Alapon

নামায রোযার হাকীকত



পৃথিবীতে আল্লাহ তাআলা একজন মাত্র স্রষ্টা আছেন। বাকী সব তাঁর সৃষ্টি। সৃষ্টির মধ্যে উত্তম সৃষ্টি মানুষ। যেমন, আল্লাহ তাআ'লা বলেন, অবশ্যই আমি মানুষকে সৃষ্টি করছি সর্বোত্তম গঠনে। (সূরা আত তীন-৪)

অন্যত্র বলা হয়েছে, তোমরা হলে সর্বোত্তম জাতি। (সূরা আলে ইমরান-১১০)

মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি বলেন, “আর মানুষকে কেবল এজন্যই সৃষ্টি করছি তারা যেন আমার ইবাদাত করে।” (সূরা যারিয়াত-৫৬)

এই থেকে বুঝা যায়, আমাদের সৃষ্টির একমাত্র উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহ তাআলার বন্দেগি করা, দাসত্ব করা, গোলামী করা। প্রশ্ন হলো, এই দাসত্ব কি নির্দিষ্ট কোন একসময় বা নির্দিষ্ট বয়সে উপনীত হলে কিংবা মাঝে মাঝে যখন মন চায় তখন করতে হবে, না প্রতিটি মুহূর্তেই আল্লাহর গোলামী করতে হবে? গোলামী বা দাসত্ব বলতে আমরা কী বুঝি? মালিকের নাম জপতে জপতে সময় অতিবাহিত করা কিংবা তাঁর সামনে গিয়ে তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বসে থাকা? না, তাঁর দেয়া দায়িত্ব পালন করা? আমরা আমাদের অধীনস্হদের থেকে যেমন আচরণ প্রত্যাশা করি তেমন আচরণ কি আমরা আমাদের মালিকের সাথে করি?

এসব প্রশ্নের সহজ এবং সঠিক উত্তর দিয়ে “নামাজ রোযার হাকীকত” নামে একটি বই রচনা করেন বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ ইসলামিক স্কলার, অসংখ্য গ্রন্থ প্রণেতা, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রহঃ)। বইটি ইসলামের মৌলিক এবং গুরুত্বপূর্ণ দুইটি বিষয় তথা নামাজ এবং রোযা নিয়ে লিখিত হলেও আমরা যে যত্রতত্র ইবাদত শব্দটা ব্যবহার করি, সেই হিসেবে ইসলামের মৌলিক দুইটি বিষয়ের উপর আলোকপাত করার আগেই লেখক ইবাদত বলতে কী বুঝায়, ইবাদত বা বন্দেগি কেমন হওয়া উচিত এবং শব্দটি আমরা কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে ব্যবহার করি তার একটা পরিষ্কার ধারণা দেয়ার জন্য ইবাদত শব্দটির অবতারণা করেছেন।

ইবাদত বলতে সাধারণত আমরা যা বুঝি তন্মধ্যে সালাত এবং সাওম অন্যতম। তবে এগুলো কি আসলেই মৌলিক এক একটি ইবাদত;যার জন্য আল্লাহ তাআ'লা আমাদের সৃষ্টি করছেন? না সমস্ত ইবাদতের মূল চাবিকাঠি বা নিয়ন্ত্রক হিসেবে এগুলোকে আল্লাহ তাআ'লা আমাদের উপর আবশ্যিক করেছেন - তা আমাদের ক্লিয়ার থাকতে হবে। যদি এগুলোকেই মূল ইবাদত মনে করি, তাহলে আমরা তো সালাত আদায় করি দৈনিক পাঁচবার, যার সময়সীমা দুই-তিন ঘণ্টা এবং সাওম আদায় করি বছরে একমাস। তাহলে বাকী যে একুশ - বাইশ ঘণ্টা বা এগারোটি মাস আমরা অতিক্রম করি- সেই সময়গুলোতে কি আমরা ইবাদত করি না বা করতে হয় না? কারণ, হজ্ব এবং যাকাত এই দুইটি তো বিশেষ সময়ে এবং বিশেষ ব্যক্তির সাথে সম্পৃক্ত। তাহলে আল্লাহ তাআ'লা যে শুধু ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করছেন বলে ঘোষণা দিলেন তাঁর আসল রহস্য কী? লেখক এই রহস্যটাই আবিস্কার করছেন এই বইয়ে।

