বাংলার কৃষকদের ওপর হিন্দু জমিদারদের জুলুমের ইতিহাস: পর্ব-০২
তারিখঃ ৯ মে, ২০২৩, ১৯:৫৩
অর্থনৈতিক দিক দিয়ে গোটা মুসলমান সমাজকে নিষ্পেষিত ও নির্মূল করার নীতি গ্রহণ করেছিল ইংরেজ শাসকগণ। মুসলমান আমলে সকল প্রকার সরকারী চাকুরীতে সিংহভাগ ছিল মুসলমানরা। ইংরেজরা এদেশের মালিক মোখতার হওয়ার পর ধীরে ধীরে মুসলমানগণ সকল বিভাগের চাকুরী থেকে বিতাড়িত হতে লাগলো। শেষে সরকারের অঘোষিত নীতিই এই হ’য়ে দাঁড়ালো যে, কোনও বিভাগে চাকুরী খালি হ’লেই বিজ্ঞাপনে এ কথার বিশেষভাবে উল্লেখ থাকতো যে মুসলমান ব্যতীত অন্য কেউ প্রার্থী হ’তে পারে।
ইংরেজ সরকার বাজেয়াপ্ত আইন পাশ করে মুসলমান বাদশাহগণ কর্তৃক প্রদত্ত সকলপ্রকার জায়গীর, আয়মা, লাখেরাজ, আলতমগা, মদদে মায়াশ প্রভৃতি ভূসম্পদ মুসলমানদের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে তাদেরকে পথের ভিখারীতে পরিণত করে। একমাত্র বাংলাদেশেই অন্যূন পঞ্চাশ হাজার ও ইনাম কমিশন দ্বারা দাক্ষিণাত্যের বিশ হাজার লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। হাজী মুহাম্মদ মুহসিনের বহু লক্ষ টাকা আয়ের ওয়াকফকৃত সম্পত্তি সরকার অন্যায়ভাবে নিজেদের তত্ত্বাবধানে রেখে প্রকৃত হকদারকে বঞ্চিত করে। সরকারের এসব দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে বহু প্রাচীন মুসলিম পরিবার ধ্বংস হয়ে যায় এবং বহু খানকাহ, মাদ্রাসা, মসজিদ প্রভৃতি মুসলিম শিক্ষা ও জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানসমূহ বিলুপ্ত হয়ে যায়।
বাংলার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও সূর্যাস্ত আইন দ্বারা মুসলমানদের অধিকার থেকে যাবতীয় জমিদারী, তালুকদারী, ইজারা প্রভৃতি কেড়ে নিয়ে হিন্দুদের মধ্যে বন্টন করা হলো। ফলে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারগুলি উৎখাত হয়ে গেল। বাংলার কৃষকদের মধ্যে শতকরা পঁচাত্তর ভাগ ছিল মুসলমান। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদার শ্রেণী হলো হিন্দু এবং জমির একচ্ছত্র মালিক। কৃষককুল হলো তাদের অনুগ্রহ মর্জির উপর একান্ত নির্ভরশীল। তাদের শুধু জমি চাষের অনুমতি রইলো, জমির উপর কোন অধিকার বা স্বত্ব রইলো না। হি!ন্দু জমিদারগণ প্রজাদের নানাভাবে রক্ত শোষণ করতে লাগলো। জমির উত্তরোত্তর খাজনা বৃদ্ধি, আবহাওয়া, সেলামী, নজরানা, বিভিন্ন প্রকারের কর প্রভৃতির দ্বারা কৃষকদের মেরুদন্ড ভেঙে পড়ার উপক্রম হলো। হিন্দু জমিদারগণ মুসলমানদের কাছ থেকে দাড়ির ট্যাক্স, মসজিদের ট্যাক্স, মুসলমানী নাম রাখার ট্যাক্স, পূজাপার্বনের ট্যাক্স প্রভৃতি জবরদস্তিমূলকভাবে আদায় করতে লাগলো। যেসবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন হাজী শরীয়তুল্লাহ, তিতুমীর প্রমুখ মনীষীগণ।
ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিক্ষার অংগন থেকেও মুসলমানদেরকে বহু দূরে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। ব্যবসা ও শিল্পবাণিজ্য বিলুপ্ত হয়ে যায়। আবদুল মওদূদ বলেন, “দেশীয় কারিগর শ্রেণীকে নির্মমভাবে পেষণ করে দেশীয় শিল্পদ্রব্যের উৎপাদনও বন্ধ করে দেয়া হয়। তার দরুণ শ্রমজীবীদের জীবিকার পথ একমাত্র ভূমি কর্ষণ ব্যতীত আর কিছুই খোলা রইলোনা। আর ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে বণিক-রাজের কুঠিরগুলিতে আশ্রয়ে নতুন দালাল শ্রেণীর ব্যবসায়ীও জন্মলাভ করলো বেনিয়ান, মুৎসুদ্দি, মুন্সী, দেওয়ান উপাধিতে। বহির্বাণিজ্যে ও অন্তর্বাণিজ্যে সবদিক দখল করে যে দালাল শ্রেণীর জন্মদান করলো, তারাও হয়ে উঠলো স্বার্থ ভোগের লোভে দেশীয় শিল্প ও কারিগরির প্রতি বিরূপ। এই নতুন আর্থিক বিন্যাসের ফলে যে নতুন ভূস্বামী ও দালাল সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হলো, তাদের একজনও মুসলমান নয় –মুসলমানদের সে সমাজে প্রবেশাধিকারও ছিলনা এবং এই সম্প্রদায়ই ছিল বিস্তৃত গণবিক্ষোভ বা জাতীয় জাগরণের প্রধান শত্রু। এ কথা লর্ড বেন্টিংকও স্বীকার করে গেছেন-
“চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বহু গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটি আছে সত্য, তবে এর দ্বারা জনগণের উপর পূর্ণ কর্তৃত্বশালী বড়ো একদল ধনী ভূস্বামী সম্পদায়ের সৃষ্টি হয়। তার একটি বড়ো সুবিধা এই যে, যদি ব্যাপক গণবিক্ষোভ বা বিপ্লবের ফলে শাসনকার্যের নির্বিঘ্নতা ব্যাঘাত ঘটে, তাহলে এই সম্প্রদায়ই নিজেদের স্বার্থে সর্বদাই ব্রিটিশ শাসন বজায় রাখার জন্যে প্রস্তুত থাকবে”। [সিপাহী বিপ্লবের পটভূমিকা, আবদুল মওদূদ (শতাব্দী পরিক্রমা), পৃঃ ৬২]।
এ সম্পর্কে আবদুল মওদূদ আরও একটু পরিষ্কার করে বলেন- “এ মতবাদের সমর্থক এ দেশীয় লোকেরও অভাব নেই। এই সেদিনও বিশ্বভারতীতে বাংলার জনগণ সম্বন্ধে বক্তৃতাকালে কাজী আবদুল ওদুদ সাহেব বলেছেনঃ সেদিনে বাংলাদেশে অন্ততঃ বাংলার প্রাণকেন্দ্র- কোলকাতায় সিপাহী বিদ্রোহের কোন প্রভাব অনুভূত হয়তি। হিন্দু পেট্রিয়টের সম্পাদক হরিশ মুখার্জি এই বিদ্রোহ সম্পর্কে মন্তব্য করেন, সিপাহী বিদ্রোহ কেবলমাত্র কুসংস্কারাচ্ছন্ন সিপাহীদের কর্মমাত্র, দেশের প্রজাবর্গের সহিত তাহার কোনও সম্পর্ক নাই। প্রজাকুল ইংরেজ গভর্ণমেন্টের প্রতি অনুরক্ত ও কৃতজ্ঞ এবং তাহাদের রাজভক্তি অবিচলিত রহিয়াছে”।
কাজী সাহেব আরও বলেন হি৳ন্দু পেট্রিয়টের সম্পাদকের মত যে মোটের উপর সেদিনের বাংলাদেশের মত ছিল, তার একটি ভালো প্রমাণ –বিদ্যাসাগর ও দেবেন্দ্রনাথের মতো স্বাধীনচেতা বাঙালীরাও সেদিন সিপাহী বিদ্রোহ সম্বন্ধে কোন রকম কৌতুহল দেখাননি। …সিপাহী বিদ্রোহ সেদিন শিক্ষিত বাঙালীকে সাড়া দেয়নি, অশিক্ষিত, হিন্দু বাঙালীকে নাড়া দেয়নি”। (সিপাহী বিপ্লবের পটভূমিকা, আবদুল মওদূদ, পৃঃ ৫৮)।
১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংস সর্বপ্রথম হিসাব করে বের করে যে, বাংলাদেশের প্রায় চার ভাগের এক ভাগ একেবারে নিষ্কর অর্থাৎ লাখেরাজ হয়ে রয়েছে। এরপর থেকেই ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী নানা বাহানায় এইসব জমি খাজনাযুক্ত করার জন্য (অর্থাৎ হিন্দুদেরকে দিয়ে লাভবান হওয়ার জন্য) এক ‘অঘোষিত যুদ্ধ’ অব্যাহত রাখে।” (সূত্র: কলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী, এমআর আখতার মুকুল, প্রকাশকাল ১৯৮৭, পৃষ্ঠা ৭৭-৭৮)।
তৎকালীন ভারত সরকারেরই একজন ইংরেজ সদস্য চার্লস মেটকাফ ব্রিটিশদের এই ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ সম্পর্কে ১৮২০ সালে মন্তব্য করেছিল যে, “এ নীতি হচ্ছে অন্যায় অবিচারের চূড়ান্ত; কোনো দেশেই এরকম নীতির নজির নেই যেখানে সমস্ত জমিজমা যাদের প্রাপ্য তাদেরকে না দিয়ে অন্য এক গোষ্ঠীর হিন্দু বাবুদের হাতে তুলে দেয়া হলো যারা নানা দুর্নীতি ও উৎকোচের আশ্রয় নিয়ে দেশের ধনসম্পত্তি চুষে খেতে চায়।” (সূত্র: কলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী, পৃষ্ঠা ৭৯)।
[চলবে]
টাইমনিউজবিডি থেকে সংগৃহীত ও পরিমার্জিত।
বাংলার কৃষকদের উপর হিন্দু জমিদারদের জুলুমের ইতিহাসঃ পর্ব:- ১
মন্তব্য: ০