ইসলামের মধ্যকার এই অপরিহার্য সীমারেখাটিকে মুছে ফেলার অপচেষ্টা করতে দেখা যায়; দেখা যায় আমৃত্যু সেক্যুলার ধর্মকে সার্ভ করে হালের খ্যাতিমান যেসব সেক্যুলাররা ইসলামের বিভিন্ন বিধিবিধান নিয়ে অসংখ্য আপত্তিকর মন্তব্য করেছে তাদেরকেও পারলে মৃত্যুর পর জান্নাতের সার্টিফিকেট দিয়ে দিতে। অনেক সময় অনেক জ্ঞানীগুণী মানুষকেও তথাকথিত সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখার তাড়নায় এ জায়গায় স্লিপ কাটতে দেখা যায়--যা খুবই শঙ্কার।

একজন মানুষ সেক্যুলার, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টান, ইহুদি কিংবা অন্য কোনো ধর্মের অনুসারী হয়েও অনেক পরোপকারী ও মানবদরদী হতে পারেন, সমাজে মানুষের বস্তুগত কল্যাণে অনেক ভুমিকা রাখতে পারেন। তার এসব ভালোকাজের জন্য তিনি অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য, কিন্তু মনে রাখতে হবে এর সাথে আখিরাতে মুক্তির কোনো সম্পর্ক নেই। আখিরাতে মুক্তির সম্পর্ক মৌলিকভাবে কেবলই শির্ক ও কুফরমুক্ত ঈমানের সাথে; শিরক-কুফরমুক্ত ঈমান থাকলেই কেবল ভালো কাজের গৃহীত হওয়ার সুযোগ থাকে; ভালো কাজের সম্পর্ক মুক্তি পাওয়ার সাথে নয়, বরং এর সম্পর্ক কেবল জান্নাতে স্তর ও মর্যাদা কমবেশি হওয়ার সাথে। একজন মানুষ যদি অনেক ভালো কাজ করে গিয়ে থাকেন আপনি তার মৃত্যুর পর তার প্রশংসা করতে পারেন, দুঃখ প্রকাশ করতে পারেন কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তিনি যদি সেক্যুলারিজম কিংবা অন্য কোনো ধর্মের অনুসারী হন সেক্ষেত্রে আপনি তার মৃত্যুতে তার জন্য জান্নাতের দুয়া করতে পারেন না।

প্রচলিত ইসলামি রাজনীতির বিভিন্ন নেতাদেরকে মাঝেমধ্যে সেক্যুলারিজম নিয়ে বেশ শক্ত বক্তব্য দিতে দেখা যায়; আলোচনার মঞ্চে এটাকে তারাও মুখ দিয়ে কুফরি ও ধর্মহীনতা হিসেবে সাব্যস্ত করে থাকেন, তাদের বইপুস্তকেও এমন বক্তব্য লেখা আছে অনেক জায়গায়; প্রশ্ন হলো এগুলো কি তবে কেবলই ফাঁকা বুলি? আসলে কি তারা এটা বিশ্বাস করেন না?!!!

আমৃত্যু সেক্যুলার সমাজব্যবস্থা ও রাজনীতিকে সার্ভ করে মৃত্যুবরণ করা লোকের জন্য যদি জান্নাতের উঁচু মাকাম লাভের দুয়া করা হয় তাহলে জীবিত সেক্যুলাররা তো এই বার্তা গ্রহণ করতেই পারেন যে আপনারা সেক্যুলারিজমের বিরুদ্ধে গালভরা যেসব শক্ত বয়ান দিয়ে থাকেন এসব আসলে কেবলই কথার কথা! বস্তুত এতে কোনো সমস্যা নেই, এগুলো কেবল আপনাদের দল ভারী করার জন্য মানুষকে ভয় দেখানোর কৌশল!

লিখেছেন: আবু তাসমিয়া আহমদ রফিক,
প্রধান সম্পাদক, সিয়ান পাবলিকেশন।

পঠিত : ৩০০ বার

মন্তব্য: ০