লেখক এখানে দেখিয়েছেন, সালাত আসলে মৌলিক ইবাদ নয়। বরং সালাত হচ্ছে সমস্ত ইবাদতের মূল নিয়ন্ত্রণকারী। অর্থাৎ পাঁচ ওয়াক্ত সালাতকে কেন্দ্র করে আমাদের যাবতীয় ইবাদতগুলো আদায় হতে থাকবে। এর অর্থ হলো দৈনিক ২৪ ঘণ্টা মিলে পাঁচবার নামাজ পড়াকে শুধু ইবাদত বা মালিকের দাসত্ব করা বুঝায় না। বরং সালাতকে কেন্দ্র করে ২৪টা ঘণ্টায় মালিকের আদেশ-নিষেধ মেনে অতিবাহিত করাকে ইবাদত বলে। আর দৈনিক পাঁচবার সালাত আমাদের সেই দায়িত্বগুলো স্মরণ করে দেয়।

লেখকের মতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আমাদের পাঁচটি বিষয় স্মরণ করিয়ে দেয়--

এক. সালাত আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় আল্লাহ আমাদের মালিক এবং আমরা তাঁর দাস বা বান্দা। একজন দাস হিসেবে ২৪টা ঘণ্টা তাঁর অনুগত হয়ে চলার শিক্ষা দেয়।

দুই. জীবন পথে চলার ক্ষেত্রে প্রতিটি মুহূর্ত যে আমাদেরকে মালিকের বেঁধে দেয়া নিয়মনীতি মেনে চলতে হবে সেই জ্ঞান এবং দায়িত্ববোধ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় সালাত।

তিন. সালাত আমাদেরকে আল্লাহর ব্যাপারে ভয় করার শিক্ষা দেয়। যে ভয় একাকী অবস্থায় পাপ থেকে বিরত রাখে এবং অবৈধ পন্থায় অঢেল সম্পদ হস্তগত হওয়ার মুহূর্তেই আল্লাহর সেই ভয় সেই অবৈধ পন্থায় সম্পদ অর্জন করার সুযোগ গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখে।

চার. আল্লাহর আইন মানার জন্য প্রথমত আইন জানা আবশ্যক। সালাত পরিপূর্ণভাবে সেই আইন জানাটা সহজ করে দেয়।

পাঁচ. সালাত আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধভাবে জীবন যাপনের শিক্ষা দেয়- যে ঐক্য ছাড়া পরিপূর্ণ ইসলাম মানা যায় না।

আল্লাহ তাআ'লা ঘোষণা করছেন, নিশ্চয় সালাত অশ্লীল ও মন্দকাজ থেকে বিরত রাখে। (সূরা আনকাবুত-৪৫) কিন্তু আমাদের নামাজগুলো আমাদেরকে পাপকাজ থেকে বিরত রাখে না। এর কারণ হলো- আমরা সালাতে যা পড়ি তা নিজেরা ভালোভাবে বুঝি না। ফলে আমাদের জীবনে সালাতের কোন প্রভাব পড়ে না।

এজন্য “নামাজে কী পড়েন” শিরোনামে লেখক একটা অধ্যায় রচনা করেন, যা শুরু করেন মোয়াজ্জিনের প্রথম ধ্বনি আল্লাহু আকবর এবং বিতরের শেষ দুআ তথা দুআয়ে কুনুত দিয়ে সেই অধ্যায়ের ইতি টানেন।

