Alapon

“ বালাকোট” উপমহাদেশের প্রথম ইসলামী জিহাদ



১৭৫৭ সালে সংগঠিত পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে উপমহাদেশের স্বাধীনতার সূর্য স্থায়ীভাবে ডুবে গেলে সবচেয়ে বেশি বিপর্যয়ের মুখে পড়ে উপমহাদেশের মুসলিম সমাজ। একদিকে বৃটিশদের আধিপত্য, অন্যদিকে হিন্দু জমিদারসহ স্থানীয় বৃটিশদের দোসরদের নির্যাতনে একেবারেই পর্যদুস্ত হয়ে পড়ে মুসলমানগণ। ধর্মীয় অধিকারগুলোর পাশাপাশি নাগরিক অধিকারগুলোও একে একে তারা খর্ব করতে থাকে। একটাই অপরাধ তাঁদের, তাঁরা মুসলিম।

মুসলমানদের উপর আপতিত নির্যাতন প্রতিরোধ, নিজেদের অধিকার আদায় এবং হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে যেসব মুসলিম মুজাহিদীন এগিয়ে আসে তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন শাহ আহমদ বেরলভি এবং শাহ ইসমাইল শহীদ রহিমাহুমুল্লাহ।

১৭৮৬ এবং ১৭৭৯ সালে জন্ম নেয়া শাহ আহমদ বেরলভি এবং শাহ ইসমাইল শহীদ রহিমাহুমুল্লাহ ভারতের উত্তর প্রদেশে বেড়ে উঠেন। ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলেন এবং জ্ঞান অর্জনের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। এভাবে জীবনের দীর্ঘপথ অতিক্রম করে ১৮২২ সালে কিছু সঙ্গীকে সাথে নিয়ে হজ্ব পালন করতে যান শাহ আহমদ বেরলভি রহিমাহুল্লাহ। হজ্ব পালন করে ১৮২৪ সালে দেশে ফিরে আসেন তিনি। দেশে ফিরে এসেই শুরু করেন মুসলমানদের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার সংগ্রাম। ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম।

শাহ আহমদ বেরলভি দ্বীন বিজয়ে প্রত্যয়ী
মুসলমানদের সাথে নিয়ে যে সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে যাচ্ছিলেন তা ছিল বিশালদেহি পাহাড়কে ছাগলের ধাক্কা দেয়ার শামিল। কারণ একদিকে ছিল মুসলমান, যারা ইতোমধ্যে পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ হয়ে পড়েন। চাকরি-বাকরি থেকে শুরু করে সব অধিকারগুলো হারিয়ে সর্বস্ব হয়ে পড়েন এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন।

আর অন্যদিকে ছিল তৎকালীন বিশ্বের সুপার পাওয়ার শক্তি বৃটিশ সরকার। যারা পৃথিবীর অধিকাংশ রাষ্ট্রকে নিজেদে পেটে ঢুকানোর মিশন নিয়ে এগিয়ে আসছিলেন। তাদের ছিল আধুনিক অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত অজস্র সৈন্যবাহিনী। ছিল স্থানীয় হিন্দু জমিদার শ্রেণি এবং তাদের দোসর, যারা নিজ স্বার্থ আদায়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বৃটিশদের পক্ষ হয়ে কাজ করতেন। সুতরাং এই বিশাল রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সাথে মুষ্টিমেয় মুসলমানদের সাথে নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা চাট্টিখানি কথা নয়। তাই শাহ আহমদ বেরলভি কৌশলে অগ্রসর হওয়ার পরিকল্পনা করলেন।

শাহ সাহেব নিজের পরিকল্পনামতে প্রথমে পাকিস্তানের উত্তর প্রদেশকে টার্গেট করে বালাকোটের দিকে অগ্রসর হয়। বালাকোটসহ আশপাশ খাইবার পাখতুনখোয়া রায়বেরলিতে ছিলো শিখদের শাসন। তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে পরাজিত করার মাধ্যমে মুসলিম বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধির পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। পরিকল্পনা মতে, ৭০০জন মুসলমানদের ছোট্ট এক বাহিনী নিয়ে সম্মুখে অগ্রসর হয় মুসলিম বীর সেনানী শাহ আহমদ বেরলভি রহঃ। সাথে ছিলেন ইসমাঈল শহীদ রহঃ।