এরপর তৃতীয় অধ্যায়ে “জামায়াতের সাথে নামাজ” শিরোনামে জামায়াতে নামাজের গুরুত্ব এবং তা থেকে বাস্তব জীবনে আমাদের জন্য যে শিক্ষা নিহিত রয়েছে তার সুন্দর চিত্রায়ণ করা হয়েছে।

নামাজের ব্যাপারে সর্বশেষ অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে “বর্তমান সময়ে নামাজের ফল পাওয়া যায় না কেন” এই নিয়ে। লেখক এককথায় এর উত্তর দিয়েছেন - আমাদের নামাজগুলো সেভাবে আদায় হচ্ছে না যেভাবে আদায় করার ব্যাপারে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদেশ দিয়েছেন। একটি উদাহরণ পেশ করে লেখক বিষয়টি বুঝিয়ে দিলেন।

বইয়ের দ্বিতীয়াংশে আলোচনা করা হয়েছে রোজা নিয়ে।

লেখক এখানে তিনটি পয়েন্টে কথা বলেছেন।
এক. রোযা। এটা এমন একটি ইবাদ, যা প্রত্যেক নবির উপর আল্লাহ তাআলা ফরজ করেছেন। এটা এমন একটি ইবাদত, যার গোপনীয়তা একমাত্র আল্লাহ এবং বান্দার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। কোন ব্যক্তি একান্তে আল্লাহর অদৃশ্য শক্তিকে বিশ্বাস না করলে সে রোজা রাখতে পারে না। অদৃশ্যের প্রতি দৃঢ়ভাবে যাদের ঈমান আছে তারাই মূলত রমজানের রোজা রাখতে পারে।

রোজার মধ্যে এমন কী হিকমত লুকায়িত আছে যার কারণে আল্লাহ তা'আলা সকল নবির উপর এটা ফরজ করেছেন? এর মূল হাকীকত লেখক এখানে তুলে ধরেছেন এবং রোজা কিভাবে মানুষকে সামগ্রিক ইবাদতের জন্য তৈরি করে, সেই বিষয়টিও উল্লেখ করেছেন।

রমজানের আরেকটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করছেন তা হলো- এটা মুসলমানদেরকে দীর্ঘকাল শরীয়তের হুকুম ধারাবাহিকভাবে পালন করতে বাধ্য করে। ফলে রমজানের একমাসের ট্রেনিং বাকি এগারো মাস মুসলমানদের সঠিকভাবে পথচলতে সাহায্য করে। কিন্তু রোজা যে উদ্দেশ্যে আল্লাহ তাআলা ফরজ করেছেন সেই উদ্দেশ্য কি বর্তমানে সফল হচ্ছে? যদি সফল হতো, তাহলে একজন রোজাদার কি কখনো মিথ্যা কথা বলতে পারতো? দ্রব্যে ভেজাল দিতে পারতো?সুদ ও ঘুষ খেতে পারতো? মজুতদারি করতে পারতো? এগুলো করার অর্থ হলো রোজার মূল শিক্ষা আমরা অর্জন করতে পারছি না। এর মূল কারণ লেখক যেটা বলছেন সেটা হলো, ইসলামের ব্যাপক বিধানকে আমরা বিভিন্ন অংশকে আলাদা করে তাতে বাইরের নতুন নতুন জিনিসগুলো আমদানি করছি।

দ্বিতীয়ত ইবাদত সম্পর্কে মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ বিপরীত হয়ে গেছে। আমরা বাহ্যিকতাকে ইবাদত মনে করা শুরু করছি। ফলে রোজা থেকে প্রত্যাশিত ফলাফল আমরা লাভ করতে পারছি না।

দুই. দ্বিতীয়ত পয়েন্ট হলো- “রোজার মূল উদ্দেশ্য”।

রোজা ফরজ হওয়ার মূল উদ্দেশ্য হলো, তাকওয়া অর্জন করা। দীর্ঘ একমাস ট্রেনিং নেয়ার মাধ্যমে বাকি ১১ মাস তার আলোকে জীবন অতিবাহিত করা। কিন্তু রোজার সেই উদ্দেশ্যও আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এর কারণ হিসেবেও লেখক যেটা বলেছেন- তা হলো, আমরা ইবাদতের সঠিক অর্থ জানি না। ইবাদত সম্পর্কে আমরা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা পোষণ করে থাকি। রোজার সঠিক অর্থ জানলে এবং তাঁর শিক্ষা হৃদয়ে ধারণ করতে পারলে বাকী এগারোটি মাস আমরা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারতাম। এখন বিষয়টা এমন হয়েছে যে, কেউ পেটভরে ভাত খেয়ে সাথে সাথে নিজেই বমি করে দিলো! অর্থাৎ রমজানে যে শিক্ষা আমরা অর্জন করি তা রমজান শেষ হওয়ার সাথে সাথেই লঙ্ঘন করতে থাকি, এমনকি ইদের দিন থেকেই! লেখক দৃঢ়ভাবে বলেছেন, এটা কখনোই রোজা ফরজ হওয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল না এবং হতেও পারে না।

তিন. তৃতীয় পয়েন্ট হলো, রোজা ও আত্মসংযম:

এই অধ্যায়ে প্রথমে আত্মসংযমের ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং এই ব্যাখ্যা থেকে যে ফলাফল এসেছে তা হলো-

আমাদের দেহ নফসের তাড়নায় যে সমস্ত দাবি-দাওয়া করে তন্মধ্যে তিনটি দাবি হচ্ছে মূল এবং এই তিনটি দাবীই মূলত আত্মসংযম অর্জনের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে অথবা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে।

এক. ক্ষুণ্নিবৃত্তির দাবী। জীবন রক্ষা একমাত্র এর উপরই নির্ভর করে।

দুই. যৌন আবেগের দাবি। মানবজাতির স্থায়িত্বে এটাই একমাত্র উপায়।

তিন. শান্তি ও বিশ্রাম গ্রহণের দাবী। কর্মশক্তিকে নতুন করে জাগ্রত এবং বলিষ্ঠ করে তোলার জন্য এটা অপরিহার্য।

একটু সুযোগ পেলেই এই দাবীগুলো মানুষকে নফসের দাসে পরিণত করে। তাই এই তিনটি দাবি যদি নিজ নিজ সীমানার মধ্যে থাকে তখন মানুষ আত্মসংযম অর্জন করতে পারে। আর যদি এই তিনটি দাবির ক্ষেত্রে অলসতা আসে, তাহলে মানুষ নফসের ফাঁদে পড়ে যায়।পরাজিত হয় নফসের কাছে। ফলে আত্মসংযমের শক্তি অর্জন করতে পারে না।
আর রোজা সেই তিনটি বিষয়কে নিয়ন্ত্রণ করে নফসের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে অভ্যস্ত করে তোলে। ফলে একজন মানুষ রোজাকে কাজে লাগিয়ে আত্মসংযম অর্জন করতে সক্ষম হয়ে উঠে।

এটা এমন একটি বই যেটি পড়ে পাঠক শুধু নামাজ- রোজা সম্পর্কে ক্লিয়ার ধারণা পাবেন তা নয়, বরং ইবাদত বলতে কী বুঝায় এবং আল্লাহ তাআ’লা যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমাদের সৃষ্টি করছেন সেই উদ্দেশ্যটা কিভাবে অর্জন করা যায় সে ব্যাপারেও স্বচ্ছ ধারণা পেতে সক্ষম হবে ইনশা আল্লাহ।

বইয়ের নাম : নামাজ রোজার হাকীকত
লেখকের নাম : সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী (রহঃ)
পৃষ্ঠা সংখ্যা : ৬২
প্রকাশনী : আধুনিক প্রকাশনী
বইয়ের মূল্য : ১১টাকা

|| রিভিউ লেখক ||

~জাহেদুল ইসলাম

পঠিত : ৩০১ বার

মন্তব্য: ০