৭০০জন মুসলমানের ক্ষুদ্র এই বাহিনীকে মোকাবেলা করার জন্য অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত ১০ হাজার বাহিনীর শিখদের বিশাল একবাহিনী চলে আসে। ১৮৩১ সালের ৬ই মে পাহাড়ঘেরা বালাকোট প্রান্তরে উভয়দল মুখোমুখি হয়। সম্মুখ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়া মুসলিম বাহিনীর প্রধান শাহ আহমদ বেরলভি রহঃ এবং ইসমাঈল শহীদ রহঃ সহ অধিকাংশই শাহাদাত বরণ করেন।

বাহ্যত দেখলে এটাকে উহুদ প্রান্তর মনে হয়। পাহাড়ঘেরা বিশিষ্ট একটি প্রান্তর। মাত্র ৭০০ জন মুসলিম মুজাহিদীনের মোকাবেলায় ১০ হাজার সৈন্যের বিরাট বাহিনী। উহুদ যুদ্ধে যা ছিল ৭৫০ জনের মোকাবেলায় ১০ হাজার। প্রতিশোধপ্রবণ হয়ে ইসলামকে পৃথিবী থেকে মুছে দেয়ার তীব্র ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ময়দানে আবির্ভূত হয় অমুসলিম বাহিনী। আর ইসলামকে পৃথিবীর উপর প্রতিষ্ঠা করতে নববী দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনী সামনে অগ্রসর হয়। শাহাদাতের তামান্না নিয়ে প্রাণপণে লড়াই করে মুসলিম বাহিনী আল্লাহর কাছে নিজেদের পেশ করেন। এই যেন কুরআনের সেই আয়াতের প্রতিধ্বনি, যেখানে আল্লাহ তাআলা বলছেন,

“নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা জান্নাতের বিনিময়ে মুমিনদের থেকে তাদের জান ও মাল ক্রয় করে নিয়েছেন। ফলে তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে দুশমন বাহিনীকে ধ্বংস করে দিয়ে নিজেরাও শহীদ হয়ে যায়।” (সূরা তাওবা, আয়াত:১১১)।

সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী রহ বালাকোট প্রান্তরের এই আন্দোলনকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেন, এর আগে বা পরে এই উপমহাদেশে এ ধরনের নির্ভেজাল ইসলামী জিহাদ আর সংঘটিত হয়নি।

সেদিন শাহ আহমদ বেরলভি তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে বাহ্যিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তাঁরা ছিলেন সফল মানুষ। তাঁদের দেখানো পথ ধরে পরবর্তী প্রজন্ম এগিয়ে এসেছেন। যখনই সুযোগ পেয়েছেন বৃটিশদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন। তাদের মুখোমুখি হয়েছেন বহুবার এবং চূড়ান্তভাবে তাদের পরাজিত করে এই দেশ থেকে বিতাড়িত করেন।

আজও মুসলিম সমাজ শাহ আহমদ বেরলভি রহঃ, ইসমাইল শহীদ রহঃ সহ বালাকোট প্রান্তরে মুশরিকদের মুখোমুখি হওয়া সবাইকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছেন এবং তাঁদের অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে পৃথিবীর বুক থেকে মুশরিক বাহিনীকে পরাজিত করতে দেশে দেশে পৃথিবীব্যাপী সংগ্রাম করে যাচ্ছেন।

তাই তাঁরা মরেও অমর হয়ে আছেন এবং থাকবেন পৃথিবীর শেষদিন পর্যন্ত। আল্লাহ তাআলা বলেন, যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়, তাদেরকে মৃত বলো না। বরং তারা জীবিত; কিন্তু তোমরা অনুভব করতে পার না। (সূরা বাকারাহ, আয়াত:১৫৪)

~জাহেদুল ইসলাম
||০৬.০৫.২৩ ||

পঠিত : ২৪৬ বার

মন্তব্য: ০